Thursday, 25 November 2021

জাপান কি তার প্রতিরক্ষানীতিকে পরিবর্তন করছে?

২৫শে নভেম্বর ২০২১

সাম্প্রতিককালে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ অস্ট্রেলিয়ার সাথে জাপানের চুক্তিও দেখিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য শক্তিরাও চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপানকে ব্যবহার করতে চাইছে। ব্রিটেনও জাপানের সাথে আরও গভীর সামরিক সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলছে। চুক্তিগুলির ফলস্বরূপ জাপানের উঠানে পশ্চিমাদের সাথে চীনাদের দ্বন্দ্ব জাপানকেও জড়াতে বাধ্য করবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের ব্যাপারে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জাপান এবং চীনের মাঝে উত্তেজনাকে যেমন বাড়াবে, তেমনি পূর্ব এশিয়াতে পশ্চিমাদের অবস্থানও সুসংহত করবে।

 
জাপানের সামরিক বাজেট দেশটার জিডিপির ১ শতাংশের বেশি হবে না বলে একটা অলিখিত সিদ্ধান্ত জাপান সরকার মেনে চলেছে। তবে গত মে মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি ‘নিকেই এশিয়া’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, জাপান জিডিপির সাথে অনুপাত রেখে কখনোই তার সামরিক বাজেটের পরিকল্পনা করে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই কথাই বলে দিচ্ছে যে, জাপান তার প্রতিরক্ষা বাজেটকে জিডিপির ১ শতাংশের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে না। নোবুও কিশি চীনা হুমকি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ নতুনভাবে সামরিক বাজেট তৈরির কথা বলেন। শুধু সামরিক বাজেট বৃদ্ধিই নয়, প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, নতুন প্রতিরক্ষানীতি তৈরির কাজে হাত দিয়েছে জাপান; যা ২০২২ সালে গতি পাবে।

২০১৪এর জুলাই মাসে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সরকার দেশটার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের রচনা করে দেয়া যুদ্ধবিরোধী সংবিধানের একটা নতুন ব্যাখ্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৬ সালের মার্চে প্রবল বাধার মুখে নতুন আইন হিসেবে জাপানের পার্লামেন্টে এই সিদ্ধান্তগুলিকে পাস করানো হয়। জাপানে অনেকেই এই আইনকে ‘যুদ্ধ আইন’ বলে আখ্যা দেয়। তারা বলছিলেন যে, এর ফলশ্রুতিতে অন্যের শুরু করা যুদ্ধে জাপানকে জোর করে জড়ানো হতে পারে। ‘জাপান টাইমস’ বলছে যে, এই আইনের ফলস্বরূপ কোরিয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়ালে জাপানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধে জড়াতে পারে। এছাড়াও এতদিন পর্যন্ত জাপানের আশেপাশে জাপানিরা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতে পারতো; এখন নতুন আইনে তৃতীয় কোন দেশেও পারবে।

২০২০এর নভেম্বরে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া তাদের একে অপরের সামরিক সদস্য এবং যন্ত্রপাতিকে রক্ষা করার ব্যাপারে চুক্তি করে। ‘দ্যা জাপান নিউজ’ বলছে যে, চুক্তি মোতাবেক, শান্তিকালীন সময়ে জাপানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ার সময় এবং জাপানের আশেপাশের সমুদ্রে অস্ট্রেলিয়ার সার্ভেইল্যান্স অপারেশন চালনার সময় জাপান তার সামরিক শক্তিকে অস্ট্রেলিয়ার সম্পদ রক্ষায় ব্যবহার করবে। জাপানের আশেপাশের সমুদ্রের মাঝে পূর্ব চীন সাগরও রয়েছে, যেখানে জাপানের সাথে চীনের রয়েছে সমুদ্রসীমা এবং আকাশসীমা নিয়ে বিরোধ। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইস্টএশিয়া ফোরাম’এর লেখায় ‘ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস’এর প্রফেসর অরেলিয়া জর্জ মুলগান বলছেন যে, এভাবেই একটু একটু করে জাপান আঞ্চলিকভাবে তার সামরিক ভূমিকাকে বৃদ্ধি করেছে; আর এই কাজ করার জন্যে তাদের যুদ্ধবিরোধী সংবিধানকেও পরিবর্তন করতে হয়নি। চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পরই অস্ট্রেলিয়া জাপানের সবচাইতে কাছের সহযোগী হিসেবে নাম লেখালো। এর ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যথেষ্ট ঘন ঘন জাপানের মাটিতে এবং এর আশেপাশের সমুদ্রাঞ্চলে সামরিক মহড়ায় অংশ নেবে। এছাড়াও আরও যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এতকাল জাপান তার নিরাপত্তার জন্যে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রকেই কাছের বন্ধু মনে করলেও এখন অন্যান্য দেশকেও তার নিজের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছে। জাপান ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে ‘কোয়াড’ জোটের অংশ হয়েছে, যা কিনা একটা চীন বিরোধী জোট হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।

