Friday, 4 October 2024

সোমালিয়াতে মিশরের সামরিক পদক্ষেপ – হর্ন অব আফ্রিকায় আবারও উত্তেজনা

০৫ই অক্টোবর ২০২৪

কায়রো; জানুয়ারি ২০২৪। এই বছরের শুরুতে সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশ সোমালিল্যান্ডের সাথে ইথিওপিয়া একটা সমঝোতা স্বক্ষর করে। এই সমঝোতা মূলতঃ একটা বিনিময়। এর একদিকে ইথিওপিয়া সমুদ্রে যাবার একটা পদ্ধতি পাবে। অপরদিকে সোমালিল্যান্ডকে ইথিওপিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। সোমালিয়া এই ব্যাপারটাকে তার স্বার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে। একারণেই জানুয়ারি মাসে সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মাহমুদ মিশর ভ্রমণ করে মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। 


গত ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমালিয়ার মোগাদিশু বন্দরে সামরিক সরঞ্জামের চালান পৌঁছে দেয় মিশরের একটা পরিবহণ জাহাজ। এই জাহাজের নিরাপত্তায় ছিল মিশরের নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক কর্ভেট 'পোর্ট সৈয়দ'। সরঞ্জাম সম্পর্কে অফিশিয়ালি কিছু না বলা হলেও বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, এই সরঞ্জামের মাঝে রয়েছে আর্টিলারি এবং বিমান বিধ্বংসী কামান। একটা সোশাল মিডিয়া পোস্টে সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিশরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অস্ত্র জাহাজ থেকে নামাবার সময় মন্ত্রী নিজে বন্দরে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত ২৭শে অগাস্ট মিশরের দু'টা সামরিক বিমান সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুতে অবতরণ করে। 'বিবিসি' বলছে যে, এই বিমানগুলিতে করে সোমালি সরকারের জন্যে সামরিক সহায়তা দেয়া হয়; যা ছিল কয়েক দশকের মাঝে সোমালিয়াতে মিশরের প্রথম সামরিক সরঞ্জামের চালান। মোগাদিশুতে অবস্থিত থিংকট্যাংক 'বালকিস ইনসাইটস'এর প্রধান সামিয়া গাইদ 'বিবিসি'কে বলছেন যে, এই সামরিক চালানের গুরুত্ব হলো এর সময়। কারণ এটা এমন এক সময়ে এলো, যখন ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মাঝে উত্তেজনা চলছে। ‘বিবিসি' মনে করে করিয়ে দিচ্ছে যে, সোমালিয়া হলো পূর্ব আফ্রিকার 'হর্ন অব আফ্রিকা' অঞ্চলের অংশ। আর হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলটা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা; যেখানে অনেক শক্তিশালী দেশ অবস্থান নিয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তুরস্কের এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। কারণ এই অঞ্চল লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত।

এই বছরের শুরুতে সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশ সোমালিল্যান্ডের সাথে ইথিওপিয়া একটা সমঝোতা স্বক্ষর করে। সোমালিল্যান্ড সোমালিয়া থেকে তিন দশক আগে আলাদা হবার ঘোষণা দিলেও এখনও পর্যন্ত কোন রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ডকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অপরদিকে ১৯৯১ সালে এরিত্রিয়া ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যাবার পর ইথিওপিয়া চারিদিকে ভূমিবেষ্টিত হয়ে পড়ে। এরপর থেকে ইথিওপিয়া বাণিজ্যের জন্যে পার্শ্ববর্তী ছোট্ট দেশ জিবুতির সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করছে। 'বিবিসি'র সাথে কথা বলতে গিয়ে 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিসি গ্রুপ'এর ওমর মাহমুদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, এই সমঝোতা মূলতঃ একটা বিনিময়। এর একদিকে ইথিওপিয়া সমুদ্রে যাবার একটা পদ্ধতি পাবে। অপরদিকে সোমালিল্যান্ডকে ইথিওপিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। সোমালিয়া এই ব্যাপারটাকে তার স্বার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে। একারণেই জানুয়ারি মাসে সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মাহমুদ মিশর ভ্রমণ করে মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। 'বিবিসি' বলছে যে, ইথিওপিয়ার এই সমঝোতার প্রতিশোধ হিসেবে সোমালিয়া মিশরের সাথে কৌশলগত চুক্তি করে। নীল নদের উপরে তৈরি করা 'গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁস' বাঁধ নির্মাণকে ঘিরে ইথিওপিয়ার সাথে মিশরের প্রায় এক দশক ধরে উত্তেজনা চলছে। সামিয়া গাইদ বলছেন যে, নীল নদের উপর মিশর এতটাই নির্ভরশীল যে, ইথিওপিয়ার গ্র্যান্ড রেনেসাঁস বাঁধ পানি দিয়ে ভরার ব্যাপারটা ভাটির দেশ মিশরের জন্যে একটা বড় ইস্যু হয়েছে। এমতাবস্থায় ইথিওপিয়ার কাছে মনে হতে পারে যে, সোমালিয়াতে প্রবেশের মাধ্যমে মিশর ইথিওপিয়াকে দুই দিক থেকে ঘিরে ফেলছে।

