Saturday, 29 April 2023

সুদানের সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা

২৯শে এপ্রিল ২০২৩
 
যুক্তরাষ্ট্র সুদানের রাজনীতিকে তাদের মিত্রদের কাছে ‘আউটসোর্স’ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দুই জেনারেলের কেউই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাইছেন না; যা কিনা দেশটার সংঘাতকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে চলেছে। ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামেদতি যখন বলছেন যে, ক্ষমতার মালিক জনগণ অথবা এই সংঘাত হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন কথাগুলি কারুর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আবার এটাও ঠিক যে, জেনারেল বুরহানের অধীনে সেনাবাহিনী জানে যে, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ক্ষমতা হারাবে। আর ‘আরএসএফ’এর জয়লাভ করার অর্থ হলো, ‘আরএসএফ’ সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হবে। কাজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র পথ হলো সামরিক শাসন বজায় রাখা।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সুদানের সেনাবাহিনী এবং মিলিশিয়ার মাঝে সংঘর্ষ শুরু হবার পর থেকে এপর্যন্ত কমপক্ষে ৫’শ মানুষের প্রাণ গেছে এবং আরও ৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ। সুদান থেকে বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সাময়িক যুদ্ধবিরতির কথা বলা হলেও সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সংঘাতের একপক্ষে রয়েছেন সুদানের সামরিক সরকারের প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান; যিনি দেশটার প্রেসিডেন্টও। আর তার বিরোধী পক্ষে রয়েছে সুদানের মিলিশিয়া ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ বা ‘আরএসএফ’; যার প্রধান হলেন জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো, যিনি হামেদতি নামেও সমধিক পরিচিত। যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত হামেদতি ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৯ সালে দুইজন একত্রে একনায়ক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। তবে পশ্চিমাদের প্রচেষ্টায় সুদানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে তারা দু’জনেই বারংবার বাধাগ্রস্ত করেছেন। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও সুদানের সামরিক শাসকের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলি সুসম্পর্ক রেখে চলেছে। ‘আল জাজিরার’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ২০২১ সালের অক্টোবরে সুদানের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী চেয়েছিল বেসামরিক নেতৃত্বের সাথে ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়ার ক্ষমতাও খর্ব করতে। কাজেই অভ্যুত্থানের পর বুরহানের সাথে হামেদতির যে দ্বন্দ্ব শুরু হবে, তা প্রায় জানাই ছিল।

সুদনের সাথে সাতটা দেশের সীমানা রয়েছে; যেকারণে অনেকেই আশংকা করছেন যে, সুদানের এই সংঘাত আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, লোহিত সাগর, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল এবং ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলের মাঝে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হবার কারণে সুদানের গুরুত্ব অনেক। এখানকার কৃষি সম্পদের কারণে আঞ্চলিক শক্তিরা সর্বদাই সুদানের রাজনীতিতে জড়িয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত এখানে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানে রুশ নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সুদানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন আঞ্চলিক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবকে সাথে নিয়ে ‘কোয়াড’ নামের একটা জোট গঠন করেছিল। সুদানের পার্শ্ববর্তী লিবিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং শাদ রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝ দিয়ে গিয়েছে। সুদানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও আশেপাশের দেশগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।

‘আল জাজিরা’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সুদানের উপরে মধ্যপ্রাচ্যের দুইটি দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কতটা প্রভাব রয়েছে, তা ফুটে উঠতে শুরু করেছে ২০১৯ সালে দেশটার একনায়ক ওমর আল-বশিরের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে। ২০২২ সালে সুদানের সামরিক সরকার এবং আমিরাতের দু’টা কোম্পানির মাঝে ৬ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক কোম্পানিদু’টা লোহিত সাগরের তীরে ‘আবু আমামা’ নামের একটা সমুদ্রবন্দর তৈরি করবে। সুদানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, আমিরাতিরা লোহিত সাগরের বন্দরগুলির নিয়ন্ত্রণ চায়। লোহিত সাগরে তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে; আর মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকাতেও তাদের এই প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর আন্দ্রেয়াস ক্রীগ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমিরাতিরা সুদানের দুই জেনারেলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু এখন তারা তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ একসাথে দুইজনকে সমর্থন দিয়ে যাওয়াটা একসময় না একসময় সমস্যার জন্ম দিতো। যদিও সুদানকে সকলেই আফ্রিকার দেশ বলেই বোঝে, তথাপি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি সুদানকে আরব দেশ বলে গণ্য করে। কাজেই সুদানে যেকোন সংঘাতের একটা আঞ্চলিক চেহাড়া রয়েছে।

জিহাদ মাশামুন বলছেন যে, সুদানের উত্তরের দেশ মিশর সুদানের সেনাবাহিনীকে মিশরের সেনাবাহিনীর প্রতিচ্ছবি মনে করে। তাদের ধারণা সুদানে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার একমাত্র চাবি সেনাবাহিনীর হাতে। অপরদিকে হামেদতিকে তারা ভাড়াটে সেনা হিসেবে দেখে। আন্দ্রেয়াস ক্রীগ বলছেন যে, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে আমিরাত এবং মিশর উভয়েই জেনারেল খলিফা হাফতারের পক্ষে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এছাড়াও ইথিওপিয়ার সংকটে কে কোন পক্ষ নেবে, সেখানেও তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব ছিল। এখন সেখানে সুদান যোগ হলো। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র সুদানে তার মিত্র দেশ আমিরাত এবং সৌদি আরবকে পাশে রেখেছে সুদানের সামরিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু এখানেই প্রকাশ পেয়ে যায় যে, আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তার প্রভাব ধরে রাখতে পারছে না; বরং এই কাজে ওয়াশিংটন তার মিত্রদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এসোসিয়েট ফেলো স্যামুয়েল রামানি ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, যদি সংঘাতে হামেদতি সমস্যা পড়ে যান, তাহলে আমিরাতিরা হয়তো ‘আরএসএফ’এর পক্ষ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা না দিয়ে তারা হয়তো লিবিয়াতে তাদের এজেন্ট জেনারেল হাফতারের হাত দিয়ে সহায়তা পাঠাতে পারে। হামেদতির সোশাল মিডিয়ার পেইজগুলি আমিরাত থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। সেগুলিতে তারা আমিরাতের রাজনৈতিক দর্শনকেই প্রতিফলিত করছে এবং আমিরাতিরা যেধরণের কথা বলে, সেগুলিই তারা ব্যবহার করছে সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল বুরহানের বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিত্র দেশ আমিরাত এবং মিশর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একই পক্ষে থাকলেও এখন তারা দুই পক্ষ হয়ে সুদানে রক্তপাত ঘটাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। সুদান বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুনের কথায়, যুক্তরাষ্ট্র সুদানের রাজনীতিকে তাদের মিত্রদের কাছে ‘আউটসোর্স’ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দুই জেনারেলের কেউই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাইছেন না; যা কিনা দেশটার সংঘাতকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে চলেছে। কানাডাভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এন্ড্রু ম্যাকগ্রেগর মার্কিন থিঙ্কট্যাংক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় বলছেন যে, ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামেদতি যখন বলছেন যে, ক্ষমতার মালিক জনগণ অথবা এই সংঘাত হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন কথাগুলি কারুর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আবার এটাও ঠিক যে, জেনারেল বুরহানের অধীনে সেনাবাহিনী জানে যে, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ক্ষমতা হারাবে। আর ‘আরএসএফ’এর জয়লাভ করার অর্থ হলো, ‘আরএসএফ’ সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হবে। কাজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র পথ হলো সামরিক শাসন বজায় রাখা।

Tuesday, 25 April 2023

যুক্তরাষ্ট্রে কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছে জনগণ?

২৫শে এপ্রিল ২০২৩

মার্কিন জনগণের রাষ্ট্রীয় ভিতগুলির উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা যথেষ্টই গভীর। মার্কিন জনগণ এখন কোনকিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষ বিভিন্ন বিশ্লেষণকে বিশ্বাস করতে পারছে না; যার ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণভাবে কোনটা সত্য, আর কোনটা সত্য নয়, সেটার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কিছু সত্যের উপরে স্থির না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় যেকোন সমস্যা, তা কোভিড-১৯ হোক, দারিদ্র্য, অভিবাসন, জলবায়ুই হোক, সেগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হবে।

গত ১৩ই এপ্রিল ‘রয়টার্স’ এবং গবেষণা সংস্থা ‘ইপসস’এর করা এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে বলা হয় যে, মার্কিন জনগণের মাঝে ৫৬ শতাংশই মনে করছেন যে, এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতে গর্ভপাত বিষয়ে যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, তা ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল যে, ‘মিফেপ্রিসটাইন’ নামক গর্ভপাত ঘটানো ঔষধ, যা একসময় মার্কিন সরকার বিক্রি করা অবৈধ ঘোষণা করেছিল, তা এখন বিক্রি করা যাবে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, এই জরিপের ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মার্কিন জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার উপরে মারাত্মকভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই মতামত ২০২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের উপরে প্রভাব ফেলবে তা প্রায় নিশ্চিত। মার্কিন রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণার সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তারা নির্বাচিত হলে গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করবেন, অথবা ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে থাকার সময় বেশকিছু ফেডারেল বিচারককে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের জুন মাসে সুপ্রীম কোর্টের এক নির্দেশনায় গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করার পর অনেকেই আদালতের রুলিংকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে আখ্যা দিয়েছিল। আর ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের নির্বাচনে আশানুরূপ বিজয় অর্জন না করার কারণ হিসেবে সেই রুলিংকে অনেকেই উল্লেখ করেছিলেন।

মার্কিন জনগণ যেকোন আইনী বিষয়ের মাঝেই রাজনৈতিক প্রভাবের গন্ধ পাচ্ছে। একমাস আগেই ‘রয়টার্স’ এবং ‘ইপসস’এর আরেক জরিপে উল্লেখ করা হয় যে, মার্কিন জনগণের অর্ধেকই বিশ্বাস করছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী পর্ণতারকাকে অর্থ দিয়ে চুপ থাকতে বলেছিলেন কিনা, সেব্যাপারে সরকারি যে তদন্ত চলেছে, তা মূলতঃ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। এমনকি ডেমোক্র্যাট ঘরানার এক-তৃতীয়াংশও সেটাই ভেবেছিল।

বিচার ব্যবস্থার উপর মার্কিন জনগণের আস্থার অভাবটা অবশ্য নতুন নয়। ২০২২ সালের জুন মাসে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্যালাপ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ১৯৭৩ সাল থেকে তারা মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের উপর জনগণের আস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়ে আসছে। সেখানে দেখা যায় যে, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৮ সালে ৫৬ শতাংশ মানুষের আস্থাই ছিল বিচার ব্যবস্থার উপরে জনগণের সর্বোচ্চ আস্থা। আর কখনোই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। আর ২০০২ সালের পর থেকে তা নিম্নগামী। ২০০৮ সালে ৩২ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৩০ শতাংশ জনগণের আস্থা পেলেও ২০২২ সালের জুনে তা ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে; যা কিনা ইতিহাসের সর্বনিম্ন।

শুধু বিচার ব্যবস্থাই নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অংশ মিডিয়া, যাকে কিনা জনগণের বিবেক হিসেবে মনে করা হয়, সেই মিডিয়ার উপরেও জনগণের আস্থা ভয়াবহভাবে কমে গিয়েছে। গত জুলাই মাসে ‘গ্যালাপ’এর এক জরিপে বলা হয় যে, মাত্র ১৬ শতাংশ মার্কিন জনগণ পত্রিকাকে এবং মাত্র ১১ শতাংশ জনগণ টেলিভিশনের খবরকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে থাকে; যা কিনা ইতিহাসের সর্বনিম্ন। ‘গ্যালাপ’ বলছে যে, ১৯৭৯ সালে এই বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। কিন্তু ১৯৮১ সাল থেকে তা ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। ১৯৯০ সালে ৩৯ শতাংশ জনগণ পত্রিকার খবর বিশ্বাস করতো; আর ১৯৯৩ সালে ৪৬ শতাংশ জনগণ টেলিভিশনের খবর বিশ্বাস করতো। ২০০৬ সালের পর থেকে উভয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাই ৩০ শতাংশের নিচে চলে আসে; আর ২০২০ সাল থেকে তা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

মার্কিন সরকারের উপরে আস্থাও মারাত্মভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২২এর জুনে গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৫৮ সালে মার্কিন সরকারের উপরে ৭৩ শতাংশ জনগণের আস্থা ছিল; যা ১৯৬৪ সালে ৭৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকেই তা পড়তে থাকে। ১৯৮০এর দশকে রোনাল্ড রেগ্যানের সময়ে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ; ১৯৯১ সালে জর্জ বুশ সিনিয়রের সময় সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ; আর ২০০১ সালে জর্জ বুশ জুনিয়রের সময় সর্বোচ্চ ৫৪ শতাংশ মানুষের আস্থা থাকলেও ২০০৮ সালের পর থেকে বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেনের সময়ে তা কখনোই ২৫ শতাংশের উপরে ওঠেনি।