গত জুনে জাপানের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াসুহিদে নাকাইয়ামা মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তাইওয়ানকে রক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ‘ওয়ান চায়না’ নীতি নিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি নিজেও এতকাল তাইওয়ানকে ‘লাল দাগ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নাকাইয়ামা প্রশ্ন বলেন যে, ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো তাইওয়ানের ব্যাপারে নীতি কতটা সঠিক ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। ভৌগোলিকভাবে তাইওয়ান জাপানের খুবই কাছে; তাইওয়ানে কিছু ঘটলে তা জাপানের ওকিনাওয়ার উপর প্রভাব ফেলবে। মহাকাশ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, পারমাণবিক এবং প্রচলিত অস্ত্রের দিক থেকে চীনের আগ্রসী চিন্তা এবং ইচ্ছার ব্যাপারে তিনি সকলকে ‘জেগে উঠতে’ বলেন। এছাড়াও তিনি সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের আশেপাশে চীন এবং রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়ার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, রাশিয়া এবং চীনের সহযোগিতা এক নতুন হুমকির সৃষ্টি করেছে। এজন্যে তিনি আরও শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রকে দেখতে চান।

মার্কিন বিমান বাহিনীর ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা রায়ান এশলি ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় বলছেন যে, সাম্প্রতিককালে জাপানের রাজনীতিবিদদের মাঝে অর্থনীতিকেন্দ্রিক চিন্তার বদলে বাস্তবতাকেন্দ্রিক চিন্তাকে শক্তিশালী দেখা যাচ্ছে। এতকাল ক্ষমতাসীন এলডিপি দলের বেশিরভাগ সদস্যই চাইতেন বেইজিংএর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিতে; তবে বর্তমানে লিবারাল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাতে অংশ নেয়াতেই তারা এখন বেশি আগ্রহী। এই হিসেবেই জাপান এখন তাইওয়ানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। জাপানিরা মনে করছে না যে, তাইওয়ানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করলে জাপানের জন্যে নতুন কোন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ ডেকে আনবে। কারণ চীনারা আগে থেকেই জাপানের আশেপাশে ব্যাপক সামরিক অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। আপাততঃ হয়তো তাইওয়ানের ব্যাপারে কূটনীতি বা নিরাপত্তা বিষয়ে জাপানের নীতির কোন পরিবর্তন হবে না। তবে জাপানি নেতৃত্বের তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া এবং চীনের হাত থেকে তাইওয়ানের রক্ষা করার ব্যাপারে জাপানি সরকারের ইচ্ছা প্রকাশ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনা সামরিক নেতৃত্বের জন্যে স্বল্পমেয়াদে মাথাব্যাপার কারণ হবে; এমনকি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রযুক্তি দেয়ানেয়ার চুক্তির চাইতেও তা বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।

‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন তার সামরিক শক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি করলেও ভৌগোলিকভাবে চীনের দুর্বলতা রয়েছে। তাইওয়ান এবং জাপানের দ্বীপগুলি চীনের প্রশান্ত মহাসাগরে বের হবার পথগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কিন সামরিক চিন্তাবিদেরা জাপানের নৌবাহিনীর সাবমেরিনগুলিকে ব্যবহার করে এই দ্বীপগুলির মাঝের প্রণালিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। আর সাম্প্রতিককালে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ অস্ট্রেলিয়ার সাথে জাপানের চুক্তিও দেখিয়ে দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য শক্তিরাও চীনকে নিয়ন্ত্রণে জাপানকে ব্যবহার করতে চাইছে। ব্রিটেনও জাপানের সাথে আরও গভীর সামরিক সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলছে। চুক্তিগুলির ফলস্বরূপ জাপানের উঠানে পশ্চিমাদের সাথে চীনাদের দ্বন্দ্ব জাপানকেও জড়াতে বাধ্য করবে। এমনই এক পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের ব্যাপারে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জাপান এবং চীনের মাঝে উত্তেজনাকে যেমন বাড়াবে, তেমনি পূর্ব এশিয়াতে পশ্চিমাদের অবস্থানও সুসংহত করবে।

2 comments:

  1. ধরে নেয়া যেতে পারে, চীন কোন একদিন তাইওয়ানের উপর সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করল। এক্ষেত্রে সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার দোসররা কিভাবে তাইওয়ানকে রক্ষা করবে? তারা কি তাইওয়ানকে রক্ষা করতে যেয়ে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাইবে এবং একটা পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে???

    ReplyDelete
    Replies
    1. Read this first....
      https://koushol.blogspot.com/2021/11/is-china-winning-without-firing-shots.html

      Delete