Saturday 7 March 2020

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ইতালি - ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’, নাকি আদর্শিক চ্যালেঞ্জ?

৭ই মার্চ ২০২০

 
মানবাধিকার, মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো পশ্চিমা আদর্শের ভিতগুলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে করোনাভাইরাস। এগুলি পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে চ্যালেঞ্জ হলেও ইতালি হয়তো সেক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উদাহরণ হিসেবে সামনে আসছে।


৬ই মার্চ ইতালিয় কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে, ২৪ ঘন্টায় ইতালিতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইতালিতে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর থেকে এটা একদিনে মৃতের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর আগের দিন মৃত্যু হয়েছিল ২৮ জনের। এখন পর্যন্ত মোট ১’শ ৯৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে ইতালিতে; আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৬’শ জনেরও বেশি। চীনের বাইরে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইতালিতেই। ইতালি সরকার সকল স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় ১০ দিনের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর এক মাসের জন্যে সকল পেশাদার খেলা দর্শকবিহীন মাঠে অনুষ্ঠিত হবে বলে বলা হয়েছে। ‘বিবিসি’ জানাচ্ছে যে, ইতালির উত্তরের কোদোনিয়ো শহরে মৃতদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান করারও অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। ইতালির ‘ইল মেসাজেরো’ পত্রিকা বলছে যে, ঠান্ডা লাগার কারণে ৮৩ বছর বয়সী পোপ ফ্রান্সিসকেও করোনাভাইরাসের পরীক্ষার সন্মুখীন হতে হয়েছে; যদিওবা তিনি আক্রান্ত নন। তবে এর কারণে তার কর্মপরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে। ‘দ্যা সান’ পত্রিকা বিভিন্ন রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলছে যে, ইতালি সরকার চুম্বন, আলিঙ্গন এবং করমর্দনের মতো সামাজিক আচরণগুলির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার চিন্তা করছে। করোনাভাইরাসের কারণে ইতালিতে স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক জটিলতা, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, এমনকি সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধও চলে আসছে, যা কিনা পুরো দেশের, এবং একইসাথে ইউরোপের জীবনযাত্রাকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

ইতালির জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট বলছে যে, ইতালিতে মৃত ব্যক্তিদের গড় বয়স ছিল ৮১; বেশিরভাগ মানুষেরই বয়স ছিল ৬৩ থেকে ৯৫ বছরের মাঝে। সবচাইতে কম বয়সী মৃতের বয়স ছিল ৫৫ বছর; যিনি অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সরকারি হিসেব বলছে যে, আক্রান্তদের মাঝে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা কিনা বিশ্বের সকল দেশের মাঝে সর্বোচ্চ হার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতালির জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বৃদ্ধ হওয়ায় করোনাভাইরাসে মৃতের হার কমানোটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মিলানের ‘সাক্কো’ হাসপাতালের ডিরেক্টর প্রফেসর মাসিমো গাল্লি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইতালি হলো বৃদ্ধ মানুষের দেশ। অসুস্থ্য বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা এখানে খুবই বেশি। ইতালির মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি; আর সেই গড় আয়ুই এখন করোনাভাইরাসে মৃতের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তুসকানি, পুইলিয়া, সিসিলি এবং সার্দিনিয়াসহ ইতালির ২০টা অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাঝে উত্তরের লোমবার্ডিতেই বেশিরভাগ আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত হয়েছে। ইতালির বাকি অঞ্চলের আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে বেশিরভাগই গত কয়েক সপ্তাহের মাঝে লোমবার্ডি ঘুরে এসেছিলেন। তবে গাল্লি বলছেন যে, এটা নিশ্চিত নয় যে এই ভাইরাস চীন থেকেই এসেছে; অন্য কোন দেশ হয়েও ইতালিতে এই ভাইরাস ঢুকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি একজন ব্রিটিন নাগরিকের কথা বলেন, যিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফ্রান্সে গিয়ে তার পরিচিতদেরকে সংক্রমিত করেছিলেন। প্রফেসর গাল্লি আরও বলেন যে, অনেকেই ‘কোয়ার‍্যান্টিন’ বা পৃথকীকরণ করায় বেশি শক্ত পদক্ষেপ নেবার জন্যে ইতালির সমালোচনা করেছেন। উত্তরের অনেক অঞ্চলেই যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে ইতালি সরকার। তারপরেও রোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়নি। ইউরোপের খোলা সীমানাগুলিকেও চাপের মাঝে ফেলেছে করোনাভাইরাস। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ আরও বড় প্রশ্ন রেখেছে। পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের হাতে খুব কম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে কর্তন করে করোনাভাইরাসের মতো রোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব কিনা।

‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে ইতালিকে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’ বা ইউরোপের রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বলা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২০ সালে ইতালির অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলবে বলেই সকলে আশা করেছিল। ইতালি সরকারের পরিসংখ্যান দপ্তর জানুয়ারি মাসে বলেছিল যে, এবছর প্রবৃদ্ধি দশমিক ২ শতাংশের বেশি হবে না। দেশটার ব্যাংকিং খাত এখনও ব্যাপক সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে; সেখানে ব্যাবসা বাড়ানোর জন্যে ঋণ পাওয়া কঠিন। এর উপর এখন যোগ হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি উত্তরের শিল্পাঞ্চলগুলির অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। তার সাথে রয়েছে প্রিয়জনদের হারাবার বেদনা এবং অসুস্থ্যদের ব্যাপক চিকিৎসা ব্যয়। ইতালি সরকার এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যবসাগুলির জন্যে কর কমানো এবং কর প্রদানে ক্রেডিটের ব্যবস্থা করছে; আর রোগী সনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় অর্থায়ন বাড়াচ্ছে। এসব মিলিয়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দেবার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই অর্থায়ন ইতালির বাজেট ঘাটতিকে আরও চাপের মাঝে ফেলবে। বাজেট ঘাটতি কমাবার বাধ্যবাধকতা নিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে ইতালির ডানপন্থী সরকারের বিতন্ডা চলছে আরও আগ থেকেই। তবে আপাততঃ ইতালির সরকারের খরচা বৃদ্ধিকে ইইউ মেনে নিলেও সামনের দিনগুলিকে বাধা দিতে পারে। কারণ এই প্রণোদনা মানবিক নয়, বরং অর্থনৈতিক। অর্থাৎ এই প্রণোদনা ইতালির শিল্পদ্রব্যগুলিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাকি ইউরোপের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে সহায়তা দেবে। ইউরোপের বাকি দেশগুলিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু ইতালির মতো অর্থনৈতিকভাবে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’এর উপর করোনাভাইরাসের প্রভাব বাকি ইউরোপের দেশগুলির চাইতে বেশি হতে পারে।

বেশি গড় আয়ু এখন আর গর্ব করার বিষয় থাকছে না। বেশি বয়সের জনসংখ্যাই ইতালির ভাইরাস সংক্রমণকে অন্যদের থেকে বেশি ভয়াবহ করেছে। অন্যদিকে অসুস্থ্য মানুষের মানবাধিকার প্রতিযোগিতা করছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির বাজারে টিকে থাকার চাহিদার সাথে। অর্থনৈতিকভাবে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’ হবার কারণে ইতালির সরকার আর্থিক প্রণোদনা দেবার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, যারা প্রণোদনাকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপের মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চেষ্টা করবে। আবার একইসাথে ব্যাপক ‘কোয়ার‍্যান্টিন’ বা পৃথকীকরণ ছাড়াও জীবনযাত্রার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে; কারণ তা ইউরোপের মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করছে। মানবাধিকার, মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো পশ্চিমা আদর্শের ভিতগুলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে করোনাভাইরাস। এগুলি পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে চ্যালেঞ্জ হলেও ইতালি হয়তো সেক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উদাহরণ হিসেবে সামনে আসছে।

No comments:

Post a Comment