Saturday, 21 December 2024

যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের ব্যবহার পরিবর্তিত হচ্ছে - ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা

২১শে ডিসেম্বর ২০২৪

রুশ অত্যাধুনিক 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেন যুদ্ধে এধরণের কমপক্ষে ৬২টা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। ব্যবহারের জায়গা এবং কৌশলের কারণেই রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টারগুলি অত্যাধুনিক হবার পরেও ব্যাপক হারে ধ্বংস হয়েছে। কারণ প্রযুক্তিই শেষ কথা নয়। 


ইউক্রেনিয় বিমান বাহিনীর ১৮তম সিকোর্স্কি ব্রিগেডের হেলিকপ্টার পাইলটরা 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'কে বলছে যে, যখন রুশরা ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তারা তৎক্ষণাৎ জানতো কি করতে হবে। কারণ তারা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল যে, রুশরা তাদের বিমান ঘাঁটিগুলিতে হামলা শুরু করলে তাদের বিমানগুলিকে কিভাবে রক্ষা করতে হবে। তারা অতি দ্রুত তাদের বিমানগুলিকে সারা ইউক্রেন জুড়ে ছড়িয়ে দেয় এবং সকল মেইনটেন্যান্স ক্রুদেরকে বলা ছিল যে, কোথায় গিয়ে মিলিত হতে হবে। এভাবে তারা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে যুদ্ধের শুরু থেকেই রক্ষা করতে পেরেছে। তিন বছর ধরে রুশ বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরেও ইউক্রেন হেলিকপ্টার অপারেট করতে পারছে, এটা অনেকের কাছেই অবাক লাগার মতো। তবে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে ইউক্রেন যুদ্ধ হেলিকপ্টারের প্রয়োজনীতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে; যদিও তা প্রথমবারের মতো নয়।

ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার অপারেশন – শত্রুর রাডার ফাঁকি দেয়া

‘এএফপি'র সাথে কথা বলতে গিয়ে ইউক্রেনের একজন 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার পাইলট বর্ণনা করেন যে, কিভাবে তারা ফ্রন্টলাইনে রুশ অবস্থানের উপর আক্রমণ করেন। হেলিকপ্টারগুলি খুব নিচু দিয়ে উড়ে যায়, যাতে করে রুশ রাডারে সেগুলি একেবারে শেষ মুহুর্তে দেখা যায়। রুশরা একটা সময় ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলিকে অবশ্যই দেখতে পাবে। তবে পাইলটরা চেষ্টা করবে, যাতে করে সবচাইতে কম সময়ের জন্যে তাদেরকে দেখা যায়। এতে করে রুশরা হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে খুব কম সময় পাবে। প্রায় ৬ দশমিক ২কিঃমিঃ দূর থেকে হেলিকপ্টারগুলি ২০ ড্রিগ্রির মতো উপরের দিকে উঠে তাদের রকেটগুলি ফায়ার করে। তারা এরকম একটা মিশনে এক হেলিকপ্টার থেকে ৩০টা রকেট ছুঁড়েছেন বলে জানান। এই রকেটগুলি টার্গেটের ১'শ থেকে ২'শ মিটারের মাঝে আঘাত করতে সক্ষম। মিশনের আগেই তারা ঠিক করে রাখেন যে, কোন রুটে তারা ফেরত আসবেন। ইউক্রেনিয়রা তাদের নিজেদের হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া রকেটের নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত করার সক্ষমতা নিয়ে কথা না বললেও রুশদেরটা নিয়ে অবশ্য কথা বলছে। ইউক্রেনিয় মিডিয়া 'ইউনাইটেড ২৪'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে থেকেই রকেট ছুঁড়ছে। ভিডিওতে দেখা যায় যে, রুশ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টার তাদের নাক কিছুটা উপরের দিকে উঠিয়ে রকেটগুলি ছুঁড়ে দিচ্ছে। এভাবে ছোঁড়া রকেটের নিশানা কতটুকু নিখুঁত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ৬কিঃমিঃ দূরত্ব থেকে রকেট ছুঁড়লে এক ডিগ্রি এদিক ওদিক হলেও টার্গেটের কয়েক'শ মিটার দূরে গিয়ে পড়বে।

