Saturday, 8 March 2025

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ২০২৫ – রাইজ অব এইচটি

০৯ই মার্চ ২০২৫

ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আগমণ যুক্তরাষ্ট্রে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে; যার প্রমাণ ন্যাটো, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে দৃশ্যমান। আটলান্টিকের ওপাড়ে এহেন বড় পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে ঢাকায় এইচটি-র উত্থান একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ৭ই মার্চ ২০২৫ সত্যিই ছিল একটা ঐতিহাসিক দিন!


গত ০৭ই মার্চ রমজান মাসের প্রথম জুমআর দিনে ঢাকার বাইতুল মুকাররম মসজিদের উত্তর গেটে হিযবুত তাহরীর বা এইচটি-র মিছিল নিয়ে পুরো দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে। সেকুলার ব্যক্তিত্বদের মাঝে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, নিষিদ্ধ্ব ঘোষণা করা এই দল কিভাবে দিনে দুপুরে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘোষণা দিয়ে একটা মিছিলের আয়োজন করতে পারে? অনেকেই মন্তব্য করছেন যে, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় ব্যাপক দমন-পীড়নের মাঝ দিয়ে যাবার পরেও কি করে তারা ১৬ বছর পর এতবড় মিছিলের আয়োজন করতে পেরেছে? অনেকেই আইনশৃংখলা বাহিনীর সমালোচনা করেছেন যে, কেন পুলিশ আরও কঠোর হলো না। কেউ কেউ বলছেন যে, পুলিশ কেন গুলি চালালো না? অবশ্য যারা বুঝতে পেরেছেন যে, এইচটি-র মিছিলে গুলি চালালে এই পুলিশ আর হাসিনা সরকারের জুলুমবাজ পুলিশের মাঝে কোন পার্থক্য থাকে না, তারা কিন্তু অন্ততঃ রয়েসয়ে কথা বলেছেন। তদুপরি অনেকেই বলেছেন যে, পুলিশের উচিৎ ছিল এইচটি-র সদস্যরা যাতে মিছিল শুরুই করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করা। এই কথা বলেও তারা অবশ্য ফেঁসে গেছেন যে, ঠিক এই কাজটাই আওয়ামী সরকার করেছিল বিএনপি-জামাতের বিরুদ্ধে - রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করার আগেই সেটাকে পুলিশ এবং গুন্ডাবাহিনী দ্বারা লন্ডভন্ড করে দেয়া। পুলিশ অবশ্য গত সাত মাসের অক্ষমতার রেকর্ড অক্ষুন্ন রেখেই নিজেদের অবস্থানকে তুলে ধরেছে - এখানে তো অনেক সাধারণ মুসল্লী ছিল। অর্থাৎ পুলিশ অন্ততঃ বুঝেছে যে, যখন বহু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের নির্দেশ মান্য করার জন্যে মামলা ঝুলছে, তখন নতুন করে কোন অমানবিক কাজের ফাঁদে আরেকবার পা দেয়াটা বিচক্ষণের কাজ হবে না। তারা অন্ততঃ এটা বুঝেছেন যে, কোন সরকারই স্থায়ী নয় – এমনকি আওয়ামী সরকার - যারা একসময় যখন মনে করতো যে তারা জার্মানির 'থাউজ্যান্ড ইয়ার রাইখ'এর মতো কিছু একটা বাংলাদেশের মাটিতে কায়েম করবে - তাদেরও পতন হয়েছে। সুতরাং আর কাউকেই পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করে আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মতো বোকামি তারা করতে রাজি ছিল না। তবে সরকারের চাপ ছিল বলেই তারা কাপুরুষের মতো মিছিলের পেছন থেকে কোন উস্কানি ছাড়াই টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং লাঠিচার্চের মাধ্যমে হামলা করেছে। এতে মিছিলকারীদের তেমন কোন ক্ষতি না হলেও পুলিশের কপালে কিন্তু আবারও জুলুমবাজের তকমা জুটে গেলো! বেচারা পুলিশ!
 
নিষেধাজ্ঞা না তোলার পরেও এইচটি তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পেরেছে; এবং একইসাথে ইউনুস সরকার কেন হাসিনা সরকারের জুলুমবাজ নীতিকে চালিয়ে নিলো, সেটার জন্যে ইউনুস সরকারের গণতন্ত্র রক্ষা করার কৌশলও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ ইউনুস সরকার যদি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে সেটাকে পুলিশী কর্মকান্ডের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে কেন? দুর্বল গণতন্ত্রকে যদি স্ক্যাচে ভর করে চলতে হয়, তাহলে সেটা এইচটি-র বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে লড়বে কিভাবে? প্রকারান্তরে হাসিনার সিদ্ধান্তকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সরকার এইচটি-র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক হারই স্বীকার করে নিয়েছে।


এইচটি কতটা সফল ছিল?

এখন প্রশ্ন হলো, এইচটি-র জন্যে এটা কি সফলতা ছিল কিনা? এটা বুঝতে হলে দেখতে হবে যে, তারা এর মাধ্যমে কি করতে চেয়েছে। 'মার্চ ফর খিলাফত' নামের প্রকল্প এবং এর ন্যারেটিভগুলি মোটামুটিভাবে ৩রা মার্চ থেকে পোস্টার আকারে সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এতে একদিকে যেমন এইচটি তাদের দলীয় সক্ষমতার প্রমাণ দেয়, তেমনি সমাজের মাঝে তাদের সরাসরি ও চাপা সমর্থনের প্রমাণও সামনে চলে আসে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই তারা দিনের বেলায় পোস্টার লাগিয়েছে; এবং অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ তাদেরকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। পুলিশ এক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নীরব ভূমিকা পালন করাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছে। অন্ততঃ আওয়ামী সময়ে এইচটি-র সদস্যদের ধরে ধরে আয়নাঘরে ছুঁড়ে ফেলার মতো বাজে কাজের দুর্গন্ধ তাদের ইউনিফর্মে যখন লেগে আছে, তখন পুলিশ বক্সের উপর এইচটি-র পোস্টার লাগানোতে বাধা দিয়ে সেই জঘন্য স্মৃতি তারা আর সামনে আনতে চায়নি। তাই পোস্টার লাগানো চলেছে; যে যা কিছুই মনে করুক; এটাই বাস্তবতা। যারা অভিযোগ করছেন, তাদেরকে বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে।

মোটকথা এইচটি বাস্তবতাকে তাদের পক্ষে পরিবর্তন করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে; যা অবশ্য ২০২৪এর ০৫ই অগাস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হলেও ১৫ বছরের শক্তিশালী রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ফলাফল হিসেবেই এসেছে। কেননা, আওয়ামী সময়ের ১৫ বছর তারা যদি কোন কাজ করতে না-ই পারতো, তাহলে কেউই বলতে পারতো না যে, এইচটি ০৫ই অগাস্টের অভ্যুত্থানের অংশীদার। আর কেউ যদি এইচটি-র নাম না-ই জানতো, তাহলে তারা আওয়ামী লীগের পতনের পরপরই বাইতুল মুকাররমের উত্তর গেটে দু'টা বড় বড় মিছিল করতে সক্ষম হতো না। এছাড়াও তারা গত ২৯শে নভেম্বর একটা আন্তর্জাতিক অনলাইন কনফারেন্সও করেছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এইচটি-র উপর থেকে হাসিনা সরকারের দেয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে না নিলেও এই কর্মকান্ডগুলিকে আটকানো সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা না তোলার পরেও এইচটি তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পেরেছে; এবং একইসাথে ইউনুস সরকার কেন হাসিনা সরকারের জুলুমবাজ নীতিকে চালিয়ে নিলো, সেটার জন্যে ইউনুস সরকারের গণতন্ত্র রক্ষা করার কৌশলও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কারণ ইউনুস সরকার যদি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে সেটাকে পুলিশী কর্মকান্ডের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে কেন? দুর্বল গণতন্ত্রকে যদি স্ক্যাচে ভর করে চলতে হয়, তাহলে সেটা এইচটি-র বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে লড়বে কিভাবে? প্রকারান্তরে হাসিনার সিদ্ধান্তকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে পুলিশি ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সরকার এইচটি-র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক হারই স্বীকার করে নিয়েছে।
 
তারা যে ব্যাপারটা ধরতেই পারেনি তা হলো, এইচটি-র পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোন কিছু লিখলেই সেটা এইচটি-কে সহায়তা করবে। কারণ এইচটি হলো একটা আদর্শিক দল; যারা সকল মুসলিমকে নিজেদের দাওয়ার আওতায় ধরে। অর্থাৎ তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, সামরিক অফিসার, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, যে কাউকে দাওয়া করে; বিশেষ করে যারা সমাজের এলিট শ্রেণি। বর্তমানে কেউ কেউ বলছে যে, এইচটি-র বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে সখ্যতা রয়েছে। আবার আরেক দল বলছে যে, এইচটি-র পেছনে আওয়ামী লীগের পান্ডারা লুকিয়ে আছে। 


এইচটি-র ব্যাপারে হাসিনা সরকারের নীতি

গত ১৫ বছর হাসিনা সরকার মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের গাইডলাইন অনুযায়ী চলেছে। এইচটি হলো একটা আদর্শিক সংগঠন। তাদেরকে হয় আদর্শিক কাউন্টার-ন্যারেটিভের মাধ্যমে আটকাতে হবে; নতুবা তাদের কথা জনগণের কাছে যাতে একেবারেই পৌঁছাতে না পারে, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমটা বেশ কঠিন। কারণ এইচটি কোন জিহাদী গ্রুপ নয়; যার বিরুদ্ধে সহজেই কোন ন্যারেটিভ তৈরি করে সাধারণ মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা থেকে দূরে রাখা সম্ভব। একারণে হাসিনা সরকার দ্বিতীয় পদ্ধতিটা অনুসরণ করেছে; যদিও তাদের সামনে আর কোন পদ্ধতিও খোলা ছিল না। কারণ ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে ভারত এবং আওয়ামী লীগের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার ব্যাপারে লিফলেট ইস্যু করার পর এইচটি আওয়ামীদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়। একইসাথে এইচটি হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্যে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের দিকে আহ্বান করতে থাকে। নিষেধাজ্ঞা আসাটা ছিল প্রায় অবধারিত। এটা জানা সত্ত্বেও তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি এবং পরবর্তীতে অনেক বছর ধরে ব্যাপক জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছে। বাংলাদেশের আইনে কোন অপরাধ প্রমাণিত না হলেও কোন কারণ ছাড়াই তাদের সদস্যদেরকে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। আয়নাঘরে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে মারত্মক নির্যাতন করা হয়েছিল।

তবে এই ১৫ বছরের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল টোটাল মিডিয়া ব্ল্যাকআউট। সকল মিডিয়াকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিলো, যাতে করে কোন মিডিয়াতে এইচটি-র কোন কর্মকান্ড না আসে। এই সুযোগে হাসিনা সরকার এইচটি-র বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। কারণ জগগণ শুধু সরকার-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াই দেখতে পেতো। এরপরেও এইচটি এই সময়ে তাদের কর্মকান্ডকে চালিয়ে নিতে পেরেছে; যা কিনা যে কোন সাধারণ রাজনৈতিক দলের জন্যে প্রায় অসম্ভব কাজ। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে এইচটি-র অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে। কারণ এইচটি বিভিন্ন দেশে ভয়াবহতম একনায়ককে মোকাবিলা করেছে; যাদের মাঝে ছিল ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মিশরের হোসনি মুবারক এবং উজবেকিস্তানের ইসলাম কারিমভ। গ্লোবাল আদর্শিক দল হবার কারণে তারা বাংলাদেশে ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের মাঝে শুধু টিকেই যায়নি; নিজেদের দলকে আরও বড় ও মজবুত করেছে। ঢাকার স্বনামধন্য স্কুল-কলেজের ছাত্ররা কালেমা খচিত পতাকা নিয়ে মিছিল করার পর দিল্লীতে অনেকেরই ঘাম ঝড়ে গিয়েছে। কারণ ভারত মনে করেছে যে, এটা এইচটি-ই করেছে। ঢাকায় জেনারেশন-জেড (জেন-জি)এর পতাকা মিছিল দিল্লীর জন্যে ছিল অশনি সংকেত।

০৫ই অগাস্টের পরিবর্তনের পর এইচটি-র জন্যে সবচাইতে বড় ব্যাপার ছিল প্রকাশ্যে দাওয়ার কাজ করতে পারা। এটা অবশ্য পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে। তথাপি মিডিয়া ব্ল্যাকআউট কিন্তু ঠিকই চলেছে। এই ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে, যখন 'মার্চ ফর খিলাফত' অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পুলিশের বিবৃতি আসে এবং সকল মিডিয়া এটাকে ফলাও করে প্রচার করে। এটা ঠিক যে, পুলিশের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এইচটি-র অনেক সমর্থকই হয়তো মিছিলে যোগ দেয়নি। তথাপি যে পরিমাণ প্রচার পুলিশ এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তারা পেয়েছে, তাতে অনুষ্ঠানের আগেই তাদের অর্ধেক বিজয় হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এইচটি-র বড় একটা বিজয় হয়ে গিয়েছে অনুষ্ঠানের আগেই। আর অনুষ্ঠানের দিন জুমআর নামাজ শেষ হবার সাথেসাথেই যখন দেখা গেলো যে, হাজারো মুসল্লির বিশাল জনস্রোত এইচটি-র সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে, তখন বাকি অর্ধেক বিজয়ও তারা পেয়ে গেছে। কারণ নিষেধাজ্ঞার পরেও এত মানুষ এই মিছিলে যোগ দেবে, এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি!

বাকিটা ছিল ইতিহাস। যে এইচটি ১৫ বছরে মিডিয়াতে আসতে পারেনি, তারা ৭ই মার্চ ছিল সকল মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম। প্রকৃতপক্ষে সেদিন এইচটি ছিল বাংলাদেশের একমাত্র শিরোনাম! এটা এই দলকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে, তা যারা ভূরাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন তাদের বোঝার কথা। এইচটি-র টার্গেট অডিয়েন্স ছিল মূলতঃ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা; যারা এইচটি-র সক্ষমতার একটা চাক্ষুশ প্রমাণ পেলো। অন্ততঃ তাদের টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে এইচটি-র সন্মান যে বহুগুণে বেড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের দমন পীড়নের পরেও এইচটি যখন এতবড় জনসমাগম করতে সক্ষম হয়েছে, তখন এদেশের সেকুলার সমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশকে দোষারোপ করেছে; যেখানে সকলেই জানে যে, সারা দেশের কোথাও নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের নেই। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কাউন্টার-ন্যারেটিভ বের করতে না পেরে হাসিনা সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুলুমবাজ নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারটা সেকুলার চিন্তাবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিউয়াত্বকেই তুলে ধরে। অথচ এইচটি-র কন্ঠরোধ করার এই নীতিতে তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রধান একটা স্তম্ভ বাক-স্বাধীনতা যে ভূলুন্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের খেয়ালই নেই।


এইচটি-র বিরুদ্ধে প্রচারণা - লাভ কার?

বাংলাদেশের পুরো সেকুলার সমাজের ব্যাপক প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেলো কিভাবে এইচটি-কে জনগণের সামনে খারাপভাবে তুলে ধরা যায়। সত্যাসত্য অনেক কিছুই সোশাল মিডিয়াতে ভরিয়ে দিতে থাকে অনেকে। অথচ তারা যে ব্যাপারটা ধরতেই পারেনি তা হলো, এইচটি-র পক্ষে বা বিপক্ষে যেকোন কিছু লিখলেই সেটা এইচটি-কে সহায়তা করবে। কারণ এইচটি হলো একটা আদর্শিক দল; যারা সকল মুসলিমকে নিজেদের দাওয়ার আওতায় ধরে। অর্থাৎ তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, সামরিক অফিসার, শিক্ষক, চিন্তাবিদ, যে কাউকে দাওয়া করে; বিশেষ করে যারা সমাজের এলিট শ্রেণি। বর্তমানে কেউ কেউ বলছে যে, এইচটি-র বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে সখ্যতা রয়েছে। আবার আরেক দল বলছে যে, এইচটি-র পেছনে আওয়ামী লীগের পান্ডারা লুকিয়ে আছে। যেটা এরা কেউই চিন্তা করতে পারছে না তা হলো, এইচটি-র এব্যাপারে কোন মাথাব্যাথা থাকবে না। কারণ এত বছরে এইচটি-র কোন ন্যারেটিভে দেখা যাবে না যে, তারা অন্য কারুর কর্মকান্ডকে অনুসরণ করে নিজেদের কর্মকান্ডকে সাজিয়েছে। তারা সর্বদাই নিজেদের অদর্শকে সমুন্নত রেখে তাদের লক্ষ্য ঠিক করেছে এবং সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিভিন্ন কর্মকান্ড করেছে। অর্থাৎ তারা সর্বদাই 'প্রোএকটিভ' থেকেছে; কখনোই 'রিএকটিভ' হয়নি। কাজেই এটা আশা করা যায় না যে, তারা কারুর মিথ্যা তথ্য ছড়ানোতে 'রিএকশন' দেখাবে। বরং এতে এইচটি-র ব্যাপারে সমাজে আরও বেশি কৌতুহল তৈরি হবে এবং আরও বেশি আলোচনা হবে; যেখানে এইচটি-কে কেউই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে হারাতে সক্ষম হবে না। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কাউন্টার-ন্যারেটিভ তৈরি করাটা যথেষ্টই কঠিন। মোটকথা, এর মাধ্যমে এইচটি আবারও বাস্তবতাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। একসময় তাদের ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলতো না; আর এখন তাদের কথা সকলের মুখে মুখে। এটা এইচটি-র জন্যে অনেক বড় একটা বিজয়।

পুরো বাংলাদেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখেছে কিভাবে এইচটি ঘোষণা দিয়ে বাইতুল মুকাররমে মিছিল করেছে; সেটাও আবার পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও। হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের দমন পীড়নের পরেও এইচটি যখন এতবড় জনসমাগম করতে সক্ষম হয়েছে, তখন এদেশের সেকুলার সমাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশকে দোষারোপ করেছে; যেখানে সকলেই জানে যে, সারা দেশের কোথাও নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের নেই। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কাউন্টার-ন্যারেটিভ বের করতে না পেরে হাসিনা সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুলুমবাজ নীতিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যাপারটা সেকুলার চিন্তাবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিউয়াত্বকেই তুলে ধরে। অথচ এইচটি-র কন্ঠরোধ করার এই নীতিতে তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রধান একটা স্তম্ভ বাক-স্বাধীনতা যে ভূলুন্ঠিত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের খেয়ালই নেই। অপরদিকে সেকুলার রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরা হতবিহ্বল হয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছে - বলছে যে, এইচটি উমুক বা তুমুক দলের সাথে রয়েছে। এইচটি কিছুই বলবে না। তারা তো আদর্শিক দল হবার কারণে সকলকেই দাওয়া করে। তাই তারা সকলকেই তাদের নিজেদের লোক মনে করে। কাজেই কেউ যদি বলে যে, এইচটি ওদের লোক, তারা কখনোই এতে ব্যাথিত হবে না। কারণ এতে তাদের সংখ্যা শুধু বৃদ্ধিই পায়। শুধুমাত্র এই বাস্তবতাটুকু অনুধাবন করার সক্ষমতাও যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবিদের নেই, সেটা আজ প্রমাণিত সত্য। বাংলাদেশের পুরো সেকুলার সমাজ আজকে এইচটি-র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত! এটা ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও দিনটাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। কারণ প্রথমতঃ এইদিনের মিছিল ছিল ৩রা মার্চের খিলাফত পতন দিবসের ১০১তম (ইংরেজি ক্যালেন্ডারে) বর্ষপুর্তি উপলক্ষে; যা সারা বিশ্বে রমজানের প্রথম জুমআর দিনে একযোগে পালিত হয়েছে। আর দ্বিতীয়তঃ ঢাকায় এইচটি-র এতবড় উত্থান ওয়াশিংটন ও দিল্লীর জন্যে বড় একটা চিন্তার বিষয়। ওয়াশিংটনে যখন বড় রকমের পরিবর্তন চলছে, দিল্লীর নেতৃত্ব তখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বিপদ গুণছে। ০৫ই অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিভিন্ন সাবভার্সনের কাজ করে বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দিতে বাধ্য করেছে। তথাপি এক্ষেত্রে হোয়াইট হাউজে বাইডেন সরকার থাকার সময় ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশের উপর রাজনৈতিক চাপ বড় ভূমিকা রেখেছিল। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আগমণ যুক্তরাষ্ট্রে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে; যার প্রমাণ ন্যাটো, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে দৃশ্যমান। আটলান্টিকের ওপাড়ে এহেন বড় পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে ঢাকায় এইচটি-র উত্থান একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ৭ই মার্চ ২০২৫ সত্যিই ছিল একটা ঐতিহাসিক দিন!

Sunday, 2 March 2025

পশ্চিমা লিবারাল বিশ্বব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক!

০২রা মার্চ ২০২৫

যে ব্যাপারটা নিয়ে পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা পুরোপুরিভাবে একমত তা হলো, পশ্চিমা লিবারাল বিশ্বব্যবস্থার মৃত্যু হয়েছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছর ধরে চলা এই বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল পশ্চিমা দেশগুলির জোট এবং তাদের তৈরি করা বিভিন্ন সংস্থা; যেগুলি গত কয়েক বছর ধরে দুর্বল হতে থাকলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে আসার সাথে সাথে এগুলি অকার্যকর হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা জোটের কেন্দ্রে থাকা ন্যাটো নিরাপত্তা জোট আজ নামমাত্র দাঁড়িয়ে আছে।


পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়া গত কিছুদিনের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে। জার্মানির মিউনিখে নিরাপত্তা সন্মেলনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো; সৌদি আরবে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেন ও ইউরোপকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাঝে আলোচনা; এবং হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে মিডিয়ার সন্মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে মারাত্মক ঝগড়ার পর হোয়াইট হাউজ থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকিকে বের করে দেয়া - এই ঘটনাগুলি পুরো বিশ্বব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা বলছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গত ৩৫ বছরে এতবড় পরিবর্তন আসেনি। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছর ধরে চলা পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত লিবারাল বিশ্বব্যবস্থা আজকে মৃত বলেই ধরে নেয়া যায়।


ইউক্রেনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা এখানেই শেষ!

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জন ম্যাকলাঘলিন নিরাপত্তা ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, ট্রাম্পের ইউক্রেন নীতিতে ইউরোপিয়দের মাঝে একতাবদ্ধ হবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ঠিকই; তবে সেটার অর্থ আসলে কি হবে, সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চ্যালেঞ্জগুলি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি ছাড়া ইউরোপের আর কোন নেতৃত্বের বুঝতে পারার কথা নয়। কারণ জেলেন্সকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে তিন বছর ধরে যুদ্ধ করছেন। একমাত্র তিনিই জানেন রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে। ইউরোপ রাশিয়ার হুমকি বোঝে না তা-ও কিন্তু নয়। ইউরোপের কিছু অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইউরোপের সকল দেশের অস্ত্রই ন্যাটোর স্ট্যান্ডার্ড মেনে তৈরি করা। কিন্তু সমস্যা হলো, সেখানে সকলেই আলাদা আলাদা অস্ত্র তৈরি করেছে; এবং সেগুলি একটা আরেকটার সাথে যায় না। শুধুমাত্র ন্যাটোর অধীনেই তারা একত্রে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ন্যাটোকে বাদ দিয়ে তারা যুদ্ধ করার মতো একত্রিত ইউরোপিয় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে পারবে কিনা, তাতে সন্দেহ রয়েছে। আবার ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ইউরোপের নিজস্ব সামরিক বাহিনী তৈরি করাটাও অদ্ভুত ঠেকছে। কারণ এই মুহুর্তে ইউরোপের সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে ইউক্রেনের। ইউক্রেন চাইলে পুরো ইউরোপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একেবারে ফ্রান্সের আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত যাবার সক্ষমতা রাখে। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্যে একটা ইউরোপিয় বাহিনীর কথা বলা হচ্ছে। এই মুহুর্তে এই বাহিনী বলতে যা বোঝা যায় তা হলো কয়েকটা ব্রিগেডের একটা বাহিনী যা রাশিয়ার সাথে সীমানায় টহল দেয়ার কাজ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, কোন মার্কিন সেনা এই বাহিনীতে থাকবে না। তথাপি যুক্তরাষ্ট্রকে এই বাহিনীর পিছনে গ্যারান্টি দিতে হবে। কারণ এই বাহিনী যদি রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা ট্রাম্পের জন্যে একটা মারাত্মক রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে আবির্ভূত হবে। কাজেই পুতিন রাজি হোক আর না হোক, যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তভাবে বলতেই হবে যে, ইউরোপিয়দের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত সমর্থন রয়েছে এবং রাশিয়া চুক্তি ভঙ্গ করলে যুক্তরাষ্ট্র শক্ত অবস্থান নেবে। তবে খুব সম্ভবতঃ এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত হবে।
 
ট্রাম্পের কথাগুলি জেলেন্সকি মেনে নিতে পারেননি এবং ট্রাম্পকে প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এটা ট্রাম্পের অতি উঁচু দম্ভের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে এবং এরপর ট্রাম্প মূলতঃ জেলেন্সকিকে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দিয়েছেন। অন্য কথায় বলতে গেলে, ইউক্রেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনকে ছেড়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে না যে, ইউরোপ ইউক্রেনকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে। অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউরোপ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হবার ক্ষমতা রাখে না।


হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে জেলেন্সকির সাথে ট্রাম্পের ঝগড়ার পর লিবারাল ঘরানার মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং 'ইউরেশিয়া গ্রুপ'এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার 'জি-জিরো মিডিয়া'তে বলছেন যে, ট্রাম্পের কথাগুলি জেলেন্সকি মেনে নিতে পারেননি এবং ট্রাম্পকে প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এটা ট্রাম্পের অতি উঁচু দম্ভের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছে এবং এরপর ট্রাম্প মূলতঃ জেলেন্সকিকে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দিয়েছেন। অন্য কথায় বলতে গেলে, ইউক্রেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এখন অনেকেই হয়তো বলবেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্ককে জোড়া লাগাতে হলে জেলেন্সকিকে পদত্যাগ করতে হতে পারে। আর গত কয়েক বছরে ইউরোপের কর্মকান্ডে যা বোঝা গেছে তা হলো, ইউরোপিয়রা যতটা বলে, ততটা করে না। অনেক কথার পরেও ইউরোপের সকল দেশ তাদের প্রতিরক্ষা বাজেটকে জিডিপির ২ শতাংশেই নিয়ে যেতে পারেনি। তাদের একেক দেশের একেক এজেন্ডা এবং একেক বাজেট। তাদের পক্ষে একটা একত্রিত সামরিক শক্তি গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপিত করা খুবই কঠিন। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনকে ছেড়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে না যে, ইউরোপ ইউক্রেনকে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারবে। অন্ততঃ এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউরোপ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হবার ক্ষমতা রাখে না।

ট্রাম্প ইউরোপ, বিশেষ করে ব্রিটিশদেরকে বাদ দিয়ে পুতিনের সাথে আলোচনায় বসেছেন – এই ব্যাপারটা ব্রিটিশরা মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল ক্লার্ক ব্রিটিশ মিডিয়া 'স্কাই নিউজ'কে বলছেন যে, ইউক্রেনে যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো ঐতিহাসিক মাত্রার ঐতিহাসিক এক বিশ্বাসঘাতকতা। ইউক্রেন তার ২০ শতাংশ ভূমি হারাবে ঠিকই; কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তাদের শতভাগ রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। একত্রিতভাবে পশ্চিমা বিশ্ব বলতে যা এতদিন বোঝাতো, সেটা এখন মৃত; আন্তর্জাতিক আইন এখন মৃত। এগুলি গত তিন-চার বছর ধরেই নিম্নগামী ছিল। তবে গত দুই সপ্তাহে এর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে। তিনি বলছেন যে, এখন বিশ্ব রয়েছে নব্য সাম্রাজ্যবাদের মাঝে; ট্রাম্প, পুতিন এবং শি জিনপিং দুনিয়াটাকে নতুন একটা ব্যবস্থার মাঝে নিয়ে আসতে চাইছে আগামী দেড়-দুই বছরের মাঝে। ট্রাম্প মূলতঃ বোঝেন বাণিজ্য এবং তিনি মার্কিন অর্থনীতিকে দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে দেখতে চান। এবং একইসাথে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক আকৃতিও বড় করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এরা তিনজনই তাদের রাষ্ট্রের ভৌগোলিক আকৃতিকে বড় করার ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প এই তিন দেশের পারমাণবিক অবস্থানকে কমিয়ে ফেলার দিকে এগুতে চাইছেন। ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরষ্কার চান এবং মাউন্ট রাশমোরএর মাঝে তার একটা প্রতিকৃতি থাকুক, সেটাও চান। তিনি ইউক্রেন, গাজা, তাইওয়ান এবং ন্যাটো নিয়ে চিন্তা করেন না। সুতরাং সামনের চার বছরে এরূপ অন্ধকারের মাঝে পতিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব।
 
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে; যাতে করে নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়। যদিও সবচাইতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শন করতেই পারে, তথাপি পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা বেশিরভাগই একমত যে, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এখন নিম্নগামী; তাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব না-ও হতে পারে। মোটকথা, পুরো বিশ্ব আজ চরম উৎকণ্ঠার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বড় ধরণের একটা পরিবর্তনের দাঁড়প্রান্তে।


যুক্তরাষ্ট্র এখন নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার চেষ্টায় রয়েছে