‘ফার্স্ট পোস্ট'এর সাথে এক সাক্ষাতে তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউসেফ বেলাল বলছেন যে, ইথিওপিয়া জিবুতির সমুদ্রবন্দর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করলেও এখন তারা সমুদ্রে একটা সার্বভৌম প্রবেশদ্বার খুঁজছে; যার মাধ্যমে তারা সমুদ্রে সামরিক অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। সোমালিল্যান্ডের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ইথিওপিয়া সোমালিল্যান্ডের ২০কিঃমিঃএর বেশি সমুদ্রতট ব্যবহার করতে পারবে। ইউসেফ বেলাল মনে করছেন যে, এই নতুন ঘটনাগুলির মাধ্যমে সোমালিয়ার আল-শাবাব গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমন্বয়ের সমস্যা দেখা দিতে পারে; কারণ ইথিওপিয়া আল-শাবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে সোমালিয়াতে সেনা মোতায়েন রেখেছে। আগামী তিন মাসের মাঝে ডিসেম্বরের শেষে সোমালিয়াতে আফ্রিকান ইউনিয়নের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ম্যান্ডেট শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই ম্যান্ডেট শেষে নতুন একটা শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; যেখানে ইথিওপিয়ার অবস্থান নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত হতে হবে। এছাড়াও পুরো হর্ন অব আফ্রিকায় চলছে উত্তেজনা; যেখানে সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং বাব-এল মান্ডেব প্রণালী ও লোহিত সাগরের অপর পাড়ে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুথি মিলিশিয়ার সাথে গাজা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইস্রাইল এবং পশ্চিমা দেশগুলির উত্তেজনা চলমান রয়েছে।

‘বিবিসি' বলছে যে, সোমালিয়ার সাথে মিশরের কৌশলগত চুক্তির মাঝে সোমালিয়াতে আফ্রিকান ইউনিয়নের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে ১০ হাজার মিশরীয় সেনা মোতায়েনের কথাও বলা হচ্ছে; যার কিছু অংশ হয়তো সোমালিল্যান্ডেও মোতায়েন হতে পারে। এটা ইথিওপিয়াকে বিচলিত করছে। সামিয়া গাইদ বলছেন যে, স্বাভাবিক সময়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে মিশর আর ইথিওপিয়ার সামরিক বাহিনী থাকাটা সমস্যার কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান উত্তেজনার মাঝে এই দুই দেশের সেনাদের সোমালিয়াতে মোতায়েন সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এর মাধ্যমে সোমালিয়ার সমস্যা সোমালিয়ার বাইরেও চলে যেতে পারে। 'ফার্স্ট পোস্ট' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সোমালিয়াতে মিশরের সামরিক সরঞ্জাম অবতরণে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্য সোমালিল্যান্ডও বিচলিত। এক বিবৃতিতে সোমালিল্যান্ড সরকার বলছে যে, এই অস্ত্র কে কিভাবে ব্যবহার করবে, তা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে। সেপ্টেম্বরে সোমালিল্যান্ডে মিশরের একটা সাংস্কৃতিক অফিস সেখানকার সরকার বন্ধ করে দিয়ে অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে সোমালিল্যান্ড ছাড়ার নির্দেশ দেয়। এর জবাবে নিরাপত্তার কথা বলে মিশর সোমালিল্যান্ড থেকে মিশরের সকল নাগরিককে চলে যাবার নির্দেশনা দেয়। অপরদিকে ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদ ঘোষণা দেন যে, যদি ইথিওপিয়ার উপর হামলা হয়, তাহলে তার জবাব দেয়া হবে।

ওমর মাহমুদ বলছেন যে, যেভাবে সোমালিল্যান্ডের সাথে ইথিওপিয়ার সমঝোতা সোমালিয়াকে বিচলিত করেছে; ঠিক তেমনি সোমালিয়াতে মিশরের সামরিক সহায়তা ইথিওপিয়াকে বিচলিত করেছে। অর্থাৎ এক পক্ষ অপর পক্ষের উপরে অবস্থান নিতে একের পর এক কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে। বাইরের শক্তিগুলি অত্র অঞ্চলের আগে থেকে থাকা উত্তেজনাকে আরও উস্কে দিতে পারে; যা এর আগের ইতিহাসে দেখা গেছে। আবার বাইরের শক্তিগুলি মধ্যস্ততার ভূমিকাও রাখতে পারে। যেমন ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মাঝে উত্তেজনা কমাতে তুরস্ক মধ্যস্ততা করছে।

হর্ন অব আফ্রিকায় উত্তেজনার মূলে হলো বাব-এল মান্ডেব প্রণালি এবং লোহিত সাগরের মাঝ দিয়ে যাওয়া বিশ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথ। সকল শক্তিশালী রাষ্ট্রই এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় রয়েছে। ভূরাজনৈতিক এই প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া এবং সুদানে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। কারণ এই সংঘাতগুলিতে কোন না কোন পক্ষ কাউকে না কাউকে সমর্থন দিয়েছে; যা সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