শুধু সরকারই নয়, পুরো সরকারব্যবস্থার উপরেই জনগণের আস্থা পড়ে গেছে। গত ৭ই এপ্রিল ‘পিউ রিসার্চ’এর প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয় যে, জনগণের ৫৬ শতাংশ মনে করছে না যে, তাদের রাষ্ট্র তাদের বড় সমস্যাগুলির সমাধান দিতে সক্ষম। শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের অধীনে প্রশাসনই নয়, উভয় দলের কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ এবং খোদ পার্লামেন্টের উপরেই জনগণের আস্থা পড়ে গেছে। মাত্র ২৬ শতাংশ জনগণের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত নেবার উপরে আস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়; জনগণের ৭৬ শতাংশ মনে করছে না যে, মার্কিনীদের সক্ষমতা রয়েছে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার। এছাড়াও জনগণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকেও ভালো চোখে দেখছে না। ৪৬ শতাংশ জনগণ আশংকা করছে যে, আসন্ন বছরে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে।

মার্কিন জনগণের রাষ্ট্রীয় ভিতগুলির উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা যথেষ্টই গভীর। মার্কিন জনগণ এখন কোনকিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মার্কিন থিঙ্কট্যাক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর এক প্রতিবেদনে এটাকে ‘ট্রুথ ডেকে’ বা সত্যের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে সত্য এবং বিশ্লেষণের গুরুত্ব কমে গেছে। মানুষ বিভিন্ন বিশ্লেষণকে বিশ্বাস করতে পারছে না; যার ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণভাবে কোনটা সত্য, আর কোনটা সত্য নয়, সেটার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সেখানে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলি করোনা মহামারির সময়ে ভ্যাকসিনের নিরাপদ হবার ব্যাপারে যথেষ্টভাবে বললেও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অনাস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, মানুষ এখন প্রচলিত তথ্যের উৎসের উপরে নির্ভর না করে সোশাল মিডিয়ার উপরে নির্ভর করছে। এছাড়াও রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মার্কিনীরা এখন প্রচন্ডভাবে বিভক্ত; যা কিনা তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিছু সত্যের উপরে স্থির না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় যেকোন সমস্যা, তা কোভিড-১৯ হোক, দারিদ্র্য, অভিবাসন, জলবায়ুই হোক, সেগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হবে।

Wednesday, 19 April 2023

ইউরোপ কি চীনের সাথে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে?

১৯শে এপ্রিল ২০২৩

এপ্রিল ২০২৩। বেইজিংএ শি জিনপিংএর সাথে ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ। চীন বিষয়ে ম্যাক্রঁর বক্তব্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপের চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকবে কি থাকবে না, অথবা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে কতটা নির্ভরশীল থাকবে, সেটাই যেন বিবেচ্য বিষয়। ম্যাক্রঁ যখন বলছেন যে, ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা থাকা উচিৎ, তখনও তিনি প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কোলে বসে থাকা উচিৎ হবে কিনা, সেটা নিয়েই কথা বলছেন।

 বেইজিংএ যেনো বিশ্ব নেতাদের মেলা শেষ হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে বেইজিং সফরে গিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন, এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক। এছাড়াও বেইজিং সফর করেছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা। তবে যার সফর মিডিয়াতে সবচাইতে বেশি হাইলাইট হয়েছে তিনি হলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ। অনেকেই প্রশ্ন করা শুরু করেছেন যে, ম্যাক্রঁ কি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন কিনা।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ কি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন?

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন বেইজিং সফর করে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর সাথে আলোচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেন যে, তিনি নিশ্চিত যে, শি জিনপিংই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করাতে পারবেন। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সাংবাদিক সন্মেলনে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বেশ অমায়িক ছিলেন এবং বারংবার শি জিনপিংএর দিকে তাকাচ্ছিলেন ও তাকে নাম ধরে সম্ভোধন করছিলেন। তবে ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ম্যাক্রঁর বেইজিং সফরের পর ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে শি জিনপিংএর চিন্তাতে বড় কোন পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। ম্যাক্রঁ মনে করছেন যে, পশ্চিমা জোটের অংশ হবার অর্থ এই নয় যে, ফ্রান্স চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারবে না। সংবাদ সন্মেলনে ম্যাক্রঁ চীনের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেননি। বরং তিনি বলেছেন যে, মানবাধিকার ফ্রান্সের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; তবে সন্মান দিয়ে কথা বলাটা ‘লেকচার দেওয়া’ থেকে ভালো। ম্যাক্রঁর সফরের মাঝে দুই দেশের মাঝে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

আরেকটা সংবাদ সন্মেলনে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডার লেইয়েন বলেন যে, তিনি মনে করছেন যে, চীন ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে সুষ্ঠু ভূমিকা নেবে। তবে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির শান্তি প্রস্তাবের পক্ষে বলেন; যেখানে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনাদের সম্পূর্ণ সরে যাবার কথা বলা হয়েছে। একইসাথে তিনি বলেন যে, চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তাহলে ইউরোপের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হবে।

৯ই এপ্রিল ফরাসি পত্রিকা ‘লে একোস’এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ বলেন যে, সবচাইতে খারাপ ব্যাপার হবে যদি ইউরোপিয়রা চিন্তা করতে থাকে যে, তাদেরকে অন্য কাউকে অনুসরণ করতে হবে; নিজেদেরকে পরিবর্তন করে মার্কিন সুর এবং এর চীনা প্রতিক্রিয়ার সাথে তাল মেলাতে হবে। ১১ই এপ্রিল দি হেগএর ‘নেক্সাস ইন্সটিটিউট’এ এক বক্তব্যে ম্যাক্রঁ জার্মানির নাম উল্লেখ না করেই বলেন যে, ইউরোপের কেউ কেউ রাশিয়া থেকে জ্বালানি ক্রয় করা জন্যে তাদেরকে বন্ধু বানিয়েছিল। কারণ তারা মনে করেছিল যে, বাণিজ্যের মাধ্যমেই সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং আগ্রাসনকে মোকাবিলা করা সম্ভব। এখন তারাই জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং ইউরোপকে মারাত্মক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন যে, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের চোখ খুলে দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের সাপ্লাই স্বল্পতা এবং যুদ্ধের দামামাকে তুলে ধরে তিনি বলেন যে, ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকতে হবে।

এপ্রিল ২০২৩। বেইজিংএ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক। জার্মানরা ওয়াশিংটনের লাইন ধরেই তাইওয়ান বিষয়ে চীনকে শক্ত কথা শোনাচ্ছে। বেয়ারবক বলেন যে, তার সরকার ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী; তবে দ্বন্দ্বের সমাধান অবশই শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে। স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের কোন চেষ্টা জার্মানি সমর্থন করবে না।


চীনের ব্যাপারে ইউরোপ বিভক্ত

ম্যাক্রঁর সাথে ইউরোপের সকলে যে একমত নয়, তা নিশ্চিত। ‘ডয়েচে ভেলে’কে ‘ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি’র প্রধান মানফ্রেড ওয়েবার বলছেন যে, তাইওয়ানের সীমানায় সামরিক মহড়ার মাঝে ম্যাক্রঁ যখন চীনের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে কথা বলছেন, তখন এটা নিশ্চিত যে, তার কথাগুলি ইউরোপের স্বার্থের বিরুদ্ধ। আবার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাতেউস মোরাভিয়েস্কি সাংবাদিকদের বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পোল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের এই বিভেদকে তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও এক ভিডিও বার্তায় প্রশ্ন করছেন যে, ম্যাক্রঁ কি ইউরোপের হয়ে কথা বলছেন? এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। মার্কিনীরা তাদের করদাতাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ইউরোপের যুদ্ধে খরচ করছে।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের পরপরই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বেইজিং সফর করে এসেছেন। অনেকেই বলছেন যে, বেয়ারবক তার সফরের মাধ্যমে ম্যাক্রঁর সফরে পশ্চিমাদের যা ‘ক্ষতি’ হয়েছে, তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। বেইজিংএ ১৪ই এপ্রিল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, এটা একটা ভালো ব্যাপার যে, ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানে চীন চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি অবাক হচ্ছেন যে, কেন এখন পর্যন্ত চীনারা রাশিয়াকে আগ্রাসী আখ্যা দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে আহ্বান করেনি। একইসাথে তিনি বলেন যে, তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে জার্মানি উদ্বিগ্ন। তার সরকার ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী; তবে দ্বন্দ্বের সমাধান অবশই শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে। স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের কোন চেষ্টা জার্মানি সমর্থন করবে না। অপরদিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং বলেন যে, তাইওয়ান প্রণালি এবং পুরো অঞ্চলে কেউ যদি শান্তি দেখতে চায়, তাহলে তাকে তাইওয়ানের স্বাধীনতার চেষ্টা এবং সেখানে বিদেশী প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।

ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন ইইউএর অর্থনৈতিক সমস্যার উপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন; এবং সেই সূত্রে চীনের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ১৮ই এপ্রিল ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপিয় পার্লামেন্টে ভন ডার লেইয়েন বলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন যে, ইউরোপের উচিৎ এবং ইউরোপের দ্বারা সম্ভব নিজেদের আলাদা নীতি অনুসরণ করা; যাতে করে ইউরোপিয়রা অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি বলেন যে, চীনের সাথে ইউরোপের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যেকারণে চীনের সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই ইউরোপের নীতি এবং কৌশল প্রণয়ন করা উচিৎ নয়। বেইজিংএ গিয়ে তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, ইউরোপ চীনের সাথে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সম্পর্ক কর্তন করতে চায় না। একইসাথে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে, চীনের ব্যাপারে ইউরোপের নীতির কেন্দ্রীয় অংশ হওয়া উচিৎ কিভাবে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমানো যায়।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি জোসিপ বোরেল আবার চীনের সাথে সম্পর্ক রাখার সাথেসাথে তাইওয়ান ইস্যুকেও সামনে এনে কিছুটা হুমকি দিয়েই কথা বলেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার কারণে তিনি বেইজিং সফরে যাননি। তবে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, ইইউ তার ‘এক চীন’ নীতিতে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ইউরোপের উচিৎ উত্তেজনা প্রশমন করা; উত্তেজক বার্তা না দেয়া এবং অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে পারে এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা। তবে চীনের পক্ষ থেকে বর্তমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার কোন চেষ্টা যদি করা হয়, তাহলে সেটা গ্রহনযোগ্য হবে না। ইইউ পার্লামেন্টে তিনি বলেন যে, চীন ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী; তবে চীনের সাথে অবশ্যই কথা চালিয়ে নিতে হবে।

ম্যাক্রঁর সমালোচকের অভাব নেই

ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য এবং কিছুদিন আগেই পদত্যাগ করা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস গত ১২ই এপ্রিল এক অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন যে, ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং বলেছেন যে, তারা পশ্চিমা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একে অপরের বন্ধু। একারণেই তিনি মনে করছেন যে, পশ্চিমা নেতাদের উচিৎ হয়নি বেইজিং গিয়ে শি জিনপিংএর সাথে দেখা করা; এবং একইসাথে তাকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা করার জন্যে অনুরোধ করা। তিনি বলেন যে, ইউরোপিয় নেতাদের এই কর্মকান্ড তাদের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। এবং একই কারণে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর উচিৎ হয়নি বলা যে, তাইওয়ানে ইউরোপের কোন স্বার্থ নেই। ট্রাস বলেন যে, পশ্চিমাদের সকলেরই উচিৎ তাইওয়ান যাতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, সেজন্য তাদেরকে সকল প্রকারের সহায়তা দেয়া। এছাড়াও তিনি বলেন যে, চীনারা যা বলছে, সেগুলিকে পশ্চিমাদের সন্দেহের চোখে দেখা উচিৎ।

জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ডিজিএপি’র সিনিয়র ফেলো জ্যাকব রস ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ম্যাক্রঁ সর্বদাই তার কথার ধরণের জন্যে আলোচিত। তিনি যেভাবে কথা বলেন অথবা সময়জ্ঞান না রেখেই যে বক্তব্য দেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করে। তার কথাগুলি হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেনি বা তাকে অনেকেই হয়তো ভুল বুঝেছে। অনেকেই মনে করেছেন যে, ম্যাক্রঁ চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এক কাতারে ফেলেছেন; যা ভাবাটা অনুচিত। তিনি রাশিয়া, চীন বা যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক চিন্তা না করে ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার ব্যাপারে যে কথাগুলি বলছেন, তা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও সমর্থিত। তবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার পদ্ধতির ক্ষেত্রে ইউরোপিয়দের হয়তো বিভেদ রয়েছে। তথাপি স্বল্প মেয়াদে হলেও তিনি যে আটলান্টিকের দুই পাড়ের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছেন, সেটা নিশ্চিত। যে ব্যাপারটা হয়তো ম্যাক্রঁকে উস্কে দিয়েছে তা হলো ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ‘অকাস’ চুক্তি। ফরাসিরা অনেকেই সেই চুক্তিকে ফ্রান্সের পিঠে চাকু মারার সাথে তুলনা করেছিল। ম্যাক্রঁ হয়তো সেটাকে উল্টে দিতেই জোরেসোরে লেগেছেন।

ফেব্রুয়ারি ২০২৩। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। পোল্যান্ড এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এখন তাদের নিরাপত্তার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা দূরে থাকুক, নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারেই তাদের অসহায়ত্ব দিবালোকের মত পরিষ্কার। ইউরোপিয়রা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া চিন্তাই করতে পারছে না; অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে ব্যালান্স করতে হিসমিস খাচ্ছে; যা ইউরোপের লক্ষ্যহীন অবস্থাকেই তুলে ধরে।

ইউরোপ কেন বিভক্ত?