ট্রাম্পের কর্মকান্ডকে স্বাভাবিক আখ্যা দিয়ে পুরো বিষয়টাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অংশ বলে আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স'এর এক পডকাস্টে তিনি বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া বিশ্বব্যবস্থাকে এখন আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সারা বিশ্বকে লিবারাল চিন্তার অধীনে আনার পশ্চিমা প্রকল্প ছিল কল্পনার জগতের একটা চিন্তা। একারণেই যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলছে। ট্রাম্পের কর্মপদ্ধতি খুবই উদ্ভট; কিন্তু তিনি যা করছেন, তার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। ইউক্রেনের প্রতি আমেরিকার কোন ভালোবাসা নেই। কঠোর বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন ছিল একটা ভূরাজনৈতিক খেলার মাঠ। ইউরোপিয়দের মাঝে অনেকেরই, বিশেষ করে ব্রিটিশদের মাঝে অনেকেরই ইউক্রেনের জন্যে ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু কেউই প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনকে রক্ষা করতে জীবন দিতে প্রস্তুত নয়। রাশিয়া ইউক্রেনের মতো প্রায় তৃতীয় বিশ্বের একটা সামরিক শক্তিকে তিন বছরে হারাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এতে তাদের সামরিক সক্ষমতা কতটুকু তা এখন প্রমাণিত। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে গেছে; তাই রাশিয়াকে শত্রু ভেবে অনেক কিছু করার সময় এখন নয়। ন্যাটোর সৃষ্টি হয়েছিল রাশিয়াকে আটকে রাখার জন্যে; যখন রাশিয়া ইউরোপের জন্যে একটা বড় হুমকি ছিল। এখন রাশিয়া ইউরোপের জন্যে কোন হুমকি নয়; তাই ন্যাটোরও এখন কোন প্রয়োজন নেই। ফ্রীডম্যান বলছেন যে, ইউক্রেনের চাইতে মধ্যপ্রাচ্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা হয়েছে সৌদি আরবে। এই আলোচনা শুধু ইউক্রেন নিয়ে নয়; এখানে মধ্যপ্রাচ্যও রয়েছে। এই আলোচনা নতুন বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। এই পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে বাদ দিয়েছে বলেই ইউরোপে এতটা হৈচৈ শুরু হয়েছে। তিনি বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য হলো সারা দুনিয়ার জ্বালানি সরবরাহের সবচাইতে বড় উৎস। মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সৌদি আরবকে প্রয়োজন। আর গাজা দখলের মতো আশ্চর্য্য পরিকল্পনা না নিয়ে আসলে হয়তো সৌদিদেরকে দিয়ে ট্রাম্প কাজ করাতে পারতেন না। তবে ফ্রীডম্যানের কথাগুলির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল নতুন বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। তিনি বলছেন যে, চীনের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কোন্নয়ন। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এর মাধ্যমে চীনের উপর চাপ সৃষ্টি করে চীনের কর্মকান্ডে পরিবর্তন নিয়ে আসা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণভাবে চীনকে পরিবর্তন করা; বিশেষ করে চীনা সরকারের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে বেসরকারি সেক্টরকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করা; যাতে করে চীন পশ্চিমা পুঁজিবাদী চিন্তাকে আরও শক্তভাবে ধারণ করে।

মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ রবার্ট ক্যাপলান ব্রিটিশ কনজারভেটিভ ঘরানার মিডিয়া 'স্পেকট্যাটর'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, ট্রাম্প যে স্বর্ণযুগের কথা বলছেন, তা প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামীতারই একটা অংশ। অপরদিকে চীনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, চীনের অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা রয়েছে। বিশ্বের সকল গ্রেট পাওয়ার রাষ্ট্রই ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার কবর। এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া মধ্য এশিয়া, ককেশাস, সাইবেরিয়া এবং পূর্ব এশিয়াতে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা হারিয়েছে। তিনি বলছেন যে, কেউই চায় না কোন গ্রেট পাওয়ার রাষ্ট্র তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করুক। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গ্রেট পাওয়ার বিশ্বকে একটা ব্যবস্থার মাঝে রাখে। গ্রেট পাওয়ার ব্যতীত বিশ্ব হলো অব্যবস্থার মাঝে থাকা একটা বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত হওয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রায় ৮০ বছর টিকেছে; যা আসলে অনেক বেশি। তবে খুব সম্ভবতঃ সেই বিশ্বব্যবস্থা এখন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্যাপলান বলছেন যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারে। ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং প্রাক্তন কনজারভেটিভ রাজনীতিবিদ মাইকেল গোভ 'স্পেকট্যাটর'কে বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি বিশ্বব্যবস্থায় অনেকগুলি বহুপাক্ষিক সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল; যেগুলি ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, অথবা তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে এই হুমকিগুলি নেই এবং এই সংস্থাগুলি নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্যে যুক্তি হারাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে যে, এই সংস্থাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

যে ব্যাপারটা নিয়ে পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা পুরোপুরিভাবে একমত তা হলো, পশ্চিমা লিবারাল বিশ্বব্যবস্থার মৃত্যু হয়েছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছর ধরে চলা এই বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল পশ্চিমা দেশগুলির জোট এবং তাদের তৈরি করা বিভিন্ন সংস্থা; যেগুলি গত কয়েক বছর ধরে দুর্বল হতে থাকলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে আসার সাথে সাথে এগুলি অকার্যকর হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমা জোটের কেন্দ্রে থাকা ন্যাটো নিরাপত্তা জোট আজ নামমাত্র দাঁড়িয়ে আছে। কারণ যেই রাশিয়াকে আটকানোর জন্যে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল, সেই রাশিয়া আজকে দুর্বল। আর যেই জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল, সেই জার্মানি আজকে এতটাই দুর্বল যে, জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, জার্মান নির্বাচন নিয়ে কেউ চিন্তিতই নয়। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউরোপ থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নেয়, তাহলে ন্যাটো অর্থহীন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে; যাতে করে নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়। যদিও সবচাইতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি প্রদর্শন করতেই পারে, তথাপি পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা বেশিরভাগই একমত যে, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এখন নিম্নগামী; তাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব না-ও হতে পারে। মোটকথা, পুরো বিশ্ব আজ চরম উৎকণ্ঠার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বড় ধরণের একটা পরিবর্তনের দাঁড়প্রান্তে।

Sunday, 16 February 2025

পশ্চিমা জোটে ভাঙ্গনের লক্ষণ…

১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের মাঝে আদর্শিক ফাটল এখন দৃশ্যমান। বাকস্বাধীনতা কতটুকু থাকবে, ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে বাকস্বাধীনতা সাংঘর্ষিক কিনা, লাগামহীন যৌনাচারের স্বাধীনতা থাকবে কিনা, গর্ভপাতের ব্যাপারটাকে কে কিভাবে দেখবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কে অংশ নিতে পারা বা কে ক্ষমতায় আসতে পারবে বা পারবে না, সেটার মাপকাঠি কি হবে, ইত্যাদি আদর্শিক ইস্যুতে পশ্চিমারা আজ বিভক্ত। 


১৪ই ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে ইতিহাস রচিত হয়েছে। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স তার ভাষণে পশ্চিমাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে নতুন এক মাপকাঠিতে দাঁড় করিয়েছেন। সকল প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলে ভ্যান্স ইউরোপের দেশগুলির আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলির জন্যে প্রধান নিরাপত্তা হুমকি রাশিয়া বা চীন বা অন্য কোন দেশ নয়; বরং তা হলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ আদর্শিক সমস্যা। তিনি বলেন যে, পশ্চিমা রাজনীতিকেরা জনগণের কথা শুনছে না। তিনি বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে কোন 'ফায়ারওয়াল' না তোলার আহ্বান জানান; এবং বলেন যে, বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে পশ্চিমাদের হয় নীতি মেনে চলা উচিৎ অথবা পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করা উচিৎ। তিনি রাজনীতিকদেরকে জনগণের কথা মেনে নেয়ার আহ্বান জানান; এমনকি জনগণ রাজনীতিকদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করলেও। ভ্যান্স ব্রিটেনে গর্ভপাতের অধিকারকে সমুন্নত রাখতে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাসের অধিকারকে পদদলিত করার কথা উল্লেখ করেন। তিনি পুরো ইউরোপে বাকস্বাধীনতার ঘাটতি নিয়ে অনেকগুলি উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি ব্রাসেলসে ইইউ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন, যেখানে বলা হয়েছে যে, ইন্টারনেটে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা ছড়ালে বিশৃংখলা বন্ধে ইইউ সোশাল মিডিয়া বন্ধ করে দিতে হতে পারে। ইন্টারনেটে ফেমিনিস্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে পোস্ট করায় পুলিশ নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে। তিনি সুইডেনে কুরআন পোড়ানোর অভিযোগে একজন খ্রিস্টানকে অভিযুক্ত করার ব্যাপারটা তুলে ধরে সেই দেশে বাকস্বাধীনতা না থাকার সমালোনা করেন। তিনি ইউরোপের প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলির মতের সাথে মিল না হওয়া একটা রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে জোর করে রোমানিয়ার নির্বাচন বাতিল করার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, যদি গণতন্ত্রকে অল্প কয়েক হাজার ডলারের অনলাইন বিজ্ঞাপণ দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলা যায়, তার অর্থ হলো ইউরোপের গণতন্ত্র দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তিনি জার্মানির সমালোচনা করে বলেন যে, মিউনিখ কনফারেন্সে বামপন্থী ও ডানপন্থী দলগুলিকে অংশ নেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভ্যান্স বলেন যে, যদি কোন দল জনগণের ভোট পেয়ে থাকে, তাহলে তাদের সাথে মতের মিল না থাকলেও অন্ততঃ কথা বলতে পারা উচিৎ। তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে যে, ইউরোপে সোভিয়েত সময়ের মত শব্দচয়নের (মিথ্যা বা ভুল তথ্য) মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপকে ভিন্ন মত দেয়া বা নির্বাচনে জেতা থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। ভ্যান্স অভিবাসনকে ইউরোপের একটা বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, এই সমস্যা গত এক দশকে রাজনীতিকদের সিদ্ধান্তের ফলাফল। তিনি কনফারেন্সের একদিন আগে মিউনিখে একজন অভিবাসী প্রত্যাশী দ্বারা হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। ভ্যান্স অভিবাসনের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলিকে আরও কঠোর হবার আহ্বান জানান।

ভ্যান্সের আগেই ন্যাটো দেশগুলির সাথে আলোচনায় মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পীট হেগসেথ ইউরোপিয়দের সামনে নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্যে ট্রাম্পের আহ্বানকে আবারও তুলে ধরেন এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন। হেগসেথের কথাগুলি সকলে হজম করে উঠতে পারার আগেই ভ্যান্সের ভাষণ নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গিয়েছে। হেগসেথ বলেছেন যে, ইউক্রেনের পক্ষে ২০১৪ পূর্ববর্তী সীমানায় ফেরত যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তিনি আরও বলেন যে, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করাটাও বাস্তবসম্মত নয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে ইউক্রেনের জন্যে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে হবে ইউরোপিয় এবং ইউরোপের বাইরের সেনাদেরকে। তবে এই সেনাদেরকে ন্যাটো জোটের 'আর্টিকেল-৫'এর অধীনে মোতায়েন করা যাবে না এবং ইউক্রেনকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে ইউক্রেনের মাটিতে কোন মার্কিন সেনাও মোতায়েন হবে না। রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে বসাতে তিনি পশ্চিমা দেশগুলিকে একত্রে তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে তেলের মূল্য কমিয়ে আনার আহ্বান জানান। ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে ইউরোপকেই বেশিরভাগ দায়িত্ব নিতে হবে বলে জানান তিনি। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন যে, ইউরোপিয় নেতাদেরকে তাদের জনগণের সাথে আলোচনা করতে হবে যাতে করে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি করার পদ্ধতি বের করা যায়। প্রতিরক্ষার জন্যে জিডিপির ২ শতাংশ যথেষ্ট নয়; প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৫ শতাংশ খরচ করার কথা বলেছেন। ইউরোপের শান্তিরক্ষায় ইউরোপিয় প্রতিরক্ষার খরচ একটা আগাম বিনিয়োগ। পারমাণবিক অস্ত্রচুক্তির বাস্তবতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে শুধুমাত্র ইউরোপকে আলাদা করে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজের নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের উপর চীনের কৌশলগত হুমকি মোকাবিলায় ইন্দোপ্যাসিফিকের নিরাপত্তাকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে; যেকারণে ইউরোপিয়দেরকে এখন নিজেদের নিরাপত্তায় এগিয়ে আসতে হবে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশের সামরিক দিক থেকে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশংসা করেন; তবে তিনি বলেন যে, দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা এবং ডিটারেন্স তৈরির ক্ষেত্রে ইউরোপকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন যে, ন্যাটোর জোট কয়েক দশক ধরে টিকে রয়েছে; তবে তা এমনি এমনিই টিকে থাকবে না। এটাকে টিকিয়ে রাখতে ইউরোপের দেশগুলিকে প্রচলিত অস্ত্রের ক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি শক্ত কন্ঠে বলেন যে, ইউরোপের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে; যেব্যাপারে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু কোন প্রকারের অসম সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করবে না; যা নির্ভরশীলতাকে উস্কে দেয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করবে।
 
যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনকে মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে ইউরোপের নিরাপত্তা ইউরোপিয়দের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে, তখন এর সমান্তরালে মার্কিনীরা আদর্শিক দিক থেকেও ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইছে। বিশেষ করে জার্মানিতে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে যখন ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন জার্মানির উগ্র ডানপন্থী দল 'অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি' বা 'এএফডি'কে সমর্থন দিচ্ছে, তখন লিবারাল ইউরোপিয়দের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। 


ইউরোপিয়রা মার্কিন লেকচার মানতে পারছে না

ইউরোপের গণতন্ত্রের ব্যাপারে ভ্যান্সএর লেকচার ইউরোপিয়রা মোটেই মেনে নিতে পারেনি। ভ্যান্সের পর স্টেজে ওঠেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস। তিনি বলেন যে, তিনি যদি ভ্যান্সের কথা বুঝে থাকেন, তাহলে ভ্যান্স ইউরোপের কিছু অংশের সাথে একনায়কতন্ত্রে চালিত সরকারের তুলনা দিয়েছেন। পিস্তোরিয়াস শক্ত কন্ঠে বলেন যে, এটা মেনে নেয়া যায় না। তার কথাগুলি পুরো শ্রোতামন্ডলী ব্যাপক করতালির মাধ্যমে সমর্থন দেয়। 'ডয়েচে ভেলে'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা 'ইইউ'এর বেশিরভাগ দেশই ন্যাটোর সদস্য। কাজেই ইইউ এবং ন্যাটোর মাঝে বেশকিছু 'ওভারল্যাপ' রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই কথা উঠছিলো যে, ইইউ তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতাকে বাড়াবে। কিন্তু এখনও ইউরোপ বেশিরভাগ অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ নিজ শক্তিতে জ্বলে উঠবে। কিন্তু সেটা এখনও হয়ে ওঠেনি। হয়তো ওয়াশিংটনে নতুন মার্কিন সরকার ইউরোপকে সেই কাজটা করতে বাধ্য করতে পারে। যদিও ইউরোপের অনেক দেশই এখনও বলছে যে, তারা ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাবে, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া তাদের এই প্রচেষ্টা কতটা এগুবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। জার্মান 'ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন' বা 'সিডিইউ'এর চেয়ারম্যান এবং নির্বাচনে চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী ফ্রিডরিক মার্জ 'ডয়েচে ভেলে'র সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, মিউনিখের এই কনফারেন্স একটা ঐতিহাসিক মুহুর্ত। হয়তো কয়েক বছর পরে বোঝা যাবে যে, এটা একটা 'টার্নিং পয়েন্ট' ছিল। ভাষণের আগেই তিনি ভ্যান্সের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন। সেই আলোচনায় ভাষণের বিষয়বস্তু না আসলেও ভ্যান্স আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি জার্মানির রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলিকে কিভাবে দেখা উচিৎ এবং পপুলিজমকে কিভাবে মোকাবিলা করা উচিৎ, সেব্যাপারে একটা শিক্ষা দেবেন। মার্জ বলছেন যে, তিনি ভ্যান্সের সাথে ভিন্নমত পোষণ করছেন। পরিষ্কারভাবেই আমেরিকানরা জার্মানির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে। এটা মার্জকে অবাক না করলেও তিনি এতে বিরক্ত। জার্মানিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কিভাবে রক্ষা করতে হবে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র বলে দিতে পারে না। মার্জ বলছেন যে, ট্রাম্পের প্রথম টার্ম থেকেই ইউরোপের নিজস্ব নিরাপত্তায় জোর দেয়া উচিৎ ছিল; যা করা হয়নি। ভূকৌশলগত কারণে জার্মানি ইউরোপের ঠিক মাঝখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। জার্মানির উচিৎ ইউরোপের মাঝে ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডের সাথে একটা নেতৃত্বশীল অবস্থান নেয়া। আর ইউরোপ থেকে আমেরিকানদের সরে যাবার বাস্তবতায় ইউরোপ জার্মানির কাছ থেকে নেতৃত্ব আশা করে।

জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক 'বেরটেলসমান ফাউন্ডেশন'এর ক্যাথরিন ক্লুভার এশব্রুক 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বহুদিনের একটা নিয়ম ভেঙ্গে ফেলেছেন; যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপিয় দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতো না এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বিদেশের মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো না। ইরাক যুদ্ধের সময় প্রাক্তন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশকা ফিশারের সাথে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ডের বিতন্ডা ছিল বিষয়ভিত্তিক। কিন্তু ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ মার্কিনীদের জন্যে একেবারেই নতুন ব্যাপার। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প আসার পর থেকে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মারাত্মক রকমের বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং ইউরোপিয়রা ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিরক্ষাসচিব পীট হেগসেথের উচ্চারিত প্রতিটা শব্দকে আলাদাভাবে বোঝার চেষ্টা করছে এবং ওয়াশিংটনের প্রকৃত বাস্তবতাকে যাচাই করতে চাইছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউরোপ থেকে তার সেনা সরিয়ে নেয়া, তাহলে ন্যাটোর 'আর্টিকেল-৫' অনুযায়ী ইউরোপের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হবে কিনা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, ইউরোপিয়রা হয়তো নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হতে পারে। যদি স্বল্প সময়ের মাঝে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার ২০ হাজার সেনা সরিয়ে নেয়, তাহলে ইউরোপিয় দেশগুলি তাদের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে ট্যাক্স বৃদ্ধি করবে, নাকি ঋণ নিয়ে এগুবার চেষ্টা করবে, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। ইউরোপের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বিকল্প তৈরি সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার মাঝে তারা কিভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। ভ্যান্সের ভাষণ শোনা অনেক ইউরোপিয়দের কাছেই মনে হয়েছে যে, ইউরোপে ব্যাপকভাবে অবৈধ অভিবাসীদের ঢলকে ইউরোপের জন্যে বড় হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়ে ভ্যান্স অল্প কিছুদিন পরেই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জার্মান নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইছেন। তিনি রোমানিয়ার নির্বাচনের ধরণ নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি হুমকি দিয়েছেন যে, যদি ইউরোপিয়রা উগ্র ডানপন্থীদেরকে রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধা দেয়, তাহলে ওয়াশিংটন ইউরোপের সাথে সম্পর্ককে আরও কঠিন করে ফেলবে। ক্যাথরিন ক্লুভার বলছেন যে, ভ্যান্স যেভাবে বলেছেন যে, ইউরোপ অবৈধ অভিবাসীদের ঢলের মাঝে রয়েছে, সেটা মোটেই সত্যি নয়। জার্মান নির্বাচনে অভিবাসন একটা ইস্যু বটে; তবে একমাত্র ইস্যু নয়।
 
ট্রাম্প চীনকে নিয়ন্ত্রণে যখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাবিদদের মাঝে ট্রাম্পের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তবে পশ্চিমা আদর্শের ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে; যা একদিকে যেমন আদর্শিক ব্যাপারগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সম্পর্কের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। নতুন বিশ্ব অব্যবস্থার এটা নতুন চেহারা।


যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ; তাই ইউরোপকে তার নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করতেই হবে

মার্কিন চিন্তাবিদেরা প্রায় সকলেই একমত যে, ইউরোপিয়রা এতকাল নিরাপত্তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে চলেছে; যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপে তার সামরিক উপস্থিতি কমাতেই হবে। এমতাবস্থায় ইউরোপকে নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে খরচ করতে হবে। তথাপি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের হস্তক্ষেপকে মার্কিন চিন্তাবিদদের অনেকেই পছন্দ করেননি। প্রাক্তন মার্কিন উপ-সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব জিম টাউনসেন্ড ব্রিটিশ মিডিয়া 'টাইমস রেডিও'কে বলেন যে, মিউনিখ কনফারেন্সে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পীট হেগসেথ ইউক্রেন নিয়ে যেসব কথা বলেছেন এবং এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ইউরোপ নিয়ে সম্পূর্ণ অন্য ধারায় যেসকল কথা বলেছেন, সেগুলি নিয়ে হিসেব করতেই সকলে হিমসিম খাচ্ছেন। তবে ভ্যান্সের ভাষণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের উপর মারাত্মক আঘাত। ভ্যান্স ইউরোপের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কথা বলতে পারেন না। টাউনসেন্ড বলছেন যে, বহু বছর ধরেই ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় কমিয়ে রাখার সমস্যা চলছে। প্রায় বছর দুয়েক ধরেই টাউনসেন্ড এবং অন্যান্যরা ইউরোপিয়দের বলছিলেন যে, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ইউরোপের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। ইউরোপিয়রা এতদিন কথা কানে নেয়নি; এখন কোনকিছু করার ক্ষেত্রে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন যদি ইউরোপ তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে, তাহলেও তাদের সামরিক ইন্ডাস্ট্রিগুলিকে জায়গামতো নিয়ে আসতে অনেক বছর লেগে যাবে। তাই আজকে ইউরোপের প্রচেষ্টাকে তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি করতে হবে। টাউনসেন্ড দুঃখ করে বলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারশ প্যাক্টের জোটের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা একত্রে সাফল্য পেয়েছে; কিন্তু এখন সেই জোটে ভাঙ্গন দেখা যাচ্ছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি 'ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি' বা 'এনএসএ'র প্রাক্তন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল মাইল রজার্স নিরাপত্তা ম্যাগাজিন 'সাইফার ব্রীফ'কে বলছেন যে, ইউরোপিয়রা এখন চিন্তা করছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের কথাগুলি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা কিনা। অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউরোপিয়দের এখন নতুন ধরণের কোন সম্পর্কে যেতে হবে কিনা। ইউরোপিয়রা যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তাহলে প্রশ্ন করতে হবে যে, এক্ষেত্রে ইউরোপের নিজস্ব কোন বিকল্প সমাধান রয়েছে কিনা।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা জোটের মাঝে আদর্শিক ফাটল এখন দৃশ্যমান। বাকস্বাধীনতা কতটুকু থাকবে, ধর্মীয় স্বাধীনতার সাথে বাকস্বাধীনতা সাংঘর্ষিক কিনা, লাগামহীন যৌনাচারের স্বাধীনতা থাকবে কিনা, গর্ভপাতের ব্যাপারটাকে কে কিভাবে দেখবে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কে অংশ নিতে পারা বা কে ক্ষমতায় আসতে পারবে বা পারবে না, সেটার মাপকাঠি কি হবে, ইত্যাদি আদর্শিক ইস্যুতে পশ্চিমারা আজ বিভক্ত। কেউ কেউ যদিও বোঝার চেষ্টা করছেন যে, এই বিভক্তি শুধুমাত্র ট্রাম্পের কারণে কিনা, তথাপি তারা এড়িয়ে যেতে পারেন না যে, ট্রাম্প বিপুল ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। ইউরোপিয়রা একইসাথে চিন্তিত যে, ইউরোপিয় লিবারাল সেকুলার আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তাধারার উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে বিপুল ভোট পাচ্ছে; কারণ লিবারাল চিন্তার রাজনীতিকেরা জনগণের সমস্যার সমাধান দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনকে মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে ইউরোপের নিরাপত্তা ইউরোপিয়দের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে, তখন এর সমান্তরালে মার্কিনীরা আদর্শিক দিক থেকেও ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চাইছে। বিশেষ করে জার্মানিতে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে যখন ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন জার্মানির উগ্র ডানপন্থী দল 'অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি' বা 'এএফডি'কে সমর্থন দিচ্ছে, তখন লিবারাল ইউরোপিয়দের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ট্রাম্প চীনকে নিয়ন্ত্রণে যখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাবিদদের মাঝে ট্রাম্পের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তবে পশ্চিমা আদর্শের ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে; যা একদিকে যেমন আদর্শিক ব্যাপারগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সম্পর্কের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। নতুন বিশ্ব অব্যবস্থার এটা নতুন চেহারা।

Monday, 10 February 2025

ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কি?

১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গত ১৫ মাসে গাজায় ইস্রাইলি হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে মিশর ও জর্দান সরকার ইস্রাইলকে নিরাপত্তা দিয়েছে। কাজেই গাজার অধিবাসীদেরকে এই দুই দেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টাটাই প্রাধান্য পাবে। সৌদিদেরকে রাজি করাবার বিভিন্ন অস্ত্রও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। অভিভাবকহীন ফিলিস্তিনিদের জন্যে সবচাইতে দুঃখজনক হলো, জাতীয়তাবাদে বিভক্ত মুসলিমরা ফিলিস্তিনের সমস্যাকে নিজেদের সমস্যা হিসেবে দেখেনি। শুধু তা-ই নয়, ইস্রাইলের রক্ষাকর্তা যুক্তরাষ্ট্রকেও তারা নিয়েছে সবচাইতে কাছের বন্ধু হিসেবে। 


গত ৫ই ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজে ইস্রাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সন্মেলনে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র, যাদের অন্তরে মানুষের জন্যে ভালোবাসা রয়েছে, তারা গাজার ১৮ লক্ষ মানুষের বসবাসের জন্যে ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। এটা একটা বা অনেক স্থানেও হতে পারে। তবে সেখানে মানুষ শান্তিতে এবং আরামে থাকতে পারবে। এই মুহুর্তে ফিলিস্তিনিরা আবারও গাজায় ফেরত যেতে চায়, কারণ তাদের যাবার আর কোন বিকল্প স্থান নেই। গাজা এখন একটা ধ্বংসস্তূপ; যেখানে সকল বাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই কর্মকান্ডের অর্থায়ন করতে পারে পার্শ্ববর্তী সেসকল রাষ্ট্র, যাদের প্রচুর সম্পদ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে এবং মালিকানা নেবে। যুক্তরাষ্ট্র গাজা থেকে সকল বিস্ফোরক সরিয়ে ফেলবে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন সরিয়ে পুরো এলাকা সমান করে সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রতিষ্ঠা করবে; যেখানে অত্র অঞ্চলের বহু মানুষের থাকার ব্যবস্থা হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গাজার জনগণ যদি গাজায় ফেরত যায়, তাহলে সেখানকার অবস্থা আগের মতোই থেকে যাবে। ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পরপরই বিশ্বজুড়ে ধিক্কার শুরু হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ইস্রাইল সরকার ট্রাম্পের কথার প্রশংসা করেছে। হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র ক্যারোলাইন লীভিট সাংবাদিকদের বলেন যে, এই মুহুর্তে গাজা বসবাসযোগ্য নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজার পুনর্নির্মাণের কথা বলেছেন। লীভিট এবং মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মারকো রুবিও যখন ট্রাম্পের কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলেন, তখন ৬ই ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প আবারও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কোন মার্কিন সেনা না পাঠিয়েই গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। তিনি সোশাল মিডিয়া 'ট্রুথ সোশাল'এর এক বার্তায় বলেন যে, এই অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদেরকে আরও নিরাপদ এবং সুন্দর স্থানে থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখন বলছেন যে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদেরকে অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেয়া হবে, তখন তার পরিকল্পনার ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে ১০ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন মিডিয়া 'ফক্স নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে ট্রাম্প বলেন যে, গাজা থেকে চলে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের গাজায় ফেরত আসার আর কোন অধিকার থাকবে না।

‘সিএনএন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গাজার অধিবাসীদের সাথে তারা কথা বলে বুঝতে পেরেছেন যে, ফিলিস্তিনিরা গাজা ছেড়ে যেতে চান না। রিজিক আবু-সিত্তা নামের একজন ফিলিস্তিনি বৃদ্ধা বলছেন যে, তার সকল সন্তানদের বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তার নিজের অর্ধ-ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির ভেতর এখন বৃষ্টির পানি এবং ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। কিন্তু এরপরেও তিনি গাজা ছেড়ে যেতে চান না; যদি তাকে তাঁবুতে থাকতে হয়, তাহলেও তিনি গাজায় থাকবেন। এমনকি তারা যদি তাকে থাকার জন্যে প্রাসাদও দেয়, তাহলেও তিনি গাজা ছেড়ে যাবেন না। সামি রামাদান নামের আরেকজন বৃদ্ধ বলছেন যে, তিনি তার নিজের জমিতে মৃত্যুবরণ করতে চান। তিনি গাজায় জন্মেছেন; এখানেই পড়াশোনা করেছেন; এখানেই সারা জীবন কাটিয়েছে; তিনি এখানেই বিয়ে করেছেন এবং তার সন্তানরাও এখানেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলছেন যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, তিনি কখনোই এই ভূমি ছেড়ে যাবেন না। 'ডয়েচে ভেলে'কে গাজার একজন মহিলা বলেন যে, গাজা ছেড়ে যাওয়ার চাইতে এখানে মারা যাওয়া উত্তম। কারণ গাজা ছেড়ে গেলে তাদের দেশ, ভূমি এবং বাড়ি কোনটাই থাকবে না।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার সরাসরি ট্রাম্পের সমালোচনা করেনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিনি বলেন যে, গাজার অধিবাসীদের অধিকার রয়েছে তাদের বাড়িতে ফেরত যাবার এবং তাদের বাড়িঘর নতুন করে তৈরি করার। ব্রিটিশদের উচিৎ 'টু-স্টেট সলিউশন'এর বাস্তবায়নে গাজার অধিবাসীদের সহায়তা প্রদান করা। অপরদিকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেন যে, গাজার অধিবাসীদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়াটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না এবং এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এক যৌথ বিবৃতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি বলেন যে, গাজা বা পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের জোরপূর্বক স্থানান্তর মেনে নেয়া যায় না। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং 'টু-স্টেট সলিউশন'এর জন্যে বাধা। এবং একইসাথে এটা মিশর ও জর্দানের জন্যে প্রধান অস্থিতিশীলতার শক্তি হিসেবে কাজ কবে। ফরাসি পররাষ্ট্র দপ্তর থেকেও একইরকম বার্তা দেয়া হয় এবং সেই বার্তাতেও ট্রাম্পের সরাসরি সমালোচনা করা হয়নি।
 
প্রশ্ন করতে হবে যে, কে গাজাকে বসবাসের অনুপযোগী করলো? এবং কোন অস্ত্র দ্বারা গাজাকে ধ্বংস করা হয়েছে? আমেরিকার সরবরাহকৃত ৮৬ হাজার টন বোমার আঘাতে ইস্রাইলিরা সবচাইতে অমানুষিকভাবে গাজাকে ধ্বংস করেছে। ১৯৪৮ সালে ইস্রাইল ফিলিস্তিনের ৭০ শতাংশ জনগণকে ঘরছাড়া করলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমি ছেড়ে যায়নি। এবং ইস্রাইল কখনোই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের বাড়িঘরে ফেরত যেতে দেয়নি। কাজেই যখন ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলছেন যে, গাজাবাসীদের যারা চলে যেতে চান, তার চলে যেতে পারেন; আর যারা পরে ফেরত আসতে চান, তারা ফেরত আসতে পারবে, তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন। নেতানিয়াহু সর্বদাই মিথ্যা কথা বলেন এবং এখনও বলছেন।



‘টু-স্টেট সলিউশন'এর ভবিষ্যৎ কি?