ইউক্রেনিয় 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় হুমকি হলো রুশ ফাইটার জেট। একারণেই তারা রাডার ফাঁকি দিতে নিচু দিয়ে ওড়ে। 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টারগুলি সোভিয়েত আমলের ডিজাইনের হলেও গতির দিক থেকে (ঘন্টায় ৩২০ কিঃমিঃ) এগুলি সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম। অন্যান্য এটাক হেলিকপ্টার থেকে যা 'এমআই-২৪' হেলিকপ্টারকে আলাদা করে দেয় তা হলো, এগুলি ৮জন সেনা বহণ করতে সক্ষম। 
 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সিএসআইএস'এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক ক্যানসিয়ান 'ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'কে বলছেন যে, সাধারণতঃ পরিবহণ হেলিকপ্টারগুলি ভূমির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে লুকিয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু এটাক হেলিকপ্টারগুলিকে শত্রুর উপর হামলা করতে হলে শত্রুর সামনাসামনি আসতেই হবে। ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে এগুলিতে এন্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র এবং পদাতিক সেনাদের অবস্থানের উপর হামলার জন্যে এগুলিতে রকেট বহণ করা হয়। এছাড়াও ভার্সনের উপর নির্ভর করে এগুলিতে মেশিনগান অথবা কামান থাকে। শত্রুর কাছাকাছি আসতে হয় বলে এটাক হেলিকপ্টারগুলি সাধারণতঃ বর্মাবৃত থাকে এবং এগুলির গতিও থাকে বেশি। ইউক্রেনিয়দের ব্যবহৃত 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টারগুলি সোভিয়েত আমলের ডিজাইনের হলেও গতির দিক থেকে (ঘন্টায় ৩২০ কিঃমিঃ) এগুলি সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম। অন্যান্য এটাক হেলিকপ্টার থেকে যা 'এমআই-২৪' হেলিকপ্টারকে আলাদা করে দেয় তা হলো, এগুলি ৮জন সেনা বহণ করতে সক্ষম। তবে এই হেলিকপ্টারে মার্কিন 'এপাচি' অথবা রুশদের সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারগুলির মতো সার্চ এবং টার্গেটিংএর জন্যে কোন রাডার নেই। একইসাথে সর্বশেষ ডিজাইনের হেলিকপ্টারগুলির মতো রাতের বেলায় মিশন চালাবার সক্ষমতা এগুলির নেই। এছাড়াও শত্রুর সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বাঁচার জন্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও এতে নেই। 'স্ক্রিপস নিউজ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে একজন ইউক্রেনিয় 'এমআই-৮' পাইলট জানান যে, তার হেলিকপ্টারের ভেতরে বড় একটা ফুয়েল ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছে; যার ব্যবহারে হেলিকপ্টারটা একনাগাড়ে সাড়ে ৩ ঘন্টা আকাশে থাকতে পারে। ইউক্রেনিয় মিডিয়া 'ইউনাইটেড ২৪'এ বলা হয় যে, ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় হুমকি হলো রুশ ফাইটার জেট। একারণেই তারা রাডার ফাঁকি দিতে নিচু দিয়ে ওড়ে। ইউক্রেনিয়রা চেক রিপাবলিকের কাছ থেকে রুশ নির্মিত 'এমআই-৩৫' (এমআই-২৪এর রপ্তানি ভার্সন) এটাক হেলিকপ্টার পেয়েছে। এই হেলিকপ্টারগুলি এখন পশ্চিমা নির্মিত 'হাইড্রা-৭০' ৭০মিঃমিঃ রকেট ব্যবহার করছে। সোভিয়েত ডিজাইনের 'এস-৮' ৮০মিঃমিঃ রকেটের চাইতে এগুলির পাল্লা অপেক্ষাকৃত বেশি বলে জানান একজন ইউক্রেনিয় পাইলট। ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলি মূলতঃ ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ১১তম আর্মি এভিয়েশন ব্রিগেডের অন্তর্গত। যুদ্ধের আগে খেরসনে তাদের ঘাঁটি থাকলেও রুশ আক্রমণের পর থেকে হেলিকপ্টারগুলিকে ফ্রন্টলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তারা মার্কিনীদের কাছ থেকেও রুশ নির্মিত 'এমআই-১৭' হেলিকপ্টার পেয়েছে; যেগুলি আফগানিস্তানের জন্যে কেনা হয়েছিলো। এগুলি প্রযুক্তির দিক থেকে বেশ অগ্রগামী। 'দ্যা ওয়ার জোন' ম্যাগাজিনের হিসেবে এই হেলিকপ্টারের সংখ্যা ২০টার মতো হবে।
 
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'র‍্যান্ড কর্পোরেশন'এর জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মার্কিন ম্যারিন কোরের প্রাক্তন 'সুপার কোবরা' হেলিকপ্টার পাইলট কাইলিএন হান্টার 'বিজনেস ইনসাইডার'কে বলছেন যে, হেলিকপ্টার যখন খুব নিচু দিয়ে উড়ছে, তখন পাইলটের মিশন সম্পর্কে খেয়ার রাখা ছাড়াও বেশকিছুটা মনোযোগ চলে যায় হেলিকপ্টার ওড়াতে; যেমন গাছপালা, ইলেকট্রিক পোস্ট ইত্যাদি বাধা সম্পর্কে তাকে বিশেষভাবে সাবধান হতে হয়। একটু ভুল হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এছাড়াও আশেপাশের হুমকি সম্পর্কে পাইলটের সচেতনতা কমে যায়; কারণ খুব নিচুতে ওড়ার কারণে সে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায় না। একারণে যেকোন বিষয়ে পাইলটের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় একেবারেই কমে যায় এবং তাকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়। যেকোন দিক থেকে হেলিকপ্টারের জন্যে হুমকি আসতে পারে; সেটা শত্রুর একটা বাংকার হতে পারে; আবার একটা বিল্ডিংএর উপর থেকেও হতে পারে। নিচু দিয়ে উড়লে শত্রুর পক্ষে একটা হেলিকপ্টারকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি অত নিচুতে কাজ করে না। তবে নিচু দিয়ে ওড়ার সময় হেলিকপ্টারগুলি সৈন্যদের কাঁধে বহন করা বিমান-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও, বিমান বিধ্বংসী কামান এবং মেশিনগানের পাল্লার মাঝে পড়ে যায়।
 
রুশ 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টারের চ্যাফ-ফ্লেয়ার ডেকয়।যুদ্ধের প্রথম দিকের কয়েকটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি একা ইউক্রেনিয় এলাকার গভীরে অপারেট করতে গিয়ে কাঁধে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের হাতে ভূপাতিত হচ্ছে। এগুলিকে ভূপাতিত করা সহজ কাজ নয়। তথাপি একা একা উড়লে একটা বিমানের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো যায়।


রুশ হেলিকপ্টার অপারেশন – টীমওয়ার্ক

যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাসের মাঝেই রুশরা বুঝে ফেলেছে যে, তাদের হেলিকপ্টারগুলি ফ্রন্টলাইনের খুব বেশি কাছে গিয়ে ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। প্রথম দিকের কয়েকটা ভিডিওতে দেখা যায় যে, ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি একা ইউক্রেনিয় এলাকার গভীরে অপারেট করতে গিয়ে কাঁধে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের হাতে ভূপাতিত হচ্ছে। শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে বোকা বানাতে রুশ 'কেএ-৫২' এবং 'এমআই-২৮' হেলিকপ্টারগুলি দু'পাশে ৬৪টা করে মোট ১২৮টা চ্যাফ ও ফ্লেয়ার বহণ করে। একইসাথে ক্ষেপণাস্ত্রকে বোকা বানাতে এগুলিতে থাকে 'ডিরেকশনাল আইআর কাউন্টারমেজার'। এর বাইরেও এগুলির ককপিট ১২.৭মিঃমিঃ থেকে শুরু করে ২৩মিঃমিঃ ক্যালিবারের গুলি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। অর্থাৎ এগুলিকে ভূপাতিত করা সহজ কাজ নয়। তথাপি একা একা উড়লে একটা বিমানের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো যায়।

