৩০শে সেপ্টেম্বর ভোরে ইস্রাইল ইয়েমেনে হামলা করে। 'সিএনএন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইলের 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান আকাশ-থেকে-আকাশে রিফুয়েলিংএর মাধ্যমে প্রায় দু'হাজার কিঃমিঃ দূরত্বে ইয়েমেনের হুথিদের হাতে থাকা হোদেইদা বন্দরে বোমাবর্ষণ করে। ইস্রাইলি বাহিনী যখন গাজায় হামলা বন্ধের ঘোষণা না দিয়েই লেবাননে ব্যাপক হামলা শুরু করেছে, তখন ইয়েমেনে এই হামলা সংঘাতকে আঞ্চলিক রূপ দিচ্ছে। ইস্রাইল বলছে যে, তারা সংঘাতকে ছড়িয়ে দিতে চায় না। কিন্তু কেউ যদি ইস্রাইলে হামলার চেষ্টা চালায়, তাহলে সে যেখানেই থাকুক, তার বিরুদ্ধে ইস্রাইল ব্যবস্থা নেবে। ২৮শে সেপ্টেম্বর ইস্রাইল ঘোষণা দেয় যে, তারা হিযবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে। এই ঘটনার পর থেকে অনেকেই আলোচনা করছেন যে, সামনের দিনগুলিতে ইস্রাইল, হিযবুল্লাহ এবং ইরান কে কি পদক্ষেপ নিতে পারে।
‘বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, হিযবুল্লাহ হয়তো তার নেতৃত্বের হত্যার পর কিছুটা বিচলিত থাকবে। বিশেষ করে কিছুদিন আগেই হিযবুল্লাহর যোগাযোগ যন্ত্রপাতির উপর ইস্রাইলি হামলার পর হিযবুল্লাহ নিজেদের গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিতে পারে। তাদের মাঝে অনেকেই চাইবে তাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ইস্রাইলের বোমা হামলায় ধ্বংস হবার আগেই ইস্রাইলের শহরগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। কিন্তু সেটা করলে ইস্রাইলের প্রতিশোধ হবে আরও বেশি ভয়াবহ। বিশেষ করে ইস্রাইল লেবাননের শহর এবং অবকাঠামোর উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে; এমনকি ইরানের উপরেও হামলা করে বসতে পারে।
‘বিবিসি' বলছে যে, হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার পরপরই ইরান আয়াতুল্লাহ খামেনিকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। খুব সম্ভবতঃ তাদের একটা ভয় কাজ করছে যে, ইস্রাইল হয়তো খামেনিকেও হত্যার চেষ্টা করে ফেলতে পারে। তবে প্রায় দুই মাস হয়ে গেলো, ইরান এখনও পর্যন্ত গত ৩১শে জুলাই হামাস নেতা ইসমাঈল হানিয়াকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়নি। তবে নাসরাল্লাহর হত্যার পর তেহরানে কট্টরপন্থীরা কিছু একটা করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করতে থাকবে। যদি ইরান কিছু একটা করতেই যায়, সেটা হয়তো তার আঞ্চলিক প্রক্সিদের মাধ্যমেও করতে পারে। এই প্রক্সিদের মাঝে হিযবুল্লাহ ইতোমধ্যেই যুদ্ধের মাঝে রয়েছে। ইয়েমেনের হুথিদের সাথেও থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে পশ্চিমাদের। এছাড়াও ইরাক এবং সিরিয়াতেও ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া রয়েছে। তবে 'বিবিসি' বলছে যে, ইরান যা-ই করুক না কেন, এটা ইস্রাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর চাইতে কম কিছু হবে; কারণ তারা জানে যে, সেই যুদ্ধ তারা জিততে পারবে না।
হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার কয়েকদিন আগেই ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন যে, ইরান যুদ্ধ চায় না; শান্তি চায়। ইরান পুরো অঞ্চলে অস্থিরতার কারণ হতে চায় না। তিনি বলেন যে, যুদ্ধ যদি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কেউই তা থেকে লাভবান হবে না। শুধু ইস্রাইলই চায় পুরো অঞ্চল জুড়ে যুদ্ধ হোক। একইসাথে তিনি ইস্রাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পশ্চিমা দেশগুলির দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করেন। তবে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে ইরান যে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক, তা তিনি পরিষ্কার করেছেন। পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ইরান যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলির সাথে স্বাক্ষরিত ২০১৫ সালের চুক্তিতে ফেরত যেতে চায়; যেই চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে গিয়েছিল।
মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'আটলান্টিক কাউন্সিল'এর এক লেখায় বলছেন যে, হিযবুল্লাহ হলো ইরানের জন্যে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো; যার আকাশ, ভূমি এবং সমুদ্রে হামলা করার সক্ষমতা রয়েছে; এবং যা ইস্রাইলের কয়েক মাইলের মাঝে অবস্থিত। হিযবুল্লাহ হলো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা থেকে ইস্রাইল দূরে রাখার জন্যে সবচাইতে বড় ডিটারেন্স। আর এই ডিটারেন্স এখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে!
