Saturday, 15 March 2025

বাংলাদেশে রাজনীতির উপর আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব

১৬ই মার্চ ২০২৫

২০২৪এর জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে জেনারেশন জেড বা 'জেন-জি'এর নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে সরচাইতে বেশি আলোচনা হয়েছে। যেটা অস্বীকার করার উপায় নেই তা হলো, ২০২৪এর ০৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সেনাবাহিনীর অফিসারদের একটা বড় অংশ হলো তরুণ বা 'জেন-জি'।


২০২৪এর জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে ছাত্র-জনতার যে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে; এখনও হচ্ছে। এর মাঝে জেনারেশন জেড বা 'জেন-জি'এর নেতৃত্ব দেয়া নিয়ে সরচাইতে বেশি আলোচনা হয়েছে। মোটামুটিভাবে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১২ সালের মাঝে জন্মানো ব্যক্তিদেরকে এই জেনারেশনের মাঝে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে; আন্দোলনের সময় যাদের বয়স মোটামুটিভাবে ১২ থেকে ২৭ বছর ছিল। এখানে বেশিরভাগই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের মাঝে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এলিট শ্রেণীর সন্তানেরাও রয়েছে। কারখানা শ্রমিক, কৃষক এবং অন্যান্য পেশার জনগণের সরাসরি সমর্থন থাকলেও তারা এখানে নেতৃত্ব দেয়নি। যদিও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সদস্যদের মাঝে এই গ্রুপগুলি ছিল। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের গত দুই দশকের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন বেশ গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুতদের ক্ষমতা ধরে রাখতে না পারা এবং বিরোধীদের এই ব্যাপারটাকে ব্যবহার করতে পারাটা শেষ ফলাফলের পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। যেটা অস্বীকার করার উপায় নেই তা হলো, ২০২৪এর ০৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সেনাবাহিনীর অফিসারদের একটা বড় অংশ হলো তরুণ বা 'জেন-জি'।

প্রযুক্তি ও গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব

গত দুই দশকে বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এর মাঝে সম্ভবতঃ সবচাইতে বড় প্রভাব ফেলেছে প্রযুক্তির ব্যবহার। এটা অবশ্য শধু বাংলাদেশ নয়; সারা বিশ্বের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। ইতিহাসে কখনো একজন ব্যক্তি এত সহজে বাকি দুনিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারেনি। মাত্র তিন দশক আগেও যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফিক্সড লাইনের টেলিফোন। এরপর একসময় এর সাথে যুক্ত হয় অতি উচ্চ খরচের মোবাইল ফোন। ১৯৯০এর দশকে এবং ২০০০এর পরেও ইন্টারনেটে ঢোকার পদ্ধতি ছিল ডায়াল-আপ কানেকশন। খুবই মন্থর গতি এবং অতিরিক্ত খরচের এই মাধ্যম ব্যবহার করে খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারতো। আর বলাই বাহুল্য যে, তখন ইন্টারনেট ছিল কম্পিউটারের মাধ্যমে। খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষের কাছেই ছিল কম্পিউটার। বাকিরা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। এই পুরো ব্যাপারটার মাঝে আমূল পরিবর্তন আসে ২০১২-১৩ সালের দিকে মোবাইল ফোনে থ্রি-জি সেবা চালুর পর থেকে। ফোর-জি সেবা শুরু হয় ২০১৮ সালে। ইন্টারনেটের খরচ নিয়ে মানুষের অভিযোগ থাকলেও মোবাইল ফোনে হাই-স্পীড ইন্টারনেট আসার সাথেসাথে স্মার্ট মোবাইল হ্যান্ডসেটও মানুষের নাগালের মাঝে চলে আসে। বিশেষ করে ২০১৭এর পর থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট যখন বাংলাদেশেই সংযোজিত হওয়া শুরু করলো, তখন হ্যান্ডসেটের মূল্য আরও কমে যায়। চীন থেকে আমদানি করা হ্যান্ডসেটগুলিও মানুষের পক্ষে কেনা সহজতর হয়ে যায়। কোটি কোটি মানুষ অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মাঝে হঠাৎ করেই ইন্টারনেট সার্ভিসের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এটা ছিল একটা বিশাল বিবর্তন।