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউরোপিয় নেতারা বেইজিং সফর করে যেসব কথা বলছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পছন্দনীয় হবার কথা নয়। কারণ জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন চীনের সাথে বিশেষ রকমের বৈরীতার নীতিতে এগুচ্ছে। ওয়াশিংটন চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে চীনে উচ্চ প্রযুক্তি রপ্তানির উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপিয় দেশগুলিকেও একই পথে হাঁটার আহ্বান করেছে। ইউরোপিয় নেতাদের বেইজিং সফরে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে তা হলো, চীনের সাথে কেমন সম্পর্ক থাকা উচিৎ, সেব্যাপারে ইউরোপিয় দেশগুলি একমত নয়। কিছু দেশ নিরাপত্তাজনিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকতে চাইছে। আর কিছু দেশ অর্থনৈতিক কারণে চীনকে ফেলে দিতে পারছে না। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর হিসেবে ২০২২ সালে ইউরোপ সবচাইতে বেশি আমদানি করেছে চীন থেকে এবং চীনারা ছিল ইউরোপের পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। এই ব্যাপারটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে যখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইউরোপিয় নেতারা চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অটুট রাখার কথা বলছেন এমন এক সময়ে, যখন মার্কিনীরা বেইজিংএর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অনেকটাই কর্তন করতে চাইছে। ইউরোপ চাইছে চীনের সাথে সম্পর্ক কর্তন না করে বরং নিজেদের অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে কমাতে।

বার্লিনের ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি’র ডিরেক্টর মারিনা হেনকা ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইইউএর প্রতিনিধিরা যখন বলছেন যে, চীন ইউরোপের সহযোগী, প্রতিযোগী এবং পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ইউরোপের মাঝে বিভেদ রয়েছে। এই কথাগুলিকে পাশাপাশি রাখলে এটা পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইইউএর কিছু দেশ চীনকে সহযোগী মনে করছে, কিছু দেশ চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে; আর কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করে চীনকে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার প্রতি হুমকি এবং বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার প্রবক্তা হিসেবে দেখছে।

চীন বিষয়ে ম্যাক্রঁর বক্তব্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপের চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকবে কি থাকবে না, অথবা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে কতটা নির্ভরশীল থাকবে, সেটাই যেন বিবেচ্য বিষয়। ম্যাক্রঁ যখন বলছেন যে, ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা থাকা উচিৎ, তখনও তিনি প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কোলে বসে থাকা উচিৎ হবে কিনা, সেটা নিয়েই কথা বলছেন। অপরদিকে তিনি যখন জার্মানদের সমালোচনা করছেন রুশ গ্যাসের উপরে নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির জন্যে, তখন জার্মানরা আবার ওয়াশিংটনের লাইন ধরেই তাইওয়ান বিষয়ে চীনকে শক্ত কথা শোনাচ্ছে। আর পোল্যান্ড এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এখন তাদের নিরাপত্তার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। চীনের বিষয়ে ইউরোপ যে একমত নয়, সেটা পরিষ্কার। তবে সবচাইতে হাস্যকর হলো, ম্যাক্রঁ এই কথাগুলি বলছেন; আবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা অনুসরণ করে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছেন; যা কিনা দেখিয়ে দেয় যে, ম্যাক্রঁ মুখে অনেক কিছু বললেও প্রকৃতপক্ষে তার যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যাবার সক্ষমতা কতটুকু। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা দূরে থাকুক, নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারেই তাদের অসহায়ত্ব দিবালোকের মত পরিষ্কার। ইউরোপিয়রা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া চিন্তাই করতে পারছে না; অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে ব্যালান্স করতে হিসমিস খাচ্ছে; যা ইউরোপের লক্ষ্যহীন অবস্থাকেই তুলে ধরে।

Monday, 17 April 2023

সুদানে আবারও সংঘাত পশ্চিমাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বেরই ফলাফল

১৭ই এপ্রিল ২০২৩

সুদানের খার্তুম বিমানবন্দরে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান থেকে ধোঁয়া উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা এবং পশ্চিমা দাতা সংস্থা ‘আইএমএফ’এর কঠোর শর্ত বাস্তবায়নের ফলাফলস্বরূপ সুদানের রাস্তায় গণবিক্ষোভ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সামরিক বাহিনীর সাথে মিলিশিয়া বাহিনী ‘আরএসএফ’এর উত্তেজনা নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো বেশকিছুদিন ধরেই।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে নতুন করে আবারও সংঘাত শুরু হয়েছে। ১৫ই এপ্রিল দেশটার সামরিক বাহিনীর সাথে শক্তিশালী মিলিশিয়া ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ বা ‘আরএসএফ’এর সদস্যদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। ‘আরএসএফ’এর সদস্যরা বলছে যে, তারা তিনটা বিমানবন্দর এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করে নিয়েছে। সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, মিলিশিয়ারা মেরোউই বিমানবন্দরে মিশরের বিমান বাহিনীর কয়েকটা ‘মিগ-২৯’ যুদ্ধবিমানসহ বেশ কয়েকজন মিশরীয় সেনাকে আটক করেছে। এছাড়াও মিলিশিয়াদের গোলার আঘাতে রাজধানী খার্তুমের বিমানবন্দরে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটা এয়ারবাস বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। খার্তুমে মিলিশিয়াদের উপর সুদানের বিমান বাহিনীর ‘মিগ-২৯’ বিমানকে রকেট নিক্ষেপ করতে দেখা যায় বিভিন্ন ভিডিওতে। এছাড়াও পূর্বাঞ্চলের বন্দর শহর পোর্ট সুদানের রাস্তাতেও ট্যাংক দেখা গেছে এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে গোলাগুলির শব্দের কথাও বলা হয়। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এ পর্যন্ত প্রায় ১’শ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে; আরও প্রায় ১১’শ আহত হয়েছে। ‘আরএসএফ’এর এক বিবৃতিতে বলে হয় যে, সুদানের সেনাবাহিনী খার্তুমে ‘আরএসএফ’এর ‘সোবা’ ক্যাম্প ঘিরে ফেলে এবং সকল প্রকারের অস্ত্র দিয়ে হামলা করে। অপরদিকে সুদানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাবিল আবদাল্লাহ বলেন যে, ‘আরএসএফ’এর সদস্যরা খার্তুমে কয়েকটা সেনা ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে।

২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পশ্চিমা দেশগুলি সামরিক সরকারের সাথে কাজ করছিলো, যাতে করে নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে একটা অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক সরকার স্থাপন করা যায়। ২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের একনায়ক ওমর আল-বশিরএর সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দেশটায় অস্থিরতা লেগেই আছে। আবদাল্লা হামদকএর নেতৃত্বে গঠিত একটা বেসামরিক সরকার জনগণের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে না পারার ফলে অনেকেই ধারণা করছিল যে, কিছু একটা ঘটবে; যা ২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা এবং পশ্চিমা দাতা সংস্থা ‘আইএমএফ’এর কঠোর শর্ত বাস্তবায়নের ফলাফলস্বরূপ সুদানের রাস্তায় গণবিক্ষোভ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সামরিক বাহিনীর সাথে মিলিশিয়া বাহিনী ‘আরএসএফ’এর উত্তেজনা নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো বেশকিছুদিন ধরেই। ১৪ই এপ্রিল ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ‘আরএসএফ’ প্রায় এক মাস ধরেই তাদের ইউনিটগুলিকে সংগঠিত করছিল। ১৫ই এপ্রিল ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামদান দাগালো, যাকে অনেকেই হামেদতি বলে ডাকে, তিনি ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, তার বাহিনী সকল সামরিক ঘাঁটি দখল করার আগ পর্যন্ত থামবে না। তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল আল-বুরহানকে একজন ‘অপরাধী’ বলে আখ্যা দেন এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের অভিযোগ তোলেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, সুদানের প্রধান কর্তাব্যক্তিরা কিছুদিন আগেই বেসামরিক নেতৃত্বে যাবার জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন। এই পথে যথেষ্টই অগ্রগতি হয়েছে। দু’দিন আগেই তিনি জেনারেল বুরহানের সাথে কথা বলেছেন এবং জেনেছেন যে, এখনও কিছু ইস্যুর সমাধান হয়নি। এখানে কিছু পক্ষ সেই অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে চাইছে। তিনি বলেন যে, বর্তমানে সেখানকার পরিস্থতি ভঙ্গুর। তবে সেখানে বেসামরিক নেতৃত্বে যাবার জন্যে প্রকৃত সুযোগ বর্তমান। অপরদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে উভয় পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধ করে আলোচনার পথে অগ্রসর হবার কথা বলা হয়।

সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল বুরহানের সাথে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও। সুদানের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে উপেক্ষা করেই পশ্চিমা দেশগুলি সুদানে গণতন্ত্রায়নের কাজ করে যাচ্ছে; যা কিনা সুদানের সামরিক বাহিনী এবং মিলিশিয়াগুলিকে অধিকতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকান্ডে আগ্রহী করেছে।



সুদানে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে ‘আরএসএফ’কে রুশ-সমর্থিত মিলিশিয়া বলে আখ্যা দিয়ে তাদের দারফুর যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারগুলিকে তুলে ধরা হয়। 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে 'আরএসএফ'এর নেতা জেনারেল হামদান দাগালোর ইতিহাস তুলে ধরা হয়; যেখানে বলা হয় কিভাবে তিনি উট বিক্রেতা থেকে মারাত্মক যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে একসময় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করেছেন। একনায়ক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে তিনি নিজেকে গণতান্ত্রিক নেতাও বলতে শুরু করেছেন। এমনকি সুদানের শীর্ষ নেতাও বনে যেতে চান তিনি। এছাড়াও রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন এবং রুশ ভাড়াটে সামরিক সংস্থা 'ওয়াগনার গ্রুপ'কেও তিনি আলিঙ্গন করেছেন স্বর্ণের খনিগুলি পাহাড়া দেবার জন্যে। ২০১৯ সালে ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পরবর্তীতে তার 'আরএসএফ' বাহিনীই রাস্তায় জনগণের উপরে হামলা চালিয়ে ১'শরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ২০১৯ সালে তিনি 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'কে বলেছিলেন যে, যারা তার মিলিশিয়াকে 'জানজাউইদ' বলে থাকে, তারা মিথ্যা কথা রটাচ্ছে। কারণ 'জানজাউইদ' অর্থ হলো ডাকাত দল, যারা রাস্তায় মানুষের সকল কিছু লুটে নেয়। বর্তমানে অনেকেই এই বাহিনীর সংখ্যা ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বলে ধারণা করেন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি প্রচুর সম্পদের মালিকও বনে গেছেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর সিনিয়র এসোসিয়েট এবং মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’এর প্রাক্তন সদস্য ক্যামেরন হাডসন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, বর্তমানে পশ্চিমাদের নেতৃত্বে সুদানে চলমান গণতন্ত্রায়নকে সামরিক বাহিনী এবং ‘আরএসএফ’ উভয়েই তাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান শান্তি আলোচনায় বেসামরিক নেতারা ছিলেনই না; যা কিনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সুদানে ক্ষমতা কাদের হাতে রয়েছে। তবে এই সংঘাতের ব্যাপারে কেউই অবাক হয়নি। এই পক্ষগুলি নিজেদের সামরিক লক্ষ্যগুলি কিছুটা বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত হয়তো আলোচনায় বসবে না। যুক্তরাষ্ট্র সুদানের নেতৃত্বকে একত্রে বসাতে বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার কথা বলেছে; কিন্তু তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করেনি; বা তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ডেপুটি ডিরেক্টর এবং মার্কিন সরকারের রাজস্ব দপ্তরের আফ্রিকা বিষয়ক প্রকল্পের প্রাক্তন প্রধান বেঞ্জামিন মসবার্গ সুদানের সহিংসতা শুরু হবার মাত্র তিন দিন আগে ১২ই এপ্রিল এক লেখায় বলেন যে, দেশের সামরিক বাহিনী এবং ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়ার মাঝে দ্বন্দ্বের অবসান না হলে দেশটা বড় রকমের সহিংসতার মাঝে পতিত হতে পারে। মসবার্গ তার লেখায় দেশটাকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবার পশ্চিমা প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, সুদানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সাথে তিনটা ব্যাপারকে সবচাইতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন; যার প্রথমটা হলো অর্থনৈতিক সংস্কার; দ্বিতীয়টা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার এবং তৃতীয়টা হলো দেশটার ব্যাপক দুর্নীতি দূরীকরণ। অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলছেন যে, পশ্চিমা দাতা সংস্থাগুলি সুদানকে কতটা সহায়তা দেবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকা উচিৎ। বিশেষ করে আইএমএফএর শর্তগুলি বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার উপর ভিত্তি করে অর্থ ছাড়ের কথা বলেছেন তিনি। এই শর্তগুলির মাঝে একটা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার। নিরাপত্তা বাহিনীকে পুরোপুরিভাবে বেসামরিক নেতৃত্বের অধীন করা ছাড়াও বাহিনীর আকার ছোট করা জরুরি। বাহিনীর অস্তিত্বের জন্যে নতুন একটা উদ্দেশ্য ঠিক করা এবং সেই উদ্দেশ্য অনুযায়ী বাহিনীর আকার ঠিক করার মাধ্যমে এর ব্যয় সংকোচন করা প্রয়োজন। ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়াকে সামরিক বাহিনীর অংশ করার পিছনেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাহিনীর সংকোচনের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবার বিরুদ্ধে বলেন তিনি।

