Saturday 21 March 2020

করোনাভাইরাস পশ্চিমা পুঁজিবাদকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে!

২১শে মার্চ ২০২০

 
জীবনরক্ষাকারী রিএজেন্ট, ওষুধ ও যন্ত্রের উপর মালিকানার স্বাধীনতা এবং যেকোন দ্রব্য যেকোন মুনাফায় বিক্রি করার মতো চিন্তাগুলি করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্যোগের মাঝে পশ্চিমা মানবাধিকারের চিন্তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যা কিনা পশ্চিমা সভ্যতার মূলেই আঘাত করছে।



১১ই মার্চ মার্কিন ‘ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘এফডিএ’এর কমিশনার স্টিফেন হান মার্কিন কংগ্রেসকে বলেন যে, ‘এফডিএ’ জানে যে, নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার জন্যে যেসকল কেমিক্যাল বা রিএজেন্ট দরকার, সেগুলির সরবরাহের উপর চাপ পড়েছে। মেডিক্যাল ম্যাগাজিন ‘মেডটেক ডাইভ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রিএজেন্ট সরবরাহকারী কোম্পানি ‘কিয়াজেন’ বলছে যে, তারা করোনাভাইরাসের ভীষণ চাহিদার কারণে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমসিম খাচ্ছে। মার্কিন চাহিদা বাড়ার কারণে কোম্পানিটা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যন্ডের জার্মানটাউনে তাদের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। ‘কিয়াজেন’ হলো মেডিক্যাল গবেষণার জন্যে কেমিক্যাল ও রিএজেন্ট সরবরাহকারী কোম্পানি, যাদের বাৎসরিক আয় দেড় বিলিয়ন ডলারের উপর। এর হেডকোয়ার্টার্স হলো নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে; এবং এর কর্মচারীর সংখ্যা ৫ হাজারের মতো। ‘ইয়াহু ফিনান্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ছয় মাসে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে মেডিক্যাল কোম্পানিগুলির স্টকের মূল্য যেখানে ৪ শতাংশ কমেছে, সেখানে ‘কিয়াজেন’এর শেয়ারের মূল্য বেড়েছে ১৪ শতাংশ। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক দরপতনের মাঝেও এর মূল্য বেড়েছে।

মার্কিন ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’ বা ‘সিডিসি’ করোনাভাইরাসের টেস্টিং কিটের জন্যে ছয়টা রিএজেন্টের নাম উল্লেখ করেছে, যার মাঝে ‘কিএম্প ডিএসপি’, ‘এজেড ১’ এবং ‘কিএকিউব’ তৈরি করছে ‘কিয়াজেন’। এর বাইরেও কোম্পানিটা ‘কিএসট্যাট ডিএক্স’ নামের একটা টেস্ট কিট বাজারে ছেড়েছে। ‘সিডিসি’র অনুমতিপ্রাপ্ত বাকি তিনটা রিএজেন্ট হলো ‘রোশ’ কোম্পানির ‘ম্যাগনা পিউর এলসি’, ‘ম্যাগনা পিউর কমপ্যাক্ট’ এবং ‘ম্যাগনা পিউর ৯৬’। ব্যাবসায়িক ম্যাগাজিন ‘ইনভেস্টর্স বিজনেস ডেইলি’ এক প্রতিবেদনে বলছে যে, মার্কিন ‘এফডিএ’এর কাছ থেকে করোনাভাইরাসের টেস্টিংএর জন্যে পণ্য সরবরাহের অনুমতি পাবার পর ১৩ই মার্চ ‘রোশ’এর শেয়ারের মূল্য এক দিনেই ১৩ শতাংশ বেড়ে যায়। ‘রোশ’ বা ‘ফ্রিতস হফম্যান লা রোশ’ ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটা বহুজাতিক মেডিক্যাল কোম্পানি, যার হেডকোয়ার্টার্স হলো সুইজারল্যান্ডে। এর বাৎসরিক আয় প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মচারীর সংখ্যা ৯৪ হাজারের উপর। অন্যদিকে এই রিএজেন্টগুলি মার্কিন বাজারে সরবরাহের অনুমতি পেয়েছে ‘ইনটেগ্রেটেড ডিএনএ টেকনলজিস’ এবং ‘বায়োরিসার্চ টেকনলজিস’ নামের দু’টা মাত্র কোম্পানি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংস্থা ‘দ্যা ইন্টারসেপ্ট’ বলছে যে, করোনাভাইরাসের আতঙ্ক শুরুর পর থেকে প্রভাবশালী ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কগুলি মেডিক্যাল কোম্পানিগুলির উপর করোনাভাইরাসের ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির জন্যে চাপ দিচ্ছে। এমনই একটা কোম্পানি হলো ‘গিলিয়াড সাইন্সেস’। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত এই বায়োটেকনলজি কোম্পানির বাৎসরিক আয় ২২ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মচারী ১১ হাজারের মতো। ‘গিলিয়াড’এর ডেভেলপ করা ‘রেমডেসিভির’ নামক এন্টিভাইরাল ড্রাগ ‘ডেঙ্গু’, ‘ওয়েস্ট নাইল’ ভাইরাস, ‘জিকা’ ভাইরাস, ‘মার্স’ ভাইরাস এবং ‘সার্স’ ভাইরাসের চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথায়, এই ‘রেমডেসিভির’ই হলো একমাত্র ওষুধ যেটা করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা গেলে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই কথা বলার সাথেসাথেই গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ‘গিলিয়াড’এর শেয়ারের মূল্য এক দিনে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ২০১৮ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ মূল্যে পৌঁছায়। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ‘গিলিয়াড’এর বাজারমূল্য ১২ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়। ‘ব্যাংক অব আমেরিকা’র বিশ্লেষকদের মতে, ‘রেমডেসিভির’ বিক্রি করে কোম্পানিটার এককালীন আড়াই বিলিয়ন ডলার আয় আসতে পারে।
  
