গত ২৭শে নভেম্বর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা তুরস্কের সরকারি বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে বলেন যে, তুরস্কের সাথে তার দেশের সম্পর্ক এখন সবচাইতে ভালো। দুই দেশের মাঝে বোঝাপড়া, নেতৃত্বের সমঝোতা এবং যৌথ প্রকল্পের ঝুড়ি নিয়ে খুশি হবার কারণ রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, দুই দেশের মাঝে ভালো সম্পর্ক শুধু তাদের দ্বিপাক্ষিক দিক থেকেই ভালো তা নয়; পুরো অঞ্চলের জন্যেও তা ভালো। ইউক্রেন এই সম্পর্কে তার বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে থাকবে বলে বলেন তিনি। ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের সুসম্পর্কের এই কথাগুলি এমন সময়ে আসছে, যখন বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যুতে তুরস্কের সাথে রাশিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স, মিশর, ইরান এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। মাত্র কিছুদিন আগেই ককেশাসে তুর্কি সমর্থনে নাগোর্নো কারাবাখে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজেরবাইজান একটা সামরিক জয় ঘরে তুলে নিয়েছে। এর আগে তুর্কি সমর্থনে লিবিয়ার ত্রিপোলি সরকারও জেনারেল হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এছাড়াও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান নিয়ে গ্রিসের সাথে বিরোধ এবং সিরিয়াতে তুর্কি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে রাশিয়া এবং ইরানের সাথে বিরোধ আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকে উত্তপ্ত রেখেছে। তদুপরি এই প্রতিটা ইস্যুতেই ভূমধ্যসাগরে প্রভাব বিস্তারের খেলায় ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের বিরোধ চরমে উঠেছে। লিবিয়ার ত্রিপোলি সরকারের জন্যে তুর্কি সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে ইউরোপিয় ইউনিয়নের নৌ অবরোধ নিয়েও তুরস্কের সাথে ইউরোপের বিরোধ চলছে; তুরস্কের উপরও অবরোধ আরোপের ব্যাপারে কথা চলছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?
২০১৫ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পরোশেঙ্কোর সময়ে ইউক্রেন তুরস্কের সাথে বেশ কয়েকটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১৮ সালে ৬৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ইউক্রেন তুরস্কের কাছ থেকে ৬টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন এবং ২’শ ক্ষেপণাস্ত্র ক্রয় করে। ২০১৯ সাল থেকেই ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এই ড্রোনগুলিকে নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা চালাচ্ছে। নতুন প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সস্কিও তুরস্কের সাথে গত ফেব্রুয়ারিতে এবং অক্টোবর মাসে তার তুরস্ক সফরের সময় সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। নভেম্বরে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রধান রুসলান খোমচাক ঘোষণা দেন যে, ২০২১ সালে ইউক্রেন আরও ৫টা ‘বায়রাকতার’ ড্রোন কেনার পরিকল্পনা করছে। এছাড়াও তুর্কি কোম্পানি ‘বায়কার মাকিনা’র সাথে যৌথ উদ্যোগে ইউক্রেন নিজেদের কারখানায় ৪৮টা ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন তৈরি করতে চাইছে। রুশ মিডিয়া ‘আরআইএ নভোস্তি’ বলছে যে, ককেশাসে ড্রোন ব্যবহারে আজেরিদের ব্যাপক সাফল্য ইউক্রেনের সামরিক নেতৃবৃন্দের কাছে উদাহরণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ডনবাসের রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নতুন করে ইউক্রেনের সামরিক হামলার আশঙ্কা করছে। ২রা ডিসেম্বর থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী মার্কিন ‘এমকিউ ৯’ ড্রোনের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে। কিছু রুশ মিডিয়া এও দাবি করছে যে, ইউক্রেন এবং তুরস্ক যৌথভাবে ক্রিমিয়া এবং ডনবাস পুনর্দখল করতে চাইছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় ফেহিম তেস্তেকিন প্রশ্ন করছেন যে, তুর্কি সহায়তা নিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার কাছ থেকে ডনবাস পুনর্দখল করতে পারবে কিনা। তুরস্ক সফরের সময় ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বলেন যে, তার দেশ চাইছে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ইস্যুতে তুরস্ক নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক। তেস্তেকিন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়াকে ব্যালান্স করতে ইউক্রেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন মূলতঃ ন্যাটোর কৌশল। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমদানির ব্যাপারে তুরস্ক রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চললেও রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেয়াটা তুরস্ক মেনে নিতে পারেনি কখনোই। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বই প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের সাথে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন যে, সিরিয়া এবং লিবিয়াতে রাশিয়া যেহেতু তুরস্কের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, হয়তো সেকারণেই তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে শক্তিশালী দেখতে চাইছে। তবে ককেশাসের যুদ্ধে রাশিয়া সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও ডনবাসের ব্যাপারটা আলাদা; কারণ ডনবাস রাশিয়ার সীমানার উপর অবস্থিত।
ইউক্রেনের সাথে তুর্কি সামরিক সহযোগিতা শুধু একমুখী নয়। সোভিয়েত সময় থেকে ইউক্রেন বেশকিছু প্রযুক্তির মালিক হয়েছে, যা তুর্কিরা বেশ গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে। ইঞ্জিন প্রযুক্তিতে তুরস্ক এখনও পশ্চিমা দেশগুলির উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি; যার ফলশ্রুতিতে তুরস্ক তার ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পশ্চিমা অবরোধের হুমকিতে পড়ছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় তুর্কি বিশ্লেষক ক্যান কাসাপোগলু মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তুরস্কের ‘বায়কার মাকিনা’র তৈরি নতুন বৃহদাকৃতির ড্রোন ‘আকিনচি’তে খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনে তৈরি ‘ইভচেঙ্কো প্রগ্রেস এএল ৪৫০টি’ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। অপরদিকে ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, বিমানের ইঞ্জিন ডেভেলপ এবং তৈরি করার ক্ষেত্রে দুই দেশের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সহযোগিতা দেখা যাচ্ছে। তুর্কি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সিফোর ডিফেন্স’এর বিশ্লেষক ওজগুর একসি বলছেন যে, ইউক্রেনের কাছে এমন কিছু প্রযুক্তি রয়েছে, যা তুরস্কের জন্যে জরুরি দরকার। তুরস্কের ‘গেজগিন’ ক্রুজ মিসাইলে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউক্রেনের ‘ইভচেঙ্কো প্রগ্রেস এএল ৩৫’ ইঞ্জিন। ‘গেজগিন’ হলো মার্কিন ‘টোমাহক’ ক্রুজ মিসাইলের আদলে তৈরি তুর্কি মিসাইল, যা পাল্লা হবে প্রায় ১ হাজার কিঃমিঃ।
ককেশাস এবং লিবিয়াতে তুর্কি সহায়তায় আজেরি এবং লিবিয়দের সাফল্য ইউক্রেনিয়ানদের ডনবাসে সফলতা পাবার আকাংক্ষা যুগিয়েছে। তবে ককেশাসের বাস্তবতা যেমন রাশিয়াকে নিরপেক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, তা ডনবাসের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল দেবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, ককেশাস এবং লিবিয়ার যুদ্ধ ইউক্রেনকে সহায়তা দেবার ক্ষেত্রে তুরস্ককে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। অপরদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকায় ইউক্রেন এবং তুরস্কের নিরাপত্তা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে স্থিতাবস্থায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একইসাথে ইউক্রেনের ইঞ্জিন নির্মাণ প্রযুক্তি তুরস্ককে তার কৌশলগত দুর্বলতাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা দিতে পারে। এই ব্যাপারগুলি ২০২১ সালে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হতে পারে।
No comments:
Post a Comment