এক যুগ আগে যখন থ্রি-জি সেবা মোবাইল অপারেটররা শুরু করেছিল, তখন এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে চালু করার পিছনে বেশি আগ্রহী ছিল চীনা হার্ডওয়্যার কোম্পানিগুলি - বিশেষ করে হুয়াই। চীনারা তাদের হার্ডওয়্যার মার্কেটিংএই বেশি আগ্রহী ছিল বলে তারাই থ্রি-জির পেছনে বেশি প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিল। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অপারেটররা প্রথমদিকে দোটানার মাঝে ছিল যে, এত বেশি খরচের একটা নেটওয়ার্কের মাঝে বিনিয়োগ করে ফেলার পর জনগণ কি এই প্রযুক্তির জন্যে খরচ করতে ইচ্ছুক কিনা। এই ব্যাপারটা পরিবর্তিত হতে থাকে সোশাল মিডিয়ার উত্থানের পর থেকে। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সোশাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলেও সেটা স্বল্প সংখ্যক কিছু উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। গত এক দশকের মাঝে এই ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় ফেইসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকএর উত্থানের মাধ্যমে। এই সার্ভিসগুলি মানুষকে ইন্টারনেটের পেছনে খরচ করার একটা কারণ দেয়। একইসাথে সারা দেশে ছড়িয়ে যেতে থাকে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সংযোগ; যার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ আরও বেশি মানুষের নাগালের মাঝে চলে আসে। ইন্টারনেট এবং সোশাল মিডিয়া শুধুমাত্র উচ্চ শিক্ষিতদের জন্যে আর থাকলো না। গত দুই দশকের মাঝে যে মানুষগুলি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে, তারা প্রায় সকলেই মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট এবং সোশাল মিডিয়ার ব্যবহারকারী। অর্থাৎ যাদের বয়স এখন মোটামুটিভাবে ১২ থেকে ৪০ বছর। এই গ্রুপটা ২০২৪এর জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে সিংহভাগ ভূমিকা রেখেছে। এর মাঝে কেউ হয়তো বেশি জড়িত ছিল; কেউ হয়তো কম।
 
শিক্ষিতদের জন্যে অনেক নতুন নতুন কাজের জন্ম হয়েছে। উবার, পাঠাও মোটরসাইকেল চালক এরকম একটা কাজ। ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার বা রিক্সা চালানোতে কিছু হলেও শিক্ষা প্রয়োজন। জনগণের একটা বিশাল সংখ্যা ইন্টারনেটে যুক্ত হবার জন্যে যথেষ্ট আয় যোগাড় করেছে। অথবা যথেষ্ট আয় না থাকলেও সামাজিক চাপের মাঝে পড়ে স্মার্টফোন যোগাড় করেছে।


অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান

এখানে অর্থনীতির একটা ব্যাপার রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দুই দশকে ব্যাপক পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে গিয়েছে। শিক্ষিতদের জন্যে অনেক নতুন নতুন কাজের জন্ম হয়েছে। উবার, পাঠাও মোটরসাইকেল চালক এরকম একটা কাজ। ইলেকট্রিক থ্রি-হুইলার বা রিক্সা চালানোতে কিছু হলেও শিক্ষা প্রয়োজন। প্যাডেল রিক্সা চালাতে শিক্ষিত যুবকরা কখনও আসেনি। কম্পিউটার পরিচালনা, মোবাইল ফোনের কারিগর, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যের কারিগর, বিভিন্ন মেশিনের অপারেটর, ইত্যাদি পেশা শিক্ষিত সমাজ থেকে অনেককেই টেনে নিয়েছে। করোনা লকডাউনের পর অনেকেই তাদের সর্বস্ব হারিয়ে নতুন কাজ খুঁজেছে। অনলাইন সার্ভিসের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে করোনার কারণে। সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে অনেকেই নতুন ব্যবসা খুঁজে নেবার চেষ্টা করেছে। যারা অনলাইনে খুব বেশি সময় ব্যয় করতো না, তারাও অনেকে করোনার পর অনলাইন এডিকশনের মাঝে পড়ে গেছে। এদের মাঝে ৫০-৬০ বছরের অধিক বয়সের মানুষও রয়েছে। কেউ কেউ আবার সোশাল মিডিয়া থেকেই আয়ের উৎস খুঁজে নিয়েছে। জনগণের একটা বিশাল সংখ্যা ইন্টারনেটে যুক্ত হবার জন্যে যথেষ্ট আয় যোগাড় করেছে। অথবা যথেষ্ট আয় না থাকলেও সামাজিক চাপের মাঝে পড়ে স্মার্টফোন যোগাড় করেছে। পঞ্চগড়ের কিছু পাথর শ্রমিক মোটরসাইকেলে চেপে কাজে যায় – এই ব্যাপারটা অনেকের কাছেই অবাক করার মতো হতে পারে। তবে এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের সর্বত্র নয়।

