২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়ারা ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে এবং একইসাথে লোহিত সাগর এবং বাব-এল মান্ডেব প্রণালি দিয়ে যাওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্য জাহাজে হামলা শুরু করে। এক বছর ধরে গাজায় চলা ইস্রাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে হুথিরা পশ্চিমা বাণিজ্য জাহাজে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিমারাও ইস্রাইলকে রক্ষার্থে এবং তাদের বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে লোহিত সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। হুথিদেরকে এই হামলা থেকে বিরত করতে পশ্চিমারা ইয়েমেনে দফায় দফায় বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে। কিন্তু এই সংঘাতের কোন কূলকিনারা দেখা যাচ্ছে না।
মার্কিন মিডিয়া 'এবিসি নিউজ'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের আক্রমণের ফলে সুয়েজ খাল দিয়ে বাণিজ্য জাহাজ যাতায়াতে মিশর সরকারের যে আয় হতো, তা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছে। এই সংঘাত শুরুর আগে বাব-এল মান্ডেব প্রণালি দিয়ে বিশ্বের মোট কনটেইনার বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ যাতায়াত করতো। প্রধান কনটেইনার শিপিং কোম্পানিগুলি তাদের জাহাজগুলিকে ঘুরপথে নিতে বাধ্য হচ্ছে; যার ফলে পরিবহণ খরচ বেড়ে গেছে। এসকল কনটেইনারে যেসব পণ্য পরিবাহিত হতো, তার সবগুলিরই মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া কোন জাহাজ থেকে যদি তেল ছড়ায়, তাহলে তা এই এলাকার ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্টগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে; যা মরু অঞ্চলে সুপেয় পানির হাহাকার তৈরি করতে পারে। এছাড়াও এই সমুদ্রপথের নিচ দিয়ে বিশ্বের সমগ্র ইন্টারনেটের এক-তৃতীয়াংশ গিয়েছে। এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হুমকির মাঝে পড়ে যাবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'ফেডারেল রিজার্ভ'এর চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল মার্কিন টেলিভিশন 'সিবিএস'কে বলেন যে, লোহিত সাগরের এই সংঘাত সারা দুনিয়ার অর্থনীতিকে হুমকির মাঝে ফেলে দিচ্ছে। তবে স্বল্প মেয়াদে এটা যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে ইউরোপকেই বেশি প্রভাবিত করবে। 'সিবিএস'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাপ্লাই চেইনে বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে ‘টেসলা' এবং 'ভলভো' তাদের ইউরোপিয় উৎপাদন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানুয়ারি মাসে মার্কিন নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহরের প্রধান ভাইস এডমিরাল ব্র্যাড কুপার দাবি করেন যে, লোহিত সাগর দিয়ে যেসকল জাহাজ যাচ্ছে, সেগুলি যেতে পারছে মার্কিন সুরক্ষার কারণেই। তবে এডমিরাল কুপার বলেন যে, হুথিরাই হলো প্রথম শক্তি যারা যেকোন যুদ্ধে জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।
হুথিরা আসলে কারা?