 
‘ফার্স্ট পোস্ট'এর সাথে সাক্ষাতে মিশরের 'ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি অব ইজিপ্ট'এর শাদওয়া জাহের বলছেন যে, মিশর বাব-এল মান্ডেব প্রণালীকে সুয়েজ খালের দক্ষিণ দরজা হিসেবে দেখে। সোমালিয়ার সাথে সামরিক চুক্তির অর্থ হলো মিশর এই অঞ্চলে বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের স্বাভাবিকতাকে তার কৌশলগত স্বার্থের অংশ হিসেবে দেখছে। তিনি মনে করেন না যে, মিশর এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে সোমালিয়ার সাথে সম্পর্ক করছে। কারণ তিনি বলছেন যে, মিশর ইথিওপিয়াকে চিন্তা করে এটা করছে না, বরং লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথে 'ব্যালান্স অব পাওয়ার'এর চিন্তা করে এটা করেছে; যেখানে এই অঞ্চলের সকল দেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের স্বার্থ জড়িত। তিনি মনে করেন যে, সোমালিয়াতে মিশরীয় সেনা মোতায়েনের যে কথা চলছে, সেটাও আফ্রিকান ইউনিয়নের লক্ষ্যের সাথে যায়।

শাদওয়া জাহের-এর কথার সাথে মিল রেখেই 'আল-জাজিরা' বলছে যে, হর্ন অব আফ্রিকাতে মিশরের সবচাইতে বড় স্বার্থ হলো বাব-এল মান্ডেব প্রণালি দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। এখান দিয়ে বিশ্বের ১২ শতাংশ বাণিজ্য এবং ১০ শতাংশ তেল পরিবহণ হয়ে থাকে। আর এই প্রণালি থেকে লোহিত সাগর হয়ে বিশ্বের ১৫ শতাংশ বাণিজ্য মিশরের সুয়েজ খাল দিয়ে হয়ে থাকে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়া বাব-এল মান্ডেবের ম্যারিটাইম পথে জাহাজের উপর হামলা করতে থাকায় বেশিরভাগ শিপিং কোম্পানি বাব-এল মান্ডেবকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের 'ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি'র ডেভিড ডেসরোচেস 'আল-জাজিরা'কে বলছেন যে, বাব-এল মান্ডেবে হুথিদের উত্থানে সবচাইতে বড় ক্ষতি হচ্ছে মিশরের, যে কিনা বাণিজ্যিক জাহাজগুলি সুয়েজ খাল এড়িয়ে যাবার কারণে তার ৩০ শতাংশ নগদ আয় হারাচ্ছে। 'রয়টার্স'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২২-২৩ সালে মিশর সুয়েজ খাল থেকে রেকর্ড ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বরে হুথিরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজে হামলা শুরু করার কারণে ২০২৩-২৪ সালে সুয়েজ খাল থেকে মিশরের আয় ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে; জাহাজের সংখ্যাও প্রায় ২৬ হাজার থেকে প্রায় ২০ হাজারে নেমে এসেছে।

মিশর গত দুই দশকে তার নৌবাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছে। ২০১৫ সালে ফ্রান্স থেকে বিলিয়ন ইউরো খরচে বিশাল আকৃতির দু'টা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করে মিশর। ২১ হাজার টনের এই জাহাজগুলির একেকটা ২০ থেকে ৩০টা হেলিকপ্টার, সাড়ে ৪'শ সৈন্য এবং ট্যাঙ্কসহ ৭০টা গাড়ি বহণ করতে সক্ষম। এছাড়াও মিশর ২০০৭ সাল থেকে ইতালি, ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে ১১টা অত্যাধুনিক ফ্রিগেট ও ৪টা সাবমেরিন ক্রয় করে। ‘দ্যা এরাব উইকলি'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি কোয়ালিশনের অংশ হয়ে মিশর প্রথমবারের মতো লোহিত সাগর এবং বাব-এল মান্ডেবের দিকে নজর দেয়। ২০১৫ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি লোহিত সাগর এবং বাব-এল মান্ডেবকে মিশরের জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ঘোষণা দেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে মিশর লোহিত সাগরে বারনিস নৌঘাঁটির উদ্ভোধন করে; যা কিনা মিশরের নৌবাহিনীকে বাব-এল মান্ডেব পর্যন্ত অপারেট করতে সহায়তা করবে বলে বলা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, মিশর লোহিত সাগরে নৌঘাঁটি তৈরির একটা কারণ হলো লোহিত সাগর এবং বাব-এল মান্ডেব প্রণালি অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবকে মোকাবিলা করা।