‘দ্যা আটলান্টিক' পত্রিকার এক বিশ্লেষণে আরাশ আজিজি বলছেন যে, তেহরানে হামাসের নেতা হানিয়াকে হত্যার পর থেকেই আয়াতুল্লাহ খামেনি "কৌশলগত ধৈর্য্য"-নামে এক নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছেন; যার মাধ্যমে ইরান সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে ইস্রাইলের আশেপাশের মিলিশিয়াদেরকে প্রস্তুত করছে। নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে খামেনি তার নীতি পরিবর্তন করবেন কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বৈরুতে ইরানের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে যে, ‘খেলার নিয়ম পরিবর্তন হয়ে গেছে'। কিন্তু তেহরান থেকে যেসব বার্তা আসছে, তা কিন্তু এত শক্ত নয়। তাদের মাঝে কেউ কেউ বলছেন যে, যখনই হিযবুল্লাহর কোন নেতার মৃত্যু হবে, তখনই তার স্থলে অন্য কেউ জায়গা নেবে। ইরানের পক্ষ থেকে বড় কোন হুমকি না আসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধ নেবার অপশন খুব বেশি একটা নেই। আর যদি ইস্রাইলের বেশি ক্ষতি করতেই হয়, তাহলে ইরানের নিজস্ব অবকাঠামো ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে; যা নতুন করে তৈরি করতে কয়েক দশক লেগে যাবে। দ্বিতীয়তঃ ইরানের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়ে শান্তির কথা বলেছেন। ইরান চাইছে, যেন পশ্চিমারা ইস্রাইলকে বাধা দেয়, যাতে করে ইস্রাইলিরা সংঘাতকে আঞ্চলিক রূপ দিতে না পারে। ইরানের এই কথাগুলি হিযবুল্লাহ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতার কথা থেকে বেশ আলাদা; যিনি বলেছেন যে, ইস্রাইলের সাথে সংঘাতের এখন কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না। ইরান চাইছে, যাতে ইরানের উপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে ইরান বিভিন্নভাবে পশ্চিমাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বলছে। একই লক্ষ্যে বাস্তবায়নে ইরানের বর্তমান উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানকে সমর্থন দিয়ে খামেনি তার দেশের কট্টরপন্থীদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।
‘বিবিসি' বলছে যে, ইস্রাইল চাইছে নিজেকে হিযবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু লেবাননের অভ্যন্তরে না ঢুকে ইস্রাইল কিভাবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে, তা মোটেই বোধগম্য নয়। ইস্রাইলের সেনাবাহিনী লেবাননের সীমান্তে ট্রেনিং নিচ্ছে বলে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। হিযবুল্লাহও গত ১৮ বছর ধরে ইস্রাইলের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্যে ট্রেনিং নিচ্ছে। ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর জন্যে লেবাননে প্রবেশ করাটা সহজ; কিন্তু বের হওয়াটা খুব একটা সহজ হবে না; অর্থাৎ বেশ কয়েক মাস লেগে যেতে পারে; যেমনটা গাজার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। 'দ্যা আটলান্টিক'এর বিশ্লেষণে আরাশ আজিজি বলছেন যে, ইরান যদি হিযবুল্লাহকে রক্ষার জন্যে নিজেকে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ায়, তাহলে নেতানিয়াহু হয়তো এই সুযোগে হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরও এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতে পারেন। তবে এতে ইরানের প্রক্সিগুলি, বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের মিলিশিয়ারা হিযবুল্লাহর পক্ষে যুদ্ধে জড়াতে ইরানকে অনুরোধ করতে পারে।
মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস বলছেন যে, কেউ কেউ যখন বলছেন যে, ইস্রাইল নাসরাল্লাহকে হত্যার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়নি, তখন প্রশ্ন করা উচিৎ যে, ইস্রাইল কেন জানাবে? ইস্রাইল কখনোই এই ব্যাপারগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়না। সকলেই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ করবে, যাতে ইস্রাইল সেটা না করে। এর উপর আবার রয়েছে অপারেশনাল সিকিউরিটির ব্যাপার; ইস্রাইল যুক্তরাষ্ট্রকে জানালে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইস্রাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা এমনই – যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ইস্রাইলের খুব কাছে থেকে সমর্থন দিয়ে যেতে থাকবে। পলিমেরোপলাস-এর কথাগুলি ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনাতে ইস্রাইল কিভাবে সংঘাতকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে। অপরদিকে ইরান যে তার নিজস্ব স্বার্থ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবরোধকে তুলে নেয়ার ব্যাপারটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, তার প্রমাণ হিসেবে খামেনির "কৌশলগত ধৈর্য্য"র নীতিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। একারণেই ইস্রাইল যখন সারা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন ইরান শান্তির কথা বলছে। হামাস নেতা হানিয়ার হত্যার পর নাসরাল্লাহর হত্যার ঘটনা ইরানের কট্টরপন্থীদের উত্তেজিত করলেও তা ইরানের বাস্তবতা-ভিত্তিক চিন্তাকে পরিবর্তন করে ফেলার মতো শক্তিশালী না-ও হতে পারে।
2006 সালের যুদ্ধে তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও ইসরায়েল সাহস পাচ্ছে কীভাবে
ReplyDelete১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইস্রাইলের ৭৭৬ থেকে ৯৮৩ জন নিহত হয়েছে; ৪,৫১৭ জন হয়েছিল আহত। ইস্রাইলের নিজস্ব হিসেবে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ২,৫০০-২,৮০০ ইস্রাইলি মারা গেছে; আর ৮,৮০০ আহত হয়েছে। ইস্রাইলের অফিশিয়াল হিসেবে ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে ইস্রাইলের ৬৫৪ জন মারা গেছে এবং ৩.৮৮৭ জন আহত হয়েছে। এরপর ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে ইস্রাইলের অফিশিয়াল হিসেবে ১২১ জন মারা গেছে এবং ১,২৪৪ জন আহত হয়েছে। আর সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালের গাজা যুদ্ধে ইস্রাইলের নিজস্ব হিসেবে ৯১৬ জন বেসামরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৯১ জন নিহত হয়েছে। এছাড়াও ১৩,০০০এর বেশি আহত এবং ২৫১ জন জিম্মি হয়েছে।
Deleteযদি শুধুমাত্র ইস্রাইলের অফিশিয়াল হিসেবই ধরা হয়, তাহলে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ ইস্রাইলের জন্যে সবচাইতে মারাত্মক যুদ্ধ ছিল না। আর ২০২৩-২৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর লেবাননে হামলা করাটা ইস্রাইলের জন্যে ভীতির কথা হবার কথা নয়। ইস্রাইলের কতজন মৃত্যুবরণ করেছে বা আহত হয়েছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। কারণ ইস্রাইল সাধারণ জনগণকে সামরিক বাহিনীতে ডাক না দিয়ে যুদ্ধ করতে পারে না; তার জনসংখ্যা কম। কয়েক'শ মানুষের মৃত্যু ইস্রাইলের জন্যে অনেক বড় একটা বিষয়। ইস্রাইলে জনমত অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; যা ঠিকমতো না বুঝতে পারলে সরকারের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। মূলতঃ ইস্রাইলের সকল সরকারই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে নিরাপত্তা নিয়ে ক্রাইসিস তৈরি করেছে এবং কারণে অকারণে যুদ্ধ করেছে। ইস্রাইলের অর্থনীতিও যুদ্ধ-নির্ভর। তাদের মূল রপ্তানি পণ্য হলো নিরাপত্তা পণ্য। যুদ্ধ হলে তাদের নিরাপত্তা কোম্পানিগুলির শেয়ারের মূল্য বেড়ে যায় এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হয়; যুদ্ধ না হলে অর্থনীতি পড়ে যায়।
আর পশ্চিমারা (১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এবং ১৯৬৭ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র) ইস্রাইলকে সর্বদাই সরাসরি ইন্ধন যুগিয়েছে। তারা ইস্রাইলকে আর্থিক, সামরিক এবং নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। ইস্রাইলের নিয়মিত গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে পশ্চিমারা নিশ্চিত করেছে, যাতে করে মুসলিমরা সারাজীবন ইস্রাইলকেই তাদের প্রধান শত্রু ভেবে যুদ্ধ করে যায়; পশ্চিমাদেরকে শত্রু মনে না করে।
ইরান এখনো কেন নিজের এয়ার ডিফেন্স ডেভেলপ করতে পারে নি এবং তাদের প্রক্সিরাও?? আপনি কি মনে করেন এই যুদ্ধ আরো ছড়িয়ে পড়বে??