‘ভোক্স'এর এক প্রতিবেদনে ইয়েমেনের ইতিহাসে হুথিদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ইয়েমেনের নেতৃত্বে ছিল জাইদি শিয়ারা। ১৯৭০এর দশকে আলী আব্দুল্লাহ সালেহ ইয়েমেনের ক্ষমতা নেন। তিনি জাইদি হলেও তার বন্ধুত্ব ছিল সৌদিদের সাথে; যা হুসেইন আল-হুথি নামের একজন জাইদি নেতা তা পছন্দ করেননি। ২০০১ সালে সালেহ সরকার মার্কিনীদের নেতৃত্বে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর আল-হুথি বলেন যে, তিনি ইয়েমেনকে মার্কিন পাপেট দেখতে চান না। একইসাথে তিনি ঘোষণা দেন যে, ইহুদিরা মুসলিম দেশগুলির উপর ছড়ি ঘোরাবে, সেটা তিনি বসে বসে দেখবেন না। ২০০৪ সালে সালেহ-এর সেনাবাহিনী আল-হুথিকে হত্যা করে। তবে আল-হুথির হত্যার পরে তার অনুসারীরা আরও শক্তিশালী হয় এবং কোন একটা সময়ে ইরানের কাছাকাছি যেতে থাকে। এরপর ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় ব্যাপক জনরোষের কারণে সালেহ ক্ষমতা ছাড়াতে বাধ্য হলে সৌদি-সমর্থিত মনসুর হাদি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। প্রথমে সরকার গঠনের আলোচনায় অংশ নিলেও ২০১৪ সালে হুথিরা নিজেদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে আলোচনা ছেড়ে যায়। সেই বছরই ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধের শুরুতে হুথিরা তাদের প্রাক্তন শত্রু আলী আব্দুল্লাহ সালেহর সাথে বন্ধুত্ব করে এবং ২০১৪এর সেপ্টেম্বরে রাজধানী সানা-র নিয়ন্ত্রণ নেয়। একইসাথে হুথিরা হোদেইদা সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সমুদ্রে যাবার একটা পথ পায়। ২০১৫ সালে সৌদি আরব এবং তার সমমনা দেশগুলি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। সৌদিরা হুথিদের উপর ব্যাপক বিমান আক্রমণ করে এবং ইয়েমেনকে নৌ-অবরোধের মাঝে ফেলে দেয়; যাতে করে ইরান থেকে হুথিদের জন্যে অস্ত্র আসতে না পারে। তবে এরপরেও হুথিরা ইয়েমেনের বড় একটা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। ২০১৭ সালে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের পর হুথিরা আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে হত্যা করে। ২০২০ সালে সৌদিরা যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে ইয়েমেন থেকে চলে যেতে থাকে। ২০২৩ সালেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, ইয়েমেনের সরকার কিরূপ হবে। ইয়েমেনের ৪ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ হুথিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথাপি হুথিদেরকে পশ্চিমাদের মাঝে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। 'ভোক্স'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের অধীনে থাকা ইয়েমেনের শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনীতি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আরব জনগণের মাঝে নিজেদের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তারা ফিলিস্তিনের ইস্যুকে নিজেদের করে নেয়; যাতে করে ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি আলোচনায় না আসে। ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরু হলে হুথিরা ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা জানিয়ে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে এবং একইসাথে লোহিত সাগরে নির্দিষ্ট কিছু বাণিজ্য জাহাজের উপর হামলা শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে হুথিদেরকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেয়। পশ্চিমারা হুথিদের উপর বিমান হামলাও শুরু করে।
লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধ
‘এবিসি নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে প্রাক্তন পেন্টাগন কর্মকর্তা মাইকেল প্যাট্রিক মালরয় বলছেন যে, উড়ন্ত, পানির উপর দিয়ে চলা এবং পানির নিচ দিয়ে চলা যেকোন মনুষ্যবিহীন ড্রোন মোকাবিলায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু একইসাথে যদি কয়েক প্রকারের অনেকগুলি ড্রোন আক্রমণ করে, তাহলে তা সমস্যার জন্ম দেবে। এটা সকলেই বোঝেন যে, হুথিদের এসকল উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা নেই। অন্যকথায় হুথিরা অস্ত্র পাচ্ছে ইরান থেকে। পশ্চিমারা এক্ষেত্রে চেষ্টা করবে ইরান থেকে হুথিদের কাছে অস্ত্রের চালান বন্ধ করতে; এবং একইসাথে হুথিদের নিজেদের অস্ত্র ব্যবহারের সক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করতে। ‘বিজনেস ইনসাইডার'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেনের হুথিরা এখন যেসকল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, তার সবগুলিই ইরানের প্রযুক্তিতে তৈরি। প্রথমেই রয়েছে চীনা 'সি-৮০২' ক্ষেপণাস্ত্রের ইরানি কপি; যেগুলি মূলতঃ জাহাজ-ধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলি নিচু দিয়ে উড়ে জাহাজে হামলা করে। যুদ্ধজাহাজে এগুলির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও বাণিজ্য জাহাজ এগুলির বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। এরপর রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র; যার মাঝে সবচাইতে বেশি হুমকির হলো জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলি অনেক উপর থেকে প্রচন্ড গতিতে ভূমির দিকে পড়কে থাকে বিধায় এগুলিকে খুঁজে পাওয়া এবং ধ্বংস করা খুব কঠিন। মার্কিন ৫ম নৌবহরের তৎকালীন কমান্ডার ভাইস এডমিরাল ব্র্যাড কুপার গত জানুয়ারিতে 'সিবিএস'কে বলেন যে, ১০ বছর ধরে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের মাঝে হুথিরা ইরান থেকে প্রচুর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের চালান পেয়েছে। লোহিত সাগরে হুথিদের বেশিরভাগ টার্গেট ছিল বাণিজ্য জাহাজ; স্বল্প সংখ্যক আক্রমণ ছিল মার্কিন নৌবহরের বিরুদ্ধে।
'সিবিএস'এর 'সিক্সটি মিনিটস' অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের অস্ত্রগুলির মাঝে রয়েছে 'সামাদ-৩' ড্রোন; যার পাল্লা প্রায় ১,৮০০কিঃমিঃ। তাদের জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ পর্যন্ত। মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ‘মেসন’এর কমান্ডার ‘সিবিএস’কে বলছেন যে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পর ১ থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত সেটাকে দেখা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে মার্কিন জাহাজের কমান্ডারকে ৯ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মাঝে সেটাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মার্কিন নৌবাহিনীর জন্যে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে থামাতে ১০০ শতাংশ সফলতা প্রয়োজন; কিন্তু হুথিদের ক্ষেত্রে একটা ক্ষেপণাস্ত্রের সফলতাই যথেষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনী ১’শটার মতো ‘স্ট্যান্ডার্ড’ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাবহার করেছে; যেগুলির একেকটার মূল্য প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। লোহিত সাগরে একটা মার্কিন যুদ্ধজাহাজকে তাদের সর্বশেষ স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা 'ফ্যালাংস' ব্যবহার করতে হয়েছে। মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বিমান এবং ডেস্ট্রয়ার থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে হুথিদের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক হামলা করা হয়েছে। লোহিত সাগরে ইরানি ইন্টেলিজেন্স জাহাজে সাইবার হামলাও করা হয়েছে। কিন্তু হুথিদের হামলা থামেনি। মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার'এর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল মার্ক মিগেজ 'সিক্সটি মিনিটস'কে বলছেন যে, হুথিদের কৌশল যথেষ্টই পরিশীলিত। তারা দেখেছেন যে, হুথিরা একটা ড্রোন উড়িয়েছে, যার মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিটের মাঝেই একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। অর্থাৎ এই ড্রোনের পাঠানো তথ্যের মাধ্যমে হুথিরা তাদের টার্গেটিংকে শক্তিশালী করেছে।
মার্কিন মিডিয়া 'সিবিএস' মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার 'কারনি'র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানায় যে, জাহাজটা উত্তর লোহিত সাগরে থাকার সময় ৫০টা ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করেছিলো; যেগুলি হয় ইস্রাইল বরাবর যাচ্ছিলো, অথবা অন্য কোন বাণিজ্য জাহাজ লক্ষ্য করে এগুচ্ছিলো। এই ৫০টার মাঝে ৪৫টাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় বলে উল্লেখ করে তারা। তবে এর মাঝে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ছিলো সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং। কারণ এগুলি শব্দের গতির চাইতে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি দ্রুত এবং মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড সময় পাওয়া যায় এগুলিকে মোকাবিলা করার। আকাশে অনেক বেসামরিক বিমান থাকার কারণে এগুলিকে ধ্বংস করার আগে জাহাজের কমান্ডারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে টার্গেটটা আসলেই শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র। মিশনের মাঝেই 'কারনি' জাহাজটাকে বন্দরে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়েছিলো; অন্য কথায় বলতে গেলে হাজার ডলারের ড্রোন ধ্বংস করতে গিয়ে তাদের মিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্রের স্টক ফুরিয়ে গিয়েছিলো। জাহাজের কমান্ডার বলছেন যে, তার জাহাজের খুব কাছাকাছি বা সাড়ে ৭কিঃমিঃএর মাঝে কোন ক্ষেপণাস্ত্রকে তারা আসতে দেননি।
