Monday, 21 October 2024

‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে' পক্ষ-বিপক্ষ বা জোট নিরপক্ষতার মাপকাঠি কি?

২২শে অক্টোবর ২০২৪

ভঙ্গুর সেকুলার বিশ্বব্যবস্থায় আজকে ঠিক-বেঠিক নিয়ে কোন মতৈক্য নেই; কারণ একেক জনের কাছে মাপকাঠি একেক রকম। লিবারাল গণতন্ত্রের চিন্তা ধারণকারীদের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে; আবার যারা সার্বভৌমত্ব-কেন্দ্রিক চিন্তা ধারণ করছে, তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে স্থিতিশীল শক্তিশালী রাষ্ট্র। যারা প্রথম পক্ষে থাকছে, তারা শুধু চীন-রাশিয়ার সাথে কঠোর ভূমিকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইছে না, অন্যান্য রাষ্ট্রকেও তাদের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে বাধ্য করার পক্ষপাতি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তারা আবার বাস্তবতার কাছে হার মেনে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। আর দ্বিতীয় পক্ষের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়ার সাথে ব্যালান্সিংএর সম্পর্ক রেখে আগের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পোস্ট-কলোনিয়াল সেটআপের উপর গড়ে ওঠা তৃতীয় পক্ষ বা 'নন এলাইন্ড মুভমেন্ট' বা 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন'এর কথা বলছেন। 


বরাবরই মার্কিন বলয়ে থাকা মিশর তাদের পুরোনো মার্কিন 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমানগুলিকে প্রতিস্থাপিত করার জন্যে চীনের কাছ থেকে 'জে-১০সি' যুদ্ধবিমান কেনার চেষ্টা করছে বলে বিভিন্ন খবরে প্রকাশ। এহেন খবর ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন; বিশেষ করে ওয়াশিংটনের আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল মিশর তার সামরিক শক্তি উন্নয়নে ব্যালান্সিংএর পথে চলছে কেন, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'চ্যাটহ্যাম হাউজ'এর এসোসিয়েট ফেলো আহমেদ আবুদুহ এক লেখায় বলছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধের মতোই মিশর ব্যালান্সিংএর নীতি নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মাঝে একটা হলো ইস্রাইলের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতাকে আরব দেশগুলির উপর রাখা। এর ফলে মিশর বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দূরপাল্লার (১০০কিঃমিঃ) 'এএমআরএএএম' বা 'এমর‍্যাম' ক্ষেপণাস্ত্র পায়নি। ওয়াশিংটনকে বাইপাস করতে মিশর ফ্রান্স থেকে 'রাফাল' যুদ্ধবিমান কিনেছে; কিন্তু সেখানেও প্যারিস তাদেরকে দূরপাল্লার 'মিটিয়র' ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি। মিশর রাশিয়ার কাছ থেকে 'সুখোই-৩৫' যুদ্ধবিমান কেনার চেষ্টা করায় যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়েছিল; কায়রো সেই প্রচেষ্টা থেকে সরে আসে। তারা ইতালির কাছ থেকে 'ইউরোফাইটার টাইফুন' বিমানও কিনছে; যেখানে তাদের দূরপাল্লার 'মিটিয়র' ক্ষেপণাস্ত্র পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তদুপরি তারা কয়েক যুগ চেষ্টার পর যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে তাদেরকে 'এফ-১৫' যুদ্ধবিমান দিতে রাজি হয়েছে; কিন্তু সেখানেও তা আসবে 'এমর‍্যাম' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাতীত। অর্থাৎ মিশরের সেনাবাহিনী যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, তার উপর বিমানের ছত্রছায়া থাকবে ইস্রাইলের বিমান বাহিনীর চাইতে দুর্বল। এই ব্যালান্সিং প্রচেষ্টার সর্বশেষ অংশ হিসেবেই মিশর বেইজিংএর দিকে তাকিয়েছে। কায়রো হয়তো মনে করছে যে, এর ফলে তারা চীনাদের দূরপাল্লার রাডার এবং ২০০কিঃমিঃ পাল্লার 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র পেতে পারে।