ReplyDelete১৯৮০ সালে যখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ইরানের বিমান বাহিনীতে ছিল ৭৭টা 'এফ-১৪এ টমক্যাট' এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটার, ১৬৬টা 'এফ-৪ডি/ই' মাল্টিরোল ফাইটার, ১৬৬টা 'এফ-৫ই/এফ' লাইট ফাইটার, 'কেসি-৭০৭' এয়ার রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার, 'বোয়িং-৭৪৭' এবং 'বোয়িং-৭০৭' স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট বিমান। ইরানের এই বিমান বাহিনী তৈরি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে। যুক্তরাষ্ট্র গ্রাউন্ড-বেজড এয়ার ডিফেন্সে খুব কমই বিনিয়োগ করে। তারা সর্বদাই ইতালিয়ান জেনারেল গিউলিও দুহে-এর কৌশল অবলম্বন করে আসছে; যা হলো আক্রমণাত্মক বিমান বাহিনীতে পুরোপুরিভাবে বিনিয়োগ করা; আর ডিফেন্সিভ জিনিসে বিনিয়োগ করে সম্পদ অপচয় না করা। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তৈরি হয়েছিল বলে ইরানের বিমান বাহিনীও সেরকমই ছিল।
ReplyDeleteতবে ইরাকের সাথে লম্বা যুদ্ধের পর ইরানের বিমান বাহিনী আগের শক্তি কিছুটা হলেও হারায়; বিশেষ করে যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের মাঝে মেইনটেন্যাস নিয়ে ইরানের সমস্যাগুলি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এর ফলশ্রুতিতে ইরানের বিশাল শক্তিশালী বিমান বাহিনীর কর্মক্ষমতা দিনদিন কমে যেতে থাকে। আর প্রযুক্তিগতভাবে ইরানের তেমন সক্ষমতা না থাকার কারণে এই অত্যাধুনিক বিমানগুলিকে আপগ্রেড করা বা এগুলির জন্যে নতুন অস্ত্র ডেভেলপ করা ইরানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। একারণে গত কয়েক দশকে ইরানের বিমান বাহিনী সংখ্যা এবং প্রযুক্তির দিক থেকে বেশ দুর্বল হয়ে গেছে।
গ্রাউন্ড-বেজড এয়ার ডিফেন্স ইরান বেশ কিছুটা ডেভেলপ করেছে। তবে এখানে সমস্যা হলো প্রযুক্তির প্রাপ্যতা। রাশিয়া এবং চীন ছাড়া আর কারুর পক্ষে ইরানকে এয়ার ডিফেন্স অস্ত্র দেয়ার সক্ষমতা রাখে না। এই দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রে সাথে সম্পর্ক ব্যালান্স করেই তবে ইরানের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। এর ফলে ইরান গ্রাউন্ড-বেজড এয়ার ডিফেন্সের ক্ষেত্রে খুব বেশি একটা এগুতে পারেনি। ফাইটার বিমানের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটাই ঘটেছে।
ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হবার কারণেই ইরান ইস্রাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে ভয় পায়। কারণ ইস্রাইল ছুতো খুঁজছে ইরানের উপর বিমান হামলা করার। জর্দান, ইরাক এবং সৌদি আরব তো ইস্রাইলকে বাধা দেবে না তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে। কাজেই ইরান জানে যে, ইরানের ভূখন্ডে ইস্রাইলের বিমান হামলার ফলাফল কি হতে পারে।