তাই রুশরা খুব নিচু দিয়ে উড়ে 'হিট এন্ড রান' ট্যাকটিকসএর দিকে মনোযোগী হয়। তারা মিশনের ধরণ ভেদে হেলিকপ্টারের গ্রুপ নিয়ে অপারেট করেছে। এইরূপ একটা মিশনে দেখা যায় যে, খুব স্বল্প সময়ের জন্যে হেলিকপ্টারের নাক ২০-৩০ ডিগ্রি উঁচু করে শত্রুর অবস্থানের উপর ১০টা ১২২মিঃমিঃ 'এস-১৩' এবং ৪০টা ৮০মিঃমিঃ 'এস-৮' রকেট ছুঁড়েছে 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টার। একই সময়ে শত্রু যখন ব্যস্ত ছিল, তখন ‘কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে একটা স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটা টার্গেটে আঘাত করার আগ পর্যন্ত 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারটাকে আকাশে এক জায়গায় অবস্থান করতে হয়; যা হেলিকপ্টারটার জন্যে খুবই বিপজ্জনক। একারণে অন্যান্য হেলিকপ্টারগুলির সাহায্য প্রয়োজন হয়। একইসাথে সেই গ্রুপে ‘এমআই-৩৫', এবং 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার ছিল; যেগুলির কাজ ছিল দরকার বিশেষে শত্রুর অবস্থানে রকেট হামলা করা অথবা কোন হেলিকপ্টার ভূপাতিত হলে সেটার পাইলটদেরকে উদ্ধার করা। মোটকথা এটা হলো একটা টীমওয়ার্ক।
 
রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টারের নাক ৩০ ডিগ্রি উঁচু করে রকেট ছোঁড়া হচ্ছে। রুশরা খুব নিচু দিয়ে উড়ে 'হিট এন্ড রান' ট্যাকটিকসএর দিকে মনোযোগী হয়েছে। তারা মিশনের ধরণ ভেদে হেলিকপ্টারের গ্রুপ নিয়ে অপারেট করেছে। এইরূপ একটা মিশনে দেখা যায় যে, খুব স্বল্প সময়ের জন্যে হেলিকপ্টারের নাক ২০-৩০ ডিগ্রি উঁচু করে শত্রুর অবস্থানের উপর ১০টা ১২২মিঃমিঃ 'এস-১৩' এবং ৪০টা ৮০মিঃমিঃ 'এস-৮' রকেট ছুঁড়েছে 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টার। 


ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান বনাম রুশ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টার

২০২৩এর গ্রীষ্মে ইউক্রেনিয়রা অগ্রাভিযানে যাবার পর রুশ হেলিকপ্টারগুলি নতুন জীবন পেয়েছিল। ইউক্রেনিয় সেনা ইউনিটগুলি যতই এগিয়েছে, ততই তারা তাদের নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে চলে গিয়েছে। এই সুযোগটাই নিয়েছে রুশ হেলিকপ্টারগুলি। ২০২২ সালে রুশরা ইউক্রেনে হামলা করার সময় ইউক্রেনিয়রাও এই সুযোগটাই নিয়েছিল। রুশদের আক্রমণকারী বাহিনীর অগ্রভাগে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি থাকার কারণে ইউক্রেন তুরস্কে নির্মিত 'বায়রাকতার টিবি-২' ড্রোন ব্যবহার করে বহু রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছিলো। ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান শুরুর পর ২০২৩এর জুনে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার (এক্স)এর এক বার্তায় বলা হয় যে, রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদেরকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে দিয়েছে। 'দ্যা ওয়ার জোন' ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায় যে, ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান শুরুর পর রুশরা বেরদিয়ান্সক বিমান ঘাঁটিতে অন্যান্য এলাকা থেকে ২০টার মতো হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছে; যার মাঝে রয়েছে ৫টা 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার, ৯টা 'এমআই-৮' অথবা 'এমআই-২৪', এবং ১৩টা 'কেএ-২৭' বা 'কেএ-২৯' হেলিকপ্টার, যেগুলি নৌবাহিনী ব্যবহার করে। ফ্রন্টলাইনের শেষ ১৫কিঃমিঃএর মাঝে নিচু দিয়ে উড়ে 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনের স্বল্প পাল্লার বা 'শোরাড' ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে থাকতে পারবে। আর রাতের বেলায় অপারেট করে অনেকাংশেই কাঁধে বহণ করা বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়াতে পারবে। সামরিক বিশ্লেষক গায় প্লপস্কি বলছেন যে, ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী 'ভিখর-১' ক্ষেপণাস্ত্র বহণের মূল প্ল্যাটফর্ম। লেজার গাইডেড এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় ১০কিঃমিঃ। রুশরা হেলিকপ্টারের হেড-আপ ডিসপ্লের বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করেছে, যেখানে 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টার থেকে ৮কিঃমিঃ বা তার চাইতেও বেশি দূরত্ব থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে দেখা যায়।

২০২২এর সেপ্টেম্বরে নতুন 'কেএ-৫২এম' ভার্সন সার্ভিসে এসেছে বলে রুশ বার্তা সংস্থা 'তাস' জানায়। ২০২১এর অগাস্টে এই হেলিকপ্টারগুলির উৎপাদন শুরু হয়; যেখানে বলা হয় যে, ২০২২ সালে ১৫টা এবং ২০২৩ সালে আরও ১৫টা হেলিকপ্টার ডেলিভারি দেয়া হবে। ২০২৩এর জুনে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেন যে, ২০২২এর তুলনায় ২০২৩এ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারের ডেলিভারির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এগুলি দূরপাল্লার 'এলএমইউআর' ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণে সক্ষম, যেগুলির পাল্লা ১৪কিঃমিঃএর বেশি। রাতের বেলায় চলমান কোন টার্গেটের বিরুদ্ধে দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার সক্ষমতা রুশদের আর কোন বিমানের নেই। ২০২৩এর জুলাই মাসে সোশাল মিডিয়া টেলিগ্রামে রুশ 'ফাইটারবম্বার' চ্যানেলে এই নতুন 'কেএ-৫২এম' হেলিকপ্টারের কিছু ছবি আপলোড করা হয়। এছাড়াও ২০২৩এর জানুয়ারিতে 'ফাইটারবম্বার' চ্যানেলে সর্বাধুনিক 'এমআই-২৮এনএম' হেলিকপ্টারের ভিডিও আপলোড করা শুরু হয়; যেখানে এই হেলিকপ্টারগুলিকেও দূরপাল্লার 'এলএমইউআর' ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে দেখা যায়। মোটকথা, রুশরা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে থেকে অপারেট করার উদ্দেশ্যে আরও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করছে।
 
রাতের বেলায় শত্রুর ট্যাঙ্ক বহরের উপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার। ‘কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী 'ভিখর-১' ক্ষেপণাস্ত্র বহণের মূল প্ল্যাটফর্ম। লেজার গাইডেড এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় ১০কিঃমিঃ। যখন অন্যান্য রুশ হেলিকপ্টার শত্রুকে ব্যস্ত রেখেছে, তখন ‘কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে টার্গেট ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রটা টার্গেটে আঘাত করার আগ পর্যন্ত 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারটাকে আকাশে এক জায়গায় অবস্থান করতে হয়; যা হেলিকপ্টারটার জন্যে খুবই বিপজ্জনক। একারণে অন্যান্য হেলিকপ্টারগুলির সাহায্য প্রয়োজন হয়। 


'ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার'এর গবেষক রাইলি বেইলি 'বিজনেস ইনসাইডার'কে বলেন যে, ইউক্রেনের শহরগুলির উপর রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে ইউক্রেনিয়রা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শহরগুলির আশেপাশে মোতায়েন করেছে। একারণে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সেনাদের উপর আকাশ প্রতিরক্ষার ঘাটতি হয়েছে এবং আক্রমণে যাওয়া সেনাদের সাথে থাকার মতো মোবাইল বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইউক্রেনের থাকছে না; যা রুশ হেলিকপ্টারগুলিকে অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছিল। ইউক্রেনিয়রা আক্রমণে যাবার আগ পর্যন্ত রুশ হেলিকপ্টারগুলিকে ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি খুব বেশি দেখা যাচ্ছিলো না। রুশরা খুব সম্ভবতঃ তাদের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কিছুটা সাবধান হয়েছিলো। ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযানের সময় তাদের হেলিকপ্টারগুলি স্বল্প পাল্লার মিশনে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। তবে সেটা সম্ভব হয়েছে রুশদের শক্তিশালী মাইনফিল্ড, আর্টিলারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারএর সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করার ফলে। তাছাড়া রুশরা শক্তিশালী পরিখা নেটওয়ার্ক তৈরি করার যথেষ্ট সুযোগও পেয়েছিলো; যেখানে তারা মাইন, 'কনসারটিনা ওয়্যার' কাঁটাতারের বেড়া এবং 'ড্রাগনস টীথ' এন্টি-ট্যাঙ্ক বাধা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলো। এই বাধাগুলির সামনে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পশ্চিমা-নির্মিত ট্যাঙ্কগুলি আটকে গেলেই তারা রুশ এটাক হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য অস্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছিলো।

রুশ সামরিক ব্লগাররা দাবি করছে যে, রুশ বিমান বাহিনী ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের উপর দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং গ্লাইড বোমা দিয়ে আক্রমণ করেছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে। রুশদের এই ট্যাকটিকস থেকে নিজেদের সেনাদের বাঁচাতে ইউক্রেনিয়রা তাদের কিছু বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফ্রন্টলাইনে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু রাডার চালু করার সাথেসাথেই সেগুলির উপর রুশরা 'ল্যানসেট' এবং অন্যান্য সুইসাইড ড্রোন দিয়ে হামলা করছিলো। এছাড়াও একেবারে ফ্রন্টলাইনের উপরে হবার কারণে রুশরা তাদের স্নাইপার দল দিয়ে এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে এমবুশ করেছিলো। রাডার অপারেটরদের হত্যা করে রুশ সেনারা অল-টেরাইন ভেহিকল বা এটিভি ব্যবহার করে দ্রুত পালিয়ে গেছে। এর ফলে ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনিয়দের পক্ষে কোন বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয়নি; যদিও সেটা না করলে ইউক্রেনিয় সেনারা রুশ বিমান আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারছিলো না। এভাবেই ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে রুশ 'কেএ-৫২' হেলিকপ্টারগুলি অবাধে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছে।

রুশদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ হেলিকপ্টার হলো 'এমআই-৮এমটিপিআর-১ রাইচাগ'। এটা একটা সাধারণ 'এমআই-৮' পরিবহণ হেলিকপ্টার; যার ভিতরে রয়েছে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সরঞ্জাম। 'দ্যা ওয়ার জোন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত রুশ সামরিক বাহিনীতে খুব সম্ভবতঃ এরকম ১৮টা হেলিকপ্টার ছিল। এগুলির কাজ হলো শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষা রাডার জ্যামিং করা। এই কাজ করার জন্যে হেলিকপ্টারগুলি রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের ভেতরে অনেক উপর দিয়ে ওড়ে। একটা নির্দিষ্ট এলাকায় শত্রুর রাডার জ্যামিং করে সেই অঞ্চলে নিজ বিমান বাহিনীর আক্রমণকে সহজ করে দেয় এই হেলিকপ্টার। ২০২৪এর নভেম্বরে রুশ বার্তা সংস্থা 'তাস' রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি 'এফএসবি'র বরাত দিয়ে বলে যে, ইউক্রেনিয়রা একজন পাইলটকে দিয়ে এরকম একটা হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করার পরিকল্পনা করেছিল। রুশরা দাবি করছে যে, ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এই কাজে ইন্ধন দিয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় পশ্চিমারা বিভিন্নভাবে সোভিয়েত সামরিক সরঞ্জাম হাইজ্যাক করেছিলো। সোভিয়েত 'মিগ-২১', ‘মিগ-১৯' এবং 'মিগ-১৭' যুদ্ধবিমান ইস্রাইলের কাছ থেকে চড়া মূল্যে পেয়েছিল মার্কিনীরা; যেগুলিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাইলট ট্রেনিংএর জন্যে 'টপগান' স্কুলের কারিকুলাম সাজিয়েছিলো। এই ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেমের সফলতা নিয়ে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করার চেষ্টার খবর যদি সত্যি না-ও হয়, তথাপি ইউক্রেনিয়দের হাতে এধরণের ৬টা হেলিকপ্টার ধ্বংস হবার খবর বলে দেয় যে, ইউক্রেনিয়রা এগুলিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে টার্গেট করেছে।
 
২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২২। রুশ পরিবহণ হেলিকপ্টারগুলি হস্টোমেল বিমানবন্দর দখলে এগুচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম কয়েক ঘন্টার মাঝেই রাজধানী কিয়েভের উত্তরে হস্টোমেল বিমানবন্দর দখলের রুশ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সেনা অবতরণ করিয়ে এই বিমানবন্দর দখলের প্রচেষ্টা ছিল। তবে এই মিশন ব্যর্থ হবার পিছনে যে হেলিকপ্টারের দুর্বলতা দায়ী ছিল না, তা বোঝা যায় যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হেলিকপ্টার ব্যবহারের দিকে তাকালে। 


হেলিকপ্টারই যখন টার্গেট

ডাচ ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ওয়েবসাইট 'ওরিক্স'এর হিসেবে রুশরা এখন পর্যন্ত ১৪৭টা হেলিকপ্টার হারিয়েছে; যার মাঝে ৪৪টা 'এমআই-৮' পরিবহণ হেলিকপ্টার (এর মাঝে ৬টা ‘এমআই-৮এমটিপিআর-১ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার হেলিকপ্টার), ১৮টা 'এমআই-২৪ বা এমআই-৩৫' এটাক হেলিকপ্টার, ১৫টা 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টার এবং ৬২টা 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার রয়েছে। ইউক্রেনিয়রা এই সময়ের মাঝে হারিয়েছে ৫০টা হেলিকপ্টার; যার মাঝে ৩১টা 'এমআই-৮ বা এমআই-১৭' পরিবহণ হেলিকপ্টার এবং ৮টা 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম কয়েক ঘন্টার মাঝেই রাজধানী কিয়েভের উত্তরে হস্টোমেল বিমানবন্দর দখলের রুশ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সেনা অবতরণ করিয়ে এই বিমানবন্দর দখলের প্রচেষ্টা ছিল। তবে এই মিশন ব্যর্থ হবার পিছনে যে হেলিকপ্টারের দুর্বলতা দায়ী ছিল না, তা বোঝা যায় যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হেলিকপ্টার ব্যবহারের দিকে তাকালে। সেবছরেরই ১লা এপ্রিল ইউক্রেনের 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার রাশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর বেলগোরদের জ্বালানি ডিপোতে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। হামলায় ইউক্রেনিয়রা সম্পূর্ণ সারপ্রাইজ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো। ইউক্রেনিয়রা আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে না থাকার পরেও ব্যাপক সাফল্যের সাথে হেলিকপ্টার অপারেট করেছে। একেকজন পাইলট দিনে ১ থেকে ৩টা সর্টিও উড়িয়েছে; যা পাইলট, হেলিকপ্টার এবং মেইনটেন্যান্স সদস্যদের সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। যদিও এই সময়ে অনেক ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। কৃষ্ণ সাগরে রুশদের হাত থেকে স্নেইক আইল্যান্ড নামের ছোট্ট একটা দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিতে ইউক্রেনিয়রা সেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সেনা অবতরণও করিয়েছিল।

২০২৩এর গ্রীষ্মে ইউক্রেনের ব্যর্থ অগ্রাভিযানের সময় পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলি ধ্বংসে রুশ হেলিকপ্টারগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খুব সম্ভবতঃ একারণেই ইউক্রেনিয়রা রুশদের হেলিকপ্টার ঘাঁটিকে টার্গেট করেছিলো। গত ১৭ই অক্টোবর ২০২৩এ বেরদিয়ান্সক এবং লুহান্সকএ রুশ বিমান ঘাঁটির উপর ইউক্রেনিয়রা মার্কিন 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা হামলা করেছিলো। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, খুব সম্ভবতঃ বেরদিয়ান্সকএ ৯টা এবং লুহান্সকএ ৫টা রুশ হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। একইসাথে সেখানে বলা হয় যে, রুশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলিকে ফ্রন্টলাইনে তেমন দেখাই যাচ্ছিলো না। সেই শূণ্যস্থান পূরণ করছিলো রুশ হেলিকপ্টারগুলি। এই বিমান ঘাঁটিগুলি তারা ফরওয়ার্ড অপারেটিং বেইস হিসেবে ব্যবহার করছিলো। হয়তো এই হামলার ফলে রুশরা তাদের হেলিকপ্টারগুলি ফ্রন্টলাইন থেকে আরও দূরে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবে। ‘ওয়ার অন দ্যা রকস' পডকাস্টে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'কার্নেগি এনডাউমেন্ট'এর সিনিয়র ফেলো মাইকেল কফম্যান বলেন যে, রুশরা যদি আগে থেকেও জানতো যে ইউক্রেনিয়রা রুশ বিমান ঘাঁটিতে হামলা করবে, তারপরও তারা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতো না। কারণ প্রাথমিকভাবে ক্ষতি সহ্য করে তারপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াটা রুশদের কর্মপদ্ধতি হয়ে গিয়েছে। এই হামলায় খুব সম্ভবতঃ ১৬০কিঃমিঃ পাল্লার 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়; যেগুলির ওয়ারহেড ছিল মূলতঃ ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা। খালি যায়গায় পার্কিং করা বিমানগুলিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো। এই বিমান ঘাঁটিগুলি থেকে অপারেট করা 'কেএ-৫২ এলিগেটর' এবং 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান ভেস্তে যাবার পিছনে বড় কারণ ছিলো।
 
ইউক্রেনিয় 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারের ভেতর বসানো হয়েছে জ্বালানির ট্যাঙ্ক; যা হেলিকপ্টারটাকে সাড়ে ৩ ঘন্টা আকাশে থাকতে সহায়তা করে। ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ১২তম ব্রিগেডের একজন পাইলট বলেন যে, মারিউপোল মিশনে অংশ নেয়া পাইলটদের বলা হয়েছিলো যে তাদের ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ভূপাতিত হবার। মারিউপোল থেকে উদ্ধার করা আহত একজন সেনা হেলিকপ্টারের পাইলটের নাম জানতে চেলেছিলেন। তিনি বলেন যে, পাইলটের নামে তার অনাগত সন্তানের নাম তিনি রাখবেন 'ওলেক্সান্ডার'।


ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার অপারেশন

সংখ্যায় কম এবং প্রযুক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টারগুলিও যথেষ্ট সফলতার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। ইউক্রেনিয় মিডিয়া 'ইউনাইটেড ২৪'এর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে, ২০২২ সালের মার্চে কিভাবে ইউক্রেনিয় হেলিকপ্টার পাইলটরা অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে প্রায় ৮০ দিনের জন্যে অবরুদ্ধ মারিউপোল শহরের আজভস্টাল স্টীল কমপ্লেক্সে আটকে পড়া ৩ হাজার ইউক্রেনিয় সেনাকে রসদ সরবরাহ করেছিলো। তারা সেখানে সাপ্লাই পৌঁছে দেয়া ছাড়াও আজভ ব্যাটালিয়ন ও ইউক্রেনিয় সামরিক ইন্টেলিজেন্স 'জিইউআর'এর সদস্যদের মারিউপোলে নিয়ে যায় ও গুরুতর আহতদেরকে সেখান থেকে নিয়ে আসে। ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনীর ১২তম ব্রিগেডের একজন পাইলট বলেন যে, এই মিশনে অংশ নেয়া পাইলটদের বলা হয়েছিলো যে তাদের ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ভূপাতিত হবার। একারণে একজন পাইলটকেও সেখানে দ্বিতীয়বার পাঠানো হয়নি। নাইট ভিশন গগলস পড়ে 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারের পাইলটরা রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকার ১০০কিঃমিঃ ভেতরে ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা দক্ষিণে সমুদ্রের উপকূল পর্যন্ত যায়। এরপর সেখান থেকে পূর্বদিকে মোড় নিয়ে সমুদ্রের দিক থেকে মারিউপোলে হাজির হয়। এভাবে তারা মোট ৭টা অপারেশন সম্পাদন করেছিলো; যেখানে ১৬টা 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার অংশ নিয়েছিল। তবে প্রথমবারের পর থেকে তারা সারপ্রাইজ ফ্যাক্টরটা হারিয়ে ফেলে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ‘অপারেশন এয়ার করিডোর'এর মাধ্যমে ৮৫ জন আহত সেনাকে মারিউপোল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এরূপ আহত একজন সেনা হেলিকপ্টারের পাইলটের নাম জানতে চেলেছিলেন। তিনি বলেন যে, পাইলটের নামে তার অনাগত সন্তানের নাম তিনি রাখবেন 'ওলেক্সান্ডার'।

'দ্যা ওয়ার জোন'এর সাথে সাক্ষাতে মারিউপোল মিশনে অংশ নেয়া 'জিইউআর'এর এক সদস্য বলেন যে, তারা হেলিকপ্টারের অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম খুলে ফেলে হাল্কা করে ফেলেছিল; যাতে করে মারিউপোলের সেনাদের জন্যে 'স্টিংগার' বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ‘এন'ল' এন্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র এবং 'স্টারলিঙ্ক' স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা বহণ করা যায়। দু'টা হেলিকপ্টারের সকলে বেসামরিক পোষাক পড়েছিলো; যাতে করে ভূপাতিত হলে জনগণের মাঝে মিশে যাওয়া যায়। রাত সাড়ে ৩টায় শুরু হয় তাদের মিশন। রাতের বেলায় পরিচালনার জন্যে নাইট ভিশন গগলস ব্যবহার করা হয়। ফ্রন্টলাইনের কাছে একটা স্থানে তারা রিফুয়েলং করে নেয়। এরপর মাটির মাত্র ১৫ ফুট উপর দিয়ে ঘন্টায় ২৪০কিঃমিঃ গতিতে তারা রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রায় ১'শ কিঃমিঃ দূরত্ব অতিক্রম করে। মিশনের গোপনীয়তা বজায় রাখতে তিনবার মিশন বাতিল করা ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্যে নেমে সকল সাপ্লাই নামানো হয় এবং ১৬ জন আহত যোদ্ধাকে তুলে নেয়া হয়। মারিউপোলের সেনারা রুশ সেনাদের সাথে গোলাগুলি করে তাদেরকে ব্যস্ত রাখে। সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ তারা ঘাঁটিতে ফিরে আসে। দ্বিতীয় মিশনের সময় রুশরা হেলিকপ্টারের দিকে গুলি ছোঁড়ে; কিন্তু এরপরেও তারা নিরাপদে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। পাইলটরা তাদের রুট বদল করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। একটা মিশনে ৪টা 'এমআই-৮' হেলিকপ্টার ছিল; যেগুলির এসকর্ট হিসেবে ছিল একটা 'এমআই-২৪' এটাক হেলিকপ্টার। এই মিশনে কমপক্ষে ৩৬ জন আহতকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। শেষ মিশনটা ছিল মে মাসের মাঝামাঝি; এর পরপরই ২ হাজারের বেশি ইউক্রেনিয় সেনা সেখানে আত্মসমর্পণ করে। মারিউপোলের সম্পূর্ণ অপারেশনে ৩টা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছিল।

ইউক্রেনিয়রা তাদের হেলিকপ্টারের জন্যে নতুন কাজ আবিষ্কার করেছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, ২০২৪এর মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়া তাদের 'শাহেদ-১৩৬' সুইসাইড ড্রোনের কর্মকান্ডে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। এতদিন ইউক্রেনিয়রা রাইফেল বা মেশিনগান দিয়ে ভূমি থেকে গুলি করে এই ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করতে পারতো। কিন্তু এখন এগুলি মেশিনগানের পাল্লার ঠিক বাইরে দিয়ে উড়ছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ইউক্রেনিয়রা তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে কাজে লাগিয়েছে। প্রথমে ভূমির রাডার থেকে ড্রোনগুলির অবস্থান নির্ণয় করে সেখানে দু'টা হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। ইউক্রেনের বর্ডার গার্ডের 'এয়ারবাস এইচ-১২৫' হেলিকপ্টার তার ইলেকট্রো-অপটিক সরঞ্জাম এবং সার্চলাইটের মাধ্যমে ড্রোনটাকে খুঁজে নেয়। এরপর সঙ্গে থাকা সেনাবাহিনীর 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারকে টার্গেট বুঝিয়ে দেয়; যা একটা নিরাপদ স্থানের উপর মেশিনগান দিয়ে ড্রোনটাকে ভূপাতিত করে। 'আর্মি রেকগনিশন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়াও তাদের হেলিকপ্টারগুলিকে ইউক্রেনিয় ড্রোন (আকাশে ওড়া এবং ম্যারিটাইম ড্রোন) ধ্বংস করতে ব্যবহার করছে।
 
রুশ হেলিকপ্টার টীমওয়ার্ক। একটা 'কে-৫২' এটাক হেলিকপ্টারকে সহায়তা দেয়ার জন্যে তার পেছনে উড়ছে একটা 'এমআই-৩৫' এটাক হেলিকপ্টার এবং একটা 'এমআই-৮' পরিবহণ হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হুমকি নতুন কিছু নয়। হুমকি যেমন রয়েছে; প্রতিরোধের প্রযুক্তি এবং ট্যাকটিকসও রয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো হেলিকপ্টারগুলি পদাতিক সেনা, আর্টিলারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাইবার সক্ষমতার সাথে কতটা সমন্বিতভাবে কাজ করতে সক্ষম। 


