Sunday, 16 February 2025

পশ্চিমা জোটে ভাঙ্গনের লক্ষণ…

১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের মাঝে আদর্শিক ফাটল এখন দৃশ্যমান। বাকস্বাধীনতা কতটুকু থাকবে, ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে বাকস্বাধীনতা সাংঘর্ষিক কিনা, লাগামহীন যৌনাচারের স্বাধীনতা থাকবে কিনা, গর্ভপাতের ব্যাপারটাকে কে কিভাবে দেখবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কে অংশ নিতে পারা বা কে ক্ষমতায় আসতে পারবে বা পারবে না, সেটার মাপকাঠি কি হবে, ইত্যাদি আদর্শিক ইস্যুতে পশ্চিমারা আজ বিভক্ত। 


১৪ই ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে ইতিহাস রচিত হয়েছে। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স তার ভাষণে পশ্চিমাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে নতুন এক মাপকাঠিতে দাঁড় করিয়েছেন। সকল প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলে ভ্যান্স ইউরোপের দেশগুলির আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলির জন্যে প্রধান নিরাপত্তা হুমকি রাশিয়া বা চীন বা অন্য কোন দেশ নয়; বরং তা হলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ আদর্শিক সমস্যা। তিনি বলেন যে, পশ্চিমা রাজনীতিকেরা জনগণের কথা শুনছে না। তিনি বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোন 'ফায়ারওয়াল' না তোলার আহ্বান জানান; এবং বলেন যে, বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে পশ্চিমাদের হয় নীতি মেনে চলা উচিৎ অথবা পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করা উচিৎ। তিনি রাজনীতিকদেরকে জনগণের কথা মেনে নেয়ার আহ্বান জানান; এমনকি জনগণ রাজনীতিকদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করলেও। ভ্যান্স ব্রিটেনে গর্ভপাতের অধিকারকে সমুন্নত রাখতে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাসের অধিকারকে পদদলিত করার কথা উল্লেখ করেন। তিনি পুরো ইউরোপে বাকস্বাধীনতার ঘাটতি নিয়ে অনেকগুলি উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি ব্রাসেলসে ইইউ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, যেখানে বলা হয়েছে যে, ইন্টারনেটে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা ছড়ালে বিশৃংখলা বন্ধে ইইউ সোশাল মিডিয়া বন্ধ করে দিতে হতে পারে। ইন্টারনেটে ফেমিনিস্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে পোস্ট করায় পুলিশ নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে। তিনি সুইডেনে কুরআন পোড়ানোর অভিযোগে একজন খ্রিস্টানকে অভিযুক্ত করার ব্যাপারটা তুলে ধরে সেই দেশে বাকস্বাধীনতা না থাকার সমালোনা করেন। তিনি ইউরোপের প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলির মতের সাথে মিল না হওয়া একটা রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে জোর করে রোমানিয়ার নির্বাচন বাতিল করার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, যদি গণতন্ত্রকে অল্প কয়েক হাজার ডলারের অনলাইন বিজ্ঞাপণ দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলা যায়, তার অর্থ হলো ইউরোপের গণতন্ত্র দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তিনি জার্মানির সমালোচনা করে বলেন যে, মিউনিখ কনফারেন্সে বামপন্থী ও ডানপন্থী দলগুলিকে অংশ নেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভ্যান্স বলেন যে, যদি কোন দল জনগণের ভোট পেয়ে থাকে, তাহলে তাদের সাথে মতের মিল না থাকলেও অন্ততঃ কথা বলতে পারা উচিৎ। তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে যে, ইউরোপে সোভিয়েত সময়ের মত শব্দচয়নের (মিথ্যা বা ভুল তথ্য) মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপকে ভিন্ন মত দেয়া বা নির্বাচনে জেতা থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। ভ্যান্স অভিবাসনকে ইউরোপের একটা বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, এই সমস্যা গত এক দশকে রাজনীতিকদের সিদ্ধান্তের ফলাফল। তিনি কনফারেন্সের একদিন আগে মিউনিখে একজন অভিবাসী প্রত্যাশী দ্বারা হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। ভ্যান্স অভিবাসনের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলিকে আরও কঠোর হবার আহ্বান জানান।

ভ্যান্সের আগেই ন্যাটো দেশগুলির সাথে আলোচনায় মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পীট হেগসেথ ইউরোপিয়দের সামনে নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্যে ট্রাম্পের আহ্বানকে আবারও তুলে ধরেন এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন। হেগসেথের কথাগুলি সকলে হজম করে উঠতে পারার আগেই ভ্যান্সের ভাষণ নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গিয়েছে। হেগসেথ বলেছেন যে, ইউক্রেনের পক্ষে ২০১৪ পূর্ববর্তী সীমানায় ফেরত যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তিনি আরও বলেন যে, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করাটাও বাস্তবসম্মত নয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে ইউক্রেনের জন্যে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে হবে ইউরোপিয় এবং ইউরোপের বাইরের সেনাদেরকে। তবে এই সেনাদেরকে ন্যাটো জোটের 'আর্টিকেল-৫'এর অধীনে মোতায়েন করা যাবে না এবং ইউক্রেনকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে ইউক্রেনের মাটিতে কোন মার্কিন সেনাও মোতায়েন হবে না। রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে বসাতে তিনি পশ্চিমা দেশগুলিকে একত্রে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে তেলের মূল্য কমিয়ে আনার আহ্বান জানান। ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে ইউরোপকেই বেশিরভাগ দায়িত্ব নিতে হবে বলে জানান তিনি। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে, ইউরোপিয় নেতাদেরকে তাদের জনগণের সাথে আলোচনা করতে হবে যাতে করে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি করার পদ্ধতি বের করা যায়। প্রতিরক্ষার জন্যে জিডিপির ২ শতাংশ যথেষ্ট নয়; প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৫ শতাংশ খরচ করার কথা বলেছেন। ইউরোপের শান্তিরক্ষায় ইউরোপিয় প্রতিরক্ষার খরচ একটা আগাম বিনিয়োগ। পারমাণবিক অস্ত্রচুক্তির বাস্তবতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে শুধুমাত্র ইউরোপকে আলাদা করে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের উপর চীনের কৌশলগত হুমকি মোকাবিলায় ইন্দোপ্যাসিফিকের নিরাপত্তাকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে; যেকারণে ইউরোপিয়দেরকে এখন নিজেদের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসতে হবে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশের সামরিক দিক থেকে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশংসা করেন; তবে তিনি বলেন যে, দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা এবং ডিটারেন্স তৈরির ক্ষেত্রে ইউরোপকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন যে, ন্যাটোর জোট কয়েক দশক ধরে টিকে রয়েছে; তবে তা এমনি এমনিই টিকে থাকবে না। এটাকে টিকিয়ে রাখতে ইউরোপের দেশগুলিকে প্রচলিত অস্ত্রের ক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি শক্ত কন্ঠে বলেন যে, ইউরোপের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে; যেব্যাপারে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু কোন প্রকারের অসম সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করবে না; যা নির্ভরশীলতাকে উস্কে দেয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে।
 
যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনকে মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে ইউরোপের নিরাপত্তা ইউরোপিয়দের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে, তখন এর সমান্তরালে মার্কিনীরা আদর্শিক দিক থেকেও ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইছে। বিশেষ করে জার্মানিতে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে যখন ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন জার্মানির উগ্র ডানপন্থী দল 'অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি' বা 'এএফডি'কে সমর্থন দিচ্ছে, তখন লিবারাল ইউরোপিয়দের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। 


ইউরোপিয়রা মার্কিন লেকচার মানতে পারছে না

ইউরোপের গণতন্ত্রের ব্যাপারে ভ্যান্সএর লেকচার ইউরোপিয়রা মোটেই মেনে নিতে পারেনি। ভ্যান্সের পর স্টেজে ওঠেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস। তিনি বলেন যে, তিনি যদি ভ্যান্সের কথা বুঝে থাকেন, তাহলে ভ্যান্স ইউরোপের কিছু অংশের সাথে একনায়কতন্ত্রে চালিত সরকারের তুলনা দিয়েছেন। পিস্তোরিয়াস শক্ত কন্ঠে বলেন যে, এটা মেনে নেয়া যায় না। তার কথাগুলি পুরো শ্রোতামন্ডলী ব্যাপক করতালির মাধ্যমে সমর্থন দেয়। 'ডয়েচে ভেলে'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা 'ইইউ'এর বেশিরভাগ দেশই ন্যাটোর সদস্য। কাজেই ইইউ এবং ন্যাটোর মাঝে বেশকিছু 'ওভারল্যাপ' রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই কথা উঠছিলো যে, ইইউ তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতাকে বাড়াবে। কিন্তু এখনও ইউরোপ বেশিরভাগ অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ নিজ শক্তিতে জ্বলে উঠবে। কিন্তু সেটা এখনও হয়ে ওঠেনি। হয়তো ওয়াশিংটনে নতুন মার্কিন সরকার ইউরোপকে সেই কাজটা করতে বাধ্য করতে পারে। যদিও ইউরোপের অনেক দেশই এখনও বলছে যে, তারা ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাবে, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া তাদের এই প্রচেষ্টা কতটা এগুবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। জার্মান 'ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন' বা 'সিডিইউ'এর চেয়ারম্যান এবং নির্বাচনে চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী ফ্রিডরিক মার্জ 'ডয়েচে ভেলে'র সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, মিউনিখের এই কনফারেন্স একটা ঐতিহাসিক মুহুর্ত। হয়তো কয়েক বছর পরে বোঝা যাবে যে, এটা একটা 'টার্নিং পয়েন্ট' ছিল। ভাষণের আগেই তিনি ভ্যান্সের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন। সেই আলোচনায় ভাষণের বিষয়বস্তু না আসলেও ভ্যান্স আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি জার্মানির রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলিকে কিভাবে দেখা উচিৎ এবং পপুলিজমকে কিভাবে মোকাবিলা করা উচিৎ, সেব্যাপারে একটা শিক্ষা দেবেন। মার্জ বলছেন যে, তিনি ভ্যান্সের সাথে ভিন্নমত পোষণ করছেন। পরিষ্কারভাবেই আমেরিকানরা জার্মানির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে। এটা মার্জকে অবাক না করলেও তিনি এতে বিরক্ত। জার্মানিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কিভাবে রক্ষা করতে হবে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র বলে দিতে পারে না। মার্জ বলছেন যে, ট্রাম্পের প্রথম টার্ম থেকেই ইউরোপের নিজস্ব নিরাপত্তায় জোর দেয়া উচিৎ ছিল; যা করা হয়নি। ভূকৌশলগত কারণে জার্মানি ইউরোপের ঠিক মাঝখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। জার্মানির উচিৎ ইউরোপের মাঝে ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডের সাথে একটা নেতৃত্বশীল অবস্থান নেয়া। আর ইউরোপ থেকে আমেরিকানদের সরে যাবার বাস্তবতায় ইউরোপ জার্মানির কাছ থেকে নেতৃত্ব আশা করে।

জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক 'বেরটেলসমান ফাউন্ডেশন'এর ক্যাথরিন ক্লুভার এশব্রুক 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বহুদিনের একটা নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছেন; যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপিয় দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতো না এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বিদেশের মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো না। ইরাক যুদ্ধের সময় প্রাক্তন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশকা ফিশারের সাথে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের বিতন্ডা ছিল বিষয়ভিত্তিক। কিন্তু ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ মার্কিনীদের জন্যে একেবারেই নতুন ব্যাপার। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প আসার পর থেকে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মারাত্মক রকমের বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং ইউরোপিয়রা ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিরক্ষাসচিব পীট হেগসেথের উচ্চারিত প্রতিটা শব্দকে আলাদাভাবে বোঝার চেষ্টা করছে এবং ওয়াশিংটনের প্রকৃত বাস্তবতাকে যাচাই করতে চাইছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউরোপ থেকে তার সেনা সরিয়ে নেয়া, তাহলে ন্যাটোর 'আর্টিকেল-৫' অনুযায়ী ইউরোপের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হবে কিনা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, ইউরোপিয়রা হয়তো নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হতে পারে। যদি স্বল্প সময়ের মাঝে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার ২০ হাজার সেনা সরিয়ে নেয়, তাহলে ইউরোপিয় দেশগুলি তাদের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে ট্যাক্স বৃদ্ধি করবে, নাকি ঋণ নিয়ে এগুবার চেষ্টা করবে, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। ইউরোপের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বিকল্প তৈরি সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার মাঝে তারা কিভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। ভ্যান্সের ভাষণ শোনা অনেক ইউরোপিয়দের কাছেই মনে হয়েছে যে, ইউরোপে ব্যাপকভাবে অবৈধ অভিবাসীদের ঢলকে ইউরোপের জন্যে বড় হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়ে ভ্যান্স অল্প কিছুদিন পরেই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জার্মান নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। তিনি রোমানিয়ার নির্বাচনের ধরণ নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি হুমকি দিয়েছেন যে, যদি ইউরোপিয়রা উগ্র ডানপন্থীদেরকে রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধা দেয়, তাহলে ওয়াশিংটন ইউরোপের সাথে সম্পর্ককে আরও কঠিন করে ফেলবে। ক্যাথরিন ক্লুভার বলছেন যে, ভ্যান্স যেভাবে বলেছেন যে, ইউরোপ অবৈধ অভিবাসীদের ঢলের মাঝে রয়েছে, সেটা মোটেই সত্যি নয়। জার্মান নির্বাচনে অভিবাসন একটা ইস্যু বটে; তবে একমাত্র ইস্যু নয়।
 
ট্রাম্প চীনকে নিয়ন্ত্রণে যখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাবিদদের মাঝে ট্রাম্পের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তবে পশ্চিমা আদর্শের ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে; যা একদিকে যেমন আদর্শিক ব্যাপারগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সম্পর্কের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। নতুন বিশ্ব অব্যবস্থার এটা নতুন চেহারা।


যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ; তাই ইউরোপকে তার নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করতেই হবে

মার্কিন চিন্তাবিদেরা প্রায় সকলেই একমত যে, ইউরোপিয়রা এতকাল নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে চলেছে; যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপে তার সামরিক উপস্থিতি কমাতেই হবে। এমতাবস্থায় ইউরোপকে নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে খরচ করতে হবে। তথাপি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের হস্তক্ষেপকে মার্কিন চিন্তাবিদদের অনেকেই পছন্দ করেননি। প্রাক্তন মার্কিন উপ-সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব জিম টাউনসেন্ড ব্রিটিশ মিডিয়া 'টাইমস রেডিও'কে বলেন যে, মিউনিখ কনফারেন্সে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পীট হেগসেথ ইউক্রেন নিয়ে যেসব কথা বলেছেন এবং এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ইউরোপ নিয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধারায় যেসকল কথা বলেছেন, সেগুলি নিয়ে হিসেব করতেই সকলে হিমসিম খাচ্ছেন। তবে ভ্যান্সের ভাষণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের উপর মারাত্মক আঘাত। ভ্যান্স ইউরোপের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কথা বলতে পারেন না। টাউনসেন্ড বলছেন যে, বহু বছর ধরেই ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় কমিয়ে রাখার সমস্যা চলছে। প্রায় বছর দুয়েক ধরেই টাউনসেন্ড এবং অন্যান্যরা ইউরোপিয়দের বলছিলেন যে, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ইউরোপের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। ইউরোপিয়রা এতদিন কথা কানে নেয়নি; এখন কোনকিছু করার ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন যদি ইউরোপ তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে, তাহলেও তাদের সামরিক ইন্ডাস্ট্রিগুলিকে জায়গামতো নিয়ে আসতে অনেক বছর লেগে যাবে। তাই আজকে ইউরোপের প্রচেষ্টাকে তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। টাউনসেন্ড দুঃখ করে বলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারশ প্যাক্টের জোটের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা একত্রে সাফল্য পেয়েছে; কিন্তু এখন সেই জোটে ভাঙ্গন দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি 'ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি' বা 'এনএসএ'র প্রাক্তন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল মাইল রজার্স নিরাপত্তা ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'কে বলছেন যে, ইউরোপিয়রা এখন চিন্তা করছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের কথাগুলি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা কিনা। অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউরোপিয়দের এখন নতুন ধরণের কোন সম্পর্কে যেতে হবে কিনা। ইউরোপিয়রা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তাহলে প্রশ্ন করতে হবে যে, এক্ষেত্রে ইউরোপের নিজস্ব কোন বিকল্প সমাধান রয়েছে কিনা।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের মাঝে আদর্শিক ফাটল এখন দৃশ্যমান। বাকস্বাধীনতা কতটুকু থাকবে, ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে বাকস্বাধীনতা সাংঘর্ষিক কিনা, লাগামহীন যৌনাচারের স্বাধীনতা থাকবে কিনা, গর্ভপাতের ব্যাপারটাকে কে কিভাবে দেখবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কে অংশ নিতে পারা বা কে ক্ষমতায় আসতে পারবে বা পারবে না, সেটার মাপকাঠি কি হবে, ইত্যাদি আদর্শিক ইস্যুতে পশ্চিমারা আজ বিভক্ত। কেউ কেউ যদিও বোঝার চেষ্টা করছেন যে, এই বিভক্তি শুধুমাত্র ট্রাম্পের কারণে কিনা, তথাপি তারা এড়িয়ে যেতে পারেন না যে, ট্রাম্প বিপুল ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। ইউরোপিয়রা একইসাথে চিন্তিত যে, ইউরোপিয় লিবারাল সেকুলার আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তাধারার উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে বিপুল ভোট পাচ্ছে; কারণ লিবারাল চিন্তার রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যার সমাধান দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনকে মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে ইউরোপের নিরাপত্তা ইউরোপিয়দের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে, তখন এর সমান্তরালে মার্কিনীরা আদর্শিক দিক থেকেও ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইছে। বিশেষ করে জার্মানিতে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে যখন ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন জার্মানির উগ্র ডানপন্থী দল 'অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি' বা 'এএফডি'কে সমর্থন দিচ্ছে, তখন লিবারাল ইউরোপিয়দের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ট্রাম্প চীনকে নিয়ন্ত্রণে যখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাবিদদের মাঝে ট্রাম্পের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তবে পশ্চিমা আদর্শের ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে; যা একদিকে যেমন আদর্শিক ব্যাপারগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সম্পর্কের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। নতুন বিশ্ব অব্যবস্থার এটা নতুন চেহারা।

No comments:

Post a Comment