কিন্তু ২০২৪ সাল পর্যন্ত মিশর তার নৌবাহিনীকে লোহিত সাগর বা বাব-এল মান্ডেব এলাকায় মোতায়েন করেনি। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবিতে মিশরের নৌবাহিনীর দু'টা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার এবং প্রায় সবক'টা ফ্রিগেটকে ভূমধ্যসাগরের আলেক্সান্দ্রিয়া বন্দরে নোঙ্গর করে থাকতে দেখা যায়। অনেকেই মনে করেন যে, এই দু'টা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার মিশর কিনেছিল সৌদি আরবের অর্থায়নে। কিন্তু মিশর এগুলিকে সৌদি আরবের সমর্থনেও কাজে লাগায়নি। মিশরের সিনিয়র সাংবাদিক হাইথাম এল-জোবাইদি 'দ্যা এরাব উইকলি'র এক লেখায় মিশর সরকারের নীতির সমালোচনা করে বলেন যে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে যে দু'টা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার কেনা হয়েছে, সেগুলিকে গত ৮ বছরে কোনরূপ ব্যবহার করা হয়নি। যেকোন নৌবাহিনী এরূপ যুদ্ধজাহাজকে ব্যবহার করে দূরের সমুদ্রে প্রভাব বিস্তারের জন্যে। কিন্তু মিশর এগুলিকে বসিয়ে রেখেছে বন্দরের ভেতর। তার নৌবাহিনীতে অনেক অত্যাধুনিক ফ্রিগেট এবং সাবমেরিন যোগ হয়েছে; কিন্তু এগুলিকে সর্বোচ্চ কোস্ট গার্ডের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদিদের সাথে যোগ দিলেও মিশর তার শক্তিশালী নৌবহরকে ব্যবহার করেনি। এখন গত নভেম্বর থেকে হুথিদের কারণে যখন রেমিট্যান্সের পর মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ বন্ধ হবার উপক্রম, তখন ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করার কোন উপায়ই নেই মিশরের কাছে। তারা এখনও তাদের যুদ্ধজাহাজগুলিকে বন্দরে বসিয়ে রেখেছে; হয়তো এই ভয়ে যে হুথিরা যদি বিশাল একটা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ডুবিয়ে দেয়! কাজেই ডুবে যাবার চাইতে এগুলি হয়তো বন্দরের ভেতর যত্ন করে রেখে দেয়াটাই উত্তম! আর ইথিওপিয়া যখন সোমালিল্যান্ডের সাথে সমঝোতা করেছে, তখন মিশরের পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্বিত ফিরেছে এবং ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে তাদের।

মিশর এমন সময়ে হর্ন অব আফ্রিকাতে খেলোয়াড় হবার চেষ্টা চালাচ্ছে, যখন অত্র অঞ্চলে তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ‘বিবিসি' বলছে যে, পুরো অঞ্চলে ব্যালান্স অব পাওয়ার নিয়ে একটা সূক্ষ্ম খেলা শুরু হয়েছে।
 
এপ্রিল ২০২৪। সোমালিয়ার মোগাদিশু বন্দরে তুরস্কের যুদ্ধজাহাজ 'কিনালিইয়াদা'। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়া তুরস্কের সাথে ১০ বছরের নৌ নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের নৌবাহিনী সোমালিয়ার সমুদ্র উপকূলের নিরাপত্তা দেবে এবং সোমালিয়ার নৌবাহিনীকে ট্রেনিং দেবে। এই চুক্তি হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবকে আরও বৃদ্ধি করবে।  


হর্ন অব আফ্রিকাতে তুরস্ক

তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউসেফ বেলাল বলছেন যে, সোমালিল্যান্ডের সাথে ইথিওপিয়ার সমঝোতাকে ব্যালান্স করতে সোমালি সরকার দু'টা সামরিক চুক্তি করেছে; যার একটা মিশরের সাথে; আরেকটা তুরস্কের সাথে। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়া তুরস্কের সাথে ১০ বছরের নৌ নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। 'ভয়েস অব আমেরিকা' বা 'ভোয়া' বলছে যে, এই চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের নৌবাহিনী সোমালিয়ার সমুদ্র উপকূলের নিরাপত্তা দেবে এবং সোমালিয়ার নৌবাহিনীকে ট্রেনিং দেবে। তুরস্কের 'সোশাল সাইয়েন্সেস ইউনিভার্সিটি'র এলেম এইরিচ-তেপেচিকোগলু-এর মতে এই চুক্তি হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাবকে আরও বৃদ্ধি করবে। অনেকগুলি দেশের সাথে তুরস্ক প্রভাব বিস্তারে প্রতিযোগিতা করছে। তুর্কি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সিনে ওজকারাশাহিন বলছেন যে, তুরস্ক তার নৌবাহিনীকে এমনভাবে তৈরি করছে, যাতে সে নিজ দেশের সমুদ্রবন্দর থেকে দূরে গিয়ে অপারেট করতে পারে। তুরস্কের নৌবাহিনী নিজ দেশের কাছাকাছি সমদ্রে অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি বন্ধু দেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে অগ্রসর হচ্ছে। সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুদের উৎপাত তুরস্ককে এই পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করেছে।

সোমালিয়ার সাথে ইথিওপিয়ার কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই গত এপ্রিল মাসে তুরস্কের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ 'কিনালিয়াদা' মোগাদিশুতে সফর করে। সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মাহমুদ নিজে এই যুদ্ধজাহাজ পরিদর্শন করেন। সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন যে, এর মাধ্যমে তুরস্কের সাথে সোমালিয়ার চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। 'রয়টার্স' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সোমালিয়াতে প্রচুর বিনিয়োগ করা এবং সোমালি ছাত্রদেরকে তুরস্কে স্কলারশিপ দেয়া ছাড়াও ২০১৭ সালে তুরস্ক সেখানে সামরিক ঘাঁটি করেছে এবং সোমালিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। 'বিবিসি' বলছে যে, ২০১১ সালে সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের সময় যখন অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা সোমালিয়া ছেড়ে যায়, তখন তুরস্ক মানবিক সহায়তার মাধ্যমে সোমালিয়াতে সুযোগ খুঁজেছে। ২০১২ সালে 'টারকিশ এয়ারলাইন্স'এর মাধ্যমে মোগাদিশু বাকি বিশ্বের সাথে যুক্ত হয়। সোমালিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, যেমন বিমানবন্দর এবং সমুদ্রবন্দর তুর্কি ব্যবস্থাপনায় চলা শুরু হয়। সোমালিয়ার সাথে তুরস্কের সামরিক চুক্তি একদিকে যেমন সোমালিয়ার সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্যে, তেমনি কৌশলগত বাণিজ্যপথের নিরাপত্তার জন্যে। সোমালিরা মনে করছে যে, তুরস্কের মতো একটা রাষ্ট্র তাদের বন্ধু হওয়ার অর্থ তাদের শক্তিশালী হওয়া। কয়েক মাস আগে তুরস্ক এবং সোমালিয়া হাইড্রোকার্বন খোঁজার জন্যেও চুক্তি করেছে।

'টারকিশ ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি'র মেহমেত ওজকান 'ভোয়া'কে বলছেন যে, এই অঞ্চলে সকলেই নিরাপত্তা সহযোগিতার দিকে ঝুঁকছে। আর তুরস্ক নিজেকে নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবেই তুলে ধরছে। ইতোমধ্যেই ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়া উভয়েই তাদের নিজ দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং গেরিলা গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে তুরস্কে তৈরি সামরিক ড্রোন ব্যবহার করছে। আঙ্কারা দুই দেশের সাথেই ভালো সম্পর্ক রেখেছে। তবে এলেম এইরিচ-তেপেচিকোগলু মনে করছেন যে, দীর্ঘ মেয়াদে আঞ্চলিক সংঘাতে তুরস্ক জড়িয়ে পড়তে পারে; যা কিনা আঙ্কারা সর্বদাই এড়িয়ে চলতে চাইছিল। তবে এরকম একটা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে হলে আঙ্কারাকে যথেষ্ট কূটনৈতিক ব্যালান্সিং প্রদর্শন করতে হবে।

গত মার্চের 'প্ল্যানেট ল্যাবস পিবিসি'র স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায় যে, বাব-এল মান্ডেব প্রণালি থেকে ৯৬০কিঃমিঃ পূর্বে আদেন উপসাগরে ইয়েমেনের আব্দ আল-কুরি দ্বীপে কেউ একটা বিমান ঘাঁটি তৈরি করছে। এই দ্বীপটা সকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের একটা অংশ। এই ঘাঁটির নির্মীয়মান রানওয়ের পাশে মাটির স্তূপ রেখে কেউ একটা বার্তা লিখেছে; যা বলছে, “আই লাভ ইউএই" বা আমি ইউএই-কে ভালোবাসি। 


হর্ন অব আফ্রিকাতে সংযুক্ত আরব আমিরাত

গত মার্চের 'প্ল্যানেট ল্যাবস পিবিসি'র স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায় যে, বাব-এল মান্ডেব প্রণালি থেকে ৯৬০কিঃমিঃ পূর্বে আদেন উপসাগরে ইয়েমেনের আব্দ আল-কুরি দ্বীপে কেউ একটা বিমান ঘাঁটি তৈরি করছে। এই দ্বীপটা সকোত্রা দ্বীপপুঞ্জের একটা অংশ। 'এসোসিয়েটেড প্রেস'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই ঘাঁটির নির্মীয়মান রানওয়ের পাশে মাটির স্তূপ রেখে কেউ একটা বার্তা লিখেছে; যা বলছে, “আই লাভ ইউএই" বা আমি ইউএই-কে ভালোবাসি। এখানে ইউএই বলতে সংযুক্ত আরব আমিরাতকেই বোঝানো হয়ে থাকতে পারে। কাজেই কেউ এই বিমান ঘাঁটির মালিকানা দাবি না করলেও এটা আমিরাতের ঘাঁটি বলেই অনুমিত হচ্ছে। আমিরাত সরকার 'এসোসিয়েটেড প্রেস'কে বলছে যে, সকোত্রা দ্বীপপুঞ্জে আমিরাতে যেকোন অবস্থান মানবিক কারণে এবং তা ইয়েমেনের সরকারের সহযোগিতায়। ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইয়েমেনের এই সরকারের ওয়াশিংটন এবং সৌদি আরবের দূতাবাস এব্যাপারে কোন মন্তব্য করেনি। এই রানওয়েটা প্রায় ৩কিঃমিঃ লম্বা; যা কিনা এটাক, সার্ভেইল্যান্স এবং পরিবহণ বিমানের জন্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এর আগের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায় যে, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে একটা ছোট রানওয়ে তৈরি করা হলেও পরবর্তীতে সেই বছরের জুলাই মাসে আরও বড় একটা রানওয়ের কাজ শুরু হয়। তবে সেটার কাজ কিছুদিন পরেই থেমে যায়। গত মার্চে আমিরাতের 'স্কাই নিউজ এরাবিয়া' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র সকোত্রা দ্বীপে আমিরাতের ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করেছে। কারণ তাদের ধারণা ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়ারা এই ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে। সকোত্রা দ্বীপ হলো আব্দ আল-কুরি দ্বীপ থেকে ১৩০কিঃমিঃ পূর্বে। তবে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা সকোত্রাতে তাদের কোন সামরিক উপস্থিতি অস্বীকার করেছে।