বাকিরাও শিখছে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন সেনাবাহিনী তাদের 'ফিউচার এটাক রেকনাইস্যান্স এয়ারক্রফট' বা 'এফএআরএ' প্রকল্প বাতিল করে দেয়। সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল র‍্যান্ডি জর্জ বলেন যে, আকাশ থেকে রেকনাইস্যান্স বা নজরদারি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। অনেক মনুষ্যবিহীন যন্ত্রের মাঝে সেন্সর এবং অস্ত্র বহণ করা যাচ্ছে; যার সাথে মহাকাশের সক্ষমতাও রয়েছে। এগুলি একদিকে যেমন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি এগুলির পাল্লা বড় এবং যথেষ্ট কম খরচেই পাওয়া যাচ্ছে। 'ফ্লাইট গ্লোবাল'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাতিল করে দেয়া 'এফএআরএ' স্কাউট হেলিকপ্টারের কাজগুলি এখন সেনাবাহিনী 'এএইচ-৬৪ এপাচি' এবং ভবিষ্যতে তাদের বহরে যুক্ত হওয়া ড্রোনের মাধ্যমে সম্পাদন করবে। এছাড়াও ইতোমধ্যেই ২০২০ সালে সেনাবাহিনী তাদের 'ব্ল্যাক হক' হেলিকপ্টার থেকে 'এলটিয়াস-৬০০' নামের ছোট ড্রোন ছুঁড়ে প্রমাণ করেছে যে, তাদের সার্ভিসে থাকা হেলিকপ্টারগুলিকে ড্রোন এবং এআইএর সমন্বয়ে ব্যবহার করে নজরদারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং ধ্বংসাত্মক সক্ষমতাকে অনেক গুণে বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব। মার্কিন সেনাবাহিনী ইস্রাইলের 'রাফায়েল' কোম্পানির তৈরি 'স্পাইক এনলস' দূরপাল্লার ট্যাঙ্ক-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র 'এএইচ-৬৪ই এপাচি ভি৬' হেলিকপ্টার থেকে ব্যবহারের জন্যে পরীক্ষা চালাচ্ছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ৫০কিঃমিঃ। 'রাফায়েল' বলছে যে, অনেক দেশই এখন তাদের 'এপাচি' হেলিকপ্টারের সাথে 'স্পাইক এনলস' ক্ষেপণাস্ত্র চাইছে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে যে, একটা হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে বাধা এখন অনেক। একারণে দূরপাল্লার আক্রমণ সক্ষমতা এখন গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি 'বোয়িং'এর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর টি জে জেমিসন 'দ্যা ওয়ার জোন'কে দেয়া সাক্ষাতে বলছেন যে, মার্কিন সেনাবাহিনী 'এএইচ-৬৪ এপাচি' হেলিকপ্টারকে ২০৬০ সাল পর্যন্ত সার্ভিসে রাখতে চাইছে। ১৯৮৪ সালে সার্ভিসে আসা এই হেলিকপ্টার বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এখন সর্বশেষ পরিবর্তন হিসেবে এর সাথে ড্রোনের ব্যবহার যুক্ত করা হচ্ছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী হেলিকপ্টার থেকে ড্রোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা ছাড়াও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, কমিউনিকেশন রিলে এবং শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার কাজ করা যাবে। শত্রুর ড্রোন ধ্বংস করাটা 'এপাচি'র একটা বড় কাজ হতে পারে। আগে 'এপাচি' হেলিকপ্টারকে পাহাড়, গাছপালা বা বিল্ডিংএর পেছনে লুকিয়ে থাকার জন্যে ডিজাইন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ধরেই নেয়া হচ্ছে যে, এই হেলিকপ্টারগুলি শত্রুর অবস্থান থেকে অনেক দূরে থাকবে; সুতরাং লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ১৯৮০এর দশকে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক বহরের বিরুদ্ধে বড় আকারের যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে এই হেলিকপ্টারকে ডেভেলপ করা হলেও এখন একে শুধু এটাক হেলিকপ্টার হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এছাড়াও অনেকেই বলছেন যে, ৩'শ কিঃমিঃ দূরত্বে অপারেট করতে পারা 'এপাচি' প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এই সমুদ্রাঞ্চলে যেকোন যুদ্ধই হবে অনেক বেশি দূরত্বে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, এটাক হেলিকপ্টারের ভবিষ্যৎ কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; বিশেষ করে যখন অর্থায়ন করার প্রশ্নটা সামনে আসছে।

‘দ্যা টেলিগ্রাফ'এর এক লেখায় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেভিড এক্স বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝ দিয়ে এটাক হেলিকপ্টারের প্রয়োজন নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এটাক হেলিকপ্টার কনসেপ্টের জন্মের পর অনেক দেশই এটাক হেলিকপ্টার যোগাড় করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের আগ পর্যন্ত শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে এটাক হেলিকপ্টারকে পড়তে হয়নি। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর ৩১টা 'এপাচি' এটাক হেলিকপ্টার ইরাকি সেনাবাহিনীর একটা ডিভিশনকে আক্রমণ করে। ফলশ্রুতিতে ২টা হেলিকপ্টার ধ্বংস হয় এবং বাকিগুলির প্রত্যেকটা ক্ষতির সন্মুখীন হয়। এই অপারেশন দেখিয়ে দিয়েছিল যে, সামনের দিনে কি আসতে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি এতটাই ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে যে, তারা ইউক্রেনিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনিয়দের আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। শুধুমাত্র ২০২৩এর গ্রীষ্মে ইউক্রেনিয়রা অগ্রাভিযানে যাবার পরই রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলি তাদের প্রয়োজন তুলে ধরতে পেরেছে। এরপর ইউক্রেনিয়রা রাশিয়ার কুর্স্কএ আক্রমণ করলে তারা 'ফার্স্ট পারসন ভিউ' বা 'এফপিভি' ড্রোন দিয়ে রুশ এটাক হেলিকপ্টারগুলিকে টার্গেট করতে থাকে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় না করে নিজেদের এটাক হেলিকপ্টারকে শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় পাঠানোটা হবে আত্মহত্যার শামিল। এরপরেও বাকি থাকবে প্রতিপক্ষের 'এফপিভি' সুইসাইড ড্রোনগুলিকে নিষ্ক্রিয় করার।
 
রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টার অপারেট করছে খোলা মাঠের মাঝে তৈরি করা অস্থায়ী বিমান ঘাঁটি থেকে। গত ১৭ই অক্টোবর ২০২৩এ বেরদিয়ান্সক এবং লুহান্সকএ রুশ বিমান ঘাঁটির উপর ইউক্রেনিয়রা মার্কিন 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা হামলা করেছিলো। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক টুইটার বার্তায় বলা হয় যে, খুব সম্ভবতঃ বেরদিয়ান্সকএ ৯টা এবং লুহান্সকএ ৫টা রুশ হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছে। এই হামলায় খুব সম্ভবতঃ ১৬০কিঃমিঃ পাল্লার 'এটাকমস' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়; যেগুলির ওয়ারহেড ছিল মূলতঃ ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা। খালি যায়গায় পার্কিং করা বিমানগুলিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিলো। এই বিমান ঘাঁটিগুলি থেকে অপারেট করা 'কেএ-৫২ এলিগেটর' এবং 'এমআই-২৮' এটাক হেলিকপ্টারগুলি ইউক্রেনিয় অগ্রাভিযান ভেস্তে যাবার পিছনে বড় কারণ ছিলো।


তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসার 'ফ্লাইট গ্লোবাল'কে বলছেন যে, শুধুমাত্র ইউক্রেন যুদ্ধ থেকেই সকল শিক্ষা নিতে হবে; তা হতে পারে না। কারণ রুশ বা ইউক্রেনিয়দের যুদ্ধ করার ধরণ পশ্চিমাদের থেকে পুরোপুরি আলাদা। তিনি বলছেন যে, হেলিকপ্টারের বিরুদ্ধে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হুমকি তো নতুন কিছু নয়। হুমকি যেমন রয়েছে; প্রতিরোধের প্রযুক্তি এবং ট্যাকটিকসও রয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো হেলিকপ্টারগুলি পদাতিক সেনা, আর্টিলারি, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং সাইবার সক্ষমতার সাথে কতটা সমন্বিতভাবে কাজ করতে সক্ষম। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে হস্টোমেল বিমানবন্দরে রুশ হামলা ভেস্তে যাবার ব্যর্থতা হেলিকপ্টারের উপর দেয়া যাবে না। সেখানে পরিকল্পনা ঠিক ছিল না এবং অভিযানের গ্রুপগুলির মাঝে সমন্বয় ছিল না। সামনের দিনগুলিতে হেলিকপ্টারের সাথে মনুষ্যবিহীন যন্ত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে সক্ষমতাকে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

ইউক্রেন যুদ্ধ আবারও প্রমাণ করলো যে, শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার কতটা অসহায়। তথাপি যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টারের ব্যবহার শেষ হয়ে যায়নি। হেলিকপ্টারকে যুদ্ধের নতুন বাস্তবতায় কিভাবে ব্যবহার করা হবে, সেব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। ড্রোন এবং এআইএর সমন্বয় ঘটিয়ে তাদের প্রায় ৮'শ 'এপাচি' এটাক হেলিকপ্টারকে সার্ভিসে রাখতে চাইছে মার্কিন সেনাবাহিনী। এর মূল কারণ হলো, মার্কিন সমরবিদেরা মনে করছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ এটাক হেলিকপ্টারের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। যেহেতু যুদ্ধের বাস্তবতাকে নির্দিষ্ট করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না, তাই হেলিকপ্টারগুলিতে সফটওয়্যার আপডেট এমনভাবে দেয়া হচ্ছে, যাতে করে ভবিষ্যতে যেকোন প্রযুক্তি এর সাথে যুক্ত করে কাজে লাগানো যায়। ব্যবহারের জায়গা এবং কৌশলের কারণেই রুশ 'কেএ-৫২' এটাক হেলিকপ্টারগুলি অত্যাধুনিক হবার পরেও ব্যাপক হারে ধ্বংস হয়েছে। কারণ প্রযুক্তিই শেষ কথা নয়। অপরদিকে অনেক পুরোনো ডিজাইনের 'এমআই-৮' হেলিকপ্টারগুলি এখনও পরিবহণ এবং সার্চ-রেসকিউএর মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও সাহসিকতার বিকল্প হয় না। মারিউপোল অপারেশনে ইউক্রেনের সাহসী পাইলট ওলেক্সান্ডারের কাহিনীই বলে দেয় যে, যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টার সর্বদাই ধ্বংসের মুখে থাকবে; কিন্তু পাইলট ও ক্রুদের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার গল্পগুলিই মানুষকে আরও একদিন যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা দেবে।

2 comments:

  1. অনেক তথ্যবহুল পোস্ট। অনেক সময় নিয়ে লেখেছেন। অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু বাংগালী বুদ্ধিজীবীরা সেই ইউক্রেন-রাশিয়া আর এদিকে সিরিয়া-গাজা থেকে বের হতে পারছেনা। ঘরের কাছে নতুন দেশ আরাকানল্যান্ড হতে যাচ্ছে সেই নিয়ে কারোর কোন খোঁজ নাই। আপনাকে বললে আপনি আপনার বিগত কয়েক বছরের মায়ানমার সংশ্লিষ্ট লেখার লিঙ্ক ধরায় দেবেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রতিদিন একই জিনিস লেখা অর্থহীন। যদি সেটা করা হয়, তাহলে হয় লেখক তার কথাগুলি ঠিকমতো বলতে পারছে না; নতুবা পাঠকেরা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্লগের সাম্প্রতিক পোস্টগুলি পড়তে বুঝতে পারার কথা যে, এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব হলো সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা। জিওপলিটিক্যাল এসেসমেন্ট প্রতিদিন পরিবর্তন হয় না। যদি সেটা হয়, এর অর্থ হলো লেখক জিওপলিটিক্স বোঝেন না।

      যেহেতু সারা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পেতে যাচ্ছে, তাই যেকোন মূল্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করাটা এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলি থেকে শিক্ষা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের প্যারাডাইম শিফট হয়ে গিয়েছে। এই পরিবর্তনগুলি না ধরতে পারলে যেকোন যুদ্ধে কয়েক দিনের মাঝেই পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে।

      আশা করি কমেন্ট করার জন্যে কমেন্ট না করে একটা লক্ষ্য নিয়ে কমেন্ট করবেন। ধন্যবাদ।

      Delete