Sunday 29 March 2020

করোনাভাইরাস পশ্চিমা সমাজের বৈষম্যকে কমাবে নাকি বাড়াবে?

২৯শে মার্চ ২০২০

   
করোনা ঝড়ের আগেই পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের উপেক্ষা করেছিল; এখন সেই বৈষম্যের ফলাফলই চোখে পড়ছে।

 
ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ব্রিটেনের অর্থনৈতিকভাবে সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল হতে ৯ বছর কম! ব্রিটেনের উচ্চবিত্ত এলাকাগুলি থেকে যাত্রা করে নিম্নবিত্ত এলাকার দিকে যেতে থাকলেই গড় আয়ুষ্কাল এক বছর করে কমতে থাকে। খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে হৃদরোগে মৃত্যুর হার উচ্চবিত্তদের চাইতে তিনগুণ বেশি। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট এবং বক্ষব্যাধিও নিম্নবিত্তদের মাঝে অনেক বেশি। পেনসনে থাকা ১৯ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে। করোনাভাইরাস এখন এই বৈষম্যের বাস্তবতার সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। উবার ড্রাইভার, ডেলিভারি সার্ভিসে থাকা মানুষগুলি, বিভিন্ন কারখানার কর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মীদের মতো কম আয়ের মানুষগুলি একাধারে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকিতে যেমন পড়ছে, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও দুর্যোগের মাঝে পতিত হতে যাচ্ছে।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মানুষ ব্যাপক মুনাফা করে নিজেদের পকেট ভরেছে; অন্যদিকে নিজেদের অর্থনৈতিক ঝুঁকিগুলিকে জনগণের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্কগুলিকে জনগণের করের অর্থে বাঁচানো হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে ব্যাঙ্কগুলি ক্ষতি থেকে তো বের হয়েছেই; তাদের মুনাফা হয়েছে আকাশচুম্বী। অথচ পুরো সমস্যার কেন্দ্রেই ছিল ব্যাঙ্কগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন ঋণ ব্যবসা এবং জনগণের লগ্নীকৃত অর্থকে ব্যবহার করে জুয়া খেলা। অন্যদিকে বেশিরভাগ খেটে খাওয়া করপ্রদানকারী নাগরিকের জীবনে বিন্দুমাত্র উন্নতি আসেনি। অনেকেরই বাড়িঘর কেড়ে নেয়া হয়েছে। কম বেতনভোগী মানুষের অবস্থা সবচাইতে খারাপ হয়েছিল। এবারেও মানুষের অবস্থা খারাপের দিকে চলেছে; তবে এর গতি অনেক বেশি দ্রুত। ‘গোল্ডমান সাক্স’এর হিসেবে এপ্রিল থেকে জুনের মাঝে মার্কিন অর্থনীতি ২৪ শতাংশ কমতে পারে। আর ‘মরগ্যান স্ট্যানলি’ বলছে যে, এটা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।

মার্কিন সরকারের অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজে ভাগ বসাবার জন্যে বিভিন্ন কারখানার মালিক গ্রুপ, বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘বোয়িং’, এয়ারলাইন্স, রেস্টুর‍্যান্ট, হোটেল চেইন, ট্রাভেল অপারেটর, কয়লা খনির মালিক, মদ উৎপাদক কোম্পানি, ইত্যাদি বাণিজ্য গ্রুপগুলি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার এবং শীর্ষ এক্সিকিউটিভরাই বরাবর সুবিধা পেয়েছে; উৎপাদন বৃদ্ধি বা গবেষণালব্ধ কাজে বিনিয়োগ হয়নি। এছাড়াও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি মানুষ চিকিৎসা ভাতা পায় না। লক্ষ লক্ষ নাগরিকের জন্যে চিকিৎসা সেবা সুলভ নয়। ‘মায়ামি হেরাল্ড’এর ফেব্রুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন ফেরত এক আমেরিকান ফ্লুএর লক্ষণ দেখা যাবার পর একজন দায়িত্ববান নাগরিকের মতো ফ্লোরিডার হাসপাতালে যান করোনাভাইরাসের টেস্ট করাতে। টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসলেও কয়েক সপ্তাহ পর তার কাছে ৩ হাজার ২’শ ৭০ ডলারের একটা মেডিক্যাল বিল চলে আসে। তার ইন্সুর‍্যান্স কোম্পানি বলছে যে, তিনি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪’শ ডলার ইন্সুর‍্যান্স বাবদ পেতে পারেন; বাকিটা তার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, তার হেলথ ইন্সুর‍্যান্স রয়েছে; অনেকের আবার সেটাও নেই। ‘ইউনাইটেড স্টেটস সেনসাস ব্যুরো’র ২০১৮ সালের হিসেবে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষ, বা যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৮ শতাংশ জনগণের হেলথ ইন্সুর‍্যান্সই নেই। এটা ২০১৭ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ বা ২ কোটি ৫৬ লক্ষ; অর্থাৎ এক বছরের মাঝেই ১৯ লক্ষ মানুষ হেলথ ইন্সুর‍্যান্স থেকে ঝরে পড়েছে। এর পুরোটাই হয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগেই। ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’এর এক সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ইন্সুর‍্যান্সএর মাঝে থাকা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম ইন্সুর‍্যান্স পেয়ে থাকে। মেডিক্যাল খরচার অনেকটাই তাদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়।

উপরন্তু, মার্কিন সেক্রেটারি অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসেস এলেক্স আজার বলছেন যে, করোনাভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন বের হলেও সেটার সুবিধা সকলে পাবে, এই নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারছেন না। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্যালাপ’এর ২০১৯ সালের এক জরিপে বলা হচ্ছে যে, জরিপে অংশ নেয়া জনগণের ১৩ শতাংশ বলছেন যে, গত ৫ বছরের মাঝে তাদের পরিচিত কেউ না কেউ অর্থের অভাবে চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মাঝে শ্বেতাঙ্গ মানুষের মাঝে এই হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ; আর অশ্বেতাঙ্গদের মাঝে তা ছিল ২০ শতাংশের বেশি; অর্থাৎ দ্বিগুণ! বার্ষিক ১ লক্ষ ডলারের বেশি আয়ের মানুষের মাঝে এই হার ছিল ৯ শতাংশ; আর ৪০ হাজার ডলারের কম আয়ের মানুষের মাঝে ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ; অর্থাৎ দ্বিগুণ!

‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ফেইসবুক, গুগল ও টুইটারএর মতো কোম্পানিগুলি নিজেদের কর্মচারীদেরকে বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে। কিন্তু হোটেল ও রেস্টুর‍্যান্টে ওয়েটারের কাজ বা সুপারস্টোরে সেলসম্যানের কাজ বা বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার কাজ তো আর বাড়িতে বসে করা যাবে না। কলেজ পাস উচ্চশিক্ষিত মানুষের অনেকেই বাড়ি থেকে কম্পিউটারে কাজ করতে পারছে; অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত মানুষের অনেকেই কাজের অভাবে বাড়িতে বসে দিন কাটাচ্ছে। সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা মানুষগুলির অনেকের জন্যেই মানুষের সংস্পর্শে আসাটা বাঞ্ছনীয়। আর করোনাভাইরাসের কারণে এই মানুষগুলি রোগের শিকারও হচ্ছে বেশি; আবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে এরাই উপার্জন ছাড়া বাড়িতে বসে থাকছে। শুধু তা-ই নয়, ‘দ্যা আটলান্টিক’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, কম আয়ের জনগণ বাস করছে গাদাগাদি করে; যার ফলে তাদের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকছে।

করোনাভাইরাস পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যকে সরাসরি আঘাত করেছে। এর ফলশ্রুতিতে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলি, যাদের হেলথ ইন্সুর‍্যান্স নেই বা থাকলেও তা অপ্রতুল। উচ্চবিত্ত এবং উচ্চশিক্ষিত জনগণের মাঝে অনেকেই বাড়িতে থেকে কাজ করে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলি আশাহীন হয়ে পড়েছে। তাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বড় বড় কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার এবং এক্সিকিউটিভদের সাথে। করোনা ঝড়ের আগেই পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের উপেক্ষা করেছিল; এখন সেই বৈষম্যের ফলাফলই চোখে পড়ছে।


1 comment: