Tuesday, 10 December 2024

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন – কি হতে চলেছে?

১০ই ডিসেম্বর ২০২৪

পশ্চিমারা মূলতঃ সিরিয়াকে দেখছে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চশমা দিয়ে। যদি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই পশ্চিমারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী সিরিয়া গড়তে তাদের প্রভাব ব্যবহার করতে প্রস্তুত। সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে কেউই খুব একটা আশাবাদী নয়। তবে গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ইসলামিক আইন বাস্তবায়নকে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র চোখ রেখেছে যাতে সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের গ্রুপগুলিও থাকবে। যদি তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের এই ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে সিরিয়ার সকল গ্রুপের উপর যথেষ্ট প্রভাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থিত কুর্দী গ্রুপ 'এসডিএফ'এর অধীনে আটক আইসিস সদস্যদেরকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।


১২ দিনে বাশারের পতন – কেউ কি সম্ভব ভেবেছিল?

সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন কতটা অবাক করার মতো ছিল, সেটা পশ্চিমা চিন্তাবিদদের কথা শুনলেই বোঝা যায়। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'ইউরেশিয়া গ্রুপ'এর প্রতিষ্ঠাতা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার আসাদ সরকারের পতনের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে বলছিলেন যে, তিনি মনে করেন না যে, বাশার সরকারের পতনের কোনরূপ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তার ধারণা ছিল রাশিয়া এবং ইরান তাদের সকল শক্তি দিয়ে বাশারকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। একইসাথে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তুরস্কের সহয়াতায় শুরু হওয়া এই আক্রমণের লক্ষ্য দামাস্কাস দখল ছিল না। কারণ সিরিয়ার এতবড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা তুরস্কের নেই। বিশেষ করে ইরান যদি সিরিয়া ত্যাগ করে চলে যায়, তাহলে এখানে সৃষ্ট শূণ্যাবস্থা মারাত্মক অনিশ্চয়তা এবং অরাজকতা জন্ম দিতে পারে। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'এমআই-৬'এর প্রাক্তন প্রধান জন সয়ার্স 'স্কাই নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, এত স্বল্প সময়ে বাশার সরকারের পতন ঘটে যাবে, সেটা কোন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা কেন, ‘এইচটিএস'এর নেতারাও হয়তো চিন্তা করতে পারেনি। বিশেষ করে বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনী যে এত দ্রুত ভেঙ্গে যাবে, সেটা কেউই চিন্তা করতে পারেনি।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর মাইকেল ক্লার্ক 'স্কাই নিউজ'কে বলছেন যে, সিরিয়ার আগে অন্যান্য যুদ্ধেও একটা সেনাবাহিনীকে কয়েকদিনের মাঝে ধ্বসে পড়তে দেখা গেছে। যেমন, গাদ্দাফির পতনের পর দাবানলের মতো লিবিয়ার সবগুলি শহরের পতন হয়েছিল। ২০১৪ সালে আইসিসের উত্থানের সময়ও তারা দুই সপ্তাহের মাঝে ইরাক এবং সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখলে নিয়ে নিয়েছিল। এবারে সিরিয়ার ক্ষেত্রে রুশ বিমান হামলা বিদ্রোহীদেরকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে মাইকেল ক্লার্ক অবাক হয়েছেন যে, সিরিয় সেনাবাহিনী একেবারেই যুদ্ধ করেনি। যখন সিরিয় সেনা অফিসাররা তাদের ইউনিট ছেড়ে পালাচ্ছিল, তখন সেনাদের বেসামরিক পোষাক পড়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর যখন এক স্থানে সেনাবাহিনী ধ্বসে পড়ে, তখন অন্যান্য এলাকার জন্যেও সেটা উদাহরণ হয়ে যায়। আসাদের বাহিনী তিনদিক থেকে তিনটা গ্রুপের আক্রমণের শিকার হয়েছিল; যেমন, উত্তর দিক থেকে আসছিল 'এইটিএস'; দক্ষিণে দেরা থেকে আসছিল 'সাউদার্ন ফ্রন্ট' নামে অনেকগুলি গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত একটা বাহিনী; আর পূর্বে দেইর-ইজ-জর থেকে আসছিল কুর্দীদের নেতৃত্বের আরেকটা বাহিনী। এতগুলি বাহিনীর আক্রমণের মুখে বিদ্রোহীরা যখন সিরিয় সেনাবাহিনীকে বলেছে যে, তোমরা যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেলে কারুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া হবে না, তখন সিরিয় সেনারা অস্ত্র ফেলে দিয়েছে। বাশারের পতনের সময় রাশিয়া এবং ইরান খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। রাশিয়ার খুব বেশি সেনা সিরিয়াতে ছিল না; তারা মূলতঃ বিমানশক্তি দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। আর ইরান মূলতঃ 'আইআরজিসি'র 'আল-কুদস ফোর্স' এবং বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপের মাধ্যমে সহায়তা দিয়েছে। উভয়েই প্রকৃতপক্ষে কম খরচে বাশারকে টিকিয়ে রেখেছিল; মূল যুদ্ধটা বাশারের লোকেরাই করেছে। বাশারের লোকেরাই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ৬ লক্ষ মৃত্যুর মাঝে ৪ লক্ষ্যের জন্যে সরাসরি দায়ী। এই হত্যাকারীদের টিকিয়ে রাখতে খুব বেশি সহায়তার প্রয়োজন হয়নি; কারণ হত্যাকারীরা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতেই যুদ্ধ করেছে।

মাইকেল ক্লার্কের কথায় এটা পরিষ্কার যে, সিরিয়ার উত্তর থেকে আসা 'এইচটিএস'এর অধীন বাহিনী অনেকগুলি বাহিনীর একটা বাহিনী ছিল মাত্র। আর বাশারের পতনের আগে ইয়ান ব্রেমারের কথাতেও এটা বোঝা যায় যে, পশ্চিমারা হিসেব করেছিল যে, শুধুমাত্র 'এইচটিএস'এর পক্ষে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। তারা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিল যে, ‘এইচটিএস' তাদের পূর্বের ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। একারণেই তুরস্ক 'এইচটিএস'কে সহায়তা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে 'এইচটিএস'এর অভিযানের সাথেসাথে বাকি সকল গ্রুপও যে অভিযানে যাবে, সেটা কেউই হিসেব করেনি। আর বাশারের সেনারাও যে যুদ্ধ না করে অস্ত্র ফেলে দেবে, সেটাও কেউ ভাবেনি। আবার রাশিয়া আর ইরানও যে বাশারকে রক্ষায় যথেষ্ট ছিল না, সেটাও অনেকেরই হিসেবের বাইরে ছিল।
 
বাশার আল-আসাদের পতন কেউই চিন্তা করতে পারেনি। তুরস্ক যে এই অভিযানের নেপথ্যে ছিল, তা পশ্চিমাদের কথাতেই পরিষ্কার। আর তুরস্ক বা পশ্চিমারা যে বাশারকে সরাতে চায়নি, সেটাও নিশ্চিত। তারা কেউই পরিকল্পনা করেনি যে, ‘এইচটিএস'এর সাথে বাকি সিরিয় গ্রুপগুলিও যুক্ত হবে; তারা চিন্তাও করেনি যে বাশারের বাহিনী যুদ্ধ করবে না; তারা বোঝেনি যে রাশিয়া এবং ইরান তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবে। মোটকথা, সিরিয়ার বর্তমান ফলাফল কেউই পরিকল্পনা করেনি; সৃষ্টিকর্তা ব্যাতিরেকে। 


সিরিয়ার পট পরিবর্তনকে পশ্চিমারা কিভাবে দেখছে?

পশ্চিমারা মূলতঃ সিরিয়াকে দেখছে পশ্চিমা গণতন্ত্রের চশমা দিয়ে। যদি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই পশ্চিমারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী সিরিয়া গড়তে তাদের প্রভাব ব্যবহার করতে প্রস্তুত। ‘বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ‘আস্তানা প্রসেস'এর অংশ হিসেবে তুরস্ক, রাশিয়া এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা দোহাতে আলোচনা করছিলেন। এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের মাঝে একটা ঐক্যে পৌঁছানো। তবে ক্ষমতা পরিবর্তনে বাশার আল-আসাদ কোনরূপ আগ্রহী ছিলেন না; যার মূল্য তাকে দিতে হয়েছে ক্ষমতা হারিয়ে। যদিও বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে থাকা 'হায়াত তাহরির আল-শাম' বা 'এইচটিএস'এর নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি বলেছেন যে, তারা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর চাইছেন, তথাপি যে ব্যাপারটা বাস্তবতা তা হলো 'এইটিএস' হলো অনেকগুলি গ্রুপের মাঝে একটা গ্রুপ। এখানে নতুন সিরিয়া যদি আফগানিস্তানের মতো (পশ্চিমা সংজ্ঞার) মানবাধিকার এবং নারী অধিকারকে পদদলিত করে, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। আবার লিবিয়ার মতো নিজেদের মাঝে যে তারা দ্বন্দ্বে জড়াবে না, সেটাও নিশ্চিত নয়।

জন সয়ার্স বলছেন যে, ১০-১২ বছর আগে তিনি যখন 'এমআই-৬'এর প্রধান ছিলেন, তখন তাদেরকে হিসেব করতে হয়েছে যে, সিরিয়ার কোন কোন বিদ্রোহী গ্রুপকে অস্ত্র সহায়তা দেয়া যায়। এর মাঝে 'এইচটিএস' ছিল সহায়তা না-পাওয়া গ্রুপের মাঝে। তবে গত ১০ বছরে 'এইটিএস'এর নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি তার দলকে 'আল-কায়েদা' থেকে দূরে সরিয়ে আনার জন্যে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এবং গত দুই সপ্তাহে 'এইটিএস'এর কর্মকান্ড ছিল মুক্তিকামী বাহিনীর মতোই; সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মতো নয়। এবং এখন হয়তো ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সকে চিন্তা করতে হবে যে, তারা এখনও 'এইচটিএস'কে সন্ত্রাসী সংগঠন বলবে কিনা। কারণ এক দশক আগে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হয়েছিল বলে সেই যুক্তিতে বর্তমানে সিরিয়ায় সরকার গঠন করা একটা দলের সাথে ব্রিটিশরা কোনরূপ যোগাযোগ না রাখলে সেটা সত্যিই ভুল হবে।

সিরিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে সকলে ততটা আশাবাদী নন। মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশকে শাসন করতেই কোন না কোন প্রকারের স্বৈরশাসক প্রয়োজন হচ্ছে। একমাত্র ব্যাতিক্রম হয় তিউনিসিয়া; যেখানে কিছুদিনের জন্যে বহুদলীয় গণতন্ত্র চললেও সেটাও ধ্বসে গিয়ে আবারও একনায়কের অধীনে চলে গিয়েছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ।

তুরস্ক জিতেছে; কিন্তু যা সে জিতেছে, তা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়। রাশিয়া হেরেছে। সিরিয়াতে রুশদের সামরিক ঘাঁটি রাখতে হলে তুরস্কের প্রভাবের (কতটা, তা নিশ্চিত নয়) উপর নির্ভর করতে হবে। এরদোগান এই ঘাঁটি নিয়ে পুতিনের সাথে দরকষাকষি করতে পারেন। 


তুরস্কের প্রভাব বাড়লো কি?

‘বিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে সহায়তা দিয়েছে। বিদ্রোহীদের বেশিরভাগই ইসলামপন্থী বা রাষ্ট্রের কর্মকান্ডের মাঝে ইসলামকে রাখার পক্ষপাতি; যেমন মুসলিম ব্রাদারহুড; তুরস্কের বর্তমান সরকার এদের মতোই। তবে এদের মাঝে কেউ কেউ রয়েছে, যারা ইসলামিক আইন দিয়েই রাষ্ট্র চালানোর পক্ষপাতি; এদের মাঝে জিহাদি গ্রুপও রয়েছে। তুরস্কের স্বার্থ রয়েছে তার দক্ষিণ সীমানায় একটা স্থিতিশীল সিরিয়া দেখার। এছাড়াও সিরিয়ার কুর্দীদের ব্যাপারেও তুরস্কের স্বার্থ রয়েছে। কুর্দিদের হাতে আইসিসের অনেক যুদ্ধবন্দী রয়েছে। মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, কুর্দীদের মাঝে 'পিকেকে' সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে, যেগুলির প্রভাবকে তুরস্ক নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের তৈরি করা 'বাফার জোন'কেও তুরস্ক হয়তো বড় করতে চাইছে। আর তুরস্কে প্রায় ২০ লাখের মতো সিরিয় শরণার্থী রয়েছে; যাদেরকে তুরস্ক সিরিয়াতে ফেরত পাঠাতে চাইছে। 'সিএনএন'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রাক্তন মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক মতি দিচ্ছেন যে, তুরস্ক নিঃসন্দেহে 'এইচটিএস'এর পিছনে ছিল। এটা কুর্দীদের (যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গ্রুপগুলির) জন্যে ভালো খবর নয়। 'সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস' বা 'এসডিএফ' নামের কুর্দী গ্রুপকে (যাদেরকে তুরস্ক 'পিকেকে' সন্ত্রাসীর সহযোগী বলে থাকে) যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিচ্ছে। তবে তুরস্কের এরদোগান এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চান; যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে যায়। জেনারেল ক্লার্ক মনে করছেন যে, সিরিয়াতে যে সরকার গঠিত হবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত কিছু গ্রুপকে (তিনি খুব সম্ভব 'এসডিএফ'কে বোঝাচ্ছেন) হয়তো বাইরে রাখা হতে পারে। আর 'এসডিএফ'এর হাতে থাকা আইসিসের সদস্যরা যদি ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে পুরো অঞ্চলে ভয়াবহ পরিস্থতির অবতারণা হতে পারে।

'এইচটিএস'এর উত্থানের পেছনে তুরস্কের হাত ছিল কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে 'এমআই-৬'এর প্রাক্তন প্রধান জন সয়ার্স বলে যে, সহযোগিতা, ট্রেনিং এবং সাপ্লাইএর ক্ষেত্রে ‘এইচটিএস' তুরস্কের সবচাইতে কাছের বন্ধু ছিল না। তবে ঘটনাপ্রবাহ তুরস্কের জন্যে খুবই সুবিধাজনক দিকে গিয়েছে। এবং এই ঘটনার ফলে বর্তমানে তুরস্ক এই অঞ্চলে সবচাইতে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। বিজয়ীদের মাঝে অনেকগুলি গ্রুপ রয়েছে; তুরস্ক এই গ্রুপগুলিকে একত্রে নিয়ে এসে নতুন সরকার গঠনে বড় ভূমিকা নিতে পারে। সকলেই বাশারের অত্যাচারী সরকারের পরিবর্তন দেখতে চেয়েছে; তবে সামনের দিনগুলি যে অনিশ্চিত হবে, সেটা এড়িয়ে যাবার অবকাশ নেই। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন যে, বাশার সরকারের প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে না গিয়ে সরকার পরিবর্তনের কাজকে সহজ করার কাজ করছেন এবং একইসাথে বিজয়ী বিদ্রোহীরা কোন গ্রুপের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন প্রতিশোধের কর্মকান্ডে জড়িত হয়নি। আসাদ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সরকার-বিরোধীদের উপরে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে; যেগুলির হিসেব কোন একটা সময় হলেও চুকাতে হবে।
 
