১৯শে এপ্রিল ২০২৩
বেইজিংএ যেনো বিশ্ব নেতাদের মেলা শেষ হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে বেইজিং সফরে গিয়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন, এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক। এছাড়াও বেইজিং সফর করেছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা। তবে যার সফর মিডিয়াতে সবচাইতে বেশি হাইলাইট হয়েছে তিনি হলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ। অনেকেই প্রশ্ন করা শুরু করেছেন যে, ম্যাক্রঁ কি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন কিনা।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ কি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন?
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন বেইজিং সফর করে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর সাথে আলোচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেন যে, তিনি নিশ্চিত যে, শি জিনপিংই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করাতে পারবেন। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সাংবাদিক সন্মেলনে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বেশ অমায়িক ছিলেন এবং বারংবার শি জিনপিংএর দিকে তাকাচ্ছিলেন ও তাকে নাম ধরে সম্ভোধন করছিলেন। তবে ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ম্যাক্রঁর বেইজিং সফরের পর ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে শি জিনপিংএর চিন্তাতে বড় কোন পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। ম্যাক্রঁ মনে করছেন যে, পশ্চিমা জোটের অংশ হবার অর্থ এই নয় যে, ফ্রান্স চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারবে না। সংবাদ সন্মেলনে ম্যাক্রঁ চীনের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেননি। বরং তিনি বলেছেন যে, মানবাধিকার ফ্রান্সের কাছে গুরুত্বপূর্ণ; তবে সন্মান দিয়ে কথা বলাটা ‘লেকচার দেওয়া’ থেকে ভালো। ম্যাক্রঁর সফরের মাঝে দুই দেশের মাঝে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
আরেকটা সংবাদ সন্মেলনে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ভন ডার লেইয়েন বলেন যে, তিনি মনে করছেন যে, চীন ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে সুষ্ঠু ভূমিকা নেবে। তবে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির শান্তি প্রস্তাবের পক্ষে বলেন; যেখানে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনাদের সম্পূর্ণ সরে যাবার কথা বলা হয়েছে। একইসাথে তিনি বলেন যে, চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তাহলে ইউরোপের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হবে।
৯ই এপ্রিল ফরাসি পত্রিকা ‘লে একোস’এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ বলেন যে, সবচাইতে খারাপ ব্যাপার হবে যদি ইউরোপিয়রা চিন্তা করতে থাকে যে, তাদেরকে অন্য কাউকে অনুসরণ করতে হবে; নিজেদেরকে পরিবর্তন করে মার্কিন সুর এবং এর চীনা প্রতিক্রিয়ার সাথে তাল মেলাতে হবে। ১১ই এপ্রিল দি হেগএর ‘নেক্সাস ইন্সটিটিউট’এ এক বক্তব্যে ম্যাক্রঁ জার্মানির নাম উল্লেখ না করেই বলেন যে, ইউরোপের কেউ কেউ রাশিয়া থেকে জ্বালানি ক্রয় করা জন্যে তাদেরকে বন্ধু বানিয়েছিল। কারণ তারা মনে করেছিল যে, বাণিজ্যের মাধ্যমেই সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং আগ্রাসনকে মোকাবিলা করা সম্ভব। এখন তারাই জ্বালানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং ইউরোপকে মারাত্মক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন যে, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের চোখ খুলে দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের সাপ্লাই স্বল্পতা এবং যুদ্ধের দামামাকে তুলে ধরে তিনি বলেন যে, ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকতে হবে।
চীনের ব্যাপারে ইউরোপ বিভক্ত