'সিবিএস'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, 'কারনি'র সাথে বেশ কয়েকটা পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজ লোহিত সাগরে মোতায়েন থাকলেও তারা বাণিজ্য জাহাজের উপর হামলা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। রিয়ার এডমিরাল কুপার 'সিক্সটি মিনিটস'কে বলছেন যে, ইরানের সহায়তা ছাড়া হুথিরা এসকল হামলা করতে পারতো না। হুথিদেরকে সরাসরি সহায়তা করছে ইরানের 'আইআরজিসি'র সদস্যরা। কিন্তু তাদের এই সহযোগিতার বিরুদ্ধে কিছু করা হবে কিনা, সেটা সরকারের রাজনৈতিক নীতিগত সিদ্ধান্ত। 'বিজনেস ইনসাইডার' বলছে যে, মার্কিন নেতৃত্বে থাকা পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একদিকে যেমন হুথিদেরকে আক্রমণ বন্ধ করার ব্যাপারে প্রভাবিত করা যায়নি; তেমনি তাদের লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা করার সক্ষমতাও বহাল রয়েছে। হুথিরা বহুদিন সৌদিদের সাথে যুদ্ধ করার পর বিমান আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছে। আর পশ্চিমাদেরও সংঘাত বাড়িয়ে ইরানকে জড়িতে করার রাজনৈতিক ইচ্ছা নেই বলেই হুথিদের বিরুদ্ধে আক্রমণগুলিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে করা হচ্ছে।
হুথি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করার পশ্চিমা সক্ষমতা আসলে কতটুকু?
মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল 'ফক্স নিউজ'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২৪এর জানুয়ারিতে মার্কিন নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো স্বীকার করে যে, তারা হুথিদের ছোঁড়া জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে 'স্ট্যান্ডার্ড এসএম-৬' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। সামরিক ম্যাগাজিন 'দ্যা ওয়ার জোন'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এর আগ পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনী কেবল 'এসএম-২' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে স্বীকার করেছিলো। 'এসএম-৬' এমন একটা প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র, যা কিনা শত্রুর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে 'টার্মিনাল' বা শেষ পর্যায়ে ধ্বংস করতে পারে; অর্থাৎ যখন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিচের দিকে পড়ন্ত অবস্থায় থাকে। এই অবস্থায় একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করা বেশ কষ্টসাধ্য। ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে অত্যাধুনিক এবং সবচাইতে দামি। অপরদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর আরেকটা প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র হলো 'এসএম-৩', যা কিনা শুধুমাত্র মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। 'এসএম-৩' শত্রুর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে এমন পর্যায়ে ধ্বংস করে, যখন সেটা 'মিড কোর্স' বা আকাশে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। যেসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্বল্প পাল্লার বা আকাশে খুব বেশি একটা উপড়ে ওঠে না, সেগুলিকে 'এসএম-৩' দ্বারা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এধরণের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে রয়েছে জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; যেগুলি হুথিরা বাণিজ্য জাহাজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।