সিলেট ও সুনামগঞ্জের সীমানার কাছের অঞ্চলগুলিতে পাথর, বালু ও কয়লার ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়েছে লাখো মানুষ। এদের বেশিরভাগেরই আয় আহামরি কিছু নয়। অথবা ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকায় গার্মেন্টস শিল্পের উপর ভিত্তি করে যে কোটিখানেক মানুষ কর্মসংস্থান পেয়েছে, তাদেরও আয়ের তুলনায় বাড়িভাড়া বেশি। রিয়েল এস্টেট শিল্পে জড়িত লাখো মানুষ এবং ঢাকা, বগুড়া, যশোর, সৈয়দপুরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সাথে যুক্ত লাখো মানুষও কোনমতে তাদের জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। কিছু অঞ্চলে কর্মসংস্থানের প্রসারের কারণে মানুষের আয় বেশি; অন্যক্ষেত্রে কম। রাষ্ট্র তাদের জন্যে তেমন কিছু না করলেও জনগণ তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করে নেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এদের মাঝে বেশিরভাগেরই স্থায়ী কর্মসংস্থান নেই। তারা বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করেছে; একেক সিজনে একেক কাজ। কৃষির সাথেই বেশিরভাগ মানুষ জড়িত। তাই কখনও তাদের হাতে টাকা থাকে; কখনও কিছুই থাকে না। হাওড় অঞ্চল প্রাকৃতিক কারণেই একফসলি এলাকা। সেখানে এখনও সিজন-ভেদে কর্মসংস্থানের সমস্যা রয়ে গেছে। পুরো বরিশাল অঞ্চলে তেমন কোন ইন্ডাস্ট্রি নেই। গ্রেটার সিলেটেও মোটামুটিভাবে একই। তবে দারিদ্রপীড়িত এবং বঞ্চিত এই মানবগোষ্ঠী ২০২৪এর জুলাই-অগাস্টে মূল শক্তি যোগায়নি। কৃষক এবং কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল না; যদিও রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলনের অংশ হিসেবে এদের মাঝ থেকেই অনেকে রাস্তায় ছিল। অনেকে হতাহতও হয়েছে।
 
ফেনী শহর। গত দুই দশকে কয়েক কোটি মানুষ বিদেশে চাকুরির মাধ্যমে তাদের পরিবারকে অর্থায়ন করেছে; যার মাধ্যমে তারা হয় তাদের গ্রামের বাড়িতে পাকা দালান নির্মাণ করেছে; অথবা গ্রামাঞ্চল থেকে মাইগ্রেট করে কাছাকাছি শহরে চলে এসেছে। এই শহরগুলিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো টাকার উপর ভিত্তি করে হাউজিং প্রকল্প হয়েছে এবং ১০-১২ তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। শহরগুলিতে মাইগ্রেট করা এই পরিবারগুলিকে সার্ভিস দেয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ক্যাডেট স্কুল ও কলেজ, ইসলামিক স্কুল ও মাদ্রাসা। বহু হাসপাতাল এবং ক্লিনিক তৈরি হয়েছে এই শহরগুলিতে।


বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রভাব

মানুষের আয়ের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়াতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে। বিদেশ যাবার জন্যে অনেকেই নিজেদের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থের উপর ভিত্তি করে তারা অনেক নতুন সার্ভিসের ক্রেতা হয়েছে। গত দুই দশকে কয়েক কোটি মানুষ বিদেশে চাকুরির মাধ্যমে তাদের পরিবারকে অর্থায়ন করেছে; যার মাধ্যমে তারা হয় তাদের গ্রামের বাড়িতে পাকা দালান নির্মাণ করেছে; অথবা গ্রামাঞ্চল থেকে মাইগ্রেট করে কাছাকাছি শহরে চলে এসেছে। এই শহরগুলিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো টাকার উপর ভিত্তি করে হাউজিং প্রকল্প হয়েছে এবং ১০-১২ তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। শহরগুলিতে মাইগ্রেট করা এই পরিবারগুলিকে সার্ভিস দেয়ার জন্যে তৈরি হয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ক্যাডেট স্কুল ও কলেজ, ইসলামিক স্কুল ও মাদ্রাসা। বহু হাসপাতাল এবং ক্লিনিক তৈরি হয়েছে এই শহরগুলিতে; সবই বেসরকারি পর্যায়ে। বিদেশে চাকুরির এই ব্যাপারটা মূলতঃ যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ের কাহিনী। যমুনার পশ্চিমে বেশিরভাগ মানুষই বিদেশে যায়নি।

ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালি, নরসিংদী, ইত্যাদি অনেক অঞ্চলের উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। গ্রেটার সিলেটের ব্যাপারটা আলাদা; কারণ সেখানকার মানুষ মূলতঃ গিয়েছে ব্রিটেনে। এবং তারা অনেকেই আর দেশে ফেরত আসেনি; সেখানকার সিটিজেনশিপের দিকে অগ্রসর হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যারা গিয়েছে, তারা কেউই সেখানকার সিটিজেনশিপ পায়নি। তাই কোন না কোন একসময় ফেরত আসা নিশ্চিত। যারা দেশে ফেরত এসেছে, তাদের অনেকেই বিভিন্ন কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে। কেউ কেউ নতুন প্রযুক্তি, জ্ঞান বা কর্মপদ্ধতি এনে এই দেশে ব্যবসা শুরু করেছে। একসময় বিদেশে যাওয়া এই পরিবারগুলির বেশিরভাগই ছিল কৃষিকাজ-ভিত্তিক। তারা আজকে অনেকেই কৃষিকাজ থেকে সরে এসেছে। অনেকেরই আবাদি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে অনাবাদি জমির মাঝখানে টাইলস-খচিত মাল্টি-স্টোরি দালান বেশ চোখে পড়বে।
 