'ডয়েচে ভেলে'র সাথে সাক্ষাতে ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ মুস্তফা বারঘুতি বলছেন যে, ট্রাম্প কোন খরচ না দিয়েই গাজার ভূমি চুরি করতে চাইছেন। এবং একইসাথে তিনি খুব সম্ভবতঃ গাজার ৫৪ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের গ্যাসফিল্ড দখল করার স্বপ্ন দেখছেন। যখন ট্রাম্প বলছেন যে, গাজা বসবাসযোগ্য নয়, তখন প্রশ্ন করতে হবে যে, কে গাজাকে বসবাসের অনুপযোগী করলো? এবং কোন অস্ত্র দ্বারা গাজাকে ধ্বংস করা হয়েছে? আমেরিকার সরবরাহকৃত ৮৬ হাজার টন বোমার আঘাতে ইস্রাইলিরা সবচাইতে অমানুষিকভাবে গাজাকে ধ্বংস করেছে। ১৯৪৮ সালে ইস্রাইল ফিলিস্তিনের ৭০ শতাংশ জনগণকে ঘরছাড়া করলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমি ছেড়ে যায়নি। এবং ইস্রাইল কখনোই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের বাড়িঘরে ফেরত যেতে দেয়নি। তারা ৯২০টা সামরিক চেকপয়েন্টের মাধ্যমে পশ্চিম তীরের জনগণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। কাজেই যখন ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলছেন যে, গাজাবাসীদের যারা চলে যেতে চান, তার চলে যেতে পারেন; আর যারা পরে ফেরত আসতে চান, তারা ফেরত আসতে পারবে, তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন। তিনি চাইছেন যে, ফিলিস্তিনিরা চলে যাক এবং আর কখনো ফেরত না আসুক। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি ফিলিস্তিনের সীমানা নিয়ন্ত্রণ করবেন। যদি গাজাবাসীদের জন্যে ইস্রাইলের দরদই থাকতো, তাহলে তারা গাজায় মানবিক ত্রাণ যেতে বাধা দিতো না। তারা গাজার অভ্যন্তরে ডাক্তার এবং মেডিক্যাল সরঞ্জামও যেতে দিচ্ছে না। নেতানিয়াহু সর্বদাই মিথ্যা কথা বলেন এবং এখনও বলছেন।

মুস্তফা বারঘুতি আরও বলছেন যে, ইস্রাইলের প্রতি পক্ষপাতের কারণে বাইডেনের সময়েও যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্ততাকারী হতে পারেনি; এখনও সেটা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলের সবচাইতে বড় সমর্থক; যেকারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মধ্যস্ততাকারী হওয়া সম্ভব নয়। এই মুহুর্তে ফিলিস্তিনের জন্যে দু'টা সমাধান রয়েছে - প্রথমতঃ ৭৩ লক্ষ ফিলিস্তিনি এবং ৭১ লক্ষ ইস্রাইলিকে একত্রে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করা; অথবা দ্বিতীয়তঃ 'টু-স্টেট সলিউশন' বা দু'টা রাষ্ট্র তৈরি করা; যেখানে ইস্রাইল এবং ফিলিস্তিন নামে দু'টা রাষ্ট্র তৈরি করা হবে। ইস্রাইলিরা এই দু'টা অপশনই ত্যাগ করেছে। বরং ট্রাম্পের প্রস্তাব হলো সেটাই যেটা নেতানিয়াহু বলছেন; আর তা হলো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর জাতিগত নিধন। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদেরা দু'টা সমাধানের যেকোন একটা মেনে নিতে রাজি আছে। ‘সিএনএন'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, গাজার অধিবাসীদের গাজা থেকে বের করে দেয়ার অর্থ হলো 'টু-স্টেট সলিউশন'এর সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যাওয়া। এটা এখন নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, মুখে না বললেও বাস্তবিক অর্থে ট্রাম্প প্রশাসন 'টু-স্টেট সলিউশন' সমর্থন করে না এবং দু'টা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার জন্যে ইস্রাইলকে ভূমি ছেড়ে দেয়ার জন্যে ট্রাম্প কোনরূপ চাপ প্রদান করবেন না। বারঘুতি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের 'আব্রাহাম একর্ড'এর মাধ্যমে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না যদি ওয়াশিংটন 'টু-স্টেট সলিউশন' সমর্থন না করে। আর সৌদিদের ছাড়া ট্রাম্পের এই প্রকল্প বাস্তব রূপ পাবেন না।
 
ইস্রাইলি বর্বরতায় প্রায় অর্ধলক্ষ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর সময় পশ্চিমারা ইস্রাইলের নিরাপত্তা রক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। লিবারাল চিন্তার পশ্চিমা মিডিয়াগুলি এই পুরো সময় গাজায় ইস্রাইলের বর্বরতার খবর পুরোপুরিভাবে সেন্সর করেছে। অথচ ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা ঘোষণার সাথেসাথেই প্রায় সকল পশ্চিমা মিডিয়া একসাথে ট্রাম্পের বিরোধিতা করা শুরু করেছে; যেন ট্রাম্পই প্রথম ইস্রাইলের বর্বর প্রকল্পে সমর্থন দিয়েছেন! প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদেরকে বাস্তুচ্যুত করার যে প্রকল্প নিয়েছে, তা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মুলের ব্রিটিশ-ইস্রাইলি প্রকল্পেরই অনুরূপ। কাজেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর গাজাবাসীদের জন্যে মায়াকান্না হাস্যকরই বটে!


ট্রাম্পের প্রকল্প কতটুকু বাস্তব?

ইস্রাইলি সাংবাদিক বালিগ স্লাডেন 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ইস্রাইলিরা ইতোমধ্যেই চিন্তা করছে যে, যেসকল দেশ (যেমন স্পেন এবং আয়ারল্যান্ড) গাজায় ইস্রাইলের অভিযানের বিরোধিতা করেছে, সেসব দেশে গাজাবাসীদেরকে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা। ট্রাম্পের প্রস্তাব ইস্রাইলিদের এধরণের চিন্তার সাথেই যায়। এই মুহুর্তে ইস্রাইলের ৫২ শতাংশ জনগণ মনে করছে যে ট্রাম্পের প্রস্তাব বাস্তব। অপরদিকে ৩০ শতাংশ জনগণ মনে করছে যে, এই প্রকল্প বাস্তব নয়; তবে তারা আশা করে যে এই প্রস্তাব বাস্তব করা গেলে খুবই ভালো হতো। অর্থাৎ ইস্রাইলের বেশিরভাগ জনগণই মনে করে যে ৭ই অক্টোবরের হামলা এবং বহু বছরের সংঘাতের পর 'গাজা সমস্যা'র সমাধান হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, ইস্রাইলের হিসেবে গাজার ৪৪ শতাংশ জনগণ গাজা ত্যাগ করার পক্ষপাতি।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পীস'এর ডিরেক্টর আমির হামজাউই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারি মিডিয়া 'দ্যা ন্যাশনাল'এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সিরিয়া থেকে আমেরিকান সৈন্যদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। এখন যদি তিনি গাজায় মার্কিন সেনা মোতায়েন করতে যান, সেটা তার নিজের বলা নীতির সাথে কতটুকু যায়? আর যদি মার্কিন সেনাদেরকে গাজাতে মোতায়েন করা না হয়, তাহলে কারা তাদের স্থান নেবে? যদি ফিলিস্তিনিরা সেখান থেকে চলে যেতে না চায়, তাহলে তিনি তাদেরকে কি করে বের করবেন? ট্রাম্পকে যারা ভোট দিয়েছিল, তাদের প্রতি ট্রাম্পের দায় রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকে তিনি এখনও রাজি করাতে পারেননি; ইউরোপিয়রাও না বলছে; আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও না বলছে। আর কয়েক'শ বা কয়েক হাজার মানুষকে যদি অন্য কোন দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ও, ২০ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে ফেলা মোটেই সহজ কথা নয়। আর চুপিসারে গাজাবাসীদেরকে সরিয়ে ফেলাও কঠিন। কারণ এর আগেও বিভিন্নভাবে ফিলিস্তিনিদেরকে চুপিসারে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে; প্রতিবারই সেগুলি ভেস্তে গেছে। ফিলিস্তিনিরা জানে যে, এখান থেকে সরে যাবার অর্থ কি।

'সিএনএন'এর সামরিক বিশ্লেষক মার্কিন বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কর্নেল সেডরিক লেইটন বলছেন যে, যদিও ট্রাম্প বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বন্ধু দেশগুলিকে একত্রে নিয়ে তিনি এই নীতি বাস্তবায়ন করবেন, তথাপি এটা নিশ্চিত যে মধ্যপ্রাচ্যে ইস্রাইলের দুই প্রতিবেশী দেশ মিশর ও জর্দান গাজা থেকে কোন ফিলিস্তিনি শরণার্থী নিতে রাজি নয়। কাতারের কাছ থেকে হাল্কা সাড়া পাওয়া গেলেও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে গাজায় মোতায়েন করার জন্যে কোন শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকেও শান্তিরক্ষী বাহিনী যোগাড় করার প্রস্তাব কেউ দেয়নি। লেবানন এবং গোলান মালভূমির মতো শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের কোন প্রস্তাব জাতিসংঘের কাছ থেকেও আসেনি। এখানে একদিকে যেমন কূটনৈতিক দিক থেকে স্থবিরতা রয়েছে, তেমনি গাজায় এধরণের কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে অবকাঠামোও নেই।

কর্নেল লেইটন আরও বলছেন যে, গাজাতে এখনও হামাসের যোদ্ধারা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি গাজাকে জনশূণ্য করতে চায়, তাহলে বাধা আসতে পারে। আর গাজাকে দখলে রাখতে ইস্রাইলি সেনাবাহিনী কমপক্ষে ১০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছিল। এই সংখ্যক সেনা মোতায়েন রাখতে আরও অনেক সেনাকে আবর্তনের মাঝে রাখতে হয়েছে। কাজেই এধরণের একটা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ থেকে ২০ হাজার সেনার প্রয়োজন হবে। এর উপরে থাকবে এয়ার সাপোর্ট, ইন্টেলিজেন্স, লজিস্টিকস, নৌবাহিনীর সাপোর্ট, ইত্যাদি। এটা কোন ছোট অপারেশন হবে না; যা বাস্তবায়ন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যান্য বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট ( যার মাঝে থাকতে পারে ইউক্রেন এবং তাইওয়ান) থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হবে যেগুলির উপরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যেই গুরুত্বারোপ করেছেন। বিশ্বের অন্য এলাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক এবং ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতাকে সরিয়ে নিয়ে গাজায় মোতায়েন করতে হবে। কর্নেল লেইটন মনে করছেন না যে, এগুলি নিয়ে কেউ খুব একটা চিন্তা করেছে।

আমির হামজাউই 'দ্যা ন্যাশনাল'কে বলছেন যে, ট্রাম্প বলেছেন যে, গাজা পুনর্নির্মাণ করতে ১৫ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এবং ট্রাম্প গাজাবাসীদেরকে সরিয়ে ফেলার পিছনে এই সময়টাকে একটা ছুতো হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যদিও পুনর্নির্মাণে সময় লাগবে, তথাপি গাজার সকল স্থানে তো ১০ থেকে ১৫ বছর লাগবে না পুনর্নির্মাণ করতে। যেহেতু গাজার ভেতরেই গাজার জনগণ একস্থান থেকে অন্যস্থানে গিয়েছে, কাজেই এই মানুষগুলিকে গাজার ভেতরে রেখেই কয়েকটা ফেইজে গাজা পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব। সুতরাং গাজাবাসীদেরকে সরিয়ে দেয়া এবং গাজার পুনর্নির্মাণ করার ট্রাম্পের প্রকল্প একটা আরেকটা সাথে যাচ্ছে না।
 
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা যখন বলছেন যে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদেরকে অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেয়া হবে, তখন তার পরিকল্পনার ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে ১০ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন মিডিয়া 'ফক্স নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে ট্রাম্প বলেন যে, গাজা থেকে চলে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের গাজায় ফেরত আসার আর কোন অধিকার থাকবে না। ফিলিস্তিনিরা গাজা ছেড়ে যেতে চান না। রিজিক আবু-সিত্তা নামের একজন ফিলিস্তিনি বৃদ্ধা বলছেন যে, তার সকল সন্তানদের বাড়িঘর ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তার নিজের অর্ধ-ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির ভেতর এখন বৃষ্টির পানি এবং ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। কিন্তু এরপরেও তিনি গাজা ছেড়ে যেতে চান না; যদি তাকে তাঁবুতে থাকতে হয়, তাহলেও তিনি গাজায় থাকবেন। এমনকি তারা যদি তাকে থাকার জন্যে প্রাসাদও দেয়, তাহলেও তিনি গাজা ছেড়ে যাবেন না। 


মিশর, জর্দান ও সৌদিদেরকে রাজি করাতে পারবেন ট্রাম্প?

১০ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন মিডিয়া 'ফক্স নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে ট্রাম্প বলেন যে, তিনি মনে করেন যে, মিশর, জর্দান ও অন্যান্য দেশ গাজার অধিবাসীদেরকে থাকার জায়গা দেবে। আর যদি মিশর ও জর্দান ট্রাম্পের পরিকল্পনার ব্যাপারে রাজি না হয়, তাহলে তিনি এই দুই দেশের জন্যে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারেন। আমির হামজাউই 'দ্যা ন্যাশনাল'কে বলছেন যে, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে ট্রাম্প তার আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধের কার্ডকে ব্যবহার করে মিশরকে রাজি করাতে পারবেন কিনা। এই মুহুর্তে মিশরকে যুক্তরাষ্ট্র আড়াই'শ থেকে তিন'শ মিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়, যা তেমন বড় কিছু নয় এবং মিশর অন্য কোথাও থেকে সেটা সহজেই যোগাড় করতে সক্ষম হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র মিশরের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিলে তাতে মিশরের ক্ষতি হবে। তথাপি ২০১৪ সালের পর থেকে মিশর সরকার তার সামরিক সরঞ্জাম যোগাড়ের উৎসে বৈচিত্র্য এনেছে। গাজার নতুন প্রকল্প যদি মিশরের অস্তিত্ব সংকট রূপে দেখা দেয়, তাহলে মিশর রাজি না-ও হতে পারে। গাজার প্রকল্প যে পশ্চিম তীরের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হবে না, সেটার কোন গ্যারান্টি নেই। সেটা হলে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের পুরো ব্যাপারটাই বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখেও মিশর না বলতে পারে। আর ফিলিস্তিনিদেরকে শরণার্থী হিসেবে নেয়ার খরচটা শুধু মিশরের সরকারের নয়, জনগণের একটা বড় অংশকেও নিতে হবে; যারা এই প্রকল্পে সায় দেবে না। হামজাউই বলছেন যে, ট্রাম্পের প্রকল্প বাস্তবায়নে সৌদিদেরকে সাথে নেয়ার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সৌদিদেরকে রাজি করাতে সৌদি আরবের নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রয়োজন হতে পারে; তাদেরকে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির প্রযুক্তি দেয়ার কথাও আসতে পারে। যদি ট্রাম্প ইস্রাইলের উগ্র ডানপন্থীদের নীতিকে অনুসরণ করতে থাকেন, তাহলে ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইচ্ছায় ঘাটতি দেখা দেবে। এছাড়াও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও অস্তিত্বগত চাপের বাস্তবতার মুখে পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলির সাথে মিশর ও জর্দানের সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে।