এই কমেন্ট লেখার সময়েই ইরান ইস্রাইলে কয়েক'শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে; যার অনেকগুলিই গ্রাউন্ডে সরাসরি হিট করেছে বলে ভিডিও ফুটেজে দেখে মনে হয়েছে। কাজেই এখন দেখতে হবে যে, ইস্রাইল এই হামলাকে ইরানের ভূখন্ডে হামলার ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে কিনা। যেটা বলেছি যে, ইস্রাইল ছুতো খুঁজছে। আর লেখাতেই বলা হয়েছে যে, ইস্রাইল ইতোমধ্যেই পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতকে ছড়িয়ে দিয়েছে; যা যুক্তরাষ্ট্র থামাতে পারেনি, যদি ওয়াশিংটন থামাতে চেয়েও থাকে। তবে এটা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্রয়েই ইস্রাইল এহেন অবাধ্য শিশুর মতো আচরণ করে যাচ্ছে গত কয়েক দশক ধরে।
চীন নিজেকে ডেভেলপ করতে পারলেও, ইরানের ক্ষেত্রে কেন হয় নি এরকমটা??
ReplyDeleteউভয়ের ক্ষেত্রেই পশ্চিমারা এই দেশগুলিকে কিভাবে দেখেছে, সেটার উপর নির্ভর করছে কে কি করতে পারবে। পশ্চিমারা ইরানকে দেখেছে তেলের খনি হিসেবে; আর চীনকে দেখেছে সস্তা শ্রমের খনি হিসেবে। সুতরাং তারা এই দেশে ভিন্ন রকমের বিনিয়োগ করেছে।
Delete১৯৭৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইরানে ব্যাপকভাবে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে; যাতে করে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারে। ১৯৭৯ সালের পর থেকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বার্থের বিপক্ষে গিয়েছে; তাই তাদেরকে অর্থনৈতিক অবরোধে পড়তে হয়েছে। অপরদিকে ১৯৮০-এর দশক থেকে দেং জিয়াও পিং-এর সময় থেকে চীন যখন নিজেদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাকে জ্বলাঞ্জলি দিয়ে পুঁজিবাদী চিন্তাকে নিজের করে নিতে থাকে, তখন পশ্চিমারা চীনকে দেখেছে স্বস্তা শ্রমের উৎস হিসেবে। একারণে পশ্চিমারা চীনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, যাতে করে পশ্চিমারা কম মূল্যে বেশি বেশি করে পণ্য কিনতে পারে। এতে কিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে ব্যাপকভাবে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। চীনও যখন রপ্তানি করার মাধ্যমে প্রচুর কাঁচা অর্থ পেতে শুরু করে, তখন তারাও তাদের দেশে বিনিয়োগ শুরু করে। একসময় চীনা সরকারও পশ্চিমাদের মত ঋণের উপর নির্ভর করে ব্যাপকভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে থাকে। এভাবে পশ্চিমা দেশগুলির উপর ভর করে চীন একদিকে তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে; অপরদিকে পশ্চিমা কোম্পানিগুলি ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে।
এখন চীনের ক্ষেত্রে আলাদা যে ব্যাপারটা হয়েছে তা হলো, ২০০০ সালের পর থেকে চীন ধীরে ধীরে তার সামরিক শিল্পকে ডেভেলপ করতে শুরু করে। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত দিক থেকে চীন অনেক বেশি অগ্রগামী হতে থাকে। এর মুল কারণ হলো, পশ্চিমারা চীনে বিনিয়োগ করার সময় চীন অনেক প্রযুক্তি এমনিতেই পেয়ে গিয়েছে। পশ্চিমাদের চাহিদার উপর ভিত্তি করেই চীনের শিপবিল্ডিং সেক্টর দুনিয়ার প্রথম তিনটা দেশের একটা হয়েছে। প্রযুক্তি পণ্যের (যেমন মোবাইল ফোন) দিক থেকে চীন দুনিয়ার এক নম্বর উৎপাদনকারী দেশ। এরপর আরও কিছু প্রযুক্তি পরবর্তীতে চীনারা চুরিও করেছে পশ্চিমাদের থেকে। যখন চীনারা