২৭শে ডিসেম্বর ২০২০
২০২০ সাল যখন শেষের দিকে চলে আসছিল, তখন থেকেই ২০২১ সালের শুরুতে ব্রিটিশ রয়াল নেভির নতুন নির্মিত দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর ভারত মহাসাগরে মোতায়েন নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ হিসেবে এই সামরিক কর্মকান্ড ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন আনবে। ‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনকে ‘কোয়াড’ জোটের পঞ্চম সদস্য হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ‘কোয়াড’ হলো এক কৌশলগত জোট, যার মাঝে রয়েছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া। ২০২০ সালে ‘কোয়াড’ তার সত্যিকারের আকার নিতে শুরু করে, যখন ভারত অবশেষে বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠিত ‘এক্সারসাইজ মালাবার’ নৌমহড়াতে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর অংশ অস্ট্রেলিয়াকে আমন্ত্রণ জানায়। ‘নিকেই এশিয়া’ বলছে যে, আপাততঃ ব্রিটিশ নৌবাহিনী হয়তো মার্কিন নৌবাহিনীর সহায়ক হিসেবেই কাজ করবে। করোনা সংক্রমণের কারণে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন পূর্ব এশিয়াতে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এর সমান্তরালে জুলাই মাসে মার্কিন নৌবাহিনীর আরেক উভচর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘বনহোমি রিচার্ড’ মারাত্মক অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, একটা রাষ্ট্র একটা অঞ্চলে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তার একাংশ নির্ধারিত হবে সেখানে তার সামরিক শক্তি মোতায়েনের সক্ষমতার উপর। ব্রিটিশরা চাইছে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এশিয়াতে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে।
জাপানের ‘কিওদো নিউজ’ বলছে যে, এশিয়াতে ব্রিটেনের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পিছনে জাপানের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা বলছে যে, ‘কুইন এলিজাবেথ’ ২০২১ সালে জাপানি এবং মার্কিন নৌবাহিনীর সাথে মহড়া দেবে। আর জাপান সফরের সময় এর ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ যুদ্ধবিমানগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে আইচি প্রিফেকচারে অবস্থিত ‘মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ’এর কারখানায় পাঠানো হবে। অর্থাৎ জাহাজটার ইন্দোপ্যাসিফিকে স্থায়িভাবে মোতায়েনের পিছনে জাপানের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। এছাড়াও জাহাজটার মূল রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ওমানের দুকমে বিশাল ড্রাইডক তৈরি করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সরকার দুকমের লজিস্টিকস ঘাঁটি তিনগুণ করার লক্ষ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে ওমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ট্রেনিং কর্মকান্ডও বৃদ্ধি পাবে।
ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের সাথে চীনের ব্যাপারে ব্রিটিশ নীতির যোগাযোগ রয়েছে। হংকংএ চীনা দমনপীড়নের ব্যাপারে ব্রিটিশ রাজনৈতিক অবস্থান চীনের বিরক্তির উদ্রেক করেছে। একইসাথে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতেও ব্রিটেন চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে তা একইসাথে ব্রিটেনকে পূর্ব এশিয়াতে নিজের অবস্থান জানান দিতে সহায়তা করেছে। চীনারা এশিয়াতে রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজের আবির্ভাবকে ‘সামরিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’এর লেখায় সামরিক বিশ্লেষক সং ঝংপিং বলছেন যে, ‘কুইন এলিজাবেথ’ যুদ্ধজাহাজ এবং এর বিমানগুলি এখনও পুরো যুদ্ধ সক্ষমতা অর্জন করেনি। তিনি বলেন যে, এমতাবস্থায় জাহাজটাকে ইন্দোপ্যাসিফিকে পাঠালে এর দুর্বলতাগুলিই প্রকাশ পাবে। তবে চীনারা ব্রিটিশদের এই সিদ্ধান্তকে পছন্দ করেনি মোটেই। গত জুলাই মাসে ব্রিটেনের ‘দ্যা সানডে টাইমস’ পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে লন্ডনে চীনা রাষ্ট্রদূত লিউ শিয়াওমিং পূর্ব এশিয়াতে ব্রিটেনের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের পরিকল্পনা বাতিল করার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে, চীনকে ভয় দেখাতে এটা করা হলে তা হবে অনেক বড় ভুল। ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন বিশ্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাচ্ছে; তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পথ নয়। এছাড়াও তিনি লন্ডনকে উপদেশ দিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বিরুদ্ধে ‘দল বাঁধা’ ব্রিটেনের ঠিক হচ্ছে না।
২০০৯ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘কুইন এলিজাবেথ’এর কমিশনিং করা হয়। এরপর থেকে জাহাজটা অপারেশনে যাবার জন্যে বিভিন্ন ট্রেনিংএ অংশ নিচ্ছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মাঝেই এই ট্রেনিং অব্যাহত রাখা হয়; যা কিনা ব্রিটেনের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০২১ সালের ইন্দোপ্যাসিফিক মিশন হবে জাহাজটার জন্যে প্রথম অপারেশনাল মিশন। এটা ৬৫ হাজার টনের জাহাজ একই রকমের দু’টা জাহাজের একটা। অপর জাহাজটা হলো ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’; যা ২০২৩ সালের আগে অপারেশনাল হবে না। ২০২১ সালে ‘কুইন এলিজাবেথ’এর সাথে কোন কোন জাহাজ থাকবে, সেটা এখনই বলা না গেলেও সাধারণভাবে জাহাজটার ব্যাটল গ্রুপের মাঝে একটা ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেট, একটা ‘টাইপ ৪৫’ ডেস্ট্রয়ার, একটা সাবমেরিন এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ থাকার কথা রয়েছে বলে বলছে ‘নেভি রেকগনিশন’। তবে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ব্যাটল গ্রুপ তৈরি করা হলে সেখানে মার্কিন এবং ডাচ নৌবাহিনীর জাহাজও ছিল। অর্থাৎ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর নিরাপত্তা শুধু ব্রিটিশ জাহাজের হাতেই থাকছে না। মিশনের সময় জাহাজটা মোট ১৪টা ব্রিটিশ বিমান বাহিনী এবং মার্কিন ম্যারিন কোরের ‘এফ ৩৫’ বহণ করবে। এছাড়াও জাহাজটা ৯টা হেলিকপ্টার বহণ করবে; যার মাঝে ৬টা ‘মারলিন এইচএম২’ সাবমেরিন ধ্বংসী হেলিকপ্টার; আর ৩টা ‘ক্রোসনেস্ট’ আর্লি ওয়ার্নিং হেলিকপ্টার। এছাড়াও দরকার বিশেষে জাহাজটা স্পেশাল ফোর্সের ‘মারলিন এইচসি৪’ ও ‘ওয়াইল্ডক্যাট এএইচ১’ হেলিকপ্টার, বিমান বাহিনীর ‘শিনুক’ পরিবহণ হেলিকপ্টার এবং সেনাবাহিনীর ‘এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার বহণ করতে পারে। জাহাজটা সর্বোচ্চ ২৪টা এবং জরুরি ভিত্তিতে ৩৬টা ‘এফ ৩৫বি’ বহণ করতে সক্ষম।
১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেন সুয়েজ খালের পূর্বে তার বেশিরভাগ অঞ্চল ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের উপর তার নিরাপত্তার জন্যে নির্ভরশীল থাকলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই ব্রিটেন বিশ্বব্যাপী তার ভূমিকাকে নতুন করে দেখতে থাকে। এটাই সেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা, যার ফসল হিসেবেই ১৯৯০এর দশকের শেষে দু’টা বড় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতার চাপে ব্রিটেন এই জাহাজগুলির নিরাপত্তার জন্যে আদর্শিক দিক থেকে একই চিন্তার দেশগুলির উপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দোপ্যাসিফিকে ব্রিটেন প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না। তথাপি অপরের শক্তির উপর ভিত্তি করে প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা বিপজ্জনক হলেও ব্রিটেনের চোখে এটা শতবছরের মাঝে সবচাইতে বড় সুযোগ।
No comments:
Post a Comment