মিশরের 'জে-১০সি' যুদ্ধবিমান কেনার খবরের মতোই নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের ব্যাপারে অনেক আলোচনা শোনা যাচ্ছে আজকাল। ‘ভোক্স'এর সাথে এক সাক্ষাতে বেইজিংএ মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নস বলছেন যে, চীনের সাথে পশ্চিমাদের নতুন প্রতিযোগিতাকে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ বললে হয়তো বেশি সরলীকরণ করা হয়ে যাবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যে ঠান্ডা যুদ্ধ হয়েছিলো, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সামরিক এবং পারমাণবিক শক্তি। অপরদিকে চীন ভিন্ন রকমের শক্তি; যা অর্থনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'নিউলাইন্স ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি'র ডিরেক্টর এবং 'ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজ'এর প্রফেসর আজীম ইব্রাহিম 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনের এক লেখায় নতুন ঠান্ডা যুদ্ধকে স্বীকার করে নিয়েই যারা চীনের মানবাধিকার এবং ভূরাজনৈতিক আধিপত্যবাদ নিয়ে কথা বললে চীনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যে সমস্যা হবে বলে মনে করছে, তাদের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, প্রথম ঠান্ডা যুদ্ধে সকলেই বুঝেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে কি হতে পারে। তাই তারা যুদ্ধকে ঠান্ডাই রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন; যা চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুদ্ধ ছাড়াই চীনের সাথে দ্বন্দ্ব চলতে পারে; কিন্তু চীনের কোন কাজেই কেউ বাধা দেবে না, এটা মেনে নেয়া যায় না।

কেউ কেউ অবশ্য নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে চীন এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে আরও শক্ত মাপকাঠির উপর দেখতে চাইছেন। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক 'লোয়ি ইন্সটিটিউট'এর এক লেখায় দিল্লীতে ব্রিটিশ হাইকমিশনের প্রাক্তন উপদেষ্টা এবং 'লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস'এর ফেলো সুশিল আরন ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'চ্যাটহ্যাম হাউজ'এর প্রাক্তন ডিরেক্টর রবিন নিবলেটএর লেখা বই 'দ্যা নিউ কোল্ড ওয়ার'এর বাস্তবতায় এশিয়া-প্যাসিফিকের দেশগুলির ব্যাপারে পশ্চিমাদের নীতি কেমন হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে আলোচনা করেন। আরন প্রকৃতপক্ষে নিবলেটের লিবারাল গণতান্ত্রিক চিন্তাকেই তার লেখার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের দুই পক্ষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে নিবলেট বলছেন যে, একপক্ষে রয়েছে এমন কিছু দেশ, যারা ব্যক্তিস্বাধীনতা, চেক-এন্ড-ব্যালান্স, বাকস্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে স্তম্ভ হিসেবে নিয়েছে। আর অপরপক্ষে রয়েছে এমন কিছু দেশ, যারা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে ভয় পায় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের উপর স্থান দেয়। নিবলেটের সমর্থনে আরন বলছেন যে, রাশিয়া এবং চীন পশ্চিমা দেশগুলির সামরিক জোটের ব্যাপারে যতটা না ভীত, তার চাইতে বেশি ভীত তাদের আশেপাশের দেশগুলিতে গণতন্ত্রের ব্যাপারে। পশ্চিমা দেশগুলির গণতন্ত্র রক্ষার ইতিহাস ভালো নয় উল্লেখ করেই আরন বলছেন যে, পশ্চিমাদের দোষত্রুটি থাকলেও তারা অন্ততঃ বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ দেয়, যার ফলে নীতির পরিবর্তন করা যায়; যা একনায়কদের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। নিবলেটের প্রস্তাবকে সমর্থন করে আরন বলছেন যে, অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পশ্চাদগামীতার কারণে ভারতকে 'জি-৭' জোট থেকে বের করে দিয়ে সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে ঢুকিয়ে জোটের নাম দেয়া উচিৎ 'জি-৯'।

সকলেই নিজেদের নীতিকে অন্যের নীতির চাইতে সেরা মনে করছেন; কারণ কারুর নীতিই ঐশ্বরিক নয়। সকলেই মনে করছেন যে, তাদের চিন্তায় সংঘাত এড়ানো সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মতবিরোধই নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে "পক্ষ বনাম নিরপেক্ষ" প্রক্সি সংঘাতের জ্বালানি।

তবে সকলে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে চাইছে না। অনেকেই আগের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পোস্ট-কলোনিয়াল সেটআপের উপর গড়ে ওঠা তৃতীয় পক্ষ বা 'নন এলাইন্ড মুভমেন্ট' বা 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন'এর কথা বলছেন। যার অর্থ দাঁড়ায়, নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-রাশিয়ার মাঝে ব্যালান্স করে চলার পক্ষপাতি। ভারতের দিল্লীর 'জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি'র গবেষক ভরত সিং 'লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস'এর এক লেখায় বলছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তারা যেমন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ভারতের উচিৎ নিজেদের স্বার্থ বুঝে আলাদা পথ অবলম্বণ করা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির উচিৎ বাইরের শক্তিশালী দেশগুলির হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সহিংস আন্দোলনের উল্লেখ করে তিনি বলছেন যে, চীনের 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' বা 'বিআরআই' প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি, বিশেষ করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক পটভূমিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে গেছে। চীনের প্রভাবকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে 'কোয়াড' সামরিক জোট এবং 'মালাবার' সামরিক মহড়ার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নেপালে 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন' নামের মার্কিন সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে 'বিআরআই'কে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। একই লক্ষ্যে কাজ করছে 'ব্লু ডট নেটওয়ার্ক' এবং 'জি-৭'এর অন্তর্ভুক্ত 'বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড' প্রকল্প। তবে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির কথা উল্লেখ করে বলছেন যে, কোন একটা বড় শক্তির সাথে যোগ দেয়ার অর্থ হলো সংঘাত ডেকে নিয়ে আসা। পশ্চিমা দেশগুলির উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখার কারণেই এই অঞ্চলে ভারতের প্রকল্পগুলি কাজ করছে না। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট 'সার্ক'ও অকার্যকর হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের দেশগুলির মাঝে যোগাযোগ যখন ভেঙ্গে পড়ছে, তখন শক্তিশালী দেশগুলির প্রতিযোগিতামূলক হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে।

নেপালের বিদ্যুৎ ভারতে রপ্তানির জন্যে ৪০০কেভির ৩১৫কিঃমিঃ বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নির্মাণে মার্কিন সাহায্য সংস্থা 'এমসিসি'র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান প্রকল্প নিয়ে নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে বামপন্থী দলগুলির মাঝে সিদ্ধান্তহীনতা চলছে বহুদিন থেকেই। ২০২২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি 'এমসিসি'র সাথে চুক্তি নেপালি পার্লামেন্টে পাস হয়। নেপালের রাস্তায় এই চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলার সময়েই দেশটার বামপন্থী দলগুলি এই চুক্তি পাস করে। এর আগে ১০ই ফেব্রুয়ারি 'কাঠমুন্ডু পোস্ট'এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারি সচিব ডোনাল্ড লু নেপালের তিনজন রাজনীতিবিদ – তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা, কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল)এর নেতা কেপি শর্মা ওলি এবং 'মাওইস্ট সেন্টার'এর প্রধান পুষ্প কমল দাহালএর সাথে ফোনালাপ করেন। একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটা বলছে যে, ডোনাল্ড লু তাদেরকে শক্ত ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, যদি ২৮শে ফেব্রুয়ারির মাঝে পার্লামেন্টে 'এমসিসি'র সাথে চুক্তি পাস না হয়, তাহলে নেপালের সাথে যুক্তরাষ্ট্র তার সম্পর্ককে নতুনভাবে দেখতে বাধ্য হবে। চুক্তি পাস হলেও দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তির বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে নেপালের রাজনৈতিক কলহের কারণে। গত জুলাই মাসে নেপালে আরেক দফা সরকার পরিবর্তন হয়; যার ফলশ্রুতিতে আবারও প্রধানমন্ত্রী হন কেপি শর্মা ওলি। কিউবা-সমর্থিত বামপন্থী পত্রিকা 'ট্রাইকন্টিনেন্টাল এশিয়া'র এক লেখায় প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি অনুদানই দেবে, তাহলে কেন এই অনুদানের চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে হুমকি দিচ্ছে? তাছাড়া এই চুক্তি নেপালের আইনের উর্ধ্বে থাকবে এবং দেশটার বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থার আওতাধীন থাকবে না। মার্কিন সংস্থা 'ইউএসএআইডি'র হিসেবে এই বিদ্যুৎ নেপালে ব্যবহৃত হলে প্রতি ইউনিটে ৮৬ সেন্টের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক লাভ হতো। অপরদিকে ভারতে রপ্তানির বিনিময়ে নেপাল মাত্র ৬ সেন্ট করে পাবে। এগুলিই শুধু নয়, এই প্রকল্প যেখানে নিজ অর্থায়নে নেপাল আরও কম খরচে করতে পারতো, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে করার কারণে মার্কিন 'ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি' বা 'আইপিএস'এর মাঝে নেপালকে ঢোকানো হলো এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় নাম লেখালো নেপাল।