ম্যাক্রঁর সাথে ইউরোপের সকলে যে একমত নয়, তা নিশ্চিত। ‘ডয়েচে ভেলে’কে ‘ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি’র প্রধান মানফ্রেড ওয়েবার বলছেন যে, তাইওয়ানের সীমানায় সামরিক মহড়ার মাঝে ম্যাক্রঁ যখন চীনের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে কথা বলছেন, তখন এটা নিশ্চিত যে, তার কথাগুলি ইউরোপের স্বার্থের বিরুদ্ধ। আবার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাতেউস মোরাভিয়েস্কি সাংবাদিকদের বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পোল্যান্ডের নিরাপত্তার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের এই বিভেদকে তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও এক ভিডিও বার্তায় প্রশ্ন করছেন যে, ম্যাক্রঁ কি ইউরোপের হয়ে কথা বলছেন? এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। মার্কিনীরা তাদের করদাতাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ ইউরোপের যুদ্ধে খরচ করছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের পরপরই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বেইজিং সফর করে এসেছেন। অনেকেই বলছেন যে, বেয়ারবক তার সফরের মাধ্যমে ম্যাক্রঁর সফরে পশ্চিমাদের যা ‘ক্ষতি’ হয়েছে, তা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। বেইজিংএ ১৪ই এপ্রিল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, এটা একটা ভালো ব্যাপার যে, ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানে চীন চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি অবাক হচ্ছেন যে, কেন এখন পর্যন্ত চীনারা রাশিয়াকে আগ্রাসী আখ্যা দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে আহ্বান করেনি। একইসাথে তিনি বলেন যে, তাইওয়ান প্রণালিতে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে জার্মানি উদ্বিগ্ন। তার সরকার ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী; তবে দ্বন্দ্বের সমাধান অবশই শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে। স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের কোন চেষ্টা জার্মানি সমর্থন করবে না। অপরদিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং বলেন যে, তাইওয়ান প্রণালি এবং পুরো অঞ্চলে কেউ যদি শান্তি দেখতে চায়, তাহলে তাকে তাইওয়ানের স্বাধীনতার চেষ্টা এবং সেখানে বিদেশী প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইয়েন ইইউএর অর্থনৈতিক সমস্যার উপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন; এবং সেই সূত্রে চীনের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। ১৮ই এপ্রিল ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপিয় পার্লামেন্টে ভন ডার লেইয়েন বলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন যে, ইউরোপের উচিৎ এবং ইউরোপের দ্বারা সম্ভব নিজেদের আলাদা নীতি অনুসরণ করা; যাতে করে ইউরোপিয়রা অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি বলেন যে, চীনের সাথে ইউরোপের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যেকারণে চীনের সাথে সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই ইউরোপের নীতি এবং কৌশল প্রণয়ন করা উচিৎ নয়। বেইজিংএ গিয়ে তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, ইউরোপ চীনের সাথে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সম্পর্ক কর্তন করতে চায় না। একইসাথে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে বলেন যে, চীনের ব্যাপারে ইউরোপের নীতির কেন্দ্রীয় অংশ হওয়া উচিৎ কিভাবে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমানো যায়।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি জোসিপ বোরেল আবার চীনের সাথে সম্পর্ক রাখার সাথেসাথে তাইওয়ান ইস্যুকেও সামনে এনে কিছুটা হুমকি দিয়েই কথা বলেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার কারণে তিনি বেইজিং সফরে যাননি। তবে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, ইইউ তার ‘এক চীন’ নীতিতে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ইউরোপের উচিৎ উত্তেজনা প্রশমন করা; উত্তেজক বার্তা না দেয়া এবং অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে পারে এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা। তবে চীনের পক্ষ থেকে বর্তমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার কোন চেষ্টা যদি করা হয়, তাহলে সেটা গ্রহনযোগ্য হবে না। ইইউ পার্লামেন্টে তিনি বলেন যে, চীন ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী; তবে চীনের সাথে অবশ্যই কথা চালিয়ে নিতে হবে।
ম্যাক্রঁর সমালোচকের অভাব নেই
ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য এবং কিছুদিন আগেই পদত্যাগ করা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস গত ১২ই এপ্রিল এক অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন যে, ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং বলেছেন যে, তারা পশ্চিমা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একে অপরের বন্ধু। একারণেই তিনি মনে করছেন যে, পশ্চিমা নেতাদের উচিৎ হয়নি বেইজিং গিয়ে শি জিনপিংএর সাথে দেখা করা; এবং একইসাথে তাকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা করার জন্যে অনুরোধ করা। তিনি বলেন যে, ইউরোপিয় নেতাদের এই কর্মকান্ড তাদের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। এবং একই কারণে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর উচিৎ হয়নি বলা যে, তাইওয়ানে ইউরোপের কোন স্বার্থ নেই। ট্রাস বলেন যে, পশ্চিমাদের সকলেরই উচিৎ তাইওয়ান যাতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, সেজন্য তাদেরকে সকল প্রকারের সহায়তা দেয়া। এছাড়াও তিনি বলেন যে, চীনারা যা বলছে, সেগুলিকে পশ্চিমাদের সন্দেহের চোখে দেখা উচিৎ।
জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ডিজিএপি’র সিনিয়র ফেলো জ্যাকব রস ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ম্যাক্রঁ সর্বদাই তার কথার ধরণের জন্যে আলোচিত। তিনি যেভাবে কথা বলেন অথবা সময়জ্ঞান না রেখেই যে বক্তব্য দেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করে। তার কথাগুলি হয়তো অনেকেই বুঝতে পারেনি বা তাকে অনেকেই হয়তো ভুল বুঝেছে। অনেকেই মনে করেছেন যে, ম্যাক্রঁ চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এক কাতারে ফেলেছেন; যা ভাবাটা অনুচিত। তিনি রাশিয়া, চীন বা যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক চিন্তা না করে ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার ব্যাপারে যে কথাগুলি বলছেন, তা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও সমর্থিত। তবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার পদ্ধতির ক্ষেত্রে ইউরোপিয়দের হয়তো বিভেদ রয়েছে। তথাপি স্বল্প মেয়াদে হলেও তিনি যে আটলান্টিকের দুই পাড়ের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছেন, সেটা নিশ্চিত। যে ব্যাপারটা হয়তো ম্যাক্রঁকে উস্কে দিয়েছে তা হলো ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ‘অকাস’ চুক্তি। ফরাসিরা অনেকেই সেই চুক্তিকে ফ্রান্সের পিঠে চাকু মারার সাথে তুলনা করেছিল। ম্যাক্রঁ হয়তো সেটাকে উল্টে দিতেই জোরেসোরে লেগেছেন।
ইউরোপ কেন বিভক্ত?
মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউরোপিয় নেতারা বেইজিং সফর করে যেসব কথা বলছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পছন্দনীয় হবার কথা নয়। কারণ জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন চীনের সাথে বিশেষ রকমের বৈরীতার নীতিতে এগুচ্ছে। ওয়াশিংটন চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে চীনে উচ্চ প্রযুক্তি রপ্তানির উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপিয় দেশগুলিকেও একই পথে হাঁটার আহ্বান করেছে। ইউরোপিয় নেতাদের বেইজিং সফরে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে তা হলো, চীনের সাথে কেমন সম্পর্ক থাকা উচিৎ, সেব্যাপারে ইউরোপিয় দেশগুলি একমত নয়। কিছু দেশ নিরাপত্তাজনিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকতে চাইছে। আর কিছু দেশ অর্থনৈতিক কারণে চীনকে ফেলে দিতে পারছে না। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর হিসেবে ২০২২ সালে ইউরোপ সবচাইতে বেশি আমদানি করেছে চীন থেকে এবং চীনারা ছিল ইউরোপের পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। এই ব্যাপারটা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে যখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইউরোপিয় নেতারা চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অটুট রাখার কথা বলছেন এমন এক সময়ে, যখন মার্কিনীরা বেইজিংএর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে অনেকটাই কর্তন করতে চাইছে। ইউরোপ চাইছে চীনের সাথে সম্পর্ক কর্তন না করে বরং নিজেদের অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে কমাতে।
বার্লিনের ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি’র ডিরেক্টর মারিনা হেনকা ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইইউএর প্রতিনিধিরা যখন বলছেন যে, চীন ইউরোপের সহযোগী, প্রতিযোগী এবং পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ইউরোপের মাঝে বিভেদ রয়েছে। এই কথাগুলিকে পাশাপাশি রাখলে এটা পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইইউএর কিছু দেশ চীনকে সহযোগী মনে করছে, কিছু দেশ চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে; আর কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করে চীনকে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার প্রতি হুমকি এবং বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার প্রবক্তা হিসেবে দেখছে।