বিভিন্ন ম্যারিটাইম ভেসেল ট্র্যাকার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা যায় যে, 'আল-তাকরীম' নামের আমিরাতে রেজিস্টার করা একটা জাহাজ নিয়মিত আবুধাবি এবং সকোত্রা দ্বীপের মাঝে যাতায়াত করছে ২০২১ সাল থেকে। ৭৮মিটার লম্বা এই ল্যান্ডিং ক্রাফট ৩,৮৭৫টন মালামাল বহণে সক্ষম। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবিতে ৭৮মিটার লম্বা একটা ল্যান্ডিং ক্রাফটকে সকোত্রার হুলাফ বন্দরে নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখা যায়। ল্যান্ডিং ক্রাফট হবার কারণে জাহাজটা তেমন কোন বন্দর সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও অনায়াসে সকোত্রায় যেতে পারে। ইরান-সমর্থিত মিডিয়া বলছে যে, সকোত্রা দ্বীপে আমিরাতের ছোট কিছু স্থাপনা রয়েছে এই অঞ্চলের উপর নজরদারি করার জন্যে। সকোত্রা দ্বীপের পূর্ব এবং পশ্চিমের উঁচু জায়গায় দু'টা রাডার স্থাপন করেছে তারা; যাতে করে আদেন উপসাগরে চলাচলকারী নৌযানের উপরে নজরদারি করা যায়। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিন-ইস্রাইল সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে আমিরাতিরা আব্দ আল-কুরি দ্বীপের দক্ষিণে ১২০মিটার লম্বা একটা জেটি তৈরি করেছে এবং বিমানবন্দরের রানওয়ে তৈরির কাজ ত্বরান্বিত করেছে।

প্রায় দশ বছর আগে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের সরকারকে উৎখাত করলে ২০১৫ সালে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনের যুদ্ধে জড়ায়। ২০১৮ সালে আমিরাতের সেনারা ইয়েমেনের সকোত্রা দ্বীপে মোতায়েন হলে ইয়েমেন সরকারের সাথে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। দু'বছর পর ইয়েমেনের দুই গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষও হয় সেখানে। ইরান-সমর্থিত মিডিয়া এবং হুথিরা দাবি করে যে, আমিরাত ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্সকে সকোত্রা দ্বীপ ব্যবহার করতে দিচ্ছে; যেব্যাপারে ইস্রাইল কোন মন্তব্য করেনি। ২০২১ সালে 'এসোসিয়েটেড প্রেস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাব-এল মান্ডেব প্রণালির মাঝে অবস্থিত মাইয়ুন দ্বীপেও কেউ বিমানঘাঁটি তৈরি করছে। ইয়েমেনের সরকার তখন বলেছিল যে, আরব আমিরাত এই বিমানঘাঁটি তৈরি করছে। গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র ছুতোয় স্পেশাল ফোর্সের সেনা এবং ড্রোনের মাধ্যমে ইয়েমেনের মাটিতে শতশত হামলা চালিয়েছে।

ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে অংশ নেবার সময় আমিরাত এরিত্রিয়ার আসাব বন্দরের কাছে ৩০ বছরের লীজ নিয়ে বড় একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে। এখান থেকে ইয়েমেবের দূরত্ব মাত্র ৭০কিঃমিঃ। তবে ২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে 'এসোসিয়েটেড প্রেস' স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে বলে যে, আমিরাত আসাব-এর সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে আমিরাত সেখানে ড্রেজিং করে একটা সমুদ্রবন্দর তৈরি করে এবং সাড়ে ৩কিঃমিঃ লম্বা বিমানবন্দরের রানওয়েকে বড় পরিবহণ বিমানের অবতরণের জন্যে প্রস্তুত করে। জাতিসংঘের বরাত দিয়ে 'ভোয়া' বলে যে, আমিরাত সেখানে ফরাসি-নির্মিত 'লেকলার্ক' ট্যাংক, দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্মিত 'জি-৬' আর্টিলারি এবং রাশিয়ায় নির্মিত 'বিএমপি-৩' এপিসি জমা করে। একইসাথে এটাক হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং অন্যান্য বিমানও সেখানে মোতায়েন ছিল। এছাড়াও আমিরাতের যুদ্ধজাহাজ, ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং অন্যান্য জাহাজ এখানে নিয়মিতভাবে মোতায়েন ছিল। সেখানকার ব্যারাকে থাকা আমিরাতি, ইয়েমেনি এবং সুদানি সেনাদেরকে 'সুইফট-১' নামের মার্কিন-নির্মিত জাহাজে করে ইয়েমেনে আনা-নেয়া করা হতো। এই জাহাজটা ২০১৬ সালে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেবার পর আমিরাত আসাব থেকে তাদের সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিতে শুরু করে।