যমুনার পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের মাঝে মেয়েদের হিযাব পড়ার হারে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। পূর্বাঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুধু অর্থই আসেনি; হিযাব পড়ার ধারণাটাও প্রভাবিত হয়েছে। যারা বিদেশে কাজ করেছে, তাদের অনেকেই শিক্ষার দিক থেকে তেমন এগুতে পারেনি। তবে তাদের অর্থায়নে তাদের সন্তানরা কিন্তু দামি স্কুলে পড়েছে। অনেকেই পড়েছে ইসলামিক স্কুল বা মাদ্রাসায়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইসলামিক স্কুল, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল এবং মাদ্রাসার চাহিদা তৈরি হয়েছে মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকার উপর ভর করেই। 


পূর্বাঞ্চল-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ও পার্থক্য

তথাপি সারা দেশের খাদ্যের বড় অংশের যোগান দেয়া দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের চেহারা যথেষ্টই আলাদা। এখানকার বাড়িভাড়ার সাথে যমুনার পূর্বাঞ্চলের বাড়িভাড়ার তুলনা করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যমুনার পূর্বাঞ্চলে বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা এপার্টমেন্টগুলি অনেক বেশি ভাড়া হাঁকাচ্ছে। অপরদিকে যমুনার পশ্চিমাঞ্চলের এপার্টমেন্টগুলি তৈরি করা হচ্ছে মাইগ্রেট করা চাকুরিজীবিদের জন্যে; যারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাজ নিয়ে সেই অঞ্চলে গিয়েছে। পূর্বাঞ্চলের গ্রামগুলির বেশিরভাগ বাড়িই পাকা হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে এখনও কাঁচা বাড়ি বেশ ভালোই চোখে পড়বে। বিশেষ করে সৈয়দপুর থেকে নিলফামারী হয়ে উত্তর দিকে চলতে শুরু করলেই প্রায় সকল বাড়িই কাঁচা দেখা যাবে। রংপুর, সৈয়দপুর, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর, ঈশ্বরদী, পাবনা, রাজশাহীর মত শহরগুলি দেখে অবশ্য গ্রামাঞ্চলের ধারণা পাওয়া যাবে না। গ্রামাঞ্চলগুলিতে দরিদ্র পরিবারগুলির মাঝে এনজিওর প্রভাব অনেক বেশি দেখা যাবে। পশ্চিমা অর্থায়নে চলা এসকল কর্মকান্ডে নারীস্বাধীনতার বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দেয়া হয় বিধায় এই অঞ্চলে মেয়েদের সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালানো চোখে পড়বে।

তবে যমুনার পূর্বাঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্যের একটা প্রভাব দেখা যাবে জনগণের মাঝে। দারিদ্র্য কম হবার কারণে এই পরিবারগুলির উপর এনজিওর প্রভাব অন্ততঃ পশ্চিমাঞ্চলের মতো নয়। যমুনার পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের মাঝে মেয়েদের হিযাব পড়ার হারে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। পূর্বাঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুধু অর্থই আসেনি; হিযাব পড়ার ধারণাটাও প্রভাবিত হয়েছে। যারা বিদেশে কাজ করেছে, তাদের অনেকেই শিক্ষার দিক থেকে তেমন এগুতে পারেনি। তবে তাদের অর্থায়নে তাদের সন্তানরা কিন্তু দামি স্কুলে পড়েছে। অনেকেই পড়েছে ইসলামিক স্কুল বা মাদ্রাসায়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইসলামিক স্কুল, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল এবং মাদ্রাসার চাহিদা তৈরি হয়েছে মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকার উপর ভর করেই। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ তাদের আগের জেনারেশনের চাইতে অনেকটাই বেশি। একারণে এদের মাঝে আলেম সমাজের প্রভাবটাও অপেক্ষাকৃত বেশি। গত কয়েক বছরের মাঝে অনলাইনে ইসলামিক বক্তাদের সংখ্যাও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশিরভাগ আলেমরাই এখন একটা ইউটিউব চ্যানেল রাখছেন। বাংলাদেশ থেকে অনেক আলেমদেরকে বিভিন্ন দেশেও পাঠানো হয়েছে। যেমন, কয়েক বছর আগে শ্রীলংকাতে অমুসলিমদের উপর হামলার পর সেই দেশ থেকে অনেক বাংলাদেশি আলেমদেরকে বের করে দেয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে দুই দেশের কথাবার্তার মাঝে তা মিটমাট করা হয়।
 