সিরিয়ায় পট পরিবর্তনে সবচাইতে বড় ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার। সিরিয়াতে রাশিয়ার দু'টা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে - তারতুসে নৌঘাঁটি এবং লাতাকিয়াতে বিমান ঘাঁটি। এরদোগান তার প্রভাব খাটিয়ে সিরিয়াতে রুশ সামরিক ঘাঁটি রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন; আবার দরকার হলে সেটা রাশিয়াকে না-ও দিতে পারেন। এরদোগান দরকার হলে পুতিনের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে এই নৌঘাঁটিকে ব্যবহার করতে পারেন।


রাশিয়া এবং ইরান কি কি হারালো?

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, সিরিয়ায় পট পরিবর্তনে সবচাইতে বড় ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ার। সিরিয়াতে রাশিয়ার দু'টা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে - তারতুসে নৌঘাঁটি এবং লাতাকিয়াতে বিমান ঘাঁটি। তারতুস হলো ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটি। এই ঘাঁটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে তার অবস্থান হারাবে। আর লাতাকিয়াতে বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে রাশিয়া আফ্রিকায় তাদের বন্ধু দেশগুলির সাথে যোগাযোগ রাখে। এক্ষেত্রে লাতাকিয়া একেবারে অবশ্য প্রয়োজনীয় না হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জন সয়ার্স মনে করছেন যে, সিরিয়ার ভবিষ্যতকে কিছুটা হলেও লিবিয়ার সাথে তুলনা দেয়া যেতে পারে; যেখানে গাদ্দাফী সরকারের পতনের পর বাইরের শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থে লিবিয়াকে বিভক্ত করেছে। নতুন সিরিয়াতে বাশার সরকারের অনুগতরা হয়তো কিছু এলাকায় সহিংসতার আশ্রয় নিতেও পারে। একইসাথে বাশারকে সহায়তা দেয়া রাশিয়াও চাইবে সিরিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলে তারতুস বন্দরে তাদের সামরিক ঘাঁটিকে টিকিয়ে রাখতে। সেই হিসেবে তারাও সিরিয়ার নতুন সরকারের সাথে কোন এক প্রকার সমঝোতায় যেতে চাইবে। মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক বলছেন যে, এরদোগান তার প্রভাব খাটিয়ে সিরিয়াতে রুশ সামরিক ঘাঁটি রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন; আবার দরকার হলে সেটা রাশিয়াকে না-ও দিতে পারেন। এরদোগান দরকার হলে পুতিনের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে এই নৌঘাঁটিকে ব্যবহার করতে পারেন।

'বিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, আরব বসন্তের সময় যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু হোসনি মুবারককে রক্ষা করেনি; কিন্তু রাশিয়া বাশার আল-আসাদকে রক্ষা করেছে; যদিও এতে রাশিয়ার স্বার্থ ছিলো। সিরিয়ার তারতুস হারালে রাশিয়া লিবিয়ার খলিফা হাফতারের অধীনে থাকা বেনগাজিতে তাদের নৌঘাঁটি সরিয়ে নেবার চেষ্টা করতে পারে। এর মাধ্যমে সিরিয়ার ঘাঁটি হারিয়েও রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে থাকতে পারে। তবে এরপরেও সিরিয়ায় রাশিয়ার ভূকৌশলগত ক্ষতিই হয়েছে।

‘বিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সিরিয়ার অনেকেই মনে করতো যে, দেশটা ইরানের নিয়ন্ত্রণে চলছিলো। ২০১৫ সালে রাশিয়ার বিমান হামলা এবং ইরানের 'আইআরজিসি' ও লেবাননের হিযবুল্লাহর সেনাদের সহায়তা ছাড়া বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় থাকতে পারতো না। সিরিয়াকে ব্যবহার করেই ইরান লেবাননে হিযবুল্লাহকে সহায়তা দিচ্ছিলো। কিন্তু ইস্রাইলের সাথে যুদ্ধ করে হিযবুল্লাহ এবং ইরানের কতটা ক্ষতি হয়েছে, সেটার ফলাফল এখন সিরিয়ায় দেখা গেলো। আর এর পুরোটাই শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে ৭ই অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে গাজা থেকে ইস্রাইলের উপর হামলা দিয়ে। সেই হামলা থেকেই শুরু হয়েছে একটা 'চেইন রিয়্যাকশন', যার ফলাফল প্রতিফলিত হয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। আর এই সুযোগটাই সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কাজে লাগিয়েছে। তারা হিসেব করেছে যে, রাশিয়া ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত এবং ইরান ও হিযবুল্লাহ বাশারকে যথেষ্ট সহায়তা দেয়ার মতো শক্তিশালী অবস্থানে নেই।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, সিরিয়ার পরিবর্তনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতি হয়েছে ইরানের। লেবাননে তাদের প্রক্সি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রাখতে ইরানের কাছে সিরিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। সিরিয়ায় ইরান তার অবস্থান হারালে লেবাননেও তাদের প্রক্সি গ্রুপ অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। তবে এহেন পরিস্থিতি ইরানকে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার দিকে ঠেলে দিতে পারে। মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কও সিরিয়াতে ইরানের অবস্থান দুর্বল হওয়াতে খুশি হয়েছেন। তিনি বলছেন যে, ইস্রাইলের কর্মকান্ডই পরিস্থিতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে। এর পেছনে বাইডেন প্রশাসনের সাফল্য রয়েছে। 'এমআই-৬'এর প্রাক্তন প্রধান জন সয়ার্স বলছেন যে, সিরিয়ার ঘটনাপ্রবাহ দেখে ইরান সরকারের মনে হতে পারে যে, এরূপ ঘটনা কোন একসময় ইরানেও ঘটে যেতে পারে। ইরান একদিকে যেমন যথেষ্ট উন্নত একটা দেশ, অপরদিকে সেদেশের সরকার বেশিরভাগ জনগণের সমর্থন ছাড়াই ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। আর কিছুদিন আগেই ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর ইস্রাইলের বিমান হামলার কারণে ইরানের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাও বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কাজেই এমতাবস্থায় ইরানের বেশ চিন্তিত হবারই কথা। সাম্প্রতিক সময়ে ইরান পশ্চিমাদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। পশ্চিমারাও চাইছে ইরান তাদের দাবিগুলি মেনে নিক; যেগুলির মাঝে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প এবং আঞ্চলিক মিলিশিয়াদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার পরিবর্তনে লাভবান হয়েছে কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী গ্রুপগুলির যথেষ্ট ক্ষতি করতে চাইছে। একারণেই তারা একটা-দু'টা হামলা না চালিয়ে ৭৫টা টার্গেটে বোমা ফেলেছে। তবে মার্কিন সেনারা সিরিয়াতে থাকবে কিনা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেবার আগেই বলেছেন যে, তিনি সিরিয়া থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করবেন।

 
ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্র কি পেলো?

ইস্রাইল অতি দ্রুতই গোলান মালভূমির সাথে লাগোয়া কিছুটা 'বাফার জোন' দখল করে নিয়েছে। তারা হয়তো মনে করছে যে, এর মাধ্যমে গোলান মালভূমির নিরাপত্তা বাড়বে। একইসাথে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইস্রাইল বিমান হামলা চালাচ্ছে। যেমন, মিডিয়াতে পাওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, বাশার আল-আসাদের নৌবাহিনীর কয়েকটা মিসাইল বোট ইস্রাইলি বিমান হামলায় পুরোপুরিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। খুব সম্ভবতঃ ইস্রাইলিরা নিশ্চিত করতে চাইছে যে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের হাতে যাতে এমন কোন অস্ত্র না পড়ে, যা কিনা ভবিষ্যতে কখনও ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও সিরিয়াতে বিদ্রোহীদের জয়ের সাথেসাথে বিমান হামলার ব্যাপারে তাদের গুরুত্বের ক্রমকে পরিবর্তন করেছে। মার্কিনীরা পূর্ব সিরিয়াতে ৭৫টার মতো স্থানে 'বি-৫২', ‘এফ-১৫' এবং 'এ-১০' যুদ্ধবিমান দিয়ে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। 'সিএনএন'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্নেল সেডরিক লেইটন বলছেন যে, এতদিন সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র ছোটখাটো হামলা চালিয়ে গেলেও এবারের হামলা ছিলো উল্লেখ করার মতো।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, সিরিয়ার পরিবর্তনে বড় লাভ যে দুই দেশের হয়েছে, তার মাঝে একটা হলো ইস্রাইল। সিরিয়াতে বিশৃংখলা সৃষ্টি হলেও তা ইস্রাইলের জন্যে সুযোগ করে দিচ্ছে ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের। জন সয়ার্স বলছেন যে, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর থেকে পাঁচ দশকে সিরিয়ার সীমান্তে ইস্রাইলকে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। এতকাল ইস্রাইলের সাথে রাশিয়ার টেবিলের নিচে দিয়ে নোংড়া ধরণের অলিখিত চুক্তি ছিল। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া নিশ্চিত করতো যে, সিরিয়ার ভেতর থেকে ইস্রাইলের উপর কোন হামলা আসবে না। এর বিনিময়ে ইস্রাইল বাশারের সরকারকে উৎখাতের কোনরূপ চেষ্টা থেকে বিরত থাকবে। সিরিয়ার সরকার পরিবর্তনে ইস্রাইলের চিন্তিত হবার কথা। ইস্রাইল হয়তো সবচাইতে খারাপ সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নেবে; যেমন, যদি সিরিয় গ্রুপগুলি একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তবে এক্ষেত্রে ইস্রাইল সবচাইতে বড় সহায়তা পাবে তুরস্কের কাছ থেকে; কারণ তুরস্কের হাতেই থাকবে সিরিয়ার ক্ষমতার মূল চাবি।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার পরিবর্তনে লাভবান হয়েছে কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী গ্রুপগুলির যথেষ্ট ক্ষতি করতে চাইছে। একারণেই তারা একটা-দু'টা হামলা না চালিয়ে ৭৫টা টার্গেটে বোমা ফেলেছে। তবে মার্কিন সেনারা সিরিয়াতে থাকবে কিনা, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেবার আগেই বলেছেন যে, তিনি সিরিয়া থেকে সকল মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করবেন।

‘বিবিসি' বলছে যে, দক্ষিণ-পূর্ব সিরিয়াতে ইরাক এবং জর্দানের সীমান্তে আল-তানফ-এ রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এখানে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স এবং লজিস্টিকসের ৯'শএর মতো সেনা রয়েছে। এখান থেকে মার্কিনীরা পুরো এলাকার উপর নজরদারি করছে এবং সিরিয়ায় কোথায় তারা বিমান হামলা করবে, সেটা নির্ধারণ করছে।
 
বাশারের পতনে ইরান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সেটা লেবাননে হিযবুল্লাহর ক্ষতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। খুব সম্ভবতঃ লেবানন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরান এবং হিযবুল্লাহর ক্ষতির হিসেব করেই তুরস্ক 'এইচটিএস'কে সমর্থন দিয়েছে। এর শুরুটা অবশ্য ছিল ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজা থেকে ইস্রাইলে হামলার মধ্য দিয়ে; যা লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইরান পারমাণবিক শক্তি হবার দিকে আরও বেশি অগ্রগামী হতে পারে। 


কি হতে চলেছে?

তুরস্ক জিতেছে; কিন্তু যা সে জিতেছে, তা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়। রাশিয়া হেরেছে। সিরিয়াতে রুশদের সামরিক ঘাঁটি রাখতে হলে তুরস্কের প্রভাবের (কতটা, তা নিশ্চিত নয়) উপর নির্ভর করতে হবে। এরদোগান এই ঘাঁটি নিয়ে পুতিনের সাথে দরকষাকষি করতে পারেন। সিরিয়া হারালে রাশিয়া লিবিয়াতে ঘাঁটি করতে চাইতে পারে। ইরান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সেটা লেবাননে হিযবুল্লাহর ক্ষতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। খুব সম্ভবতঃ লেবানন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইরান এবং হিযবুল্লাহর ক্ষতির হিসেব করেই তুরস্ক 'এইচটিএস'কে সমর্থন দিয়েছে। এর শুরুটা অবশ্য ছিল ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজা থেকে ইস্রাইলে হামলার মধ্য দিয়ে; যা লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইরান পারমাণবিক শক্তি হবার দিকে আরও বেশি অগ্রগামী হতে পারে। ইস্রাইল জিতেছে; কিন্তু বিনিময়ে সে পেয়েছে অনিশ্চিত প্রতিবেশী। সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে কেউই খুব একটা আশাবাদী নয়। তবে গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ইসলামিক আইন বাস্তবায়নকে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখবে। যুক্তরাষ্ট্র চোখ রেখেছে যাতে সিরিয়াতে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের গ্রুপগুলিও থাকবে। যদি তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের এই ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করতে সিরিয়ার সকল গ্রুপের উপর যথেষ্ট প্রভাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থিত কুর্দী গ্রুপ 'এসডিএফ'এর অধীনে আটক আইসিস সদস্যদেরকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

বাশার আল-আসাদের পতন কেউই চিন্তা করতে পারেনি। তুরস্ক যে এই অভিযানের নেপথ্যে ছিল, তা পশ্চিমাদের কথাতেই পরিষ্কার। আর তুরস্ক বা পশ্চিমারা যে বাশারকে সরাতে চায়নি, সেটাও নিশ্চিত। তারা কেউই পরিকল্পনা করেনি যে, ‘এইচটিএস'এর সাথে বাকি সিরিয় গ্রুপগুলিও যুক্ত হবে; তারা চিন্তাও করেনি যে বাশারের বাহিনী যুদ্ধ করবে না; তারা বোঝেনি যে রাশিয়া এবং ইরান তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবে। মোটকথা, সিরিয়ার বর্তমান ফলাফল কেউই পরিকল্পনা করেনি; সৃষ্টিকর্তা ব্যাতিরেকে। সিরিয়ায় পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ধাঁচের সরকার গঠনে যারা আগ্রহী ছিলো, তাদের বাইরেও অনেকেই আসাদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছে। একারণেই সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। মোটকথা, বাশার আল-আসাদ ব্যতীত সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত; যা তুরস্ক বা রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র, কেউই চায়নি; পরিকল্পনাও করেনি। কাজেই সিরিয়ার ভবিষ্যৎও যে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হবে না, সেটা বলাই যায়।

6 comments:

  1. সিরিয়া দখলের দারপ্রান্তে তো ইজরাইলে। সিরিয়া পতনের ফলে বুঝা যাচ্ছে আমেরিকা এদের লাভটাই বেশি হলো।
    নেক্সট সিরিয়া সরকার কারা হতে পারে? সিরিয়া নেক্সট ৬ মাস কেমন হতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রথমতঃ সিরিয়া গাজা নয় যে কয়েক হাজার সেনা ব্যবহার করে ইস্রাইল সিরিয়া দখল করে ফেলবে। আর সিরিয়ার বেশিরভাগ জনবহুল এলাকা ইস্রাইলের কাছাকাছি। কাজেই দখল করতে হলে সিরিয়ার জনবহুল শহরগুলি দখল করতে হবে।
      দ্বিতীয়তঃ সিরিয়ার শহরগুলি দখল করে ইস্রাইল কি করবে? উদ্দেশ্য কি? এখান থেকে তার সুবিধা কি হবে? এই শহরগুলির কোনরূপ কৌশলগত প্রাকৃতিক বাধা নেই। একারণেই একটা শহর দখলের পর আরেকটা শহরে পৌঁছে যাওয়া যায় কয়েক ঘন্টার মাঝে।
      তৃতীয়তঃ সিরিয়াতে এখন বহু সামরিক গ্রুপ রয়েছে; যাদের নিজেদের মাঝে বিরোধ রয়েছে। ইস্রাইল যদি সিরিয়া দখল করতে যায়, তাহলে এই সবগুলি গ্রুপ ইস্রাইলের বিরুদ্ধে এক হয়ে যেতে পারে।
      চতুর্থতঃ সিরিয়ার মতো বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিতে ইস্রাইলের কত লক্ষ সেনার প্রয়োজন হবে? সিরিয়া আকারকে চিন্তা মাঝে নেবেন না? দেশটার জনসংখ্যা অনেকে দেশের বাইরে চলে যাবার পরেও প্রায় আড়াই কোটি। অপরদিকে ইস্রাইল যুদ্ধ করে রিজার্ভিস্ট দিয়ে। সেনাবাহিনীতে রিক্রুট কম পাওয়ার কারণে তারা মহিলা সেনা দিয়ে শূণ্যস্থান পূরণ করছে।

      এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রাইল এবং তুরস্ক সিরিয়া জুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা চালাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধ গ্রুপগুলিকে দুর্বল করে ফেলা। ইস্রাইল অফিশিয়ালি বলেছে যে, ইস্রাইল-বিরোধী কোন গ্রুপের হাতে যাতে পড়ে না যায়, সেইজন্য তারা সিরিয়ার নৌবাহিনীর পুরোটাই ধ্বংস করে ফেলেছে। তারা সিরিয়ার সেসব ঘাঁটিতে বোমা হামলা করেছে, যেগুলিতে একসময় বাশার সরকার কেমিক্যাল অস্ত্র মজুত রাখতো। তুরস্ক বিমান হামলা চালিয়েছে অস্ত্রের কনভয়ের উপর। তুর্কিরা বলছে যে, তারা সেগুলিকে টার্গেট করেছে যাতে করে সেগুলি মার্কিন সমর্থিত কুর্দি গ্রুপ 'এসডিএফ'এর হাতে না পড়ে। তুর্কিরা 'এসডিএফ'কে সন্ত্রাসী বলে থাকে। আর মার্কিনীরা সকল আইসিস কয়েদিকে রেখেছে 'এসডিএফ'এর হাতে। প্রয়োজন হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইশারায় 'এসডিএফ' আইসিসের সদস্যদেরকে আবারও ছেড়ে দেবে।

      মোটকথা সিরিয়া এখন অত্যন্ত অনিশ্চিত একটা 'এলাকা'। এটাকে রাষ্ট্র বলাটা কঠিন!

      Delete
  2. আসলে ব্যাপারটা জগাখিচুড়ির মতো লাগতেছে; রাশিয়া, ইরান ছাড়াও আমেরিকা ও তুরস্কের সহায়তা ও নিরাপওা ছাড়া বাসারের গদিও আগেই নড়ে যাওয়ার কথা,হঠাৎ করে এই প্লানটা তুরস্ক কেন খেললো,এর পিছনে আমেরিকা ও তুরস্কের উদ্দেশ্য কি??

    কোনো কিছুর অভ্যুত্থানের পিছনে একটা মূলমন্ত্র ও উদ্দেশ্য থাকে যা এখনো ক্লিয়ার হতে পারছি না যেহেতু বাসারের চিন্তার ভিওির সাথে পশ্চিমা আদর্শের কোনো সাংঘর্ষিক ছিলো না??

    ReplyDelete
    Replies
    1. বর্তমানে যে অবস্থা সিরিয়াতে চলছে, তাতে খিচুরি পাকিয়ে গিয়েছে বলেই ধারণা হতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ লেখার মাঝেই দেখেছেন যে পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্সও বুঝে উঠতে পারছে না কি হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, তারা একটা চেয়েছিল; হয়েছে আরেকটা। তারা বাশারকে সরাতে চায়নি। কারণ তারা জানে যে, বাশারকে সরালে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। যে ব্যাপারটা মনে রাখতে হবে তা হলো, শক্তিশালী দেশগুলি নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা করে ঠিকই, কিন্তু তারা চায়না যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক।

      তুরস্ক এখানে কিছু হিসেব কষেছে; যার মাঝে প্রথমেই থাকবে ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। ট্রাম্পের প্রথম টার্মে কেউই জানতো না যে তার সময়টা কেমন যেতে পারে। কিন্তু এবারে সকলেরই একটা ধারণা রয়েছে। একারণে সকলেই নিজের আখের গোছাচ্ছে। যেমন, জার্মানিতে সরকার ভেঙ্গে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণে গিয়েছে যাতে করে যুদ্ধ শেষ করার আগে আগে যতটুকু সম্ভব এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া যায়।

      তুরস্কও সেই সুযোগটাই নিয়েছে। তারা মনে করেছে যে, সিরিয়াতে শক্ত একটা অবস্থান নিতে পারলে সিরিয়াতে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটিগুলি ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দাবার গুটি হিসেবে কাজ করবে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের গুরুত্ব শুধু কমছেই। এখন তুরস্ক সেটা আবারও বাড়ানোর সুযোগ পাবে। একইসাথে ট্রাম্প তুরস্কের উপর দায়িত্ব দিয়ে সিরিয়া ছেড়ে যেতে পারবেন। এই ব্যাপারগুলি ট্রাম্প নির্বাচনে জেতার আগে বাস্তবতা ছিল না। যদিও লেবাননে হিযবুল্লাহর হার এবং ইরানের ব্যাপক ক্ষতির পর সেটা তুরস্কের সামনে একটা সুযোগ করে দিয়েছে, তথাপি ট্রাম্প আসার পর তুরস্কের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করার কোন লক্ষ্য না থাকলে তুরস্ক হয়তো সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতো না। বিশেষ করে তুরস্ক কিন্তু চায়নি যে বাশার আল-আসাদের পতন হোক। কারণ পুরো সিরিয়ার দেখাশোনা করার মতো সক্ষমতা তুরস্কের নেই। এখন সেখানে ইরানও নেই। এখন বাশার-পরবর্তী সিরিয়া কারুর নিয়ন্ত্রণেই নেই - এটা যেহেতু দুনিয়ার কারুর পরিকল্পনায়ই ছিল না, তাই বলাই যায় যে এই পরিকল্পনা হলো সৃষ্টিকর্তার নিজের।

      Delete
    2. তাহলে সিরিয়ার পরবর্তী যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতায় নিবে তারা কি পশ্চিমা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে অর্থাৎ গণতন্ত্র কি আবারো ফিরে আসবে;যেখানে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সবকিছু বাইরে থেকে লজিস্টিকাল সাপোর্ট নেওয়া যেহেতু HTS এর কথা শুনে মনে হচ্ছে না ওরা পুরোপুরি ইসলামিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে??

      এই অভুত্থান অন্যান্য আরব দেশগুলোতে কি ইমপ্যাক্ট পড়তে পারে??

      Delete
    3. পশ্চিমারা চাইছে যে সিরিয়াতে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু উপরের লেখাতেই বলা হয়েছে যে সেই ব্যাপারে কেউই তেমন একটা আশাবাদী নয়। তবে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে প্রভাবিত করে যেতে থাকবে। এই কাজে তারা আশেপাশের দেশগুলিকে ব্যবহার করবে। যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত - এই দেশগুলি সিরিয়াতে বিভিন্ন ভূমিকা নিতে থাকবে। বিত্তবান দেশগুলি এখানে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রভাব বিস্তার করবে আর তুরস্ক নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করবে। এদের পিছনে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এরা কেউই সিরিয়াতে ইসলামিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা দেখতে ইচ্ছুক নয়। তবে যেটা মুল লেখাতেই বলা হয়েছে যে, বিদ্রোহীরাও চিন্তা করতে পারেনি যে ১২ দিনে এভাবে আসাদ সরকারের পতন হবে। অর্থাৎ কেউই এই পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত ছিল না। আর আরেকটা ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো - সিরিয়ার বিদ্রোহীরা বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ নয়; যারা মূলতঃ বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা যোদ্ধা বা মিলিশিয়া। তারা রাষ্ট্রের রাজনীতি কতটা বুঝবে, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে পশ্চিমারা যে এখানে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে কলকাঠি নাড়বে, সেটা কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেটা তাদের জানা থাকবে না। এই জ্ঞানটার জন্যেই তাদের প্রয়োজন ছিল আদর্শিক রাজনীতির শিক্ষা; যা তাদের বেশিরভাগেরই নেই। তবে তাদের মাঝে কোন গ্রুপ যদি এহেন রাজনীতিবিদ যোগার করে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে, সেটা হবে ইতিহাস।

      অন্যান্য দেশের উপর প্রভাব অবশ্যই পড়বে। যেমন, সৌদি আরব, মিশর, এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যেগুলি পশ্চিমাদের সমর্থনে একনায়ক হিসেবে দেশ শাসন করছে, সেই দেশগুলি সিরিয়ার পরিবর্তনে চিন্তিত হবে। তাদের মাথায় ঘুরবে যে, এরকম পরিবর্তন তাদের ক্ষেত্রে যেন না হয়।

      ইস্রাইলও এই ব্যাপারে চিন্তিত থাকবে। কারণ অন্যান্য আরব দেশে সিরিয়ার মতো পরিবর্তন ইস্রাইলের জন্যে অস্তিত্বের সংকট। তবে যেটা উপসংহারে বলা যায় তা হলো, ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজা থেকে ইস্রাইলের উপর হামলার মাধ্যমে ইস্রাইল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গেছে এবং নিজেকে বাঁচাতে যারপরনাই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

      Delete