'আরএসএফ'এর প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো এবং সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। ‘আরএসএফ’ যেখানে বলছে যে, ১০ বছর সময়ের মাঝে তাদেরকে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ, সেখানে সেবাহিনী বলছে এত সময় না নিয়ে মাত্র দুই বছরের মাঝেই সেটা করা সম্ভব। যে ব্যপারটা পরিষ্কার তা হলো, সামরিক বাহিনী চাইছে ‘আরএসএফ’কে দ্রুত সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে এসে মিলিশিয়ার নেতাদের ক্ষমতাকে খর্ব করতে। তবে সবচাইতে বড় সমস্যা হলো, মার্কিনীরা সুদানের গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে এই ব্যাপারটাই চাইছে।


‘আরএসএফ’ এবং সামরিক বাহিনীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব

তবে সামরিক বাহিনীর আকার সংকোচনের মাঝে সেখানে ‘আরএসএফ’এর সদস্যদেরকে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেব্যাপারে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে সুদানের পশ্চিমাঞ্চলে দারফুরে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে দমন করতে দেশটার একনায়ক ওমর আল-বশির আঞ্চলিক ‘জানজাউইদ’ মিলিশিয়াকে নিয়োগ করেছিল। এরাই পরবর্তীতে সরকারের কাছ থেকে ‘আরএসএফ’ নামে স্বীকৃতি পায় এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে যায়। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সামরিক বাহিনী আর ‘আরএসএফ’এর দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে ‘আরএসএফ’কে কত সময়ের মাঝে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেব্যাপারে দুই পক্ষের ভিন্ন চিন্তা। ‘আরএসএফ’ যেখানে বলছে যে, ১০ বছর সময়ের মাঝে তাদেরকে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ, সেখানে সেবাহিনী বলছে এত সময় না নিয়ে মাত্র দুই বছরের মাঝেই সেটা করা সম্ভব। ‘বিবিসি’র এই প্রতিবেদনে যে ব্যপারটা পরিষ্কার তা হলো, সামরিক বাহিনী চাইছে ‘আরএসএফ’কে দ্রুত সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে এসে মিলিশিয়ার নেতাদের ক্ষমতাকে খর্ব করতে। অপরদিকে ‘আরএসএফ’এর নেতৃত্ব চাইছে না ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। তবে সবচাইতে বড় সমস্যা হলো, মার্কিনীরা সুদানের গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে এই ব্যাপারটাই চাইছে। ব্যাপারটা যে রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে রূপ নিতে পারে, সেটা বেঞ্জামিন মসবার্গ তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। অর্থাৎ এই সংঘাতের সম্ভাবনা কারুর কাছেই অজানা ছিল না।

মসবার্গ সুদানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলিকে তুলে ধরেছিলেন। আইএমএফএর কঠিন শর্তগুলি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুদানের জনগণ যে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এমনভাবে এগুনো, যাতে করে আইএমএফএর চাপে সুদানের জনগণ গণতন্ত্রায়নের বিরুদ্ধে না চলে যায়। আবার সুদানের সামরিক বাহিনী এবং ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়া কেউই তাদের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক নয়। এই সংস্থাগুলির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষমতাও রয়েছে; যেগুলি তারা ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক। ‘আরএসএফ’সহ মিলিশিয়াদের হাতে সুদানের স্বর্ণ ক্ষণিগুলি রয়েছে। আবার সুদানের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন ব্যবসায়িক কোম্পানির মাধ্যমে আয় করে থাকে। মসবার্গ বলছেন যে, সুদানের নেতৃত্বের উপরে যথেষ্ট পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করে এবং আঞ্চলিক বন্ধু দেশ মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাবকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ সুদানের গণতন্ত্রায়নকে ত্বরান্বিত করা। তবে সুদানের মানবাধিকার লংঘন করা ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলিকে এই গণতন্ত্রায়নের মাঝে রাখার ব্যপারে মসবার্গ কিছু বলেননি। বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা ‘আরএসএফ’কে সামরিক বাহিনীর অংশ রাখাকে তিনি প্রশ্ন করেননি। বরং গণতন্ত্রায়নের জন্যে আপাততঃ মানবাধিকারের বিষয়গুলিকে দীর্ঘমেয়াদে দেখার কথা বলেন তিনি।

জানুয়ারি ২০২৩। ইস্রাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেনের সাথে সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল আল-বুরহান। জো বাইডেন সরকার তাদের সুদান নীতিতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, লোহিত সাগরের নিরাপত্তা, এবং চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কর্তনের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ মার্কিনীদের কাছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের সামরিক নেতারা ঠিক একারণেই ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে; যাতে করে ইস্রাইলি লবি যুক্তরাষ্ট্রকে সুদানের সামরিক সরকারের পক্ষে রাখতে সহায়তা দেয়।

সুদানের সামরিক নেতৃত্বের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় ওয়াশিংটনের নীতির সমালোচনা করেছেন সুদানি গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুন। তিনি বলছেন যে, জো বাইডেন সরকার তাদের সুদান নীতিতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, লোহিত সাগরের নিরাপত্তা, এবং চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কর্তনের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ মার্কিনীদের কাছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের সামরিক নেতারা ঠিক একারণেই ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে; যাতে করে ইস্রাইলি লবি যুক্তরাষ্ট্রকে সুদানের সামরিক সরকারের পক্ষে রাখতে সহায়তা দেয়।

লোহিত সাগরের নিরাপত্তাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী হবার কারণে লোহিত সাগরের গুরুত্ব যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র লোহিত সাগরের দক্ষিণে বাব এল-মান্ডেব প্রণালির পাশে জিবুতিতে তার সামরিক ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিতেও অত্র অঞ্চলে তার প্রভাব ধরে রাখতে চাইছে। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে রাশিয়া বা চীন সমুদ্রপথের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করুক। ঠিক একারণেই সুদানের সমুদ্রবন্দর পোর্ট সুদানে রুশ নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা সুদানের সামরিক নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছে টেনে এনেছে। মার্কিনীরা চেয়েছে সুদানিরা যেন রাশিয়াকে কোনভাবেই নৌঘাঁটির সুবিধা না দেয়; বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকা মেনে নিয়েছে। এছাড়াও সুদানের সামরিক নেতৃত্ব চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করেছে; যা ওয়াশিংটনের প্রভাবকে কমাতে সহায়তা করছে।

জিহাদ মাশামুন বলছেন যে, বাইডেন প্রশাসন স্থিতিশীলতাও ধরে রাখতে চাইছে, আবার সুদানে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বাইডেন প্রশাসনের এই অদ্ভুত নীতির সফলতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন। তবে সুদানের সর্বশেষ পরিস্থিতি মাশামুনের দুশ্চিন্তাকেই প্রতিফলিত করছে।

সুদানের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের অদ্ভুত নীতির সাথে ইউরোপিয়দের চিন্তার পার্থক্য রয়েছে। ইউরোপিয়রা ওয়াশিংটনের নীতিকে পরিবর্তন করে বেসামরিক নেতৃত্বের সাথে সামরিক নেতৃত্বকেও মেনে নিতে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছে; যদিও ওয়াশিংটনে গণতান্ত্রিক আদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকেই সুদানের সামরিক নেতাদের, বিশেষ করে ‘আরএসএফ’এর নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত দেখতে আগ্রহী। পর্তুগালের ‘অটোনমাস ইউনিভার্সিটি অব লিসবন’এর সহকারী অধ্যাপক ফেলিপ দুয়ার্তে ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, সুদানে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামদান দাগালো; কারণ তিনিই সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। ফেলিপ দুয়ার্তে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের শুধুমাত্র বেসামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব না দিয়ে কারা কারা পশ্চিমাদের সাথে আলোচনার জন্যে যথেষ্ট নমনীয়, সেটা দেখা উচিৎ। কারণ নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে নমনীয় হওয়ার অর্থই হলো এই নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা করবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নমনীয় সামরিক নেতাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়, তাহলে সেটা সুদানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কমাতে সহায়তা করবে।

সুদানের সীমানা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলীকৃত ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সীমানা; যা একসময় সুদান এবং শাদএর সীমানা হিসেবে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের এঁকে দেয়া সেই সীমানাকে কেন্দ্র করেই সুদানে বহুদিন গৃহযুদ্ধ চলেছে। আঞ্চলিক মিলিশিয়া ‘আরএসএফ’এর শক্তিশালী হবার কারণ ছিল সুদানের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি। সুদানের সামরিক সরকারগুলি দেশটার ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করতে সকল প্রকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও পশ্চিমারা সুদানকে ছেড়ে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ গণতান্ত্রিক আদর্শ নয়, বরং নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। পশ্চিমাদের মাঝে প্রভাব ধরে রাখার এই প্রতিযোগিতাই সুদানের রাজনীতিকে করেছে অস্থির।


সুদানের রাজনীতিতে পশ্চিমা স্বার্থ

সুদানের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে উপেক্ষা করেই পশ্চিমা দেশগুলি সুদানে গণতন্ত্রায়নের কাজ করে যাচ্ছে; যা কিনা সুদানের সামরিক বাহিনী এবং মিলিশিয়াগুলিকে অধিকতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকান্ডে আগ্রহী করেছে। মার্কিনীরা মোটামুটিভাবে ‘আরএসএফ’এর বিরুদ্ধে বললেও ব্রিটিশ এবং ইউরোপিয়রা সুদানে সামরিক ও বেসামরিক সকলকেই আলোচনার টেবিলে দেখতে ইচ্ছুক। সুদানের রাজনীতিতে ব্রিটেন ও ইউরোপের প্রভাব অনেক পুরোনো। সুদানের সীমানা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলীকৃত ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সীমানা; যা একসময় সুদান এবং শাদএর সীমানা হিসেবে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের এঁকে দেয়া সেই সীমানাকে কেন্দ্র করেই সুদানে বহুদিন গৃহযুদ্ধ চলেছে। এর মাঝে ২২ বছর যুদ্ধের পরে দক্ষিণ সুদান যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে আলাদা দেশ হয়েছে। আর দারফুরে ১৭ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছে; যেখানে ফ্রান্সের মদদপুষ্ট শাদ সরাসরি জড়িত ছিল। দারফুরের বিদ্রোহীদের দমন করতে সুদানের সরকার ‘জানজাউইদ’ মিলিশিয়াদের ব্যবহার করেছিল; যারা পরবর্তীতে ‘আরএসএফ’ নামে সুদান সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে।

আঞ্চলিক মিলিশিয়া ‘আরএসএফ’এর শক্তিশালী হবার কারণ ছিল সুদানের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি। সুদানের সামরিক সরকারগুলি দেশটার ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করতে সকল প্রকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও পশ্চিমারা সুদানকে ছেড়ে যায়নি। নীল নদের উপরে এবং লোহিত সাগরের পাশে অবস্থিত সুদানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সর্বদাই বেশি। সুদানকে দেয়া ‘আইএমএফ’এর ঋণ মওকুফ এবং দেশটাতে বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটা সেই ভূরাজনৈতিক গুরুত্বেরই প্রমাণ। কিন্তু ওয়াশিংটন ও ইউরোপ সুদানের গণতান্ত্রিক সরকারের গঠনের ব্যাপারে একমত হতে পারেনি। ওয়াশিংটনে অনেকেই সুদানের সরকারে সামরিক নেতৃত্বকে দেখতে না চাইলেও ইউরোপিয়রা বেসামরিক ও সামরিক সকলকেই সুদানের রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ করতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ গণতান্ত্রিক আদর্শ নয়, বরং নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। পশ্চিমাদের মাঝে প্রভাব ধরে রাখার এই প্রতিযোগিতাই সুদানের রাজনীতিকে করেছে অস্থির।