২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলা তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' প্রকৃতপক্ষে ইসলামকেই টার্গেট করা হয়েছে - এই ব্যাপারটা এখন সকলেই অনুধাবন করেন। এই অনুধাবন এসেছে ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে। ইতোমধ্যেই যখন এদেশের জনগণের একটা বড় অংশ ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে, তখন এই ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলি বিভিন্ন ন্যারেটিভের মাধ্যমে তাদের ফলোয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।


সমাজে ইসলামিক কনসেপ্টের পরিবর্তন

গত দুই দশকে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি ছিল দেখার মতো। ১৯৮০-৯০এর দশকেও মানুষ "শষ্যের চেয়ে টুপি বেশি; ধর্মের আগাছা বেশি"-টাইপের লেখা পাঠ্যবইতে পড়েছে এবং মুখস্ত করে পরীক্ষায় লিখে নম্বর পেয়েছে। এই সময়ে পড়াশোনা করা দেশের উচ্চশিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষই এধরণের ইসলাম-বিদ্বেষী কনসেপ্টগুলি পেয়েছে। তবে ২০০০ সালের পর থেকে দেশে যেসকল নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, সেগুলির বেশিরভাগই ছিল টেকনিক্যাল জ্ঞান-ভিত্তিক; যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল এবং আইটি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। এই বিষয়গুলির মাঝে সামাজিক কনসেপ্টগুলি ততটা শক্তভাবে যায়নি; যতটা গিয়েছিল ১৯৮০-৯০এর দশকে। একারণে সেই সময়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চিন্তার সাথে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রাপ্তদের চিন্তার একটা বড় পার্থক্য দৃশ্যমান। তথাপি শিক্ষার বাইরেও যে ব্যাপারগুলি সমাজের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে, তার মাঝে ছিল গল্প-সাহিত্যের বই, টেলিভিশন মিডিয়ায় নাটক-বিজ্ঞাপণ এবং ইন্টারনেট। এখানে উল্লেখযোগ্য একটা পরিবর্তন দেখা যায় জনগণের বই পড়ার হার কমে যাওয়া এবং টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা কমে যাবার মাঝে। মানুষের এই সময়টাকে প্রতিস্থাপিত করেছে ইন্টারনেট এবং সোশাল মিডিয়া। এতকাল মানুষ কি কি কনসেপ্ট পাবে, সেটা নির্ধারণ করতো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই ঠিক করতো পাঠ্যবইতে কি কি কনসেপ্ট দেয়া হবে, কি ধরণের গল্পের বই বাজারে পাওয়া যাবে এবং টেলিভিশনে কি কি নাটক-সিনেমা-বিজ্ঞাপণ দেখানো হবে। এখনও সেটা চলে আসছে। এখনও দেশের সাহিত্য এবং সোশাল সাইন্সের বেশিরভাগ শিক্ষকই ইসলাম-বিদ্বেষী কনসেপ্ট ধারণ করে থাকেন। কিন্তু টেকনিক্যাল বিষয়গুলিতে পড়াশোনা করা ছাত্রদের উপর এই শিক্ষকদের প্রভাব ততটা নয়। আর অনেকেই ইন্টারনেটের প্রভাবে রাষ্ট্র ইসলাম সম্পর্কে যেসকল ধারণা দিয়েছে, তার বাইরেও ধারণা পেয়েছে। একারণে গত দুই দশকে শিক্ষা নেয়া বেশিরভাগ জনগণের মাঝে ইসলামের ব্যাপারে ধারণা ১৯৮০-৯০এর মাঝে পড়াশোনা করা ব্যক্তিদের চাইতে অনেকটাই ভিন্ন। ইসলাম বিদ্বেষী-কনসেপ্ট শক্তভাবে না পাবার কারণেই তারা ইসলামের ব্যাপারে অনেক আলোচনাই শুনতে ইচ্ছুক; যে ব্যাপারটা ১৯৮০-৯০এর দশকে একেবারেই দেখা যায়নি। এমনি ২০০০ থেকে ২০১০এর মাঝেও তেমনটা ছিল না।

