গত ২০শে মার্চ তুরস্ক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গঠিত ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ কনভেনশন’ থেকে বের হয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। ‘ইস্তাম্বুল কনভেনশন’ নামে পরিচিত এই চুক্তিতে ২০১১ সালে ৪৫টা দেশ স্বাক্ষর করলেও এখন পর্যন্ত ৩৪টা দেশের পার্লামেন্টে এই চুক্তি আইন হিসেবে পাস হয়েছে; বাকিগুলি আইন পাস করেনি। এসব দেশের মাঝে ব্রিটেন, ইউক্রেন, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি রয়েছে। ২০১১ সালে তুর্কি পার্লামেন্টে আইন হিসেবে চুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ ২০১২ সালের জুনে স্বাক্ষর করলেও ব্রিটেন এখনও তা করেনি। তুর্কি সরকার বলছে যে, এই আইন পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করাকে উৎসাহিত করা ছাড়াও পারিবারিক সহিংসতা এবং বিবাহবিচ্ছেদ বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও তুরস্কের সমকামি গোষ্ঠিগুলি এই আইনকে ব্যবহার করে সমাজে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে বলে তারা অভিযোগ করছেন। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, তুরস্কের পারিবারিক বন্ধনের পুরোনো ঐতিহ্যের মাধ্যমেই নারীর সন্মান নিশ্চিত করা সম্ভব; এর জন্যে বাইরের কাউকে নকল করার দরকার নেই। ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’এর হিউম্যান রাইটস কমিশনার দুনিয়া মিয়াতোভিচ এর প্রত্যুত্তরে বলেন যে, এতে নারীঅধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুরস্কে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার এমন এক সময়ে তাদের উচিৎ হবে না কনভেনশন থেকে নাম প্রত্যাহার করা। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে নারীর অধিকার আজকে কতটুকু?
ওশেনিয়া অঞ্চলের উন্নত দেশ অস্ট্রেলয়া থেকে নারী নির্যাতনের খবর আসছে। ২২শে মার্চ অস্ট্রেলিয়ার ‘টেন নেটওয়ার্ক’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা গত দুই বছর ধরে দেশটার পার্লামেন্ট অফিসের ভিতর বিভিন্ন যৌন আচরণ করে সেগুলির ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ করে আসছিলো। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পরদিন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘোষণা দেন যে, সেই ব্যক্তিদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই পুরো অস্ট্রেলিয়া জুড়ে হাজারো নারী যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। এছাড়াও মরিসন সরকারের এটর্নি জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান পোর্টারের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। সরকার এই অভিযোগের তদন্ত করতে অস্বীকৃত জানানোতে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। এর উপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের একজন উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা ২০১৯ সালে পার্লামেন্ট ভবনের ভিতর ব্রিটানি হিগিন্স নামের একজন জুনিয়র মহিলা উপদেষ্টাকে ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেসময় পার্লামেন্টে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডসের অফিসে কাজ করা ব্রিটানি হিগিন্সকে বলা হয় তিনি যেন পুলিশের কাছে অভিযোগ না করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস তার অধীনস্ত সেই মহিলা কর্মকর্তাকে মিথ্যুক আখ্যা দিয়ে আইনী সমস্যা পড়েন। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য হিগিন্সের কাছে ক্ষমা চান এবং তার বিরুদ্ধে আইনী অভিযোগের ব্যাপারটা গোপনে অর্থিকভাবে দফারফা করেন। শুধু তাই নয়, হিগিন্সকে ধর্ষণের পরের বছর সেই একই ব্যক্তি বেসরকারি সেক্টরে কাজ করার সময় আরেকজন মহিলাকে যৌন নিপীড়ন করে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই মহিলা নিপীড়নকারীর সাথে রাতে ডিনার করে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান; যেখানে সেই ঘটনা ঘটে বলে জানান সেই মহিলা। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের সংস্কৃতিতেই ব্যাপক সমস্যা রয়েছে।