আর মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যবহার করা কয়েক দশকের পুরোনো প্রযুক্তির 'এসএম-২' প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র 'টার্মিনাল' বা শেষ পর্যায়ে একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার সীমিত ক্ষমতা রাখে। মার্কিনীরা কেন তাদের সবচাইতে দামি ক্ষেপণাস্ত্র (‘এসএম-৬') ব্যবহার করে হুথিদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে, সেটা পরিষ্কার নয়। তবে প্রশ্ন আসতেই পারে; কারণ এর আগে 'এসএম-২' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম বলেই বলা হয়েছিলো। তথাপি ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটা ডেস্ট্রয়ার রক্ষা করতে যদি এহেন অস্ত্র ব্যবহার করতেই হয়, তাতে কারুর কিছু বলার কথা নয়। 'বিজনেস ইনসাইডার'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, লোহিত সাগরেই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুদ্ধজাহাজের 'ফ্যালাংস ক্লোজ ইন ওয়েপন সিস্টেম' বা 'সিআইডব্লিউএস' ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ২০মিঃমিঃ একটা কামান, যা মিনিটে কয়েক হাজার রাউন্ড গুলিবর্ষণ করতে সক্ষম। এটা একটা যুদ্ধজাহাজের প্রতিরক্ষার সর্বশেষ স্তর। যেহেতু জাহাজের সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে হয়েছিল, কাজেই বলা যায় যে, সেটা খুবই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি ছিল। কারণ জাহাজের ক্রুরা দেখেছে যে, শেষ রক্ষার এই অস্ত্রটা তখনই ব্যবহার করতে হয়েছে, যখন জাহাজের বাকি অস্ত্রগুলি শত্রুর সেই ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মার্কিন নৌবাহিনীর 'সারফেস ওয়ারফেয়ার ডিভিশন'এর ডিরেক্টর রিয়ার এডমিরাল ফ্রেড পাইল মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সাথে এক সাক্ষাতে ইয়েমেনের উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতার ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি স্বীকার করেন যে, হুথিদের স্বল্পমূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ঠেকাতে মার্কিনীরা দশ গুণ বেশি মূল্যমানের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে। এডমিরাল পাইল বলেন যে, তার কাছে তার জাহাজের নাবিকদের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। তাই এখানে কত মূল্যের অস্ত্র দিয়ে কত মূল্যের আক্রমণ ঠেকাতে হচ্ছে, সেটা তিনি হিসেব করতে চান না। তবে তিনি এ-ও বলেন যে, স্বল্প খরচে এধরণের আক্রমণ ঠেকাবার চেষ্টা তারা করে যাচ্ছেন; যা অপারেশনাল গোপনীয়তার কারণে তিনি আলোচনা করতে চান না। মার্কিন ডেস্ট্রয়ারগুলি একেবারে শেষ প্রতিরক্ষা হিসেবে তাদের ২০মিঃমিঃ 'ফ্যালাংস ক্লোজ ইন ওয়েপন সিস্টেম' বা 'সিআইডব্লিউএস' ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে, এমন খবরের ব্যাপারে তিনি বলেন যে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলিতে অনেকগুলি প্রতিরক্ষার স্তর রয়েছে; যার মাঝে 'এসএম-৬', ‘এসএম-৩' ক্ষেপণাস্ত্র জাহাজের সবচাইতে দূরে গিয়ে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে ঘায়েল করে। এরপর রয়েছে 'সী স্প্যারো' ক্ষেপণাস্ত্র; এরপর রয়েছে 'রোলিং এয়ারফ্রেম মিসাইল'; আর সর্বশেষ স্তরে রয়েছে 'সিআইডব্লিউএস'। এছাড়াও মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বিমানগুলিও হুথি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছে। এখানে একটা স্তর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আরেকটা স্তর কাজ করবে। যদি হুথিদের কোন ক্ষেপণাস্ত্র শেষ স্তর পর্যন্ত চলে আসতে সক্ষম হয়, তাহলেও সমস্যা নেই; কারণ সেই হুমকিকে সফলভাবে মোকাবিলা করা গিয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করে বলেন যে, এতকাল মার্কিন নৌবাহিনী যে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়নি তা হলো, একটা জাহাজের প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শেষ হয়ে গেলে কি করতে হবে। এই ব্যাপারটা এখন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ সমুদ্রে থাকা অবস্থায় 'ভার্টিক্যাল লঞ্চ সিস্টেম'এর সেলগুলির মাঝে ক্ষেপণাস্ত্র রি-লোড হয়েছে। তবে এই পদ্ধতি এখনও অপারেশনাল হয়নি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে মার্কিন নৌবাহিনীতে মনুষ্যবিহীন যুদ্ধজাহাজের ব্যবহারের কথা তিনি উল্লেখ করেন। এসব মনুষ্যবিহীন জাহাজ অতিরিক্ত ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করবে; যেগুলি ডেস্ট্রয়ার থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ফায়ার করা যাবে। এতে সমুদ্রে বহণ করা ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
লোহিত সাগরের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাচ্ছে?
ব্রিটিশ সামরিক বিশ্লেষক মাইকি কে 'বিবিসি'কে বলছেন যে, পশ্চিমারা এখনও বহু ড্রোন একত্রে হামলা করলে সেগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সক্ষমতা রাখে না। ইয়েমেনের হুথিদের ছোঁড়া ড্রোন ধ্বংস করতে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের 'টাইফুন' যুদ্ধবিমান দু'টা 'এএসআরএএএম' বা 'এসর্যাম' ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল; যেগুলির একেকটার মূল্য আড়াই লক্ষ ডলারের বেশি। এই বিমানগুলি হয়তো একত্রে ৪টার বেশি এই ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারবে না। কিন্তু আকাশে যদি ২০টা ড্রোন থাকে, তাহলেই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। তিনি 'কাউন্টার রকেট আর্টিলারি মর্টার' বা 'সি-র্যাম' নামের এক প্রকারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন; যা সেকেন্ডে অনেকগুলি বুলেট ছুঁড়ে দেয়ার মাধ্যমে আকাশে আক্রমণকারী বস্তুকে ধ্বংস করতে সক্ষম। তবে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার প্রতিরক্ষার জন্যেই মোতায়েন করা সম্ভব; সকল স্থানে নয়। তবে সামনের দিনে লেজার অস্ত্র বেশি গুরুত্ব পাবে। কারণ লেজারের মাধ্যমে একসাথে বহু ড্রোনকে টার্গেট করা সম্ভব।
লোহিত সাগরের সংঘাত বন্ধে মার্কিনীরা এবং ইউরোপিয়রা একে অপরকে ঠেলছে। মার্কিনীরা বলছে যে, লোহিত সাগরের সংঘাত ইউরোপের বেশি ক্ষতি করছে। কিন্তু মার্কিনীরা আবার একদিকে যেমন ইস্রাইলকে গাজা এবং লেবাননে হামলা থেকে নিবৃত করছে না, অপরদিকে সংঘাতকে ছড়িয়ে ইরানকেও সরাসরি জড়াতে চাইছে না। এক বছর হয়ে গেলো মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখতে বাধ্য হচ্ছে; অথচ ওয়াশিংটনের ধোঁয়াশা নীতির মাঝেই হুথিরা লোহিত সাগরের বাস্তবিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ‘ভোক্স'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে এবং এর ফলাফলস্বরূপ দুর্ভিক্ষে সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গৃহযুদ্ধ শেষে হুথিদের অধীনে ইয়েমেনের পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। এরপরেও হুথিরা যে সফলভাবে জনগণের আবেগকে পুঁজি করতে পেরেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুরো ইয়েমেন জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা সমর্থন করে বিশাল জনসমাবেশ দৃশ্যমান হয়। লোহিত সাগরে হামলা ইয়েমেনের জনগণের বাস্তবতাকে উন্নতির দিকে না নিলেও হুথিদের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ‘বিজনেস ইনসাইডার'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, লোহিত সাগরের সংঘাতে ব্যালান্স অব পাওয়ারে এগিয়ে রয়েছে হুথিরাই। কারণ কৌশলগত অবস্থানের কারণে হুথিরা নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতাও রয়েছে যথেষ্ট। আর হুথিদের সক্ষমতাকে ধ্বংস করতে হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে; যার রাজনৈতিক সদিচ্ছা পশ্চিমাদের কারুরই নেই।
No comments:
Post a Comment