মোটামুটিভাবে ২০১০এর পর থেকে ইসলামের ব্যাপারে আলোচনা বেশ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখানে ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে এই মিডিয়াগুলিতে কি প্রকারের কনটেন্ট পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও চিন্তা করার মতো। কারণ কনটেন্টগুলি তো কোন যন্ত্র তৈরি করেনি; মানুষই তৈরি করেছে। ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলা তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' প্রকৃতপক্ষে ইসলামকেই টার্গেট করা হয়েছে - এই ব্যাপারটা এখন সকলেই অনুধাবন করেন। এই অনুধাবন এসেছে ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে। ইতোমধ্যেই যখন এদেশের জনগণের একটা বড় অংশ ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে, তখন এই ব্যক্তি এবং সংগঠনগুলি বিভিন্ন ন্যারেটিভের মাধ্যমে তাদের ফলোয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। তবে এখানে কিছু সংগঠনের প্রভাব ছিল বাকিদের চাইতে অনেক বেশি। এদের মাঝে হিযবুত তাহরীর বা এইচটি এবং বিভিন্ন সালাফিস্ট ও জিহাদি গ্রুপগুলি রয়েছে। বাকিরা এই গ্রুপগুলির কর্মকান্ডের 'রিয়্যাকশন' হিসেবে নিজেদের ন্যারেটিভকে সাজাবার চেষ্টা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে এই দেশে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই; কিন্তু কনসেপ্টের ব্যাপারে এই গ্রুপগুলি অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছে। এই গ্রুপগুলির প্রভাবে ইসলামের ভিন্ন ন্যারেটিভের আবির্ভাব ঘটেছে সমাজে। যেমন, একটা সময়ে সমাজ-স্বীকৃত আলেমরা যা বলতেন, সেটাই সকলে মেনে নিতো। এখন প্রশ্ন করার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এইচটি-র কার্যকলাপ শুরুর পর থেকে জনগণের মাঝে ইসলামের ব্যাপারে প্রশ্ন বেড়ে গেছে। আগে একজন আলেম কথা বললে, কেউ রেফারেন্স জিজ্ঞেস করতো না; এখন প্রশ্ন করে যে, এর পিছনে আয়াত এবং হাদিস রয়েছে কিনা; অথবা এটা কোন একজন আলেমের নিজস্ব মতামত কিনা। একসময় পাঠ্য বইতেও কিছু জিনিস ঢোকানো হয়েছিল হাদিসের নাম করে। সামাজিক চাপের মুখে পাঠ্যবইতে পরিবর্তন এনে সেগুলির পাশ থেকে হাদিস শব্দটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একসময় কোন আলেমই সমাজে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের কথা বলতো না। কিন্তু এখন জনগণের চাপে আলেমরা অনেকেই শরীয়াহ আইনের পক্ষে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। আবার আলেমরা একসময় কেউই খিলাফতের কথা বলতো না। কিন্তু এখন অনেকেই খিলাফতের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। এর পেছনে অবশ্য বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের উপর অত্যাচার যথেষ্টই দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র মাঝে মুসলিমরা যতই নির্যাতিত হয়েছে, মুসলিমদের ঢাল হিসেবে খিলাফতের দাবি ততটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে। হাসিনা সরকার খিলাফতের এই দাবিকে গলা টিপে হত্যা করতে গিয়ে সফল তো হয়ই নাই, বরং এই দাবিকে আরও শক্তিশালী করেছে এবং এই দাবি বাস্তবায়নের একটা কারণ হিসেবে নিজেদের জুলুমকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিগত সরকারের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় এই দেশে একদিকে যেমন বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তৈরি করা হয়েছে, তেমনি মসজিদ-মাদ্রাসায় কি ধরণের কথা বলা হবে, তার উপরে দেয়া হয়েছে নির্দেশিকা। একইসাথে আলেমদের উপর চলেছে ব্যাপক দমন-পীড়ন। ইসলামের কথা বলা হয়ে গিয়েছিল অপরাধ; এমনকি টুপি-দাড়িওয়ালা মানুষই টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মুসলিমদের উপর এতটাই দমন-পীড়ন চালিয়েছিল যে, একসময় এই সরকার কোন ভাবেই প্রমাণ করতে পারছিলো না যে, তারা ইসলাম-বিদ্বেষী নয়। পশ্চিমা দেশসহ বাংলাদেশে রাসূল (সাঃ) এবং কুরআন অবমাননার প্রতিবাদে মুসলিমরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইস্রাইলি গণহত্যার প্রতিবাদেও মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। অপরদিকে হাসিনা সরকার বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ইস্রাইলে যাবার নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে ফেলে। আর অনেক ক্ষেত্রেই ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বাধা দেয়। হাসিনা সরকার জাতিসংঘের প্রেসক্রিপশন অনুসারে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে রংধনু নামে এলজিবিটি বা সমকামীদের প্রমোট করেছে। বাইডেন প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এলজিবিটি প্রমোট করার জন্যে বাংলাদেশে অর্থও ঢেলেছে। হাসিনা সরকার এগুলি করতে দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিমদের চরম আঘাত করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একটা বড় কারণ ছিল নিজেদের ইসলাম-বিদ্বেষী তকমাটাকে মুছে ফেলতে না পারা। আওয়ামী বিরোধীরা বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে ২০২৪এর জুলাই-অগাস্টে এই ব্যাপারটাকেই কাজে লাগিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে সফলও হয়েছে। অন্ততঃ ইসলামপন্থীদেরকে রাস্তায় নামাতে না পারলে এই আন্দোলন সফল করাটা কঠিন ছিলো।
 
বাংলাদেশের মানুষ সর্বদাই ভারত-বিদ্বেষী। ভারতকে বাংলাদেশের জনগণ দেখে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা রাষ্ট্র হিসেবে; যেখানে নিয়মিতই মুসলিমদের উপর দমন-পীড়ন হয়। হিন্দুত্ববাদী সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকে এই ন্যারেটিভের পালে আরও শক্তিশালী হাওয়া লেগেছে। এমনকি ২০২৪এর জুলাই-অগাস্টে এই ন্যারেটিভ আওয়ামীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। দিল্লীর চিন্তাবিদেরা বুঝতে পারছে না যে, ভারত যখনই ঢাকায় আসীন নেতৃত্বের সাথে সখ্যতা তৈরি করবে, তখনই সেই নেতৃত্ব জনগণের আক্বীদার শত্রুতে পরিণত হবে। শুধুমাত্র সেকুলার চিন্তার মাঝে থেকে কারুর পক্ষে এই বাস্তবতা অনুধাবন সম্ভব নয়।


বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং জনগণের মতামত

২০১৪ সালে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতা নেবার পর থেকে বাংলাদেশে সামাজিকভাবে ইসলামের প্রভাব আরও বাড়তে থাকে। ভারতে মুসলিমদের উপর অত্যাচার ও দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বাংলাদেশে নিয়মিতভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সরকারের এক্ষেত্রে কিছু বলার ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার নীরব ভূমিকা পালন করেছে। কারণ ভারতের আসামে এনআরসি নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করে যখন সেখানকার মুসলিমদেরকে বাংলাদেশে ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছিলো, তখন বাংলাদেশ সরকার হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে সমাবেশগুলিকে একটা রক্ষাকবচ হিসেবেই দেখেছে। এছাড়াও ২০২০ সালে করোনা ইমার্জেন্সির মাঝে চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনার সময় বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নীতি ভারতের পছন্দ হয়নি। বাংলাদেশের সাথে চীনের বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিকেও ভারত সন্দেহের চোখে দেখেছে। তবে যখনই বাংলাদেশের জনগণ হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের সখ্যতাকে টার্গেট করেছে, তখনই দমন-পীড়নের নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। আওয়ামী লীগ সরকার ভারত-তোষণ নীতিকেই ভারতের বিরুদ্ধে প্রধানতম ডিটারেন্ট হিসেবে দেখেছে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ভারতের সাথে নিয়মিতভাবে যৌথ মহড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এর আগে যেহেতু ভারতে কোন হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষমতাসীন হয়নি, তাই ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সখ্যতাকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণ খারাপ চোখে দেখেছে। নিশ্চিতভাবেই গত দুই দশকের ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন আওয়ামী লীগ ধরতে পারেনি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে জনগণ শুধুমাত্র রাজনীতি বা স্টেটক্রাফট হিসেবে দেখেনি; দেখেছে নিজেদের বিশ্বাসের প্রতি অপমান হিসেবে। অর্থাৎ কখন যে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলাম একত্রিত হয়ে গিয়েছে, তা কেউ খেয়ালই করেনি!

বাংলাদেশের মানুষ সর্বদাই ভারত-বিদ্বেষী। এর মূল কারণ শুধুমাত্র এ-ই নয় যে, ভারত একটা বিশাল রাষ্ট্র, যা বাংলাদেশকে ঘিরে রয়েছে। বরং ভারতকে বাংলাদেশের জনগণ দেখে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা রাষ্ট্র হিসেবে; যেখানে নিয়মিতই মুসলিমদের উপর দমন-পীড়ন হয়। ভারতের কোন সরকারই এই ন্যারেটিভ পরিবর্তন করতে পারেনি। আর হিন্দুত্ববাদী সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকে এই ন্যারেটিভের পালে আরও শক্তিশালী হাওয়া লেগেছে। এমনকি ২০২৪এর জুলাই-অগাস্টে এই ন্যারেটিভ আওয়ামীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ভারত চাইছে বাংলাদেশ সরকারের উপর তার প্রভাব ধরে রাখতে। দিল্লীর চিন্তাবিদেরা বুঝতে পারছে না যে, ভারত যখনই ঢাকায় আসীন নেতৃত্বের সাথে সখ্যতা তৈরি করবে, তখনই সেই নেতৃত্ব জনগণের আক্বীদার শত্রুতে পরিণত হবে। শুধুমাত্র সেকুলার চিন্তার মাঝে থেকে কারুর পক্ষে এই বাস্তবতা অনুধাবন সম্ভব নয়।
 
যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' হাসিনা সরকারের একাত্মতা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ইসলামের প্রতি ভালোবাসাকে থামাতে তো পারেইনি; উল্টো, ওয়াশিংটনের প্রেসক্রিপশনে ইসলামপন্থীদের উপর দমন-পীড়ন করে, এলজিবিটি প্রমোট করে, এবং হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকারের সাথে সখ্যতা করে নিজেদের উপরে ইসলাম-বিদ্বেষী তকমা নিয়ে এসেছিল আওয়ামী সরকার। এছাড়াও ফিলিস্তিন এবং ভারতে মুসলিমদের উপর নির্যাতন এখন বাংলাদেশের মুসলিমদের ইস্যুও বটে। অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলাম এখন আলাদা কিছু নয়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সম্পর্ক কিরূপ হবে, তা এই দেশের মানুষের আক্বীদার বিরুদ্ধে গেলে নিঃসন্দেহে বড় রকমের সমস্যা তৈরি করছে।


গত দুই দশকে ইন্টারনেট এবং সোশাল মিডিয়ার আবির্ভাব; মধ্যপ্রাচ্যে মাইগ্রেশন; টেকনিক্যাল শিক্ষা, বই পড়ার প্রতি অনাগ্রহ, টেলিভিশনের প্রভাব কমে যাবার কারণে সেকুলার কনসেপ্টের প্রভাব কমে যাওয়া ছিল উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এর মাঝে বিভিন্ন ইসলামি গ্রুপ মানুষের মাঝে কনসেপ্টের ঘাটতিগুলিকে পুরণ করেছে। সমাজে ইসলাম এখন একটা আলোচ্য বিষয়; যেই বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার কোন পদ্ধতিই নেই। যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে' হাসিনা সরকারের একাত্মতা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ইসলামের প্রতি ভালোবাসাকে থামাতে তো পারেইনি; উল্টো, ওয়াশিংটনের প্রেসক্রিপশনে ইসলামপন্থীদের উপর দমন-পীড়ন করে, এলজিবিটি প্রমোট করে, এবং হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকারের সাথে সখ্যতা করে নিজেদের উপরে ইসলাম-বিদ্বেষী তকমা নিয়ে এসেছিল আওয়ামী সরকার। এছাড়াও ফিলিস্তিন এবং ভারতে মুসলিমদের উপর নির্যাতন এখন বাংলাদেশের মুসলিমদের ইস্যুও বটে। অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতি এবং ইসলাম এখন আলাদা কিছু নয়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সম্পর্ক কিরূপ হবে, তা এই দেশের মানুষের আক্বীদার বিরুদ্ধে গেলে নিঃসন্দেহে বড় রকমের সমস্যা তৈরি করছে। এবং একইসাথে তা ১৯৪৭এর সেকুলার নেশন স্টেটএর কন্সট্রাক্টকে চ্যালেঞ্জ করছে।

2 comments:

  1. তাইলে আমেরিকা হাসিনাকে সরালো কেন

    ReplyDelete
    Replies
    1. যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক নয়; ভূরাজনৈতিক এবং বৈশ্বিক। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবচাইতে গুরুত্ব পাওয়া বিষয় হলো চীনকে নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও মিয়ানমারে চীনের অবস্থানকে দুর্বল করা, মিয়ানমারকে ব্যবহার করে চীনের সীমানাকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলা এবং রাখাইনে চীনের তৈরি করা সমুদ্রবন্দর ও গ্যাস পাইপলাইনকে সমস্যা ফেলা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের অংশ। বাংলাদেশে যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইবে তার এই লক্ষ্যগুলিকে যতটুকু বাস্তবায়ন করা যায়।

      যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সমস্যা হলো, জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশের ডিএনএ-র মাঝে ব্রিটিশ চিন্তা রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সবসময়েই সকলকে ব্যালান্স করে চলতে চায়; অর্থাৎ সকলের সাথেই সম্পর্ক ভালো রাখতে চায়। এটা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। এব্যাপারে নিচে লিঙ্ক দেয়া পোস্ট পড়তে পারেন।
      https://koushol.blogspot.com/2024/08/balancing-politics-bangladesh-dna.html

      যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই তার স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যেতে থাকবে - হয়তো কারুর উপর কম, বা কারুর উপর বেশি। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের বেসিক ডিএনএ-র মাঝেই ব্রিটিশ চিন্তা রয়েছে, তাই সরকার পরিবর্তন হলেও এই ডিএনএ পরিবর্তন হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মাঝে এই কৌশল নেই যে, সে বাংলাদেশের মতো একটা রাষ্ট্রের ডিএনএ পরিবর্তন করবে। তারা সরকার পরিবর্তনের মাঝেই নিজেদের লক্ষ্যকে সীমাবদ্ধ রেখেছে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই। আর সকল সরকারের কাছ থেকেই তারা স্বার্থ আদায় করে নেবার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতা পাকিস্তানের মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫০এর দশক থেকেই পাকিস্তানকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসতে পেরেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভীষণ রকম অনুগত। কিন্তু এরূপ বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তৈরি করতে পারেনি। একারণে যুক্তরাষ্ট্র যতটুকু সম্ভব তার স্বার্থ বাস্তবায়ন চেয়েছে; দরকার হলে বিকল্প খুঁজেছে।

      Delete