Thursday, 13 April 2023

মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের ঘটনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

১৩ই এপ্রিল ২০২৩

ঘটনাটা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও একধাপ কমতে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি আদর্শিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে থাকতো, তাহলে এরূপ ঘটনা খুব একটা ক্ষতিকর হতো না। ক্ষতি কতটা হয়েছে, সেটাও মার্কিনীরা পুরোপুরি বুঝতে পারছে কিনা, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র মতো। তাদের এক প্রতিবেদনে তারা এই ডকুমেন্টগুলির ছবি ঝাপসা করে দিয়ে প্রকাশ করেছে। যখন এটা পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গিয়েছে এবং পুরো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেছে, তখন এহেন প্রচেষ্টা হাস্যকরই বটে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের কিছু গোপন দলিল অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ওয়াশিংটনসহ বিশ্বব্যাপী আলোচনারা ঝড় উঠেছে। যে ব্যাপারটা প্রায় অবাক করার মতো তা হলো, প্রায় মাসখানেক ধরেই এই দলিলাদি অনলাইনে ঘোড়াফেরা করলেও ৬ই এপ্রিল ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এই দলিল প্রকাশ করার পরেই এটা জনসন্মুখে আসে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, প্রায় শ’খানেক গোপন দলিল প্রকাশ হয়ে গেছে। এগুলি মূলতঃ ছিল মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ বা ‘এনএসএ’, ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা ‘সিআইএ’, ‘ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা ‘ডিআইএ’, ‘ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘ডিইএ’, এবং ‘ন্যাশনাল নেকনাইস্যান্স অফিস’ বা ‘এনআরও’এর সংগ্রহ করা এবং বিশ্লেষিত বিভিন্ন তথ্য। ডকুমেন্টগুলির উপর লেখা দেখে বোঝা যায় যে, এগুলি হয়তো সর্বোচ্চ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা জয়েন্ট চিফ অব স্টাফএর চেয়ারম্যান জেনারেল মাইক মিলিএর জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। তবে ‘নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিন’ বলছে যে, যেকোন কর্মকর্তা, যার যথেষ্ট উচ্চ পর্যায়ের অনুমতি রয়েছে, তার পক্ষে এগুলি দেখা সম্ভব। ফাঁস হওয়া তথ্য মূলতঃ প্রিন্ট করা বিভিন্ন ডকুমেন্ট এবং স্লাইডের ছবি। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, এগুলি কেউ একজন পকেটে পুড়েছিল; এরপর অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে সুযোগ বুঝে সেগুলির ছবি তুলে নিয়েছে। এগুলির কিছুর উপরে লেখা রয়েছে যে, এগুলি মার্কিন বন্ধু দেশগুলির সাথে শেয়ার করার জন্যে। আর অন্যগুলির উপরে লেখা রয়েছে যে, সেগুলি শুধুমাত্র মার্কিনীদের জন্যে। এর থেকে যে ব্যাপারটা বোঝা যায় তা হলো, ডকুমেন্টগুলি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই বের হয়েছে; অন্য কারুর কাছ থেকে নয়। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ডকুমেন্টের ছবিগুলির পাশে বিভিন্ন বস্তুও দেখা যাচ্ছে, যেগুলি থেকে হয়তো কে এই কাজটা করেছে, তাকে বের করা যেতে পারে। কিছু ডকুমেন্টে আবার কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে সেটা খুব সম্ভবতঃ ডকুমেন্টগুলি ফাঁস করার পরে করা হয়েছে। যেমন, ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো এবং ইউক্রেনের হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে পরে কেউ করেছে।

কিভাবে, কে বা কারা এগুলি করতে পারে

মার্কিন ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘বেলিংক্যাট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, মার্চের প্রথম দুই দিনে অনলাইনে ‘ডিসকর্ড’ নামের একটা গেমিং বিষয়ক চ্যাটরুমে কেউ একজন প্রায় ৩০টার মতো ডকুমেন্ট পোস্ট করে। এরপর কিছুদিনের মাঝে সেগুলি অন্যান্য সাইটেও চলে আসে। এরপর মাসখানেক পরে এগুলি ‘টেলিগ্রাম’, ‘ফোরচ্যান’ মেসেজ বোর্ড এবং ‘টুইটার’এ ছড়িয়ে পড়লে তা অনেকের সামনেই চলে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষেও সম্ভবতঃ ‘ডিসকর্ড’এ কিছু ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয়। ‘বেলিংক্যাট’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ‘ডিসকর্ড’এর কিছু ব্যাবহারকারী বলছেন যে, খুব সম্ভবতঃ গত ১৭ই জানুয়ারি আরেকটা সার্ভারে এগুলি শেয়ার করা হয়েছিল। ৭ই এপ্রিল এই ডকুমেন্টগুলির বেশ অনেকগুলি সোশাল মিডিয়াতে আসা শুরু হয়। ডকুমেন্টগুলি খুব সম্ভবতঃ সবচাইতে দেরিতে হলে মার্চ মাসে তৈরি করা হয়েছিল। তবে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত নয় তা হলো, এগুলি কি শুধুমাত্র একবারের ঘটনা নাকি ধারাবাহিক ঘটনার অংশ? অথবা যে ফাঁস করেছে, তার কাছে এগুলির বাইরেও কি আরও ডকুমেন্ট রয়েছে কিনা।

কে এই কাজটা করেছে এবং কেন, সেটা এখনও কেউ নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও এর পেছনে যে রাশিয়ার হাত নেই, সেব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত। লন্ডনের ‘ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি’র শিক্ষক ড্যান লোমাস ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’কে বলছেন যে, ডকুমেন্টগুলি একদিকে যেমন তথ্য সংগ্রহে মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের দক্ষতাকে তুলে ধরে, তেমনি তা রুশ ইন্টেলিজেন্স ‘এফএসবি’, ‘জিআরইউ’ এবং ‘এসভিআর’এর ভেতরে মার্কিনীদের ঢুকে পড়াকে তুলে ধরে। এমনিতেই ইউক্রেনে তাদের যুদ্ধটা ভালো যাচ্ছে না। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই কেউ এই কাজটা করেছে বলেই মনে হচ্ছে। নিজেদের ভেতরের শত্রুই প্রকৃতপক্ষে বড় শত্রু।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দক্ষিণ কোরিয় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়ুল। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধু হিসেবে পরিচিত মিশর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইস্রাইলের মতো দেশগুলি হয়তো তাদের রাষ্ট্রের তথ্য নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে চাইবে; যাতে করে এহেন ঘটনায় তাদের দেশের নাম আবারও না আসে। তবে এই দেশগুলি যেহেতু নিরাপত্তা এবং অস্ত্রের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল, সেকারণে এই দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সহসাই হুমকির মাঝে পড়বে, সেটা আশা করা যায় না। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ কিছুটা হলেও খর্ব হবে, তা নিশ্চিত।


এর ফলাফল কি হতে পারে

‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, তথ্য ফাঁসের পর থেকে পেন্টাগনে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের ডকুমেন্ট দেখার উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অনেকেই মনে করছেন যে, ঘটনাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে খুবই খারাপ হয়েছে; এমনকি হয়তো দশ বছর আগে এডওয়ার্ড স্নোডেনএর ফাঁস করা তথ্যের চাইতেও এগুলি আরও খারাপ ফলাফল বয়ে আনতে পারে। এর কারণ হলো, ডকুমেন্টগুলিতে একেবারে সর্বশেষ তথ্য রয়েছে। এর মাধ্যমে মার্কিনীরা কি পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করে অথবা কোন উৎস থেকে তারা তথ্য পেয়ে থাকে, সেগুলিও ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া এবং চীন সেক্ষেত্রে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। ডকুমেন্টগুলিতে ইউক্রেনের কিছু সামরিক দুর্বলতার কথা উল্লেখিত হয়েছে; যা মস্কোর কাছে অজানা থাকলে হয়তো রুশদের ব্যবহারযোগ্য হতে পারে। তবে ডকুমেন্টগুলির আরও একটা সংবেদনশীল দিক হলো এগুলিতে মার্কিন সিগনালস ইন্টেলিজেন্সের বিভিন্ন তথ্য রয়েছে; যেগুলি যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু এবং বন্ধু উভয় ধরণের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নজরদারির মাধ্যমে সংগৃহীত। এর ফলে অনেক দেশই হয়তো নিজেদের তথ্যের ব্যাপারে আরও সাবধানতা অবলম্বন করবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলির সাথে কূটনৈতিক দিক থেকে কিছু সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ‘পলিটিকো’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এরূপ গোপনীয় তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তথ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে যে, গোপনীয়তা রক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মাঝেই তথ্য শেয়ার করার সক্ষমতা রয়েছে কিনা।

কি ধরণের তথ্য ফাঁস হয়েছে

কেউই ডকুমেন্টগুলির সত্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি স্বীকার না করলেও পেন্টাগন একপ্রকার স্বীকারই করে নিয়েছে যে, ঘটনাটা আসলেই ঘটেছে। আর সকল বিশ্লেষকেরাই বলছেন যে, এগুলি যে সত্যি, তার কোন সন্দেহ নেই। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, গোপন দলিলাদির মাঝে বিশ্বের বিভিন্ন নেতার রুদ্ধদ্বার বৈঠকের উল্লেখ রয়েছে। এর মাধ্যমে অনেকেই ধারণা করে ফেলতে পারে যে, মার্কিনীরা কিভাবে বা কোথায় বা কার মাধ্যমে এই তথ্য জানতে পেরেছে। আবার রুশ ভাড়াটে সামরিক সংস্থা ইউক্রেনে যুদ্ধে করার জন্যে কোন একসময় ন্যাটোভুক্ত দেশ তুরস্ক থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমেও তথ্যের উৎস বের করে ফেলা সম্ভব হতে পারে। এছাড়াও এমন কিছু তথ্য এখানে এসেছে, যেগুলি এর আগে অপ্রকাশিত মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের দ্বারা সংগৃহীত। এগুলির সক্ষমতা, এমনকি এগুলি যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে, তা এর আগে কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। এখন রুশরা জানতে পারছে যে, কি ধরণের স্যাটেলাইট মার্কিনীরা রুশদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।

১। রাশিয়ার অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তৎপরতা

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ডকুমেন্টগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে এবং সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে নিজেদের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কথোপকথনের উপরে যেমন যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি করতে পারছে, তেমনি রুশ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘জিআরইউ’এর অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনাও মার্কিনীরা জানতে পারছে। এছাড়াও ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা এবং পরিকল্পনার ব্যাপারে কাজে লাগানোর মতো ইন্টেলিজেন্স পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; যার অনেকটাই মার্কিনীরা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনিয়দেরকে সরবরাহ করেছে।

মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসিএর সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি গোপনে রাশিয়াতে সরবরাহ করার জন্যে ৪০ হাজার আর্টিলারি রকেট প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ডকুমেন্টে বলা হয় যে, এল-সিসি বলে দিয়েছেন যাতে করে এই পরিকল্পনা পশ্চিমারা জানতে না পারে।


২। যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধু দেশগুলির নেতৃত্বের উপর গোয়েন্দাবৃত্তি করছে

‘সিএনএন’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, একটা ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিনীরা সিগনালস ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির মন্তব্য জানতে পেরেছে; যেখানে জেলেন্সকি বলছেন যে, রাশিয়ার অভ্যন্তরে রস্টোভে ড্রোন বিমানের মাধ্যমে রুশ লজিস্টিকস টার্গেটে হামলা করা যেতে পারে। কারণ ইউক্রেনের হাতে অত দূরে আঘাত করার মতো অস্ত্র নেই। যদিও এটা অবাক করা ব্যপার নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নেতৃত্বের উপরে নজরদারি করছে, তথাপি ইউক্রেনিয়রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে যে, মার্কিনীদের তথ্য ফাঁসের কারণে ইউক্রেনিয়দের বসন্তকালীন আক্রমণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে।

ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে যা এসেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা চিন্তিত ছিলেন যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে যে আর্টিলারি শেল সরবরাহ করছেন, তা হয়তো ইউক্রেনের হাতেই যাবে। এটা প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়ুলএর জন্যে খুবই সমস্যাজনক; কারণ এটা হবে কোরিয়ার দীর্ঘমেয়াদী নীতির বরখেলাপ। এই নীতি অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়া কোন যুদ্ধেক্ষেত্রে দুই পক্ষের কোন পক্ষকেই অস্ত্র সরবরাহ করে না। আর বেশিরভাগ ভোটারই এই নীতির পক্ষে। গত বছরের জুনে ‘গ্যালাপ কোরিয়া’র এক জরিপে বলা হয় যে, দেশটার ৭২ শতাংশ জনগণ ইউক্রেনকে শুধুমাত্র মেডিক্যাল, খাদ্য এবং অন্যান্য বেসামরিক সহায়তা দেয়ার পক্ষপাতি। অপরদিকে মাত্র ১৫ শতাংশ জনগণ সামরিক সহায়তা দেয়ার পক্ষপাতি। কোরিয়ার ‘ইয়োনহাপ’ সংবাদ সংস্থাকে দেশটার কর্মকর্তারা বলছেন যে, প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে প্রাথমিক তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে, খুব কমই সম্ভাবনা রয়েছে যে, মার্কিনীরা কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের কথোপকথন শুনতে পাবে। তারা বলছেন যে, এই তথ্য অসত্য এবং বিকৃত।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টের বিশ্লেষণে বলছে যে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি গোপনে রাশিয়াতে সরবরাহ করার জন্যে ৪০ হাজার আর্টিলারি রকেট প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ডকুমেন্টে বলা হয় যে, এল-সিসি বলে দিয়েছেন যাতে করে এই পরিকল্পনা পশ্চিমারা জানতে না পারে। মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আহমেদ আবু জেইদ বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধে মিশরের নিরপেক্ষ থাকার নীতি পরিবর্তিত হয়নি। আর পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন যে, এধরনের কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ তারা দেখেননি। এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধু দেশ মিশরের সাথে এই ঘটনার কারণে কোন কূটনৈতিক সমস্যা হবে কিনা।

৩। ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতা নিয়ে মার্কিনীদের সন্দেহ রয়েছে

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ফাঁস হওয়া ডকুমেন্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ইউক্রেনিয়দের বসন্তকালীন আক্রমণের পরিকল্পনার সফলতার ব্যাপারে মার্কিনীদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ এবং সৈন্যের স্বল্পতার কারণে আক্রমণে খুব বেশি একটা জায়গা রুশদের হাত থেকে পুনর্দখল করার সম্ভাবনা নেই। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনিয়দের প্রশিক্ষণ এবং গোলাবারুদের স্বল্পতা আক্রমণে তাদের ক্ষয়ক্ষতিকে অনেক বাড়িয়ে দেবে। 

যদিও এটা অবাক করা ব্যপার নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের নেতৃত্বের উপরে নজরদারি করছে, তথাপি ইউক্রেনিয়রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে যে, মার্কিনীদের তথ্য ফাঁসের কারণে ইউক্রেনিয়দের বসন্তকালীন আক্রমণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। যদি ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন কিছু দেখাতে না পারে, তাহলে সেটা এই তথ্য ফাঁসের ঘটনার কারণে হবে না। আর এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে বড় কোন বন্ধু ইউক্রেনের নেই; কাজেই তথ্য ফাঁসের ঘটনার পরেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের উপদেশ শুনতেই বাধ্য হবে।

৪। রুশ ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ তুরস্কের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে চেষ্টা করছে

ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে রুশ ভাড়াটে সামরিক সংস্থা ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ আফ্রিকার দেশ মালির মাধ্যমে তুরস্কের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে চেয়েছে বলে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে। মালির অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্ব এব্যাপারে রাজিও হয়েছে যে, তারা তুরস্কের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে তা ‘ওয়াগনার গ্রুপ’কে সরবরাহ করবে, যাতে তারা সেগুলি ইউক্রেনে ব্যবহার করতে পারে। যদি ব্যাপারটা সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, তুরস্ক গোপনে ইউক্রেন যুদ্ধের উভয় পক্ষেই অস্ত্র সরবরাহ করছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এব্যাপারে মন্তব্য করতে চায়নি।

৫। ব্রিটেন ও কানাডার ব্যাপারে মার্কিন তথ্য

গত বছর অক্টোবরে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে বলেছিলেন যে, ইউক্রেনের কাছাকাছি কৃষ্ণ সাগরের আকাশে একটা রুশ যুদ্ধবিমান একটা ব্রিটিশ ‘আরসি-১৩৫’ সামরিক গোয়েন্দা বিমানের প্রায় ১৫ ফুটের মাঝে চলে আসে। আর আরেকটা যুদ্ধবিমান থেকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছিল, যা রুশরা যান্ত্রিক ত্রুটি বলে আখ্যা দিয়েছিল। ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিনীরা ধারণা করছিল যে, রুশরা প্রায় ব্রিটিশ বিমানটাকে ভূপাতিত করে ফেলছিল। ব্রিটিশরা অবশ্য ব্যাপারটাকে এভাবে দেখতে চাইছে না।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, একটা ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে যে, ইউক্রেনে ন্যাটো দেশগুলির মোট ৯৭ জন স্পেশাল ফোর্সের সদস্য কাজ করছে; যাদের মাঝে ৫০ জনই ব্রিটিশ। এর তুলনায় মার্কিনী রয়েছে মাত্র ১৪ জন এবং ফরাসি মাত্র ১৫ জন। ব্রিটিশ সরকার এই তথ্য নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি; বরং ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আর ফরাসি সরকার অস্বীকার করেছে যে, তাদের কোন সেনা ইউক্রেনের মাটিতে রয়েছে।

আরেকটা ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে যে, এবছরের শুরুতে রুশ অনলাইন হ্যাকিং গ্রুপ ‘জারইয়া’ কানাডার একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস পাইপলাইন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় হ্যাকিং করে অবস্থান নিয়েছে। এই তথ্য হ্যাকাররা রুশ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘এফএসবি’র সাথে শেয়ার করেছে এবং ‘এফএসবি’র পক্ষ থেকে হ্যাকারদেরকে চুপচাপ থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়। কানাডিয়রা এই ব্যাপারটাকে অস্বীকার করেছে। ‘গ্লোব এন্ড মেইল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এখন পর্যন্ত এমন কোন ঘটনার খবর তারা নিশ্চিত করতে পারেনি।

৬। ইস্রাইলের গোয়ান্দা সংস্থার উপরে যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারি


ইস্রাইলের পত্রিকা ‘হারেতস’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, একটা ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে যে, পহেলা মার্চের ‘সিআইএ’এর এক ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণে সিগনালস ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, ইস্রাইলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’এর নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভকে সমর্থন দিয়েছে। এর মাঝে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। ইস্রাইলি কর্মকর্তারা ফাঁস হওয়া মার্কিন ডকুমেন্টকে পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করেছে। কোন কোন ইস্রাইলিরা বলছেন যে, মার্কিনীরা হয়তো প্রাক্তন মোসাদ নেতাদের খোলাচিঠিকেই গুরুত্ব দিয়ে তাদের বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছে।

৭। মধ্য আমেরিকাতে চীনারা সমুদ্রবন্দর চাইছে


‘মায়ামি হেরাল্ড’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, একটা ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখা যাচ্ছে যে, চীনারা মধ্য আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়ার ‘ব্লুফিল্ডস’এ একটা গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে চাইছে। মার্কিন বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, নিকারাগুয়া সরকার হয়তো অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বিনিময়ে চীনা নৌবাহিনীকে বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে।

৮। সার্বিয়া ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়ায় সম্মত

‘রয়টার্স’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ফাঁস হওয়া একটা ডকুমেন্টে সার্বিয়া ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে রাজি হয়েছে অথবা ইতোমধ্যেই অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ইউরোপের মাঝে সার্বিয়াকে রাশিয়ার কাছিকাছি বলেই মনে করা হয়। আর সার্বিয়া রাশিয়ার উপরে অবরোধ দিতে অস্বীকার করেছে। ডকুমেন্টে দেখা যায় যে, ২রা মার্চের একটা স্লাইডে দেখানো হচ্ছে যে, সার্বিয়া অস্ত্র দিতে রাজি বা ইতোমধ্যেই দিয়েছে। তবে তারা ইউক্রেনিয়দেরকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি নয়। সার্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্যাপারটা অস্বীকার করে বলেন যে, তার সরকার অবশ্যই ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে না; কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের কোন পক্ষকেই তার দেশ অস্ত্র দেবে না।

অপরদিকে ব্রিটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলি, যারা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোটের অংশ, তারা স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ঘর সামলাতে উপদেশ দেবে; যা কিনা ওয়াশিংটনের জন্যে অপমানজনক। বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজেদের তথ্য গোপন রাখতে পারছে না, এটা সত্যিই অবাক করার মতো। এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো আরও লোক যুক্তরাষ্ট্রের অতি গোপনীয় কাগজপত্র উন্মুক্ত করে দিতে চাইছে - এটা ছোট কোন বিষয় নয়; বরং তা রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার লক্ষণ।


যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা এটাকে কিভাবে দেখছে?

দক্ষিণ কোরিয়ার উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিম তায়ে-হিও সাংবাদিকদের বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র হলো এমন একটা দেশ, যাদের রয়েছে বিশ্বের সবচাইতে ভালো গোয়েন্দা সক্ষমতা। আর কোরিয়রা সর্বদাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সকল প্রকারের ইন্টেলিজেন্স শেয়ার করে থাকে। তিনি অস্বীকার করেন যে, এধরণের তথ্য ফাঁসের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে কোন প্রকারের ভাটা পড়তে পারে। মিশর এবং ইস্রাইলের পক্ষ থেকেও ফাঁস হওয়া তথ্যকে গুরুত্বহীন বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করা হয়েছে। কোরিয়া, মিশর বা ইস্রাইল ব্যাপারটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলেও কেউ কেউ ব্যাপারটাকে অনেক বড় বলেই চিন্তা করছেন। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল এনগাস ক্যাম্পবেল থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন যে, এপ্রকারের তথ্য ফাঁসের ঘটনা বন্ধুদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতায় আঘাত করতে পারে। এই তথ্য কিভাবে পত্রিকার প্রথম পাতায় চলে আসছে, সেই প্রশ্ন তুলে জেনারেল ক্যাম্পবেল বলছেন যে, এই প্রকারের তথ্য গোপন রাখার একটা জাতীয় নিরাপত্তার বাধ্যবাধকতা ছিল।

তথ্য ফাঁসের ঘটনায় ইউক্রেন যুদ্ধে বড় কোন পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। কারণ ঘটনা ঘটার আগে থেকেই উভয় পক্ষই যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন আক্রমণে যাবার মতো অবস্থায় ছিল না। যদি ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন কিছু দেখাতে না পারে, তাহলে সেটা এই তথ্য ফাঁসের ঘটনার কারণে হবে না। আর এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে বড় কোন বন্ধু ইউক্রেনের নেই; কাজেই তথ্য ফাঁসের ঘটনার পরেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের উপদেশ শুনতেই বাধ্য হবে। অপরদিকে রাশিয়া তার ইন্টেলিজেন্সের বিশাল ফুঁটোগুলো কিছুটা হলেও মেরামতের সুযোগ পাবে। তবে সেই সুযোগও অসীম নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধু হিসেবে পরিচিত মিশর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইস্রাইলের মতো দেশগুলি হয়তো তাদের রাষ্ট্রের তথ্য নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে চাইবে; যাতে করে এহেন ঘটনায় তাদের দেশের নাম আবারও না আসে। তবে এই দেশগুলি যেহেতু নিরাপত্তা এবং অস্ত্রের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল, সেকারণে এই দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সহসাই হুমকির মাঝে পড়বে, সেটা আশা করা যায় না। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজ কিছুটা হলেও খর্ব হবে, তা নিশ্চিত।

অপরদিকে ব্রিটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলি, যারা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোটের অংশ, তারা স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ঘর সামলাতে উপদেশ দেবে; যা কিনা ওয়াশিংটনের জন্যে অপমানজনক। বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজেদের তথ্য গোপন রাখতে পারছে না, এটা সত্যিই অবাক করার মতো। এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো আরও লোক যুক্তরাষ্ট্রের অতি গোপনীয় কাগজপত্র উন্মুক্ত করে দিতে চাইছে - এটা ছোট কোন বিষয় নয়; বরং তা রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার লক্ষণ। যে ব্যাপারটা সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা হলো, ঘটনাটা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও একধাপ কমতে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি আদর্শিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে থাকতো, তাহলে এরূপ ঘটনা খুব একটা ক্ষতিকর হতো না। ক্ষতি কতটা হয়েছে, সেটাও মার্কিনীরা পুরোপুরি বুঝতে পারছে কিনা, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র মতো। তাদের এক প্রতিবেদনে তারা এই ডকুমেন্টগুলির ছবি ঝাপসা করে দিয়ে প্রকাশ করেছে। যখন এটা পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গিয়েছে এবং পুরো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেছে, তখন এহেন প্রচেষ্টা হাস্যকরই বটে।

Monday, 10 April 2023

ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত… কেন?