 
ইতালির এক তরুন ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ্চিয়ান ফ্রাকাসি হাসপাতালে ‘ভেনচুরি’ ভালভ নামে পরিচিত একটা যন্ত্রের অপ্রতুলতার কথা শুনে ‘থ্রিডি প্রিন্টার’এর সাহায্যে যন্ত্রটার ১’শটা কপি করার ব্যবস্থা করেন। এই যন্ত্রের প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘ইন্টারসার্জিক্যাল’এর কাছ থেকে যন্ত্রটার ব্লুপ্রিন্ট চাওয়া হলে তারা তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে যে, এই যন্ত্রের স্বত্ব শুধুমাত্র তাদের কোম্পানির এবং অন্য কারুর এই যন্ত্র কপি করাটা বেআইনী। কোম্পানিটা এমন এক সময়ে তার যন্ত্রের ডিজাইন দিতে অস্বীকৃতি জানালো, যখন বাস্থ্যসেবা, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার মাঝে সর্বোচ্চ কত বয়স পর্যন্ত রুগীকে চিকিৎসা দেয়া হবে, সেব্যাপারেও ডাক্তারদের চিন্তা করতে বলা হয়েছে।




অন্যদিকে বিপুল সখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে অক্সিজেন দেবার জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতালির এক তরুন ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ্চিয়ান ফ্রাকাসি এবং তার সহযোগী আলেসান্দ্রো রোমাইওলি ইতালির উত্তরে মিলানের কাছাকাছি চিয়ারি শহরের এক হাসপাতালে ‘ভেনচুরি’ ভালভ নামে পরিচিত একটা যন্ত্রের অপ্রতুলতার কথা শুনে ‘থ্রিডি প্রিন্টার’এর সাহায্যে যন্ত্রটার ১’শটা কপি করার ব্যবস্থা করেন; আর এই কাজের জন্যে খরচ হয় নামমাত্র; যেখানে এই যন্ত্রের অরিজিনাল ভার্সনের মূল্য কয়েক হাজার ডলার। হাসপাতালের ডাক্তাররা বলছেন যে, কপি করা মূল্যহীন এই যন্ত্র মুমুর্ষু রোগীর জন্যে অমূল্য সেবা দিচ্ছে। এই যন্ত্রের প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘ইন্টারসার্জিক্যাল’এর কাছ থেকে যন্ত্রটার ব্লুপ্রিন্ট চাওয়া হলে তারা তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে যে, এই যন্ত্রের স্বত্ব শুধুমাত্র তাদের কোম্পানির এবং অন্য কারুর এই যন্ত্র কপি করাটা বেআইনী। ১৯৮২ সালে স্থাপিত হওয়া ‘ইন্টারসার্জিক্যাল’এর হেডকোয়ার্টার্স হলো ব্রিটেনে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রুগীদের জন্যে কোম্পানিটা বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে থাকে। বর্তমানে এর কর্মচারী ৩ হাজারের বেশি। কোম্পানিটা এমন এক সময়ে তার যন্ত্রের ডিজাইন দিতে অস্বীকৃতি জানালো, যখন ইতালির কলেজ ‘এসআইএএআরটি’ স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার মাঝে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি, শুধু তাদেরকেই চিকিৎসা দেবার জন্যে গাইডলাইন দিয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ কত বয়স পর্যন্ত রুগীকে চিকিৎসা দেয়া হবে, সেব্যাপারেও ডাক্তারদের চিন্তা করতে বলেছে।

রিএজেন্ট, ওষুধ বা যন্ত্রপাতি ছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সকলকিছুরই মারাত্মক স্বল্পতা চলছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চলছে ব্যবসা এবং মুনাফার দৌরাত্ম। সামরিক পত্রিকা ‘এয়ারফোর্স টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মার্কিন বিমান বাহিনীর এক প্রাক্তন সদস্য ১৭ হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেন। তারই মতো আরেকজন সাড়ে ৩ ডলার দামে ২ হাজার জীবনরক্ষাকারী কিট নিনে ৪০ ডলার করে বিক্রি করেছেন। ‘এনবিসি নিউজ’ আড়াই’শ মেডিক্যাল কর্মীর উপর করা এক গবেষণার ফলাফলের বরাত দিয়ে বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে বহু মেডিক্যাল কর্মী কোন মাস্ক বা জীবাণুনাশক ছাড়াই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’ এখন মারাত্মক স্বল্পতায় রয়েছে। চাকুরি হারাবার ভয়ে নিজের নাম পরিচয় গোপন করা মিশিগানের এক নার্স বলছেন যে, তার মনে হয় না যে তাদের হাসপাতাল তাদের ব্যর্থতার কারণ; বরং পুরো ব্যবস্থাটাই এখন ব্যর্থ! মিশিগানের নার্সের মন্তব্য পুঁজিবাদের গোড়ার সমস্যাকেই তুলে ধরে। জীবনরক্ষাকারী রিএজেন্ট, ওষুধ ও যন্ত্রের উপর মালিকানার স্বাধীনতা এবং যেকোন দ্রব্য যেকোন মুনাফায় বিক্রি করার মতো চিন্তাগুলি করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্যোগের মাঝে পশ্চিমা মানবাধিকারের চিন্তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যা কিনা পশ্চিমা সভ্যতার মূলেই আঘাত করছে।

No comments:

Post a Comment