আটলান্টিকের ওপাড়ে ব্রাজিলের দ্বিতীয় ডিভিশনের ফুটবল ক্লাব ‘সামপাইও করেয়া’র একটা বিজ্ঞাপনকে সরিয়ে নেবার নির্দেশ দিয়েছে দেশটার মারানিয়াও প্রদেশের ভোক্তা অধিকার সংস্থা। ২৪শে মার্চের ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিজ্ঞাপনটাতে একজন সংক্ষিপ্ত বসনা নারীর ছবির সাথে ‘ওয়েসিস মোটেল’এর একটা অফারের কথা বলা হয়। এতে বলা হয় যে, ফুটবল ক্লাবের সমর্থকেরা মোটেলে ১২ শতাংশ ডিসকাউন্টে ‘গোল করতে পারেন’ বা নারীসঙ্গ পেতে পারেন। বিজ্ঞাপনটা প্রকাশের কয়েক ঘন্টার মাঝেই ভোক্তা অধিকার সংস্থা এটাকে সরিয়ে বিকল্প বিজ্ঞাপন প্রকাশের নির্দেশ দেয়। একইসাথে তারা বলে যে, নারীদেরকে ‘পণ্য সমতুল্য’ করার জন্যে তাদেরকে আদালতের সামনে হাজির করে ব্যাখ্যা দিতে বলা হবে। তবে ক্লাবটা ১১ ঘন্টার মাঝে বিজ্ঞাপনটা না সরিয়ে বরং আরেকটা ছবি পোস্ট করে, যেখানে লেখা ছিল যে, ‘একজন মহিলা সেখানেই থাকতে পারেন, যেখানে তিনি থাকতে চান’। প্রকৃতপক্ষে এই দ্বন্দ্ব বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে। কারণ একদিকে ‘ওয়েসিস মোটেল’এ নারীসঙ্গ বেচাবিক্রি ব্রাজিলে যেমন অবৈধ নয়, তেমনি স্বল্পবসনা নারীদের ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহারও নিষেধ নয়। ব্রাজিলে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত কার্নিভাল অনুষ্ঠানে এর চাইতে আরও কম কাপড়ে প্রায় নগ্ন অবস্থায় নারীদের ‘সাম্বা’ নৃত্য করতে দেখা যায় রাজধানী শহরের রাস্তায়; যা উপভোগ করে ছেলে বুড়ো শিশু সকলে; এবং মূলতঃ পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসা বহু পর্যটক। এই অনুষ্ঠান ব্রাজিলের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব রাখে। ‘সামপাইও করেয়া’র বিজ্ঞাপনে যে নারীর ছবি ব্যবহার করা হয়, তিনি মূলতঃ ২০১৫ সালে ক্লাবের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতার নিয়ম হিসেবেই সেই নারীকে স্বল্পবসনা হয়ে ছবি তুলতে হয়েছিল। ক্লাব সেই ছবিকে পুঁজি করেই ব্যবসা চালাচ্ছে। ব্রাজিলে ফুটবল ক্লাব ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার এহেন সুন্দরী প্রতিযোগিতা চলে সারা বছর জুড়ে; যেখানে নারীদেরকে অতিরিক্ত স্বল্পবসনা হয়ে সকলের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। এর মাধ্যমে নারীরা অর্থ উপার্জন করে এবং সোশাল মিডিয়াতে বহু অনুসারী পায়। অনেক প্রতিযোগিতার বিজয়ীরা পুরুষদের ম্যাগাজিনে নগ্ন হয়ে মডেলিং করার ‘সুযোগ’ পায়। নারীদের সৌন্দর্যবর্ধনকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলে বিশাল অর্থনৈতিক কার্মকান্ডও চলে। এতকিছুর পরেও সেদেশের বিজ্ঞাপনে নারীদেরকে ‘পণ্য সমতুল্য’ করার জন্যে যে ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করার হয়েছে, তা অন্তসারশূণ্যই বটে।
দেশের সর্বোচ্চ অফিসে কাজ করাও যে নারী নির্যাতন বন্ধের জন্যে যথেষ্ট নয়, তা অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের ঘটনাই বলছে। আর ব্রাজিলের ঘটনা দেখিয়ে দেয় নারীকে ‘পণ্য সমতুল্য’ করার সংস্কৃতিকে। পশ্চিমা চিন্তায় নারীর অধিকার কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকেই মূল্যায়িত হয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাই হয়েছে সকল কিছুর মাপকাঠি। আইন তৈরির সংস্থা থেকে শুরু করে ফুটবল ক্লাব পর্যন্ত কেউই নারীর সন্মান এবং নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়নি। একুশ শতকেও তাই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, পশ্চিমা দুনিয়ায় নারীর প্রকৃত সন্মান আদৌ কোনকালে প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা।