Sunday, 13 October 2024

ইউক্রেন যুদ্ধ - ভুহলেদার শহর রুশদের হাতে চলে যাবার কৌশলগত গুরুত্ব

১৩ই অক্টোবর ২০২৪

ভুহলেদার শহরটা দুই বছর ধরে ইউক্রেনিয় সেনারা রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। রুশরা তাদের যুদ্ধকৌশলকে অনেকটাই বদলে ফেলেছে। তাদের সেনারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণে যাচ্ছে এবং সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে একত্রে ব্যবহার করছে; যা তাদের সামরিক সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। গ্লাইড বোমা, ড্রোন এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগের ব্যবহার তাদের সাফল্যের বড় কারণ ছিল। 


গত ১লা অক্টোবর ইউক্রেনের ছোট্ট শহর ভুহলেদার রুশ সামরিক বাহিনীর দখলে চলে যায়। এই শহরটা দুই বছর ধরে ইউক্রেনিয় সেনারা রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। ‘আল-জাজিরা' বলছে যে, পাহাড়ের উপরে অবস্থিত মাইনিং শহর ভুহলেদার রুশদের হাতে চলে যাওয়ায় রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনিয় হামলার আঘাতটাকে মস্কো কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারে। অপরদিকে এই হার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির পরিকল্পনাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে হামলার সাথে সাথে জেলেন্সকি চাইছিলেন যে, পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার ভেতরে হামলা করতে। ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক 'চ্যাটহ্যাম হাউজ'এর 'ইউক্রেন ফোরাম'এর প্রধান ওরিসিয়া লুটসেভিচ 'আল-জাজিরা'কে বলছেন যে, জেলেন্সকি ইউক্রেনিয় জনগণের কাছে বার্তা দিতে চাইছিলেন যে, তার পরিকল্পনা মোতাবেকই যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে; যদিও তিনি সরাসরি বলছেন না যে, ইউক্রেনিয়রা কুর্স্ক-এ হামলা করে রাশিয়ার এলাকা দখলে নিয়েছে। জেলেন্সকি তার নিজের জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধে জয়ের ধারায় রয়েছেন। ‘কিংস কলেজ লন্ডন'এর গবেষক মারিনা মিরন 'ডয়েচে ভেলে'র সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, যদি ন্যাটো ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়ও, সেটা ডনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আনবে না। কারণ এসব ক্ষেপণাস্ত্র যে সংখ্যায় ইউক্রেনের কাছে আসছে, তা খুব একটা বড় নয়। তাছাড়াও রাশিয়ার ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এবং অর্থনৈতিক টার্গেটের ইন্টেলিজেন্স ন্যাটোকেই দিতে হবে।

মারিনা মিরন বলছেন যে, ভুহলেদার একটা গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রথমতঃ শহরটা কিছুটা উঁচু যায়গায় অবস্থিত। দ্বিতীয়তঃ এই শহরটা কুরাখোভে নামের আরেকটা শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। কুরাখোভের ঠিক উত্তরে রয়েছে নদী। কাজেই এই শহরটার নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে দক্ষিণ থেকে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ভুহলেদারকে রুশরা ব্যবহার করতে পারবে। তৃতীয়তঃ ভুহলেদারকে ব্যবহার করে গ্রেটার ঝাপোরিঝঝিয়া এলাকায় রুশদের ঢুকে পড়াটা সহজ হবে। আর ভুহলেদার হারানোটা ইউক্রেনিয়দের জন্যে সামরিক হার হলেও তা ইউক্রেনিয় মনোবলেও বেশ বড় আঘাত করবে।

মারিনা মিরন বলছেন যে, রাশিয়ার কুর্স্ক-এ ইউক্রেনিয় আক্রমণের কারণে ইউক্রেনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে সদস্যসংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। ইউক্রেনের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে আর্টিলারি শেলও নেই; যে শূণ্যস্থান তারা ড্রোনের মাধ্যমে পূরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়াও রুশরাও তাদের কৌশলকে পরিবর্তন করেছে; যার কারণে রুশরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। রুশরা সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে একত্রে ব্যবহার করছে; যা তাদের সামরিক সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। 'দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রুশরা তাদের যুদ্ধকৌশলকে অনেকটাই বদলে ফেলেছে। তাদের সেনারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগেও তারা ইউক্রেনের একটা শক্ত অবস্থানকে আক্রমণ করতে ১০ থেকে ২০ জন সেনাকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এখন তারা হয়তো মাত্র ৪ জন সেনা দিয়ে একই মিশন পরিচালনা করছে। স্বল্প সংখ্যক সেনারা অনেক বড় এলাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে একদিকে যেমন তাদেরকে খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে, তেমনি তাদেরকে ড্রোন বা আর্টিলারি দিয়েও টার্গেট করা যাচ্ছে না। এর আগের শরৎকালে ইউক্রেনিয়রা একই কৌশল অবলম্বন করেছে; কিন্তু রুশরা এই কৌশলের সাথে যুক্ত করেছে তাদের ব্যাপক আর্টিলারি সক্ষমতা এবং ক্ষতি পুষিয়ে নেবার মানসিকতা। এছাড়াও রুশরা স্যাটেলাইট যোগাযোগ সরঞ্জামের মাধ্যমে তাদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগ যথেষ্ট উন্নত করেছে; যা তাদের সেনাদের সাথে ড্রোনের সমন্বয়ে আক্রমণকে সহজ করেছে। যদিও রুশদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক; তথাপি সংখ্যার দিক থেকে বেশি থাকায় রুশরা ইউক্রেনিয়দের উপর চাপ বহাল রাখতে পারছে। অপরদিকে ইউক্রেনিয়দের যা ক্ষতি হচ্ছে, পশ্চিমা সহায়তা তার চাইতে তুলনামূলক কম। ইউক্রেনের ৭২তম মেকানাইজড ব্রিগেডের সেনারা বলছে যে, রুশ বিমান বাহিনীর গ্লাইড বোমার আঘাতে একেকটা পরিখার বড় একটা অংশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ইউক্রেনিয়দের ১টা আর্টিলারি শেলের বিপরীতে রুশরা ১০টা শেল ব্যবহার করছে। ইউক্রেনিয়রা যদি পিছিয়ে না আসতো, তাহলে রুশরা তাদেরকে ঘিরে ফেলতো এবং তাদের সকল সৈন্য এবং সরঞ্জাম হারাতে হতো।
 
পশ্চিমা সরকারগুলি যে মুহুর্তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের সহায়তা দিতে গরিমসি করছে, ঠিক তখনই রাশিয়া ডোনেটস্ক অঞ্চলে একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে। জেলেন্সকি রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে আক্রমণের মাধ্যমে কৌশলগত যে সাফল্য আশা করেছিলেন, তা যে আসছে না, সেটা নিশ্চিত। উল্টো, কুর্স্ক অপারেশনের কারণে ইউক্রেনিয়রা ডোনেটস্ক অঞ্চলে হারতে বসেছে।


বিশ্লেষকেরা মত দিচ্ছেন যে, রুশদের গ্লাইড বোমা ডোনেটস্কএর যুদ্ধে বড় প্রভাব ফেলছে; বিশেষ করে ইউক্রেনিয়দের শক্তিশালী অবস্থানগুলিকে দুর্বল করতে এই গ্লাইড বোমা বড় ভূমিকা রাখছে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২৪এর শুরু থেকেই রুশরা হাজারো সাধারণ বোমার সাথে স্যাটেলাইট গ্যাইড্যান্স কিট এবং ডানা লাগিয়ে সেগুলিকে 'গ্লাইড বোমা' হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে। এই বছরে রুশদের সফলতার একটা বড় কারণ এই গ্লাইড বোমা। একটা শহর রক্ষা করতে গিয়ে ইউক্রেনিয় সেনারা হয়তো একটা ভবনের নিচে বেইজমেন্টে তাদের থাকার জায়গা তৈরি করতো। আর্টিলারি শেল হয়তো বেইজমেন্টের ক্ষতি করতে পারতো না। কিন্তু এই গ্লাইড বোমাগুলি সেনাদের উপর পুরো ভবনকেই ধ্বসিয়ে ফেলতে সক্ষম। এই বোমাগুলি চলমান টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা না গেলেও স্থায়ী পরিখা, দুর্গ বা শক্তিশালী অবস্থানের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবহার করা যায়। এই বোমাগুলি খুব সহজেই তৈরি করা যায়; যা রুশদের দামি সব অস্ত্র থেকে ভিন্ন। তাছাড়া এই বোমাগুলি আকাশে থাকা অবস্থায় সহজে গুলি করে ধ্বংস করা যায় না। আর এখন ইউক্রেন যুদ্ধ এমন একটা অবস্থানে এসেছে, যখন অর্থনৈতিক দিকটা যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। রুশরা আগের চাইতে অপেক্ষাকৃত বড় গ্লাইড বোমাও তৈরি করছে; যার কিছু কিছু ৩টন পর্যন্ত। ইউক্রেনিয়দের হিসেবে রাশিয়া ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ২০২৩এর তুলনায় ১৬গুণ বেশি গ্লাইড বোমা ব্যবহার করেছে। অনেকেই মনে করছেন যে, এই বছরের শুরুতে আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেবার পিছনে গ্লাইড বোমার অবদান ছিল যথেষ্ট। তারা ছোট এক জায়গায় একসাথে এতো বেশি গ্লাইড বোমা ব্যবহার করেছে, যার কারণে ইউক্রেনিয়রা বাধ্য হয়েছে সেই স্থান ছেড়ে আসতে। গ্লাইড বোমা থেকে বাঁচতে গেলে ইউক্রেনিয়দের হয় রুশ বোমারু বিমানগুলিকে আমেরিকান 'এফ-১৬' বিমান দিয়ে ধ্বংস করতে হবে; অথবা আমেরিকান 'প্যাট্রিয়ট' আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফ্রন্টলাইনের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। অথবা ইলেকট্রনিক জ্যামিংএর মাধ্যমে এই বোমাগুলির স্যালেটাইট টার্গেটিং সিস্টেম অকার্যকর করতে হবে। এই কাজগুলির কোনটাই সহজ নয়।