মালয়েশিয়ার প্রবীন অর্থনীতিবিদ যোমো কোয়ামে সুন্দারাম 'দ্যা সান' পত্রিকার এক লেখায় এশিয়ার দেশগুলিকে পশ্চিমা বলয়ে নাম লেখাতে সাবধান করছেন। তিনি বলছেন যে, নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাইতে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। অর্থনৈতিক নীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং অন্যান্যরা কোনো দেশের উপর অবরোধ আরোপ করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছ আর যাচ্ছে না। কাজেই এই অবরোধগুলি জাতিসংঘের চার্টার এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সুন্দারাম এই প্রকারের অবরোধকে বেআইনী বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, ন্যাটো, ‘ওইসিডি', ‘জি-৭' এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি জাতিসংঘের স্থান নিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনকে সুবিধামতো ব্যবহার করা হচ্ছে; আর অসুবিধা মনে হলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। করোনা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সমস্যার কারণে সাপ্লাইএর যে সমস্যাগুলি হয়েছিলো, তা পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধের ব্যবহারের কারণে আরও বেড়েছে। সাপ্লাই সাইড ঠিক না করেই সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ার কারণে অর্থনীতি আরও খারাপ হয়েছে। দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একারণে সুন্দারাম মনে করছেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলির উচিৎ জোট নিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এই নিরপেক্ষতা হয়তো ১৯৫৫ সালের বানদুং বা ১৯৬১ সালের বেলগ্রেডের মতো হবে না, তবে নতুন কোন প্রকারের হতে পারে।

ভঙ্গুর সেকুলার বিশ্বব্যবস্থায় আজকে ঠিক-বেঠিক নিয়ে কোন মতৈক্য নেই; কারণ একেক জনের কাছে মাপকাঠি একেক রকম। লিবারাল গণতন্ত্রের চিন্তা ধারণকারীদের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে; আবার যারা সার্বভৌমত্ব-কেন্দ্রিক চিন্তা ধারণ করছে, তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে স্থিতিশীল শক্তিশালী রাষ্ট্র। যারা প্রথম পক্ষে থাকছে, তারা শুধু চীন-রাশিয়ার সাথে কঠোর ভূমিকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইছে না, অন্যান্য রাষ্ট্রকেও তাদের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে বাধ্য করার পক্ষপাতি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তারা আবার বাস্তবতার কাছে হার মেনে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। আর দ্বিতীয় পক্ষের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়ার সাথে ব্যালান্সিংএর সম্পর্ক রেখে আগের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পোস্ট-কলোনিয়াল সেটআপের উপর গড়ে ওঠা তৃতীয় পক্ষ বা 'নন এলাইন্ড মুভমেন্ট' বা 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন'এর কথা বলছেন। তবে এই জোট নিরপেক্ষ গ্রুপের সকলেই বোঝেন যে দুই নৌকায় পা রাখলে কাউকেই খুশি করা সম্ভব নয়। বরং এতে প্রথম গ্রুপের চাপ সামলাতে গিয়ে সার্বভৌমত্ব যতটুকু রয়েছে, সেটাও হারাতে হতে পারে। সকলেই নিজেদের নীতিকে অন্যের নীতির চাইতে সেরা মনে করছেন; কারণ কারুর নীতিই ঐশ্বরিক নয়। সকলেই মনে করছেন যে, তাদের চিন্তায় সংঘাত এড়ানো সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মতবিরোধই নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে "পক্ষ বনাম নিরপেক্ষ" প্রক্সি সংঘাতের জ্বালানি।

No comments:

Post a Comment