তবে এরিত্রিয়া থেকে প্রস্থান করলেও হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে এখনও আমিরাতের বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। ২০২১ সালে সোমালিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশ সোমালিল্যান্ডে আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ আল-নাকবি-কে আমিরাতের বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। সোমালিল্যান্ডে আমিরাতের সবচাইতে বড় প্রকল্প হলো ৩০ বছরের লীজে বারবেরা সমুদ্রবন্দরের উন্নয়ন। 'আল-মনিটর'এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আল-নাকবি-কে সোমালিল্যান্ডে অফিস দেয়াকে সোমালিয়া তার সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে। তবে আমিরাত মূলতঃ অত্র অঞ্চলে তুরস্ক এবং কাতারের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে কাজ করছে। তুরস্কের 'আল-বায়রাক গ্রুপ' ১৪ বছরের জন্যে মোগাদিশু বন্দরের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে; অপরদিকে কাতার সোমালিয়ার হোবইয়ো-তে একটা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করছিলো। ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে নিজেদেরকে উঠিয়ে নিয়ে আমিরাত হর্ন অব অফ্রিকা অঞ্চলে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের কৌশল থেকে সরে এসে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং দূর থেকে প্রভাব বিস্তারের কৌশলে গিয়েছে। একসময় সোমালিল্যান্ডের বারবেরাতে আমিরাতিরা সামরিক ঘাঁটি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল; যা ২০১৯ সালে পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় বেসামরিক বিমানবন্দরে। একইসাথে তারা মাইয়ুন এবং সকোত্রা দ্বীপে চুপিসারে ঘাঁটি তৈরি করে বাব-এল মান্ডেব প্রণালিতে তাদের প্রভাব ধরে রেখেছে। দরকার হলে তারা এই অঞ্চলে আবারও সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সুফান সেন্টার'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসার পরেও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আবুধাবি বিমানবন্দরে ইয়েমেনের হুথিদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা ইরান এবং ইরান-সমর্থিত প্রক্সিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার আমিরাতি কৌশলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এছাড়াও ইয়েমেনের 'সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল' বা 'এসটিসি' নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে সমর্থন দিয়ে আমিরাতিরা সৌদি আরব এবং মিশরের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছে। আমিরাতিরা নিশ্চিত করছে, যাতে করে সৌদিরা কোন প্রকারেই আদেন উপসাগরের কৌশলগত বন্দরগুলি থেকে আমিরাতকে বের করে দিতে না পারে। সোমালিয়াতেও আমিরাতের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছিল; যখন ২০১৮ সালে সোমালিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী পুন্টল্যান্ড এবং সোমালিল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক করার অভিযোগে আমিরাতের সাথে নিরাপত্তা প্রশিক্ষণের চুক্তি বাতিল করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আমিরাত আবারও সোমালিয়ার সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তথাপি সোমালিল্যান্ডে আমিরাতের বারবেরা সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প চলছে। এই সমুদ্রবন্দরের মূল লক্ষ্য হলো সাড়ে ১২ কোটি মানুষের ভূমিবেষ্টিত দেশ ইথিওপিয়াকে জিবুতি ছাড়াও সমুদ্রে পৌঁছাবার আরেকটা সুযোগ করে দেয়া। তিগ্রেদের সাথে গৃহযুদ্ধে আবি আহমেদের ইথিওপিয়া সরকারকে সহায়তা করেছে আমিরাত। আর ২০২৩ সালের অগাস্টে ইথিওপিয়ার সাথে ম্যারিটাইম চুক্তিও করে আমিরাত। ইথিওপিয়ার সাথে আমিরাতের সম্পর্কোন্নয়ন এবং সোমালিল্যান্ডে ইথিওপিয়ার জন্যে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ একদিকে যেমন সোমালিয়ায় সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, তেমনি মিশরকেও করেছে উদ্বিগ্ন। কারণ ইথিওপিয়ার সাথে গ্র্যান্ড রেনেসাঁস বাঁধ নিয়ে মিশরের বিরোধ চলছে। এছাড়াও সুদানের গৃহযুদ্ধেও আমিরাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী 'আরএসএফ' মিলিশিয়াকে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালে ইয়েমেনের যুদ্ধে 'আরএসএফ'এর নেতা জেনারেল হামেদতি সুদানি সেনাদের পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়। লিবিয়ার বেনগাজি-ভিত্তিক সরকারের নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারের মাধ্যমে আমিরাতিরা সুদানের 'আরএসএফ'কে সহায়তা পাঠাচ্ছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। অপরদিকে সুদানের গৃহযুদ্ধে সুদানের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে মিশর।

২০২৪ সাল পর্যন্ত মিশর তার নৌবাহিনীকে লোহিত সাগর বা বাব-এল মান্ডেব এলাকায় মোতায়েন করেনি। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ছবিতে মিশরের নৌবাহিনীর দু'টা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার এবং প্রায় সবক'টা ফ্রিগেটকে ভূমধ্যসাগরের আলেক্সান্দ্রিয়া বন্দরে নোঙ্গর করে থাকতে দেখা যায়। অনেকেই মনে করেন যে, এই দু'টা হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার মিশর কিনেছিল সৌদি আরবের অর্থায়নে। কিন্তু মিশর এগুলিকে সৌদি আরবের সমর্থনেও কাজে লাগায়নি। মিশরের সামরিক শক্তি রয়েছে; কিন্তু সেটাকে কোথায় কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা সে জানে না। ভৌগোলিক দিক থেকে অতি শক্তিশালী অবস্থানে থাকা মিশর সামরিক দিক থেকেও শক্তিশালী; কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যহীন রাষ্ট্র মিশর কি সর্বদা শক্তিশালী দেশগুলিকে অনুসরণ করেই যাবে?


হর্ন অব আফ্রিকার জটিল সমীকরণ

সকলেই একমত যে, হর্ন অব আফ্রিকায় উত্তেজনার মূলে হলো বাব-এল মান্ডেব প্রণালি এবং লোহিত সাগরের মাঝ দিয়ে যাওয়া বিশ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথ। সকল শক্তিশালী রাষ্ট্রই এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় রয়েছে। জিবুতিতে রয়েছে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জাপানের সামরিক ঘাঁটি। সৌদি আরব এই এলাকার অংশ বলে তারাও এখানে প্রভাব রাখে। এর বাইরে এই এলাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তুরস্ক সামরিক ঘাঁটি করেছে এবং অর্থনৈতিকভাবেও প্রভাব বিস্তার করছে। তাছাড়া ব্রিটেন এবং ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি এই অঞ্চলে নিয়মিত নৌবাহিনী মোতায়েন রাখে। ভূরাজনৈতিক এই প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া এবং সুদানে গৃহযুদ্ধ হয়েছে। কারণ এই সংঘাতগুলিতে কোন না কোন পক্ষ কাউকে না কাউকে সমর্থন দিয়েছে; যা সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

সর্বশেষ সংঘাত হিসেবে এসেছে গাজায় ইস্রাইলি বর্বরতার প্রতিবাদ হিসেবে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুথিদের বাব-এল মান্ডেব প্রণালিতে বাণিজ্যিক জাহাজের উপর আক্রমণ। এর ফলে সুয়েজ খাল দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য জাহাজের সংখ্যা কমে গিয়েছে এবং মিশরের অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। এই চাপে পড়ে গত এক দশকে মিশর যে কাজটা করা থেকে বিরত থেকেছিল সেটাই তারা করেছে - হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে সরাসরি জড়িয়ে পড়া। সরাসরি কারণ হিসেবে ইথিওপিয়ার সাথে সোমালিল্যান্ডের সমঝোতাকে উল্লেখ করা হলেও মূল কারণ বাব-এল মান্ডেব নৌপথের নিরাপত্তা। এর আগে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে মিশর সাইডলাইনে ছিল; এমনকি ইথিওপিয়া যখন মিশরের লাইফলাইন নীল নদের উপর 'গ্র্যান্ড রেনেসাঁস' বাঁধ তৈরি করেছে, তখনও মিশর ইথিওপিয়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সোমালিয়াতে ঢুকে পড়ে মিশর কতটুকু সুবিধা করতে পারবে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়। কারণ যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, মিশর কোন পরিকল্পনা করে এই ভূরাজনৈতিক খেলায় ঢোকেনি। এছাড়াও এই খেলায় তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তুরস্কের চাইতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মিশরের সামরিক শক্তি রয়েছে; কিন্তু সেটাকে কোথায় কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা সে জানে না। ফিলিস্তিনের সংঘাতে সে নিজ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইস্রাইলের পক্ষ নিয়েছে; তথাপি তার শক্তিশালী নৌবহরকে সে ইস্রাইলের কাছাকাছি আলেক্সান্দ্রিয়াতেই আটকে রেখেছে। মিশর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছে তুরস্কের প্রতিযোগী হিসেবে; কিন্তু সেখানেও সে তার নৌবহরকে ব্যবহার করেনি। ভৌগোলিক দিক থেকে অতি শক্তিশালী অবস্থানে থাকা মিশর সামরিক দিক থেকেও শক্তিশালী; কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যহীন রাষ্ট্র মিশর কি সর্বদা শক্তিশালী দেশগুলিকে অনুসরণ করেই যাবে?

No comments:

Post a Comment