ফিনল্যান্ডের ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপ'এর পাসি পারোইনেন 'দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট'কে বলছেন যে, গত অগাস্ট এবং সেপ্টেম্বরে রুশরা যত দ্রুততার সাথে এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তা গত দুই বছরে দেখা যায়নি। ঠিক এই সময়টাতেই ইউক্রেনিয়রা রাশিয়ার ভেতর কুর্স্ক অঞ্চলে হামলা চালিয়েছে। দক্ষিণ ডোনেটস্ক এলাকায় রুশরা ৩১৮বর্গমিঃমিঃ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে; যার মাঝে ২৬৮বর্গকিঃমিঃ ছিল বাখমুত এবং ভুহলেদারের মাঝামাঝি। কুর্স্ক আক্রমণে ইউক্রেনিয়রা ৩০ হাজার সেনা ব্যবহার করেছে। তারা আশা করেছিল যে, রুশরা ডোনেটস্ক অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে কুর্স্ক অঞ্চলে মোতায়েন করবে; কিন্তু সেটা হয়নি। ইউক্রেনের যে ইউনিটগুলি কুর্স্ক আক্রমণে গিয়েছে, সেগুলি ছিল তাদের অপেক্ষাকৃত ভালো ইউনিট এবং সেই ইউনিটগুলি রসদ পাবার ক্ষেত্রে ডোনেটস্ক অঞ্চলের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট'এর সিনিয়র ফেলো রব লী 'দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট'কে বলছেন যে, আরও আগে থেকেই ইউক্রেনিয়দের মানবসম্পদের সমস্যা ছিল; যা কুর্স্ক আক্রমণে আরও খারাপ হয়েছে। অভিজ্ঞ সেনাদের মাঝে হতাহত বেড়ে যাবার কারণে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেনাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করতে হচ্ছে। এগুলি তাদের মূল সমস্যা; যেগুলি রয়েই যাচ্ছে; যদিও তারা হয়তো সামনের দিনগুলিতে আরও 'অপারেশনাল সারপ্রাইজ' নিয়ে আসবে। এই যুদ্ধে সেই পক্ষই হয়তো জিতবে, যে কিনা শেষ পর্যন্ত ক্ষতি সহ্য করে টিকে থাকবে পারবে।

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে রুশরা তাদের যুদ্ধকৌশলকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করেছে। তারা যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে এবং প্রযুক্তিকে যথাসম্ভব ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ড্রোন, গ্লাইড বোমা এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগের ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। আর সংখ্যাগত দিক থেকে ইউক্রেনের চাইতে অনেক এগিয়ে থাকায় রুশরা ব্যাপকভাবে আক্রমণে যেতে সক্ষম হচ্ছে। পশ্চিমা সরকারগুলি যে মুহুর্তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের সহায়তা দিতে গরিমসি করছে, ঠিক তখনই রাশিয়া ডোনেটস্ক অঞ্চলে একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে। জেলেন্সকি রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে আক্রমণের মাধ্যমে কৌশলগত যে সাফল্য আশা করেছিলেন, তা যে আসছে না, সেটা নিশ্চিত। উল্টো, কুর্স্ক অপারেশনের কারণে ইউক্রেনিয়রা ডোনেটস্ক অঞ্চলে হারতে বসেছে।

No comments:

Post a Comment