বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত করতে চাইছে, যার মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে স্থাপিত সেকুলার ভারতই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। |
২৯শে ডিসেম্বর ২০১৯
২০১৯ সালে ভারতের অগুণিত সমস্যা দেশটার সাংগঠনিক মূলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, ১৯৪৭ সালে যে সেকুলার ভারতের জন্ম হয়েছিল, তা আসলে টিকবে কিনা। তবে এই প্রশ্নের সাথে ভারতের ১৯৪৭ সালের রাষ্ট্র গঠনের মূলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। মুম্বাইএর ‘গুরু নানক কলেজ অব আর্টস, সাইন্স এন্ড কমার্স’এ অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা ভারতের একত্রিত থাকার গুরুত্বকে তুলে ধরেন। তারা বলেন যে, ভারতের রাজনীতি ধর্মের উপর নির্ভর করে হতে পারে না। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেকুলার ভারতে মুসলিম হিসেবে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট ভারতের পার্লামেন্টে দেয়া বক্তৃতায় জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন যে, সকল ধর্মের মানুষ ভারতে একই অধিকার পাবে। কিন্তু ৭০ বছর পর নেহেরুর চিন্তাগুলি সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হলো জাতিগত, ভাষাগত এবং বিশ্বাসগত দিক থেকে বিশাল বিভক্তি থাকার পরেও ভারত রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে। টিকে থাকার সেই ভিতটাই হলো সেকুলারিজম, যা বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।ভারতের সেকুলার সমাজব্যবস্থার মাঝ দিয়েই জন্ম নিয়েছে আরএসএস; ক্ষমতা পেয়েছে বিজেপি; ধ্বংস হয়েছে বাবরী মসজিদ; আইনী বৈধতা পেয়েছে রাম মন্দির; পার্লামেন্টে পাস হয়েছে এনআরসি।বর্তমান এই সমস্যাগুলি এমন কিছু ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে, যেগুলি ভারত রাষ্ট্রের স্থায়িত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
‘অক্সফাম’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারতের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ জাতীয় সম্পদের ৭৭ শতাংশের মালিক। আর ২০১৭ সালে ভারতে উৎপাদিত হওয়া মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ গিয়েছে সবচাইতে উপরের ১ শতাংশের কাছে। মাত্র ১ শতাংশ গিয়েছে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে। আর ভারতের জনসংখ্যার নিচের ৬৭ কোটি মানুষের সম্পদ বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। ভারতে এখন ১’শ ১৯ জন বিলিয়নায়ার রয়েছে, যা ২০০০ সালে ছিল ৯ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ১শ ১ জন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মাঝে ভারতে প্রতিদিন ৭০ জন করে নতুন মিলিয়নায়ার তৈরি হবে বলে আশা করছে ‘অক্সফাম’। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে না পেরে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে পতিত হয়েছে; সময়ের হিসেবে তা প্রায় প্রতি সেকেন্ডে দু’জন। ভারতের গ্রামাঞ্চলে নিম্ন পর্যায়ে কাজ করা এক ব্যক্তিকে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করা উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার এক বছরের আয়ের সমান আয় করতে হলে ৯’শ ৪১ বছর কাজ করতে হবে! যদিও অন্য দেশ থেকে ভারতে মানুষ চিকিৎসা করাতে আসে, ভারতের গরীব রাজ্যগুলিতে শিশুমৃত্যুর হার আফ্রিকার দরিদ্র এলাকাগুলির চাইতেও খারাপ! সারা বিশ্বে সকল মাতৃমৃত্যুর মাঝে ১৭ শতাংশ ঘটে ভারতে; আর পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর মাঝে ২১ শতাংশ ঘটে ভারতে।