চীন বিষয়ে ম্যাক্রঁর বক্তব্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপের চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকবে কি থাকবে না, অথবা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে কতটা নির্ভরশীল থাকবে, সেটাই যেন বিবেচ্য বিষয়। ম্যাক্রঁ যখন বলছেন যে, ইউরোপের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা থাকা উচিৎ, তখনও তিনি প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কোলে বসে থাকা উচিৎ হবে কিনা, সেটা নিয়েই কথা বলছেন। অপরদিকে তিনি যখন জার্মানদের সমালোচনা করছেন রুশ গ্যাসের উপরে নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির জন্যে, তখন জার্মানরা আবার ওয়াশিংটনের লাইন ধরেই তাইওয়ান বিষয়ে চীনকে শক্ত কথা শোনাচ্ছে। আর পোল্যান্ড এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এখন তাদের নিরাপত্তার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। চীনের বিষয়ে ইউরোপ যে একমত নয়, সেটা পরিষ্কার। তবে সবচাইতে হাস্যকর হলো, ম্যাক্রঁ এই কথাগুলি বলছেন; আবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনা অনুসরণ করে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছেন; যা কিনা দেখিয়ে দেয় যে, ম্যাক্রঁ মুখে অনেক কিছু বললেও প্রকৃতপক্ষে তার যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যাবার সক্ষমতা কতটুকু। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা দূরে থাকুক, নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারেই তাদের অসহায়ত্ব দিবালোকের মত পরিষ্কার। ইউরোপিয়রা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া চিন্তাই করতে পারছে না; অথবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে ব্যালান্স করতে হিসমিস খাচ্ছে; যা ইউরোপের লক্ষ্যহীন অবস্থাকেই তুলে ধরে।
বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কিভাবে কমছে? যুক্তরাষ্ট্র এখনো পৃথিবীর একমাত্র সুপার পাওয়ার এবং অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন দেশের সরকার পতন করতে সে সক্ষম।
ReplyDeleteআপনি ঠিকই বলেছেন যে, বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজার এখনও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সমস্যা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে। মূল্যস্ফীতি রোধ করতে গিয়ে ফেডেরাল রিজার্ভ যখন সুদের হার বৃদ্ধি করেছে, তখন দুনিয়াব্যাপী যারা মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কিনেছিল, তারা সকলেই ক্ষতির মাঝে পড়েছে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মার্কিন সরকারি বন্ডের আকর্ষণীয়তা কমতে শুরু করেছে। এছাড়াও ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ফলে অনেক দেশই বেঁচে থাকার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থাকে বাইপাস করার চেষ্টা করছে। এটা এখনও যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ না করতে পারলেও প্রসেসটা শুরু হয়েছে।
Deleteযুক্তরাষ্ট্র ডলার ছাপিয়েছে ইচ্ছেমতো; যা বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির সবচাইতে বড় কারণ।
https://koushol.blogspot.com/2021/02/us-printing-dollar-for-economic-recovery-how-long.html
আর বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব কমার পিছনে সবচাইতে বড় কারণ হলো পশ্চিমা আদর্শের নেতৃত্বের অবস্থান থেকে সড়ে আসা।
https://koushol.blogspot.com/2021/08/afghan-disaster-snaches-last-hope-for-us-to-regain-world-leadership.html
https://koushol.blogspot.com/2021/09/usa-after-afghanistan.html
নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা নিয়ে সমস্যায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; যার মাঝে প্রধান সমস্যা হলো রিক্রুটিং। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীতে কেউ সার্ভিস দিতে চাইছে না।
https://koushol.blogspot.com/2022/09/why-us-military-facing-dangerous-recruitment-problems.html
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বন্ধু দেশগুলিও এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আদান-প্রদানের সম্পর্কে চলে গেছে; একসময় যা ছিল নির্দেশ পালনের। এর মাঝে প্রধানতম হলো মধ্যপ্রাচ্য।
https://koushol.blogspot.com/2022/07/what-did-biden-get-from-middle-east-trip.html
https://koushol.blogspot.com/2022/10/geopolitical-importance-of-oil-production-cut-by-opec-plus.html
এবং তুরস্ক...
https://koushol.blogspot.com/2021/05/turkey-coming-out-of-us-sphere-of-influence.html
পূর্ব এশিয়াতেও যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধুদের দেখাশোনা করতে হিমসিম খাচ্ছে।
https://koushol.blogspot.com/2021/01/japan-korea-dispute-biden-admin-no-solution.html
চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে হাতে রাখতেও ব্যাপকভাবে ছাড় দিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
https://koushol.blogspot.com/2022/04/is-india-russias-friend-or-us-friend.html
আফ্রিকাতেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
https://koushol.blogspot.com/2023/01/china-russia-us-geopolitical-competition-in-africa.html
অনেক ধন্যবাদ। আরেকটা বিষয় হচ্ছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস গত ১২ই এপ্রিল এক অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন যে, ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং বলেছেন যে, তারা পশ্চিমা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একে অপরের বন্ধু।
Deleteকিন্তু যতদূর জানি রাশিয়া-চীন পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণ করছে। তাহলে তারা পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সিস্টেমের এর বিরুদ্ধে যাবে কেন?
ভালো প্রশ্ন করেছেন। আপনি ঠিক ধরেছেন যে রাশিয়া এবং চীন উভয়েই পুঁজিবাদী দেশ এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী। এবং উভয় দেশই কখনোই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। এখানে বিরোধটা হলো রাষ্ট্রচালনার ধরণ নিয়ে।
Deleteলিজ ট্রাস বোঝাতে চাইছেন যে, পুঁজিবাদ খুবই ভালো একটা আদর্শ; যা রাশিয়া এবং চীন অনুসরণ করছে না বলেই সমস্যা হচ্ছে। ট্রাস এবং তাদের মতো মানুষগুলি বলছে যে, পুঁজিবাদ ঠিকমতো চলতে হলে সকলকিছুই পশ্চিমাদের মতো হতে হবে; যেমন পশ্চিমাদের মতো নির্বাচন হতে হবে; পশ্চিমা দেশগুলির মতো মানবাধিকার আইন থাকতে হবে; পশ্চিমাদের মতো মিডিয়া স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, অবাধ যৌনতার স্বাধীনতা, ধর্মত্যাগের স্বাধীনতা, ইচ্ছেমতো চলার ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি থাকতে হবে। পশ্চিমারা বলে যে, মুক্ত বাজার অর্থনীতি বাস্তবায়ন না করতে পারলে সেটা পুঁজিবাদ নয়। আর মুক্তবাজার অর্থনীতির অর্থ হলো পশ্চিমা কোম্পানিগুলি যেকোন দেশে যেকোন ধরণের ব্যবসা করতে পারবে, তেমন কোন কর দেয়া ছাড়াই ব্যবসা করতে পারবে, আমদানি শুল্ক থাকবে না, সরকারের কোন প্রকারের বাধা থাকবে না পশ্চিমা কোম্পানিগুলির উপর আয়ের উপর বা তাদের লভ্যাংশ তুলে নেবার উপর, ইত্যাদি।
কাজেই পশ্চিমারা অনেকেই রাশিয়া এবং চীনকে মূলতঃ পুঁজিবাদী বলতে চাইছেন না; কারণ তারা বলতে চাইছে যে, পুঁজিবাদ খুবই ভালো একটা ব্যবস্থা, যা কিনা চীন এবং রাশিয়া ঠিকমতো বাস্তবায়ন করছে না; বা কেউ কেউ বলছে যে, তারা পুঁজিবাদী দেশই নয়।