১০ই এপ্রিল ২০২৩

ফিনল্যান্ডের শীর্ষ তিনজন রাজনীতিবিদ - সানা মারিন, পেটারি অরপো এবং রিক্কা পুররা। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্ব দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাক্তিগত জীবনে স্বাধীনচেতা হয়ে জনগণের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি করাটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যথেষ্ট নয়। আবার তা এও দেখিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা নারীবাদীদের মধ্যমণি হওয়ার জন্যে একজন নারীকে শুধুমাত্র জনপ্রিয় নেতা হলেই চলবে না, তাকে ব্যাক্তিগত জীবনেও স্বাধীনচেতা হতে হবে। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়েই রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নারীস্বাধীনতার এক অদ্ভুত মিশ্রণের উদাহরণ হয়েছে ফিনল্যান্ড; যার পিছনে নিঃসন্দেহে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

ন্যাটোতে ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের মধ্য-বামপন্থী ‘সোশাল ডেমোক্র্যাট’ দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে রক্ষণশীল ‘ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি’র নেতা পেটারি অরপো নির্বাচনে বিজয় পেয়েছেন। হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়াইয়ের ফলাফল শেষ পর্যন্ত আসে ফিনল্যান্ডের সবচাইতে বড় মিডিয়া ‘ওয়াইএলই’এর কাছ থেকে। পেটারি অরপোর দল ২০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ৪৮টা আসনের মালিক হয়েছে। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ৩৭টা আসন। এরপর রয়েছে ডানপন্থী ‘ফিনস পার্টি’, যারা ২০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৬টা আসনের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ৩৯টা আসন। আর সানা মারিনের মধ্য-বামপন্থী ‘সোশাল ডেমোক্র্যাট’রা পেয়েছে ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সানা মারিন তার দলের আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৪০ থেকে ৪৩এ নিলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। এর পিছনে বড় কারণ ছিল তার বামপন্থী কোয়ালিশনের তিন দল, ‘সেন্টার পার্টি’, ‘লেফট এলায়েন্স’ এবং ‘গ্রিন লীগ’; যারা সব মিলিয়ে ২০টা আসন হারিয়েছে। অপরদিকে ডানপন্থীরা তাদের আসন ১৮টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।

এবারের নির্বাচনে ডানপন্থী ‘ফিনস পার্টি’র জনপ্রিয়তা ছিল দেখার মতো। পার্টির নেতা ৪৫ বছর বয়সী রিক্কা পুররা অন্য যেকোন রাজনীতিকের চাইতে বেশি ভোট পেয়েছেন। তিনি ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। অনেকেই বলছেন যে, তার দলের বেশি ভোট এসেছে নবীন ভোটারদের কাছ থেকে। সোশাল মিডিয়া, বিশেষ করে ‘টিকটক’এ ডানপন্থী দলের প্রচার ছিল অনেক বেশি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ সরকার প্রধান হিসেবে সানা মারিন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। তার কোয়ালিশনে ছিল ৫টা দল; যাদের সকল নেতাই ছিল মহিলা। যেহেতু ফিনল্যান্ডের সকল দলই দেশটার ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকরণে একমত ছিল, সেকারণে পররাষ্ট্রনীতি দেশের নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং মূল আলোচ্য বিষয় ছিল অর্থনীতি এবং সরকারি ঋণ।

‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি মূলতঃ দেশটার প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণে। আর এই পদটাতে রয়েছেন দেশটার সবচাইতে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ সাউলি নিনিস্ত্রো। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে ন্যাটোর দিকে ধাবিত করার পিছনে নিনিস্ত্রোর ভূমিকাই ছিল সবচাইতে বেশি। ফিনল্যান্ডের বামপন্থীদের মাঝে একটা অংশ সেটা অপছন্দ করলেও প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই সেই নীতিকে অনুসরণ করেছে। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সানা মারিন তার দলের চাইতে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তবে এবারে পার্শ্ববর্তী সুইডেনের মতো ফিনল্যান্ডেও ডানপন্থীরা বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সানা মারিনের সরকারের সবচাইতে বড় সমালোচনা ছিল তার সরকারের ঋণের পরিমাণ। ফিনল্যান্ডের ঋণ এখন দেশটার জিডিপির ৭০ শতাংশ। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় তা খুব বেশি না হলেও ফিনল্যান্ডের অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল সংস্কৃতিতে এটা অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য। এর সাথে তুলনা করলে ব্রিটেনের সরকারি ঋণ প্রায় ৯৫ শতাংশ; আর ফ্রান্সে ২০২৩ সালের শেষে তা ১’শ ১৩ শতাংশ হতে চলেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মারিনের বিরোধীরা যেখানে সরকারের বাজেটকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছেন, সেখানে মারিন বাজেট সম্পর্কে কোন কথা না বলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম হবার মাঝেই আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সানা মারিনের ব্যক্তিগত জীবন মিডিয়াতে আলোচিত হয়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে পার্টিতে গিয়ে গান ও নৃত্য করার পাশাপাশি মদের গ্লাস হাতে তার ভিডিও সোশিলা মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়লে তার ব্যাপারে জনমত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিমা দেশগুলিতে অনেক স্বাধীনচেতা নারীরা সানা মারিনের পক্ষে কথা বললেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সানা মারিনের কার্যকলাপ ভিন্ন হওয়া উচিৎ ছিল কিনা, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। সানা মারিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ৫৩ বছর বয়সী পেটারি অরপো ১৯৯০এর দশক থেকে রাজনীতিতে রয়েছেন; আর সানা মারিনের মতো ‘রক স্টার’ ইমেজ নেই তার। যদি রক্ষণশীলরা একটা কোয়ালিশন গঠন করতে পারে, তবে অরপোই হবেন ফিনল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। সরকার গঠন করতে গেলে ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্টের ২’শ আসনের মাঝে ১’শর বেশি আসন প্রয়োজন। ফিনল্যান্ডের ‘ইউনিভার্সিটি অব টুরকু’র প্রফেসর ভেসা ভারেস ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, অরপো হয়তো রিক্কা পুররার ডানপন্থীদের সাথে কোয়ালিশন করতে চেষ্টা করবেন। তবে ডানপন্থীরা রাজনীতিতে খুবই অনভিজ্ঞ। একারণে সানা মারিনের ‘সোশাল ডেমোক্র্যাট’দের সাথে কোয়ালিশনের সম্ভাবনা যথেষ্ট। তবে সমস্যা হলো, সানা মারিন নিজেই তাদের দলের মাঝে বামপন্থী গ্রুপের একজন। তিনি রক্ষণশীলদের পছন্দ করেন না।

ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকাতে নারীবাদী সাংবাদিক জো উইলিয়ামসএর লেখা প্রকাশিত হবার পর ফিনিসরা অনেকেই লিখিতভাবে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। উইলিয়ামস তার লেখায় বলেন যে, ফিনল্যান্ডে নারী নেতৃত্বের প্রতি বিদ্বেষের কারণেই ডানপন্থীরা বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচনে জিতেছে। কারণ ফিনল্যান্ডে অনেকেই সানা মারিনের স্বাধীনচেতা ব্যাক্তিগত জীবনকে পছন্দ করেনি। এই লেখার জবাবে এক প্রতিবাদপত্রে আনা হোমেন বলছেন যে, সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া তিনজন রাজনীতিবিদই নারী - রিক্কা পুররা, সানা মারিন এবং ‘ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি’র এলিনা ভালটোনেন। মারিন তার ক্ষমতা হারিয়েছেন তার সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যয় নীতির কারণে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়তো একজন পুরুষই হবেন। কিন্তু তাদের সাথে অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো মহিলাই হবেন। আরেক প্রতিবাদপত্রে পল ফেয়ারচাইল্ড বলছেন যে, উইলিয়ামস এড়িয়ে গেছেন যে, ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্টে ৯টা দলের মাঝে ৭টারই নেতৃত্ব মহিলাদের হাতে। এর কারণ হলো, ফিনল্যান্ডের জনগণ তাদের নেতারা মহিলা কি পুরুষ, যেটা নিয়ে চিন্তিত নয়; বরং তাদের কথা এবং কাজ নিয়ে চিন্তিত। আর ফিনল্যান্ডের রাজনীতি হয় মধ্য-বাম বা মধ্য-ডানের মাঝেই সীমাবদ্ধ। তাই সানা মারিন হয়তো আবারও ক্ষমতায় যাবার কাছাকাছিই থাকবেন। ফিনল্যান্ডের জনগণ অনেকেই দেশের সরকারি ঋণের ব্যাপারে চিন্তিত। উইলিয়ামস তার লেখায় ডানপন্থীদের অর্থনৈতিক নীতিকে হাস্যকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। অথচ তিনি যেটা বুঝতে পারছেন না তা হলো, ফিনল্যান্ডে যা ডানপন্থী, ব্রিটেনে তা বামপন্থীদেরও অনেকের মাঝেই অনুপস্থিত। বিশেষ করে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যনীতি ব্রিটেনে কল্পনাই করা যাবে না। কাজেই ফিনিস রাজনীতি ১৯৩০এর দশকের ‘ফ্যাসিস্ট’দের দিকে চলে যাচ্ছে, এটা চিন্তা করাটা অনুচিত।

পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়াতে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের ব্যক্তিগত স্বাধীনচেতা ইমেজ যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, ততটা গুরুত্ব পায়নি তার সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। তার ব্যাক্তিগত স্বাধীনচেতা জীবনকে যতটা হাইলাইট করে আলোচনার জন্ম দেয়া হয়েছে, তার সিকিভাগ গুরুত্বও পায়নি তার রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা। ডানপন্থী দলগুলি সহ ফিনিস পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ নেতাই মহিলা হওয়া সত্ত্বেও সানা মারিনের ক্ষমতাচ্যুত হওয়াটা নারীবাদীরা মেনে নিতে পারেনি। আবার ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে কিছু পশ্চিমা মিডিয়াতে সানা মারিনের ‘বিশেষ ভূমিকা’কে হাইলাইট করা হলেও পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয় যে, ফিনল্যান্ডের পরররাষ্ট্রনীতিতে প্রেসিডেন্টের ভূমিকাই সর্বোচ্চ। একারণেই ফিনল্যান্ডের সকল রাজনৈতিক দলই প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছেন; শুধু সানা মারিনই নন। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্ব দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাক্তিগত জীবনে স্বাধীনচেতা হয়ে জনগণের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি করাটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যথেষ্ট নয়। আবার তা এও দেখিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা নারীবাদীদের মধ্যমণি হওয়ার জন্যে একজন নারীকে শুধুমাত্র জনপ্রিয় নেতা হলেই চলবে না, তাকে ব্যাক্তিগত জীবনেও স্বাধীনচেতা হতে হবে। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়েই রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নারীস্বাধীনতার এক অদ্ভুত মিশ্রণের উদাহরণ হয়েছে ফিনল্যান্ড; যার পিছনে নিঃসন্দেহে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

Saturday, 8 April 2023

ভারত কেন ভূটানকে নিয়ে চিন্তিত?

০৮ই এপ্রিল ২০২৩

দিল্লী, মে ২০১৯। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যখন বলা হচ্ছে যে, ভূটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে পড়াশোনা না করার ফলে ভূটানের উপরে ভারতের প্রভাব কমছে, তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং তার কাছের লোকদের কথাই বলা হয়েছে, যারা অনেকেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলায় কথা বলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ যে এখন ভারতের একার হাতে নেই, সেটা এখন পরিষ্কার।

এপ্রিলের শুরুতেই ভূটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভারত সফরে গিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাতের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বেশকিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়; যার মাঝে রয়েছে লাইন অব ক্রেডিটের মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা। ভূটানের সানকোস এবং পুনাতসাংছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আশ্বাস দেয়া হয়। ১৯৮০এর দশকে ভারতের ঋণে তৈরি ভূটানের ৩’শ ৩৬ মেগাওয়াটের ছুখা পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটাও ভারত সরকার চিন্তা করবে বলে বলা হয়। এছাড়াও ৬৪ মেগাওয়াটের বাসোছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ভারত বিদ্যুৎ আমদানিতে রাজি হয়েছে। ভারতের কোকরাঝর থেকে ভূটানের গেলেফু পর্যন্ত সাড়ে ৫৭ কিঃমিঃ দৈর্ঘ্যের রেললাইন নির্মাণ, দুই দেশের মাঝে সড়কপথের বাণিজ্যের জন্যে জয়গাঁওএ নতুন চেকপয়েন্ট নির্মাণ এবং তৃতীয় দেশের অতিথিদের জন্যে চেকপয়েন্ট নির্মাণ প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ভবিষ্যতে ভূটানকে মহাকাশ গবেষণা, শিক্ষা, ইন্টারনেট, ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাসও ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। এই প্রকল্পগুলিকে ভূটানের রাজার ‘ট্রান্সফর্ম ইনিশিয়েটিভ’এর অংশ হিসেবে বলা হচ্ছে।

ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, ভূটানে যখন যুবসমাজের মাঝে বেকারত্বের হার ২১ শতাংশে পৌঁছেছে, তখন ভারতের নিঃসন্দেহে সেখানে কিছু করার রয়েছে। একসময় ভূটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে শিক্ষা নিতো। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার কারণে ভূটানের নীতি নির্ধারণ এবং সরকারি সিদ্ধান্তের উপর ভারতের প্রভাব কমতে বসেছে। এক্ষেত্রে ভূটানে ভারত সরকারের নতুন প্রকল্পগুলি ভারতের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

কিন্তু ভূটান এবং ভারতের এতো কাছের সম্পর্কের মাঝেও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সাথে ভূটানের সীমান্ত নিয়ে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংএর মন্তব্য ভারতীয়দের বিচলিত করেছে। গত ২৫শে মার্চ বেলজিয়ামের মিডিয়া ‘লা লিব্রে বেলজিক’এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, তার সরকার শীঘ্রই চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করবে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ভূটানের ভেতর চীনা গ্রাম তৈরির ভারতীয় দাবির কোন ভিত্তি নেই। ভারতীয়রা চিন্তিত যে, চীনারা ভূটানের সাথে যখন সীমান্ত সমস্যা সমাধানের কথা বলছে, তার মাঝে তারা দোকলাম নিয়েও কথা বলছে। ২০১৭ সালে দোকলাম সীমান্তে ভারতের সাথে চীনের সামরিক দ্বন্দ্ব হয়েছিল। এই এলাকাটা তিন দেশের সীমান্তের সংযোগ এবং ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেন নেক’এর খুবই কাছে। এই করিডোরের মাধ্যমেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটা রাজ্যের সাথে ভারতের মূল ভূখন্ডের স্থলযোগাযোগ রক্ষা করা হয়। সরু এই ‘চিকেন নেক’এর উত্তরে ভূটান ও চীন এবং দক্ষিণে বাংলাদেশ।

ভারত সরকার বলছে যে, চীনারা দোকলামে তিন দেশের সীমান্তকে ‘বাটাং লা’ এলাকার ৭ কিঃমিঃ দক্ষিণে ‘মাউন্ট গিপমোচি’ নামক এলাকায় নিয়ে আসতে চায়। এতে পুরো দোকলাম মালভূমি আইনগতভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দোকলামের নিয়ন্ত্রণ চীনের কাছে চলে যাবার অর্থ হলো চীনারা ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেন নেক’এর আরও কাছে চলে আসবে।

যদিও ভূটানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, দোকলামের ব্যাপারে যেকোন সমঝোতাতে তিন দেশের স্বার্থকেই দেখা হবে, তথাপি ভারতীয়রা এব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেছেন যে, দোকলাম ইস্যু সমাধানে তিন দেশেরই ‘সমান অধিকার’ রয়েছে। ভারতীয় পত্রিকা ‘হিন্দুস্থান টাইমস’ বলছে যে, ভূটানের প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলি ভূটানের নীতির পরিবর্তন। কারণ এর আগে ভূটানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, তিন দেশের সীমান্তে সবারই যেকোন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ। ভারত সরকার বলছে যে, চীনারা দোকলামে তিন দেশের সীমান্তকে ‘বাটাং লা’ এলাকার ৭ কিঃমিঃ দক্ষিণে ‘মাউন্ট গিপমোচি’ নামক এলাকায় নিয়ে আসতে চায়। এতে পুরো দোকলাম মালভূমি আইনগতভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দিল্লী চীনের এই পরিকল্পনার ঘোর বিরোধী। ভারত বলছে যে, চীনারা বেআইনীভাবে দোকলাম দখল করে রেখেছে। দোকলামের নিয়ন্ত্রণ চীনের কাছে চলে যাবার অর্থ হলো চীনারা ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেন নেক’এর আরও কাছে চলে আসবে। তবে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী ‘দ্যা ভূটানিজ’ পত্রিকাকে বলেছেন যে, বেলজিয়ান পত্রিকায় তার মন্তব্য নতুন কিছু নয়। কারণ সীমান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ভূটানের নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ৪ঠা এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারতের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত যেকোন ব্যাপারেই ভারত খবর রাখে এবং প্রয়োজনমতো ভারত তার নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে যেকোন পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরও বলেন যে, ভূটানের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক নিরাপত্তা সহযোগিতা রয়েছে। একারণেই উভয় দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বদাই আলোচনা করে থাকে। তবে ভারতীয়দের মাঝে কেউ কেউ ভূটানের সাথে এগুনোর ক্ষেত্রে ধীরে চলার নীতিতে বিশ্বাসী। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে যে, ভারতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যদি ভূটানের উপর বেশি চাপ প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে ভূটান দিল্লীর হাত থেকে ছুটে যেতে পারে।

ভারতীয় কলামিস্ট এবং ‘বিবিসি’র সাবেক সাংবাদিক আদিল ব্রার ভারতের ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, সীমান্ত আলোচনা নিয়ে চীনারা ভূটানের উপর চাপ সৃষ্টি করছে; এবং সেটা বিভিন্ন চীনা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি চীনা বিশ্লেষকদের বক্তব্যগুলি তুলে ধরেন, যেখানে বলা হচ্ছে যে, ভূটানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির উপর ভারতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে ভূটানের অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতির উপর ভারতের আধিপত্য রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভূটানের প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি চীনের জন্যে বিজয় এবং ভারতের জন্যে পরাজয়। একইসাথে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে, চীনের সাথে ভূটানের সীমান্ত আলোচনায় ভারত চাইছে ভূটানের হয়ে চীনের সাথে কথা বলতে।

অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার দিক থেকে ভূটানের উপরে পুরোপুরি আধিপত্য থাকার পরেও ভূটানের ব্যাপারে ভারত চিন্তিত। আকারের দিক থেকে শক্তিশালী না হলেও ভূটান তার ভৌগোলিক অবস্থানকে ভূরাজনৈতিক দরকষাকষির মাঝে নিয়ে এসেছে। দোকলাম ইস্যুতে ভূটানের প্রধানমন্ত্রীর তিন দেশের ‘সমান অধিকার’এর পক্ষে বিবৃতি দিল্লীর চোখে ভারতের ‘চিকেন নেক’এর জন্যে প্রচ্ছন্ন হুমকির সৃষ্টি করেছে। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যখন বলা হচ্ছে যে, ভূটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে পড়াশোনা না করার ফলে ভূটানের উপরে ভারতের প্রভাব কমছে, তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং তার কাছের লোকদের কথাই বলা হয়েছে, যারা অনেকেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলায় কথা বলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ যে এখন ভারতের একার হাতে নেই, সেটা এখন পরিষ্কার।

Saturday, 1 April 2023

মস্কোতে শি জিনপিং… কে কি পেলো

০১লা এপ্রিল ২০২৩

মস্কোতে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শি জিনপিং। চীনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র হলো সবচাইতে বড় পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র তার কতটা সম্পদকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, আর কতটা সম্পদ চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, সেটাই বরং বেইজিংএর কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের ধোঁয়াশা বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমারাও নিশ্চিত করতে চাইছে যাতে করে আপাততঃ চীনাদের এই অবস্থানে কোন পরিবর্তন না আসে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর মস্কোতে দুই দিনের আলোচনা শেষে ২১শে মার্চ এক যৌথ বিবৃতিতে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে দায়িত্বপূর্ণ আলোচনার কথা বলা হয়। তবে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীনের শান্তি প্রস্তাবকে মূল স্তম্ভ ধরে নিয়ে আলোচনার কথা বললেও অভিযোগ করেন যে, ইউক্রেন এবং পশ্চিমারা সমস্যা সমাধানে ইচ্ছুক নয়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শি জিনপিং তার সফরে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনা প্রস্তাবের উপরেই সবচাইতে গুরুত্বারোপ করেছেন। যুদ্ধ বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ না দেখাতে পারলেও শি জিনপিং শান্তির দূত হিসেবে তার বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। একইসাথে তিনি একটা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন যে, দুই দেশের সহযোগিতায় চীন বড় ভাইয়ের ভূমিকা নিয়েছে; যেখানে রাশিয়ারই চীনকে বেশি প্রয়োজন। তবে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, চীন পশ্চিমা হুমকিকে উপেক্ষা করে রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। তথাপি পশ্চিমাদের সাথে চীনের যখন প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন চীনারা মস্কোকে দুর্বল দেখতে চায় না। অপরদিকে পুতিন খুব সম্ভবতঃ আলোচনার ফলাফল নিয়ে খুশিই থাকবেন; কেননা ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জ্বালানি বাণিজ্যসহ বহু ইস্যু নিয়ে দুই নেতার মাঝে আলোচনা হয়েছে। গত ১০ বছরে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়ে ১’শ ৯০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রাশিয়া চীনের কাছ থেকে কৃষি এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে সহায়তা পাবে; অন্যদিকে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে তেল ও গ্যাস পাবে। পশ্চিমা অবরোধের মাঝে এটা রাশিয়ার জন্যে একটা ‘লাইফলাইন’।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, আলোচনার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, পুতিন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে ব্যবহার করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। যদিও উভয় পক্ষই বলছে যে, দুই দেশের মাঝে এটা কোন রাজনৈতিক বা সামরিক জোট নয়, তথাপি তারা উভয়েই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে একমত পোষণ করছেন। তারা ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’, ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ এবং ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ‘ব্রিকস’এর আওতায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা ছাড়াও ন্যাটো এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝে ‘অকাস’ চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

‘রাশান একাডেমি অব সায়েন্সেস’এর চীন বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার লুকিন চীনা সরকারি মিডিয়া ‘সিজিটিএন’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, শি জিনপিংএর মস্কো সফর তেমন বড় কোন ঘটনা হতো না, যদি বিশ্বের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতো। নতুনভাবে ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকে শি জিনপিংএর এটা প্রথম রাশিয়া সফর; যার একটা প্রতীকি অর্থ রয়েছে। লুকিনের কথায়, রাশিয়া এবং চীনের একমত হবার মূল জায়গাটা হলো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা। শি জিনপিংএর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, পৃথিবীর একটা অংশ নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে থাকবে; আর বাকি অংশ নিরাপত্তার কিছুই পাবে না, সেটা অনুচিত। রাশিয়াও ঠিক এই ব্যাপারটার সাথেই একমত। কারণ রাশিয়াও বলে যাচ্ছে যে, ন্যাটো তার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে, যা কিনা রাশিয়া এবং চীনের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি করছে; এটা অন্যায়। অপরদিকে তাইওয়ানের ‘সুচাউ ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ভিক্টর গাও ‘সিজিটিএন’কে বলছেন যে, চীন এবং রাশিয়ার মাঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সফর ছিল এটা। এই সফরে দুই দেশের মাঝে সকল ক্ষেত্রে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। একইসাথে এই সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন ঘটনা যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্যে চীনের শান্তি প্রস্তাব। চীনের প্রস্তাবকে সন্মান জানিয়ে রাশিয়াও যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার পথকে প্রসারিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। ভিক্টর গাও বলছেন যে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই মুহুর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাব ব্যাতীত মানজাতির কাছে আর কোন শান্তি প্রস্তাব নেই। চীনের এই প্রস্তাব হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধের আরও বিস্তৃতি বা এর পরিসর পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত যাওয়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’ বলছে যে, শি জিনপিং পরিষ্কার করেছেন যে, তিনি কোন বিষয়গুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে বিশাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও চীনের দৃষ্টি এখন সেদিকে নয়। তাদের প্রাধান্য হলো বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের দিকে; যা গত ৭০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে চলছে। চীনারা অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি ছাড়াও তাদের কূটনৈতিক অবস্থানকে জানান দিচ্ছে; যার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে চীনের মধ্যস্ততার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্টিমসন সেন্টার’এর সিনিয়র ফেলো ইউন সুন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, পশ্চিমা অবরোধের যাঁতাকলে রাশিয়া কেন চীনকে পাশে চাইবে, সেটা খুবই পরিষ্কার। অপরদিকে ভূরাজনৈতিক কারণেই চীন রাশিয়াকে পাশে চায়। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে দুই দেশের লক্ষ্য একইরকম হওয়ার কারণে তার একত্রে হাঁটছে। তবে ইউরোপিয়রা যাতে এক্ষেত্রে মস্কোর সাথে চীনের সম্পর্কোন্নয়নকে খারাপ চোখে না দেখে, সেজন্য শি জিনপিং নিজেকে শান্তির দূত হিসেবেই বেশি উপস্থাপন করতে চাইছেন। সামনের দিনগুলিতে চীনারা হয়তো ইউক্রেনের সাথেও আলোচনায় বসতে পারে। এতে বিশ্ব চীনকে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্ততাকারী হিসেবে চিনবে। তবে ইউন সুন মনে করেন না যে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা বা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাটাই চীনের মূল উদ্দেশ্য। আর একটা সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারার মতো সক্ষমতাও চীনের নেই। চীনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র হলো সবচাইতে বড় পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র তার কতটা সম্পদকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, আর কতটা সম্পদ চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, সেটাই বরং বেইজিংএর কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের ধোঁয়াশা বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমারাও নিশ্চিত করতে চাইছে যাতে করে আপাততঃ চীনাদের এই অবস্থানে কোন পরিবর্তন না আসে।