ভারতে এখন ১’শ ১৯ জন বিলিয়নায়ার রয়েছে, যা ২০০০ সালে ছিল ৯ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ১শ ১ জন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মাঝে ভারতে প্রতিদিন ৭০ জন করে নতুন মিলিয়নায়ার তৈরি হবে বলে আশা করছে ‘অক্সফাম’। |
ভারতের ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ বা ‘সিএমআইই’এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। ২০১৭ সালের জুলাইএ এই হার ছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশের নিচে। সেই সময় থেকে বেকারত্বের হার সর্বদাই বাড়ছে। একইসাথে কর্মক্ষেত্রে অংশ নেবার হার (কতজন কাজ করতে ইচ্ছুক) দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশের কিছু বেশি, যা কিনা ২০১৬ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। বেকারত্বের হার শহর এলাকায় আরও বেশি – পার ৯ শতাংশের কাছাকাছি; আর গ্রামাঞ্চলে তা ৭ শতাংশের কাছাকাছি। আবার ভারতের সকল রাজ্যে বেকারত্বের হার এক নয়। গোয়াতে ৩৪ শতাংশের বেশি বেকার; ত্রিপুরায় প্রায় ২৬ শতাংশ; হিমাচলে ২৩ শতাংশ; হরিয়ানায় ২১ শতাংশ; দিল্লীতে ১৬ শতাংশ; বিহারে ১৩ শতাংশ; আর উত্তর প্রদেশে ৮ শতাংশ। অপরদিকে পন্ডিচেরিতে ১ শতাংশের নিচে বেকারত্ব; মেঘালয়ে ২ শতাংশের নিচে; কর্ণাটকে ২ শতাংশ; তামিল নাড়ুতে আড়াই শতাংশ; আর মধ্য প্রদেশে সাড়ে ৩ শতাংশের কাছাকাছি বেকার। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের সকল স্থানে কর্মসংস্থানের সুযোগ একরকম নয়। বিশেষ করে ভারতের রাজ্যগুলি অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিসিল’ বলছে যে, ভারতের মোট সরকারি খরচার প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন রাজ্য সরকারের হাতে, যা কিনা রাজ্যগুলিকে আলাদা নীতিতে চলতে প্রেরণা যুগিয়েছে।
রাজ্যকেন্দ্রিক চিন্তার কারণে বেশিরভাগ মানুষই নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে বসবাস করতে পারে না। ভারতের অর্থনীতি যে অবস্থানে রয়েছে, তাতে মনে করা হয় যে, দেশের ভিতরে মানুষের যাতায়াত আরও বেশি হবার কথা ছিলো। ২০১৬ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ভারতের অনেক রাজ্যে বাইরের রাজ্য থেকে মানুষ আসাকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইকনমিক এন্ড সোশাল এফেয়ার্স’এর এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ৮০টা দেশের মাঝে মানুষের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ছিল ৮০তম। অথচ ভারতের সংবিধানের ‘আর্টিকেল ১৯(১)’এ রয়েছে যে, ভারতের নাগরিক হলে তার অধিকার রয়েছে যে কোন রাজ্যে যেতে পারার, এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার। ভারতের প্রতিটা রাজ্যে নিজ রাজ্যের মানুষের সরকারি চাকুরি, উচ্চশিক্ষা, এবং সামাজিক সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে কোটা রয়েছে।
‘ইন্ডিয়া মাইগ্রেশন নাউ’ নামের একটা এনজিও ‘ইন্টারস্টেট মাইগ্র্যান্ট পলিসি ইন্ডেক্স ২০১৯’ নামে একটা গবেষণা চালিয়েছে। তারা বের করতে চাইছে যে, ভারতের কোন রাজ্য অন্য রাজ্য থেকে আসা মানুষের জন্যে কতটা সুবিধা দিচ্ছে। যে ৭টা রাজ্যে প্রচুর মানুষ যাচ্ছে, সেগুলির মাঝে সবচাইতে ভালো ফলাফল দেখিয়েছে কেরালা, মহারাষ্ট্র আর পাঞ্জাব। কেরালার জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে, যা এই রাজ্যের মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে। তদুপরি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ এবং সহজে বাসস্থান পাবার ক্ষেত্রে কেরালা অভিবাসীদের আলাদা চোখে দেখেছে। অন্যান্য রাজ্যে অভিবাসীরা জীবনধারণের জন্য নিজেদের নেটওয়ার্ক এবং কর্মক্ষেত্রের উপর পুরোপুরি নির্ভর করেছে। তাদের বেতন কম দেয়া হয়; সুযোগসুবিধাও নেই বললেই চলে। খারাপ জীবনযাত্রার কারণে সুযোগমতো নিজ রাজ্যে ফিরে যাবার আকাংক্ষাও তাদের মাঝে থাকে প্রবল। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাতায়াত করাটা বেশিরভাগ মানুষের জন্যে যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি অনিশ্চয়তার; ব্যাপারটা অনেকটা অন্য কোন রাষ্ট্রে যাতায়াতের মতোই। স্বল্প আয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা বেশিদূরে যায় না; তাই তারা বেশিরভাগ সময়ই নিজ রাজ্যের মাঝেই থেকে যায়। অন্যদিকে যারা অর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে, তারাই ভারতের অন্য রাজ্যে বা বাইরের কোন দেশে কাজের জন্যে যায়।
ভারতের ফিনানশিয়াল পত্রিকা ‘লাইভমিন্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারত হলো একটা মহাদেশের মতো; যার একেকটা রাজ্য একেক ধরনের উন্নয়ন পেয়েছে। গত দুই দশকে ভারতের রাজ্যগুলির মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালের দিকে ভারতের সবচাইতে বিত্তশালী পাঁচটা রাজ্যের মাথাপিছু আয় সবচাইতে নিচের রাজ্যগুলির মাথাপিছু আয়ের প্রায় দেড় গুণ ছিল। ২০১০ সালের দিকে এটা বেড়ে ২ দশমিক ৯ গুণে পৌঁছায়। আর ২০১৮ সালে সেটা ৩ দশমিক ৪ গুণ হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত গরীব রাজ্যগুলির আয় কম; তাই তারা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের পিছনে কম খরচ করতে পারে। কেন্দ্র সরকারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও রাজ্যগুলির এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাতে সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে ধনী রাজ্যগুলিই বেশি লাভবান হচ্ছে। অথচ ভারতের বেশিরভাগ শিশুই রয়েছে গরীব রাজ্যগুলিতে।
‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারতের বৈষম্য মহাকাশ থেকেই দেখা যায়। অর্থনীতিবিদ প্রবীন চক্রবর্তী এবং ভিভেক দেহাজিয়া মার্কিন সামরিক স্যাটেলাইটের তোলা ছবি বিশ্লেষণে এই উপসংহারই টেনেছেন। এই স্যাটেলাইটগুলি রাতের বেলায় ভূমি থেকে আসা আলোর ছবি তুলতে পারে। এই ছবির বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মুম্বাই এবং ব্যাঙ্গালুরুর মত শহরগুলি অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি উজ্জ্বল। এই দুই গবেষকের কথায়, ভারতের গরীব রাজ্যগুলি ধনী রাজ্যগুলির সাথে পেরে উঠছে না। তাই আয় বৈষম্যও বেড়েই চলেছে। বড় ফেডারেল রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে এত বড় বৈষম্য ইতিহাসেই নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এতে ভারতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে এবং গরীব অঞ্চলগুলি ধনী অঞ্চলের মতো সুবিধা পেতে চাইবে।
১৯৪৭ সাল থেকে সেকুলারিজম ভারতকে একত্রে রেখেছে, কিন্তু দেশটার অভ্যন্তরীণ বৈষম্যকে দূর করতে পারেনি; বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথেসাথে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের রাজ্যগুলি আলাদা দেশের মতো চলছে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জাতীয়তাবোধ। এই জাতীয়তাবোধকে আরও উস্কে দিচ্ছে রাজ্যগুলির মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য। একইসাথে গণতান্ত্রিকভাবেই নির্বাচিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি, যা কিনা সেকুলারিজমের গোড়ায় আঘাত করেছে। বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত করতে চাইছে, যার মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে স্থাপিত সেকুলার ভারতই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালে ভারতের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মাঝে ভারতের আর্থসামাজিক সঙ্কট আরও প্রবল আকার ধারণ করেছে। ২০২০ সালে সেকুলার ভারতের স্থায়িত্ব নিয়েই আলোচনা হবে।