তাদের বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষায় নৌবাহিনীর উন্নয়ন করা শুরু করে, তখনই চীন পশ্চিমাদের শত্রু হয়ে যায়। যতদিন চীনের সেনাবাহিনী দুনিয়ার সবচাইতে বড় সেনাবাহিনী ছিল, ততদিন চীন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ছিল না। কিন্তু যখনই চীন এয়ার ডিফেন্স ডেস্ট্রয়ার, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এবং স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরি করা শুরু করলো, তখনই চীন যুক্তরাষ্ট্রে এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গেলো।
এখানে যে ব্যাপারটা বুঝতে হবে তা হলো, পশ্চিমারা দুনিয়ার শ'দুয়েক রাষ্ট্রকে কি চোখে দেখে, সেটার উপরেই অনেকটা নির্ভর করবে সেই দেশ কতটা এগুতে পারবে বা কি কি করতে পারবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, পশ্চিমারা কোন ভুল করে না। কারণ পশ্চিমাদের ভুলের কারণেই চীনের হাতে প্রযুক্তি গেছে; আর পশ্চিমাদের ভুলের কারণেই চীন এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবাহিনীর মালিক।
এব্যাপারে আরও কিছু ধারণা পেতে স্যামুয়েল হান্টিংটনের চিন্তা নিয়ে নয় বছর আগের এই লেখাটা পড়তে পারেন -
https://koushol.blogspot.com/2015/09/huntington-bangladesh.html
একটি বিষয় কখনোই বুঝে উঠতে পারি না ইরান কেন সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেলিজেন্সকে জানিয়ে হামলা করে।গ্লোবাল নিউজে দেখলাম আগে থেকেই প্রেডিকশন করে রাখছে।এর আগেও কাশেম সুলাইমানি হত্যার পরে স্বকথিত প্রতিশোধ নিতে মার্কিনদের ঘাটিতে এটাক করে জানিয়ে রেখে, এর উদ্দেশ্যই বুঝলাম না??
ReplyDeleteআশ্চর্যের বিষয় যুক্তরাষ্ট্র তা এলাউ করছে আবার ইস্রাইল আগে থেকেই সব কিছু সরিয়ে নিরাপওা স্থানে জায়গা করে দিয়েছে।
আর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশেষ করে ব্রিটেন ইরানকে কে কি হিসেবে ট্রিট করতে চায়?
আপনি যদি এই ব্লগে ইরানের উপর লেখাগুলি পড়ে থাকেন, তাহলে জেনে থাকবেন যে, ইরানের বর্তমান প্রধান লক্ষ্য হলো তার নিজের উপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ ওঠানো। এই লক্ষ্যকে সমস্যায় না ফেলার জন্যেই ইরান পশ্চিমা দেশগুলির সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে চায়। আর যখন জনমতের চাপে ইরানকে কিছু একটা করতেই হবে, তখন ইরান এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা কিনা ইস্রাইল বা পশ্চিমা স্বার্থের খুব বেশি ক্ষতি না করে। ক্ষয়ক্ষতি কমাবার জন্যেই ইরান আগে থেকে ওয়ার্নিং দেয়। ইস্রাইল এবং পশ্চিমা দেশগুলি নিজেদের মানুষের জীবনকে খুব বেশি মূল্য দেয়; যা ইরান জানে। এই দেশগুলির মানুষকে হত্যা করলে তারা অনেক বড় আকারের প্রতিশোধ নিতেও প্রস্তুত থাকে। আর ইরান কখনোই চায় না যে, ইস্রাইল বা পশ্চিমারা এমন কোন প্রতিশোধ নিক, যা কিনা ইরানের পুরো অবকাঠামো ধ্বংস করে ফেলে।
Deleteআর ইরান সম্পর্কে ওয়াশিংটন এবং লন্ডনের চিন্তার পার্থক্যটা এই লেখায় পাবেন -
https://koushol.blogspot.com/2021/11/what-is-irans-goal.html