জর্দান থেকে অবশ্য ট্রাম্পের নীতিকে তোষণের কথাই শোনা যাচ্ছে। জর্দানের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক আমের সাবাইলেহ 'দ্যা ন্যাশনাল'কে বলছেন যে, জর্দানিরা মনে করে যে ফিলিস্তিনের ইস্যু তাদের নিজেদের ইস্যু। একারণেই জর্দানিদের দ্বারা রাজনৈতিক উদ্বেগ প্রকাশ বা রাস্তায় বিক্ষোভ করার মতো কাজগুলি সম্ভব হয়েছে। তবে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে জর্দান যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। জর্দানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই মার্কিন-বিরোধিতা নেই। কাজেই জর্দান নিঃসন্দেহেই ট্রাম্পের সাথে আলোচনায় বসবে। সাবাইলেহ মনে করছেন যে, জনপ্রিয় সিদ্ধান্তের চাইতে বাস্তবতা-কেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইস্রাইলের সাথে চুক্তি থাকার পরেও গত দেড় বছরে জর্দানকে সবচাইতে বেশি ইস্রাইল-বিরোধী দেখা গেছে; যা বাস্তবতা-বিরুদ্ধ। জর্দানের জনগণ বুঝতে পারছে না যে, মার্কিন-বিরোধী রাষ্ট্রের তকমা জর্দানের জন্যে কতটা বিপদের হতে পারে।
 
ট্রাম্প মূলতঃ ইস্রাইলের চিন্তাটাকেই প্রকল্প রূপে ব্যাখ্যা করেছেন; যেটাকে পুঁজি করেই ইস্রাইল ১৫ মাস ধরে গাজার সকল ভবন ধ্বংস করে পুরো অঞ্চলকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। মার্কিন সরকারের, বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসনের সরবরাহ করা ৮৬ হাজার টন বোমার মাধ্যমে এই অমানবিক প্রকল্প বাস্তবতা পেয়েছে। এই পুরো সময় লিবারাল চিন্তার পশ্চিমা সরকারগুলি সকলেই গতবাধা একটা লাইন বলে গিয়েছে - ‘ইস্রাইলের নিজেকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে'। ইস্রাইলি বর্বরতায় প্রায় অর্ধলক্ষ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর সময় পশ্চিমারা ইস্রাইলের নিরাপত্তা রক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। 



ট্রাম্পের প্রস্তাবের সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে?

'নিউ ইয়র্ক টাইমস'এর প্রবীণ সাংবাদিক এবং লেখক ডেভিড স্যাংগার 'সিএনএন'কে বলছেন যে, জর্দানের রাজার কাঁধের উপরে এই মুহুর্তে বিশাল ফিলিস্তিনি জনগণের বোঝা রয়েছে; যা কিনা জর্দানের জন্যে অস্থিতিশীলতার কারণ। ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধগুলিকে বন্ধ করবেন; যার মাঝে ছিল ইরাক এবং আফগানিস্তান। কাজেই এটা অবাক করার বিষয় যে তিনি এমন একটা সামরিক মিশনের কথা বলছেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ১৫ থেকে ২০ বছর স্থায়ী হতে পারে। এবং এরূপ একটা মিশন ট্রাম্পের নিজের প্রশাসনকেও বিভক্ত করে ফেলবে। তিনি এমন কিছু লোককে তার সরকারে নিয়েছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে জড়ানোকে পছন্দ করেননি এবং যারা চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সকল শক্তিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করে তাইওয়ানকে রক্ষা করতে।

তবে অনেক বিশ্লেষকই গত সাত দশকের ইস্রাইলি দখলদারিত্বকে সমস্যার কেন্দ্রে না টেনে ২০০১-পরবর্তী তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সাথে ফিলিস্তিন ইস্যুকে ট্যাগ করতে চাইছেন। আমির হামজাউই 'দ্যা ন্যাশনাল'কে বলছেন যে, ট্রাম্প ইস্রাইলের সাথে বসে ফিলিস্তিনিদের কোন মতামত না নিয়েই তাদেরকে নিয়ে পরিকল্পনা করছেন; যা ফিলিস্তিনিদের বহুকালের সংগ্রামের সাথে সাংঘর্ষিক। হামজাউই মনে করছেন যে, এহেন প্রকল্প আরও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে এবং পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে; এবং মার্কিন-বিরোধী চিন্তাকে উস্কে দিতে পারে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস মার্কিন মিডিয়া 'এমএসএনবিসি'কে বলছেন যে, ট্রাম্পের এই প্রস্তাব সিআইএ-এর মধ্যপ্রাচ্যের সকল স্টেশন প্রধানদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এটা সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকান্ডের জন্যে একটা দুঃস্বপ্ন। ট্রাম্প বলছেন যে, তিনি গাজার 'নিয়ন্ত্রণ' নেবেন এবং গাজার 'মালিকানা' নেবেন। এই শব্দগুলি ইসলামিক জিহাদি গ্রুপগুলি রিক্রুটিংএর জন্যে ব্যবহার করে। 'টেক এগেইনস্ট টেরোরিস্টস' এনজিওএর বিশ্লেষক লুকাস ওয়েবার 'এনবিসি'কে বলছেন যে, জিহাদি গ্রুপগুলি গাজার সংঘাত এবং ফিলিস্তিনি জনগণের কষ্টকে পুঁজি করে মার্কিন সরকারের উপর হামলা করার জন্যে উৎসাহ যোগাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যেই সোশাল মিডিয়াতে ট্রাম্পের কথাগুলিকে প্রচার করছে। 'ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো'র প্রফেসর রবার্ট পেইপ 'এনবিসি'কে বলছেন যে, ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মার্কিনীদের বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় সুইসাইড হামলা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলতে শুরু করার পর থেকে এই হামলা যথেষ্টই কমে গেছে। অনেক বছর ধরেই এই গ্রুপগুলি ট্রাম্পের পরিকল্পনার মতো একটা ছুতো খুঁজছিলো। পেইপ বলছেন যে, ট্রাম্প যদি তার বক্তব্য থেকে সড়েও আসেন, বা তিনি যদি গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবার ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না-ও করেন, তবুও জিহাদি গ্রুপগুলি ধরেই নেবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রয়েছে গাজার উপর। ক্ষতি যা হবার হয়েই গেছে। বাস্তবতাকে ঘুরিয়ে এখন কোন লাভ হবে না।

ট্রাম্প মূলতঃ ইস্রাইলের চিন্তাটাকেই প্রকল্প রূপে ব্যাখ্যা করেছেন; যেটাকে পুঁজি করেই ইস্রাইল ১৫ মাস ধরে গাজার সকল ভবন ধ্বংস করে পুরো অঞ্চলকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। মার্কিন সরকারের, বিশেষ করে বাইডেন প্রশাসনের সরবরাহ করা ৮৬ হাজার টন বোমার মাধ্যমে এই অমানবিক প্রকল্প বাস্তবতা পেয়েছে। এই পুরো সময় লিবারাল চিন্তার পশ্চিমা সরকারগুলি সকলেই গতবাধা একটা লাইন বলে গিয়েছে - ‘ইস্রাইলের নিজেকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে'। ইস্রাইলি বর্বরতায় প্রায় অর্ধলক্ষ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর সময় পশ্চিমারা ইস্রাইলের নিরাপত্তা রক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। লিবারাল চিন্তার পশ্চিমা মিডিয়াগুলি এই পুরো সময় গাজায় ইস্রাইলের বর্বরতার খবর পুরোপুরিভাবে সেন্সর করেছে। অথচ ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা ঘোষণার সাথেসাথেই প্রায় সকল পশ্চিমা মিডিয়া একসাথে ট্রাম্পের বিরোধিতা করা শুরু করেছে; যেন ট্রাম্পই প্রথম ইস্রাইলের বর্বর প্রকল্পে সমর্থন দিয়েছেন! প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদেরকে বাস্তুচ্যুত করার যে প্রকল্প নিয়েছে, তা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মুলের ব্রিটিশ-ইস্রাইলি প্রকল্পেরই অনুরূপ। কাজেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর গাজাবাসীদের জন্যে মায়াকান্না হাস্যকরই বটে। মিশর ও জর্দানের সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টি করার সক্ষমতা যথেষ্ট। আর গত ১৫ মাসে গাজায় ইস্রাইলি হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে মিশর ও জর্দান সরকার ইস্রাইলকে নিরাপত্তা দিয়েছে। কাজেই গাজার অধিবাসীদেরকে এই দুই দেশে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টাটাই প্রাধান্য পাবে। সৌদিদেরকে রাজি করাবার বিভিন্ন অস্ত্রও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। অভিভাবকহীন ফিলিস্তিনিদের জন্যে সবচাইতে দুঃখজনক হলো, জাতীয়তাবাদে বিভক্ত মুসলিমরা ফিলিস্তিনের সমস্যাকে নিজেদের সমস্যা হিসেবে দেখেনি। শুধু তা-ই নয়, ইস্রাইলের রক্ষাকর্তা যুক্তরাষ্ট্রকেও তারা নিয়েছে সবচাইতে কাছের বন্ধু হিসেবে। ট্রাম্প আতঙ্কে সকলেই আজ ভীত! ট্রাম্প অখুশি হন, এমন কিছুই কেউ করতে চাইছে না!

Sunday, 9 February 2025

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো এবং ইউরোপ কি বৈশ্বিক পুলিশম্যান?

০৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ইতালিয় যুদ্ধজাহাজের গ্রুপের সাথে যুক্ত হয় আরেকটা ইতালিয় ফ্রিগেট 'রাইমন্ডো মন্টেকোকুলি'। এই জাহাজটা হাওয়াই দ্বীপে 'রিমপ্যাক ২০২৪' মহড়ায় অংশ নেয়। ইতালিয় জাহাজের গ্রুপ ২০২৪এর অগাস্টে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের পূর্বে ফিলিপাইন সাগরে জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ইজুমো', ডেস্ট্রয়ার 'ওনামি', ফরাসি ফ্রিগেট 'ব্রেটানি', জার্মান ফ্রিগেট 'বাডেন-উট্টেমবার্গ' ও সাপ্লাই জাহাজ 'ফ্রাঙ্কফুর্ট আম-মেইন' এবং অস্ট্রেলিয়ান ডেস্ট্রয়ার 'সিডনি'র সাথে 'নোবেল র‍্যাভেন ২৪-৩' যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়।  


পেশী শক্তির প্রদর্শন – শুধু ইউরোপ নয়; বিশ্বের সকল প্রান্তে

২০২৩এর অগাস্টে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে 'ডালো ইন্ডাস্ট্রি ডেইজ ২০২৩' নামের সামরিক মেলায় ডেনমার্কের নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল হেনরিক রাইবার্গ 'নেভাল নিউজ'কে বলেন যে, ডেনমার্কের নৌবাহিনী প্রতি বছর অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদেশের কমপক্ষে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের স্ট্রাইক গ্রুপের সাথে একত্রিত হয়ে ডেনমার্ক থেকে দূরের গন্তব্যে বিভিন্ন মিশনে অংশ নেয়ার লক্ষ্য রেখেছে। এই মুহুর্তে ন্যাটোর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সাথে তারা কাজ করতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগরে ফরাসী বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সাথে ড্যানিশ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন ছিল। ড্যানিশ নৌবাহিনী প্রধানের কথাগুলি যে শুধু ডেনমার্কের নয়; পুরো ইউরোপ, তথা পশ্চিমা দেশগুলির, যেটার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা শক্তি প্রদর্শনের হিরিকএর মাঝে।

২০২৪এর দ্বিতীয়ার্ধে ইতালিয়ান নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ক্যাভুর' ও ফ্রিগেট 'আলপিনো'কে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়। এই গ্রুপের প্রধান শক্তি ছিল ৮টা 'এফ-৩৫বি' স্টেলথ যুদ্ধবিমান ও ৭টা 'এভি-৮বি হ্যারিয়ার' যুদ্ধবিমান। 'ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট'এর খবরে বলা হচ্ছে যে, চলতিপথে জ্বালানি ও অন্যান্য সরবরাহের জন্যে এই জাহাজগুলি তাদের মিত্র দেশগুলির সাপ্লাই জাহাজের উপর নির্ভর করেছে। এই জাহাজদু'টাকে ভূমধ্যসাগরে এসকর্ট করেছে ফরাসি ফ্রিগেট 'একোনিট' ও স্প্যানিশ ফ্রিগেট 'নুমানসিয়া'; এরপর লোহিত সাগরে এসকর্ট করেছে ফরাসি ফ্রিগেট 'ফোরবিন' এবং দক্ষিণ চীন সাগরে এসকর্ট করেছে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার 'রাসেল'। এরপর ভারত মহাসাগরে ইতালিয় গ্রুপের সাথে ছিল ফরাসি ফ্রিগেট 'ব্রেটানি'। ইতালিয় এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হয় আরেকটা ইতালিয় ফ্রিগেট 'রাইমন্ডো মন্টেকোকুলি'। এই জাহাজটা হাওয়াই দ্বীপে 'রিমপ্যাক ২০২৪' মহড়ায় অংশ নেয়। ইতালিয় জাহাজের গ্রুপ ২০২৪এর অগাস্টে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপপুঞ্জের পূর্বে ফিলিপাইন সাগরে জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ইজুমো', ডেস্ট্রয়ার 'ওনামি', ফরাসি ফ্রিগেট 'ব্রেটানি', জার্মান ফ্রিগেট 'বাডেন-উট্টেমবার্গ' ও সাপ্লাই জাহাজ 'ফ্রাঙ্কফুর্ট আম-মেইন' এবং অস্ট্রেলিয়ান ডেস্ট্রয়ার 'সিডনি'র সাথে 'নোবেল র‍্যাভেন ২৪-৩' যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। এই মহড়ায় জাপানিরা ইতালিয়দের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে 'এফ-৩৫বি' যুদ্ধবিমান অপারেট করার অভিজ্ঞতা নেয়। চীনকে মোকাবিলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে জাপান বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ অপারেট করছে। আর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের আক্রমণাত্মক কনসেপ্টকে ধোঁয়াশার মাঝে রাখতে এই জাহাজগুলিকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ না বলে বলা হচ্ছে 'হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার'! জাপানিদের সাথে মহড়া দেয়া ছাড়াও ইতালিয়রা অস্ট্রেলিয়াতে সেই দেশের বিমান বাহিনীর সাথে 'পিচ ব্ল্যাক' সামরিক মহড়ায় 'এফ-৩৫বি' স্টেলথ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভূমিতে বিমান আক্রমণের মহড়া দেয়; এবং মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুয়ামে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'আব্রাহাম লিংকন'এর সাথে 'এফ-৩৫বি' বিমানে বহণ করা 'এমর‍্যাম' ক্ষেপণাস্ত্রের লাইভ ফায়ারিং মহড়ায় অংশ নেয়। ফেরত যাবার সময় অক্টোবরে ইতালিয়রা ভারত মহাসাগরে আবারও মার্কিন 'আব্রাহাম লিংকন' গ্রুপের সাথে মহড়ায় অংশ নেয়।

পাঁচ মাস সমুদ্রে থাকার পর গত অক্টোবরের শেষে ইতালিয় নৌবাহিনীর গ্রুপ দেশে ফেরত যায়। তবে এর পরপরই নভেম্বরের শেষে যাত্রা করে ফরাসী যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ; যার কেন্দ্রে রয়েছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'শার্ল দ্য গল'। ফরাসি নৌবাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই গ্রুপটার ভারতীয় নৌবাহিনীর সাথে 'ভারুনা' মহড়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় 'লা পেরৌজি' মহড়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরে 'প্যাসিফিক স্টেলার' মহড়ায় অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। 'জাপান টাইমস' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে ফরাসি উপনিবেশ এবং সামরিক উপস্থিতি থাকলেও গত চার দশকের মাঝে প্রথমবারের মতো কোন ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন হচ্ছে। এই যাত্রার পথিমধ্যে ভূমধ্যসাগরে মার্কিন ডেস্ট্রয়ার 'পল ইগনাশিয়াস', ইতালিয় ফ্রিগেট 'ভারজিনিও ফাসান', গ্রীক ফ্রিগেট 'কুনটুরিওটিস' ও মরক্কোর ফ্রিগেট 'মোহাম্মদ ৬' এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়। 'ইউএস নেভাল ইন্সটিটিউট' বলছে যে, ৩১শে ডিসেম্বর ফরাসি গ্রুপ সুয়েজ খাল অতিক্রম করে লোহিত সাগরে প্রবেশ করে। এই গ্রুপে ছিল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'শার্ল দ্য গল', ডেস্ট্রয়ার 'ফোরবিন', দু'টা ফ্রিগেট, সাপ্লাই জাহাজ 'জাক শেভালিয়ের' এবং একটা পারমাণবিক শক্তিচালিত এটাক সাবমেরিন। ২রা জানুয়ারি সোশাল মিডিয়া 'এক্স'এর এক বার্তায় ফরাসি নৌবাহিনী বলে যে, ফরাসি নৌবাহিনীর গ্রুপ লোহিত সাগর অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে। মার্কিন নৌবাহিনীর এক বার্তায় বলা হচ্ছে যে, ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ফিলিপাইন সাগরে 'প্যাসিফিক স্টেলার' নামের মহড়ায় ফরাসি গ্রুপের সাথে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'কার্ল ভিনসন' এবং জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'কাগা'র অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মিডিয়া 'গ্লোবাল টাইমস'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে 'বেইজিং ফরেন স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি'র বিশ্লেষক ঝুও হুয়া বলছেন যে, এশিয়াতে ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের উদ্দেশ্য ফ্রান্সের সামরিক সক্ষমতার জানান দেয়া এবং ইইউএর নিরাপত্তায় ফ্রান্সের ভূমিকাকে হাইলাইট করা। একইসাথে এশিয়াতে ইউরোপিয় সামরিক শক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউরোপের সামরিক গুরুত্বকে তুলে করা হচ্ছে; যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোতে তার অবস্থান ধরে রাখে। কিছুদিন আগেই ইতালিয় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ক্যাভুর' ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন হয়েছিল; আর ২০২৫ সালে ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'প্রিন্স অব ওয়েলস'এরও ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন হবার কথা রয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালির অত্র অঞ্চলে সামরিক শক্তি মোতায়েনের পিছনে লক্ষ্যের ভিন্নতা রয়েছে, তথাপি বাইরে থেকে সামরিক শক্তি মোতায়েন হওয়ার অর্থ হলো এখানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়ার দেশগুলির স্বাধীনভাবে কোন নিরাপত্তা বলয় তৈরির প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।

ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'শার্ল দ্য গল' এবং সাপ্লাই জাহাজ 'জাক শেভালিয়ের'। পশ্চিমা আদর্শ রক্ষা করা ও সকলকে এই আদর্শ মেনে চলতে বাধ্য করার জন্যেই পশ্চিমা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলি একের পর এক এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোতায়েন হচ্ছে। ন্যাটো হোক বা ইইউ হোক, পশ্চিমাদের একটা প্রধান স্বার্থ হলো মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ। ইউরোপকে নিজেদের গন্ডি থেকে বের করে ইন্দোপ্যাসিফিকে নিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়েছে এবং একইসাথে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে বহু যুদ্ধজাহাজের আনাগোণায় ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পেশী শক্তিই যেন এখন পশ্চিমা আদর্শকে দুনিয়ার বুকে জারি রাখার সর্বশেষ উপায়!


ন্যাটোর লক্ষ্য আসলে কি?

ন্যাটো তাদের লক্ষ্যকে বারংবার পরিবর্তন করছে। বিশেষ করে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশ হয়ে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে ন্যাটো তাদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে বের হয়ে এসেছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত লোহিত সাগর, আরব সাগর, আদেন উপসাগর ও বাব-এল-মান্ডেব প্রণালি এলাকায় জলদস্যুতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে ন্যাটো তাদের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রাখে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ন্যাটো তাদের লক্ষ্যকে আবারও নতুন করে সাজাচ্ছে। ২০২২এর এপ্রিলে ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ জোটের এক আলোচনার পর তার বক্তব্যে বলেন যে, চীন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ধিক্কার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এবং বেইজিং মস্কোর সাথে যুক্ত হয়ে একটা রাষ্ট্রের নিজস্ব পথ খুঁজে নেয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এমতাবস্থায় স্টলটেনবার্গ তাদের 'আদর্শ'কে রক্ষা করার জন্যে একত্রিত থাকার আহ্বান জানান। তিনি আরও জানান যে, ন্যাটোর লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের এশিয়ার সহযোগী দেশগুলি (অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) সাইবার নিরাপত্তা, নতুন প্রযুক্তি ও মিথ্যা তথ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এছাড়াও এই দেশগুলির সাথে ন্যাটো নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কাজ করছে। কারণ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন। ন্যাটো দেশগুলির মন্ত্রীরা একমত হয়েছেন যে, ন্যাটোর সামনের দিনগুলির প্রধান কনসেপ্ট হবে কিভাবে রাশিয়াকে মোকাবিলা করা হবে। এবং প্রথম বারের মতো এর মাঝে হিসেবে নিতে হবে যে, কিভাবে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি এবং আগ্রাসী নীতি ন্যাটোর নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। স্টলটেনবার্গের কথায় বলার অপেক্ষা নেই যে ন্যাটো চীনকে টার্গেট করছে।

২০২৪এর জুনে প্রকাশিত ন্যাটোর এক অফিশিয়াল ডকুমেন্টারিতে বলা হচ্ছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যাটোর আবির্ভাব হয়েছিল শান্তিরক্ষা করা এবং যুদ্ধ এড়াবার জন্যে। ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি মোকাবিলায় ১২টা পশ্চিমা দেশ নতুন এই জোট গঠন করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ছাড়াও এর মাঝে ছিল নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ইতালি, পর্তুগাল ও আইসল্যান্ড। এর মূল কনসেপ্ট ছিল যে, এই জোটের একটা দেশের উপর হামলা হলে বাকি দেশগুলিও নিজেদের উপর হামলা হয়েছে বলে মনে করবে। সেই সময় থেকে ন্যাটো তাদের সদস্য দেশগুলির জন্যে শান্তি ধরে রেখেছে। ন্যাটোর বর্তমান ৩২টা সদস্য দেশ একমত হলে এই জোটে নতুন রাষ্ট্রকে নেয়া যেতে পারে। তবে সেই দেশকে আদর্শের ব্যাপারে একমত হতে হবে; যেগুলি হলো - ব্যাক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। এর বাইরেও সেই দেশকে জাতিসংঘের চার্টারের সাথে একমত পোষণ করতে হবে। সেই দেশের কিছু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে; যেমন, সেই দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়িত থাকতে হবে এবং বিভিন্ন সংঘাত মোকাবিলায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ইউরোপ তৈরি করবে। এছাড়াও ন্যাটো বিশ্বের অন্যান্য দেশকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করে; যেমন – সন্ত্রাসবাদ, সাইবার নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন। ন্যাটোর আদর্শের সাথে একমত পোষণকারী দেশগুলির সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে ন্যাটোর সীমানার বাইরেও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং একইসাথে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে।

তবে ন্যাটোর এই লক্ষ্যকে কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখে। চীনারা ন্যাটোর লক্ষ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে। চীনা মিডিয়া 'নিউ চায়না টিভি'র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ একদিকে চীনকে ন্যাটোর জন্যে হুমকি হিসেবে তুলে ধরছেন; অথচ অন্যদিকে ন্যাটোই অন্যান্য দেশকে একটা নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বন করার জন্যে চাপ দিচ্ছে। বহু বছর ধরেই ন্যাটো মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও শান্তিরক্ষার নামে বারংবার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করে সমস্যা তৈরি করে যাচ্ছে। নিউ নিয়র্কের 'বার্ড কলেজ'এর সিনিয়র ফেলো জন প্যাং 'নিউ চায়না টিভি'র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে মূল দায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা ন্যাটো জোটকেই নিতে হবে। এই যুদ্ধ ২০২২এর ২৪শে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়নি; বরং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলিকে ন্যাটোর মাঝে ঢুকাবার মাধ্যমেই এর সূচনা। মিশরের থিংকট্যাঙ্ক 'আল-আহরাম সেন্টার ফর পলিটিক্যাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ'এর গবেষক আহমেদ এলিবা 'নিউ চায়না টিভি'কে বলছেন যে, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির সরকারকে উৎখাতের পিছনে ন্যাটো সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এবং বড় পরিসরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অরাজকতা তৈরিতে পশ্চিমা দেশগুলি ইন্ধন যুগিয়েছে। মেক্সিকোর 'ইউনিভার্সিটি অব গুয়াদালাজারা'র রিসার্চ ডিরেক্টর জাইমে তামায়ো 'নিউ চায়না টিভি'কে বলছেন যে, ন্যাটো প্রকৃতপক্ষে এক মেরুর বিশ্ব বজায় রাখার যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিচ্ছে। ন্যাটো আসলে একটা অপরাধী সংস্থা; যা বিভিন্ন দেশকে ধ্বংস করেছে এবং আরও অনেক দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ওয়াশিংটনের 'আমেরিকান ইউনিভার্সিটি'র এসিসট্যান্ট প্রফেসর এনটন ফেদিয়াশিন চীনা মিডিয়া 'সিজিটিএন'কে বলছেন যে, ন্যাটো ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরিই জড়িয়েছে এবং সেটা ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলি মোটেই গোপন রাখার চেষ্টা করেনি। এমনকি বাইডেন প্রশাসনের মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো রাশিয়ার সক্ষমতাকে খর্ব করা।

শুধু ন্যাটোই নয়; ইউরোপিয় সংস্থা হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ইইউ বৈশ্বিক নিরাপত্তায় অংশ নেয়া থেকে বাদ থাকতে চাইছে না। নিরাপত্তা সংস্থা না হয়েও তারা অনেক বছর ধরেই সামরিক মিশনে অংশ নিচ্ছে। ইইউএর অনেক দেশই ন্যাটোরও সদস্য। তাই ন্যাটোর মিশন থেকে ইইউএর মিশনে যেতে তাদের শুধু নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে আদেন উপসাগর ও আরব সাগরে ইইউ 'অপারেশন আটলান্টা' নামে একটা মিশনের মাধ্যমে জলদস্যুতা মোকাবিলার ছুতোয় যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রেখেছে। ২০২৩এর অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজা থেকে ইস্রাইলের অভ্যন্তরে হামলা হলে গাজার উপর ইস্রাইলের নির্বিচার বোমাবর্ষণ শুধু হয়। হাজারো ফিলিস্তিনিকে হত্যার প্রতিবাদে ইয়েমের হুথি মিলিশিয়ারা ইস্রাইলের উপর এবং লোহিত সাগর ও বাব-এল মান্ডেব প্রণালিতে ইস্রাইলি ও ইস্রাইলের সাথে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক জাহাজের উপর হামলা করা শুরু করে। এর জবাবে ২০২৪এর ফেব্রুয়ারিতে ইইউ লোহিত সাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন শুরু করে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সামরিক শক্তি মোতায়েনের মাধ্যমে পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে যে, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়' সমুদ্র বাণিজ্যের রুটের উপর 'সন্ত্রাসী হামলা'র বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিতে একত্রে দাঁড়াবে। তবে বেয়ারবক 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়' বলতে যে শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশগুলিকেই বুঝিয়েছেন, সেটা নিশ্চিত। 'আল-জাজিরা' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপের এলএনজি সরবরাহের ১৩ শতাংশ লোহিত সাগর হয়ে আসে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাহাজগুলি লোহিত সাগর এড়িয়ে চলছে বিধায় ইউরোপে পণ্য সরবরাহের সময় ও খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ন্যাটোর ২০২৪ সালের ডকুমেন্টারিতে পরিষ্কার যে, ন্যাটো তাদের সদস্য রাষ্ট্রদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে। আর ন্যাটোর সদস্য হবার শর্ত হলো পশ্চিমা আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা; যার কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন। পশ্চিমা আদর্শ রক্ষা করা ও সকলকে এই আদর্শ মেনে চলতে বাধ্য করার জন্যেই পশ্চিমা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলি একের পর এক এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোতায়েন হচ্ছে। অথচ গাজায় ইস্রাইলের বর্বরতার সময় পশ্চিমারা মানবাধিকার ইস্যুতে টিনের চশমা পড়ে ছিল! পশ্চিমা আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইস্রাইল আইনের শাসনকে বাইপাস করলেও পশ্চিমারা ইস্রাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। লোহিত সাগরের বাণিজ্য রুট ও ইস্রাইলের নিরাপত্তা বিধানে ইউরোপিয় ইউনিয়নের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন বলে দিচ্ছে যে, ন্যাটো হোক বা ইইউ হোক, পশ্চিমাদের একটা প্রধান স্বার্থ হলো মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ। ইউরোপকে নিজেদের গন্ডি থেকে বের করে ইন্দোপ্যাসিফিকে নিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়েছে এবং একইসাথে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে বহু যুদ্ধজাহাজের আনাগোণায় ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পেশী শক্তিই যেন এখন পশ্চিমা আদর্শকে দুনিয়ার বুকে জারি রাখার সর্বশেষ উপায়!

Sunday, 2 February 2025

মার্কিন প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে চীনা 'এআই' ‘ডীপসীক'!

০২রা ফেব্রুয়ারি ২০২৫

চীনে 'ডীপসীক'এর ডেভেলপ করাকে দেখা হচ্ছে চীনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে। তবে এই চিন্তাধারা বৈশ্বিকভাবে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনাদেরকে পশ্চিমাদের থেকে আলাদা করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।


গত ২৭শে জানুয়ারি মার্কিন স্টক মার্কেটে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির শেয়ার মূল্যে ব্যাপক ধ্বস নেমে আসে। 'সিএনএন' বলছে যে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির এই ধ্বসের কারণ হলো এর আগে ২০শে জানুয়ারি চীনা 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স' বা 'এআই' কোম্পানি 'ডীপসীক'এর নতুন প্রকল্পের উদ্ভোধন; যা নাম হলো ‘আর১'। এটা একটা 'এআই'; যা কিনা মার্কিন কোম্পানি 'ওপেনএআই'এর ডেভেলপ করা 'চ্যাটজিপিটি'এর প্রায় সমকক্ষ। মার্কিন কোম্পানি 'ওপেনএআই', ‘গুগল' বা 'মেটা' যত খরচ করে 'এইআই' ডেভেলপ করছে, চীনা কোম্পানি 'ডীপসীক' তাদের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খরচে 'এইআই' ডেভেলপ করেছে। এর পেছনে যে পরিমাণ কম্পিউটিং সক্ষমতা প্রয়োজন হয়েছে, তা মাত্র ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। অপরদিকে মার্কিন কোম্পানিগুলি 'এআই' ডেভেলপ করতে গিয়ে কয়েক'শ মিলিয়ন কিংবা বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। কিছুদিন আগেই 'ফেইসবুক'এর মূল কোম্পানি 'মেটা' জানায় যে, তারা ২০২৫ সালে 'এআই' ডেভেলপ করার পেছনে ৬৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করবে। আর গত বছর 'ওপেনএআই'এর প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বলেছিলেন যে, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে 'এআই' ডেভেলপ করতে। এই অর্থ খরচ করতে হবে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির সেমিকন্ডাক্টর ডেভেলপ করতে, বড় বড় ডাটা সেন্টার তৈরি করতে, এবং সেগুলি পরিচালনার জন্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে।

২৭শে জানুয়ারি এক দিনে 'এআই'এর জন্যে সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী মার্কিন কোম্পানি 'এনভিডিয়া'র শেয়ারের মূল্য প্রায় ১৭ শতাংশ পড়ে যায়। এর ফলে কোম্পানির মূল্যমান এক দিনে ৫শ ৮৯ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে! ‘সিএনএন' বলছে যে, মার্কিন মুল্লুকে মাত্র ১৩টা কোম্পানি রয়েছে, যেগুলির সর্বসাকুল্যে মূল্য ৬'শ বিলিয়ন ডলার বা তার চাইতে বেশি। 'এনভিডিয়া' এক দিনেই সমপরিমাণ মূল্য হারিয়েছে! এটা ছিল মার্কিন স্টক মার্কেটের ইতিহাসে কোন কোম্পানির একদিনে হারানো সর্বোচ্চ মূল্য। 'এনভিডিয়া'র ধ্বসের কারণে 'মেটা' (ফেইসবুক), ‘এলফাবেট' (গুগল), ‘মারভেল', ‘ব্রডকম', ‘মাইক্রন', 'টিএসএমসি', ‘ওরাকল', ‘ভারটিভ', ‘কন্সটেলেশন', ‘নিউস্কেল' ছাড়াও ডাটা সেন্টার কোম্পানিগুলির শেয়ারমূল্যও পড়ে যায়।
 
সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের সাথে চ্যাট করার 'এআই' 'চ্যাটজিপিটি' নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। 'ডীপসীক' এমনই একটা 'এআই'। এটা অনলাইনে থাকা তথ্য থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কনটেন্ট তৈরি করে। তবে তথ্যের মাঝে মিথ্যা কিছু থাকলে 'এআই' সেগুলি আলাদা করতে পারে না। বর্তমানকালে 'চ্যাটজিপিটি' ব্যবহার করে কোটি কোটি মানুষ ইমেইল লিখছে, লেখার সারমর্ম তৈরি করছে, অথবা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিচ্ছে। 


‘ডীপসীক' ‘এআই' আসলে কি?

‘এআই'এর কাজের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে 'বিবিসি' বলছে যে, ‘এআই' হলো এমন একটা প্রযুক্তি, যা প্রচুর তথ্য থেকে শেখার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে। 'এআই' তথ্যের মাঝ থেকে প্যাটার্ন বের করে। এর ফলাফল হলো একটা সফটওয়্যার, যা কিনা মানুষের মতোই আচরণ করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের কর্মকান্ডের পূর্বাভাস দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের সাথে চ্যাট করার 'এআই' 'চ্যাটজিপিটি' নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। 'ডীপসীক' এমনই একটা 'এআই'। এটা অনলাইনে থাকা তথ্য থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কনটেন্ট তৈরি করে। তবে তথ্যের মাঝে মিথ্যা কিছু থাকলে 'এআই' সেগুলি আলাদা করতে পারে না। বর্তমানকালে 'চ্যাটজিপিটি' ব্যবহার করে কোটি কোটি মানুষ ইমেইল লিখছে, লেখার সারমর্ম তৈরি করছে, অথবা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিচ্ছে। 'বিবিসি' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনাদের 'এআই'গুলি, যেমন 'বাইডু'র ডেভেলপ করা 'আরনি' অথবা 'বাইটড্যান্স'এর ডেভেলপ করা 'ডুবাও' চীনা সরকারের নীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলে। যেসকল ব্যাপার চীনা সরকার পছন্দ করে না, সেগুলির ব্যাপারে তাদের 'এআই'গুলি উত্তর এড়িয়ে চলে। যেমন, ১৯৮৯ সালের ৪ঠা জুনে তিয়ানআনমেন স্কয়ারের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করার পর 'ডীপসীক' উত্তর এড়িয়ে যায়।

‘ডীপসীক'এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং 'ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি' থেকে তথ্য প্রযুক্তিতে ডিগ্রি নিয়েছেন। ২০১৯ সালে তিনি 'হাই-ফ্লাইয়ার' নামের একটা ফিনানশিয়াং কনসালটিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যা কিনা 'এআই'এর মাধ্যমে ফিনানশিয়াল তথ্য গবেষণা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত দেয়। এই কাজটাকে 'কোয়ান্টিটেটিভ ট্রেডিং' বলা হয়ে থাকে। এক সাক্ষাৎকারে ওয়েনফেং বলছেন যে, অনেকেই বলে যে, চীনারা মার্কিনীদের থেকে এক-দুই বছর পিছিয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে এই পিছিয়ে থাকা হলো কপি করা বা নতুন কিছু করে দেখানোর ক্ষেত্রে। তিনি বলেন যে, এই মনমাসকিতার পরিবর্তন না হলে চীনারা শুধুমাত্র অনুসারীই রয়ে যাবে।
 
‘ডীপসীক' অপেক্ষাকৃত কম শক্তির সেমিকন্ডার দিয়েই এরূপ শক্তিশালী 'এআই' ডেভেলপ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রযুক্তিগত শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছেন যে, তার সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্বের মাঝে একটা হলো 'এআই'। চীনারা এখন কাপড় ও ফার্নিচারের ব্যবসা থেকে প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে, যার মাঝে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রিক গাড়ি ও 'এআই'।


চীন-মার্কিন প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা

'সিএনএন' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনারা এরূপ 'এআই' ডেভেলপ করতে সক্ষম হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে তার সর্বোচ্চ প্রযুক্তির সেমিকন্ডাক্টর চীনের কাছে বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। এর অর্থ হলো, ‘ডীপসীক' অপেক্ষাকৃত কম শক্তির সেমিকন্ডার দিয়েই এরূপ শক্তিশালী 'এআই' ডেভেলপ করতে সক্ষম হয়েছে। 'বিবিসি' বলছে যে, প্রযুক্তিগত শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছেন যে, তার সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্বের মাঝে একটা হলো 'এআই'। চীনারা এখন কাপড় ও ফার্নিচারের ব্যবসা থেকে প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে, যার মাঝে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর, ইলেকট্রিক গাড়ি ও 'এআই'।

ফিনানশিয়াল কোম্পানি 'ট্রুইস্ট'এর বিশ্লেষক কীথ লারনার 'সিএনএন'কে বলছেন যে, বাকি বিশ্ব থেকে মার্কিনীদের এগিয়ে থাকার পিছনে সবচাইতে বড় ফ্যাক্টরটাই ছিল তাদের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি। আর এই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির এগিয়ে থাকার কারণ হলো 'এআই' প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা। 'ডীপসীক'এর উদ্ভোধনের পর বিনিয়োগকারীরা মার্কিন কোম্পানিগুলির এগিয়ে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। তারা এ-ও বলছেন যে, ‘এআই'এর পেছনে সত্যিই কি এতো খরচ করার প্রয়োজন রয়েছে কিনা; অথবা এতো খরচের পর সেটা অতিরিক্ত খরচে রূপ নেবে কিনা। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক 'সাক্সো'র প্রধান কৌশলী চারু চানানা 'সিএনএন'কে বলছেন যে, ভূরাজনৈতিক দুশ্চিন্তা এবং কম চাহিদার কারণে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির শেয়ার অনেক কম মূল্যে কেনাবেচা হচ্ছে। 'ডীপসীক'এর উদ্ভোধনের পর চীনা 'এআই' কোম্পানিগুলির দিকে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকতে পারে।

‘বিবিসি' বলছে যে, ‘ডীপসীক'এর প্রতিষ্ঠাতা খুব সম্ভবতঃ 'এনভিডিয়া'র তৈরি 'এ১০০' সেমিকন্ডাক্টর চিপ মজুত করেছিলেন, যেগুলি যুক্তরাষ্ট্র চীনে রপ্তানি করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কোন কোন বিশ্লেষক মনে করছেন যে, তিনি ৫০ হাজার চিপ যোগার করে সেগুলির সাথে অপেক্ষাকৃত কম খরচের এবং কম সক্ষমতার চিপকে ব্যবহার করেছেন। 'কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চ'এর বিশ্লেষক ওয়েই সান 'বিবিসি'কে বলছেন যে, ‘ডীপসীক' প্রমাণ করেছে যে, স্বল্প কম্পিউটিং সক্ষমতা ব্যবহার করেই উন্নত ‘এআই' ডেভেলপ করা সম্ভব। এখন 'ওপেনএআই'এর ১৫৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যমান নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এর খরচের উপর লাভ করা যাবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়।
 
‘ডীপসীক' যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কত বড় হুমকি তৈরি করেছে, সেটা সময়ই বলে দেবে। আর এটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি চীনাদের অগ্রগামিতা দেখে কি ব্যবস্থা নিতে পারবে। তথাপি, একটা চীনা কোম্পানি দাবি করেছে যে, তারা অতি কম খরচে 'এআই' ডেভেলপ করেছে; কেউ সেটার সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। এছাড়াও 'এআই'এর আরও যেসকল উচ্চাভিলাসী লক্ষ্য রয়েছে, সেগুলি চীনারা 'এআই' অবকাঠামোতে কতটা কম বিনিয়োগ করে ডেভেলপ করতে পারবে, সেটাও এখনও নিশ্চিত নয়। 


চীনারা 'এআই'তে কতটা অগ্রগামী হয়েছে?

'সিএনবিসি'র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনা কোম্পানি 'বাইডু' ডেভেলপ করেছে 'ওয়েনকু' প্ল্যাটফর্ম; যা কিনা তথ্য দিলে পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড বা অন্যান্য ডকুমেন্ট তৈরি করে দিতে সক্ষম। এই সার্ভিসের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৪ কোটি ছুঁয়েছে; যার ফলে এর আয় এক বছরে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'গার্টনার'এর ডিরেক্টর বেন ইয়ান 'সিএনবিসি'কে বলছেন যে, প্রায় ১০ শতাংশ চীনা কোম্পানি বর্তমানে 'এআই' ব্যবহার করছে। মাত্র ৬ মাস আগেও এটা ছিল ৮ শতাংশ। কিছু চীনা কোম্পানি 'এআই' এজেন্ট ডেভেলপ করছে; যা কিনা মানুষের হয়ে কিছু কাজ করে দেবে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারও থাকবে; যেমন রেস্টুরেন্টে সীট বুকিং দেয়া। চীনা ফিনানশিয়াল কোম্পানি 'র‍্যাফলস ফামিলি অফিস'এর জো হুয়াং 'সিএনবিসি'কে বলছেন যে, চীনা 'এআই' সেক্টর মার্কিনীদের সমান তালে উন্নয়ন করছে। চীনা কোম্পানি 'আলীবাবা'র আন্তর্জাতিক অংশ 'একসিও' গত নভেম্বরে চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিছু শব্দ বা ছবি দিয়ে সার্চ করে পাইকারি দরের পণ্য খুঁজে পেতে পারে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৫ লক্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর থেকে সুবিধা পেতে শুরু করেছে। 'একসিও' ব্যবসায়ীদেরকে এরূপ ধারণাও দেয় যে, এই পণ্য নিয়ে ব্যবসা করলে পণ্যের চাহিদা কতো হতে পারে এবং ব্যবসায় সম্ভাব্য লাভ কত হতে পারে। 'একসিও' কয়েক সপ্তাহের গবেষণার সময়কে এক দিন বা এরও কম সময়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে বলে বলছেন এর একজন মার্কিন সুবিধাভোগী। তিনি বলছেন যে, তিনি আর আগে ‘আলীবাবা' বা 'আমাজন' ব্যবহার করতেন, যা শতশত বা হাজারো সার্চ ফলাফল সামনে নিয়ে আসে এবং ৫টা থেকে ১০টা কোম্পানির সাথে আলোচনার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত একটার সাথে কাজ করার অবস্থানে নিয়ে আসে। পরবর্তী জেনারেশনের 'এআই' হয়তো পণ্যের একটা ছবি দিলে সেটা দিয়ে একটা বিজ্ঞাপণ তৈরি করে দিতে সক্ষম হবে!

ফিনানশিয়াল কোম্পানি 'থার্ড সেভেন ক্যাপিটাল'এর কৌশলী মাইকেল ব্লক 'সিএনএন'কে বলছেন যে, ‘ডীপসীক' যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কত বড় হুমকি তৈরি করেছে, সেটা সময়ই বলে দেবে। আর এটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলি চীনাদের অগ্রগামিতা দেখে কি ব্যবস্থা নিতে পারবে। তথাপি, একটা চীনা কোম্পানি দাবি করেছে যে, তারা অতি কম খরচে 'এআই' ডেভেলপ করেছে; কেউ সেটার সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। এছাড়াও 'এআই'এর আরও যেসকল উচ্চাভিলাসী লক্ষ্য রয়েছে, সেগুলি চীনারা 'এআই' অবকাঠামোতে কতটা কম বিনিয়োগ করে ডেভেলপ করতে পারবে, সেটাও এখনও নিশ্চিত নয়। বাজার গবেষণা সংস্থা 'রিফ্লেস্কিভিটি'র প্রেসিডেন্ট গুইসেপ সেটে-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ট্যালেন্ট ও পুঁজির ক্ষেত্রে দুনিয়ার নেতৃত্বে রয়েছে। এবং একারণেই এটা আশা করাই যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এমন 'এআই' আসবে, যা কিনা নিজেকে নিজে উন্নয়ন করতে সক্ষম।

‘ডীপসীক'এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, চীনের 'এআই' সেক্টর সারাজীবন মার্কিনীদের অনুসারী হয়ে থাকতে পারে না। 'ডীপসীক' নিয়ে পশ্চিমাদের অবাক হবার ব্যাপারটা হলো, তারা বিশ্বাস করতে পারছে না যে, চীনারা অনুসারী না হয়ে আবিষ্কারকদের খেলায় নাম লিখিয়েছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগকারী এবং নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন সমর্থক মার্ক আন্দ্রেসসেন সোশাল মিডিয়া 'এক্স'এর এক বার্তায় চীনা 'এআই'এর ব্যাপক প্রশংসা করেন। তিনি বলেন যে, প্রযুক্তিগত এমন উৎকর্ষতা তিনি এর আগে দেখেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন যে, এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে জেগে ওঠার বার্তা; মার্কিন কোম্পানিগুলিকে এখন জেতার জন্যে প্রতিযোগিতা করতে হবে। 'বিবিসি' বলছে যে, চীনা সরকারি মিডিয়াতে ইতোমধ্যেই হাইলাইট করা হচ্ছে যে, ‘ডীপসীক' উদ্ভোধনের পর সিলিকন ভ্যালি ও ওয়াল স্ট্রীটের বিনিয়োগকারীদের ঘুম নষ্ট হয়েছে। 'ইউনিভার্সিটি অব টেকনলজি সিডনি'র এসোসিয়েট প্রফেসর মারিনা ঝাং 'বিবিসি'কে বলছেন যে, চীনে 'ডীপসীক'এর ডেভেলপ করাকে দেখা হচ্ছে চীনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং স্বনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে। তবে এই চিন্তাধারা বৈশ্বিকভাবে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনাদেরকে পশ্চিমাদের থেকে আলাদা করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।