Wednesday, 23 October 2024

চাগোস দ্বীপপুঞ্জ এবং ফকল্যান্ডস – ব্রিটেন-আমেরিকার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এখন সর্বসন্মুখে

২৩শে অক্টোবর ২০২৪

নভেম্বর ২০০১; দিয়েগো গার্সিয়া, ভারত মহাসাগর। মার্কিন 'বি-১' বোমারু বিমানগুলি এখান থেকে উড়ে আফগানিস্তানে বোমা ফেলছে। মার্কিনীরা অফিশিয়ালি এই দ্বীপকে বলে 'ফুটপ্রিন্ট অব ফ্রিডম'। মার্কিন বিমান বাহিনীর ম্যাগাজিনের এক লেখায় উল্লেখ করা হয় যে, আফগানিস্তানে 'ফ্রিডম' আনতে মার্কিন 'বি-২' বোমারু বিমানগুলি কিভাবে এই ঘাঁটির সহায়তা নিয়েছিল। আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিংএর জন্যে ট্যাঙ্কার বিমানগুলি এই ঘাঁটি থেকেই অপারেট করেছে। এছাড়াও পরবর্তীতে 'বি-৫২', ‘বি-১' এবং 'বি-২' বোমারু বিমানগুলি এই ঘাঁটি থেকে অপারেট করে আফগানিস্তান, ইরাক এবং অন্যান্য দেশের উপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। 


চাগোস দ্বীপপুঞ্জ – ভারত মহাসাগরে ব্রিটেন

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় হঠাৎ করেই ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত চাগোস দ্বীপপুঞ্জকে ব্রিটিশরা মরিশাসের হাতে তুলে দেয়। প্রায় দুই বছর ধরে চলা আলোচনার ফলাফল হিসেবে 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশান টেরিটোরি' হিসেবে পরিচিত ৫০টারও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জ এখন থেকে মরিশাসের অধীনে থাকবে। ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, গত ৩রা অক্টোবর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রাভিন্দ যুগনথএর মাঝে আলোচনার পর চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের হাতে তুলে দেয়ার যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়। একইসাথে সেখানে বলা হয় যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ ব্রিটেনের কাছে ৯৯ বছরের জন্যে লীজ দেয়া হয়েছে। এই চুক্তির পিছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সমর্থন রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে যে ব্যাপারটা সবচাইতে বেশি আলোচনায় আসছে, তা হলো দিয়েগো গার্সিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।

ব্রিটিশ কনজারভেটিভ রাজনৈতিক দল লেবার সরকারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা করলেও কেউই ভুলে যাননি যে, ২০২২ সালে কনজারভেটিভরা ক্ষমতায় থাকার সময়েই চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা হয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে দুই রাজনৈতিক দলই একই লক্ষ্যে এগিয়েছে; যদিও তারা এখন রাজনৈতিক স্বার্থে একে অপরকে দোষারোপ করছে। তবে মার্কিন রিপাবলিকান দলের অনেকেই আবার ব্রিটেনের এই চুক্তির ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। রক্ষণশীল মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'হাডসন ইন্সটিটিউট'এর সিনিয়ন ফেলো লিউক কফি 'পলিটিকো'কে বলছেন যে, এই চুক্তি নিঃসন্দেহে চীনকে সহায়তা করবে। তিনি বলছেন যে, ৯৯ বছরের লীজের মাঝে চিন্তাকে বেঁধে ফেললে হবে না। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন হংকংকে ছেড়ে দেয়ার পর এর ফলাফল কেমন ছিল সেটা দেখতে হবে। এটা লেবার সরকারের একটা বড় ভুল। যারা জিবরালটার এবং ফকল্যান্ডসকে ব্রিটেনের সাথে রাখার পক্ষপাতি, তারা যথেষ্টই চিন্তিত হবেন। 'দ্যা টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন কর্মকর্তারা লেবার সরকারকে সতর্ক করেছিল যে, দিয়েগো গার্সিয়া মরিশাসের হাতে ছেড়ে দিলে চীনারা এর আশেপাশের দ্বীপগুলিতে 'লিসেনিং পোস্ট' বা আঁড়ি পাতার যন্ত্রপাতি স্থাপনের চেষ্টা করতে পারে।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র এক লেখায় জ্যাক ওয়াটলিং ব্রিটিশ সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন যে, এতে একদিকে যেমন ভারত মহাসাগরে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্বার্থ সমস্যায় পড়তে পারে, তেমনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিবরালটার ও ফকল্যান্ডস নিয়েও একই রকমের দাবি উঠতে পারে। তিনি বলছেন যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব ছেড়ে দেয়ার ফলে দিয়েগো গার্সিয়ার আশেপাশের দ্বীপগুলিতে ব্রিটেনের আইনী অধিকার থাকবে না। এমতাবস্থায় এই দ্বীপগুলিকে মরিশাসের সরকার যদি অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চায়, তখন সমস্যা তৈরি হতে পারে। কারণ মরিশাসে মূল বিনিয়োগকারী সর্বদাই চীন। এছাড়াও এই দ্বীপগুলির আশেপাশের সমুদ্রে চীনা মাছ ধরার জাহাজের উপরেও ব্রিটিশদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আর এসকল মাছ ধরা জাহাজ যে চীনা নৌবাহিনীর জন্যে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহের কাজ করে, তা মোটামুটি সকলেরই জানা।
 
দিয়েগো গার্সিয়াতে রয়েছে '২১তম স্পেস অপারেশস স্কোয়াড্রন'; যা মূলতঃ স্যাটেলাইট 'ট্র্যাকিং স্টেশন', যার মাধ্যমে আকাশে সকল মার্কিন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা সারা বিশ্বে এরকম ৭টা মার্কিন স্থাপনার একটা। এছাড়াও '২০তম স্পেস কন্ট্রোল স্কোয়াড্রন' যার অধীনে রয়েছে 'গ্রাউন্ড বেজড ইলেকট্রো অপটিক্যাল ডীপ স্পেস সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম'; যা মূলতঃ শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে আকাশে সকল স্যাটেলাইটের উপর নজর রাখে। এটা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এরকম মাত্র তিনটা স্থাপনার একটা। এগুলি বলে দিচ্ছে যে, মার্কিনীদের মহাকাশ নিরাপত্তার জন্যে এই ঘাঁটির গুরুত্ব কতটুকু।


দিয়েগো গার্সিয়া - ‘ফুটপ্রিন্ট অব ফ্রিডম'

১৯৬৭ সালে মার্কিনীরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ৫০ বছরের জন্যে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ লীজ নেয়। 'বিবিসি' বলছে যে, ব্রিটিশরা এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জোরপূর্বক মরিশাস এবং সেইশেলে পাঠিয়ে দেয়। মূলতঃ ভারত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় এবং দ্বীপে স্বল্পসংখ্যক লোকের বাস থাকায় মার্কিনীরা এই দ্বীপের ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছিলো। এর জন্যে মার্কিনীরা ব্রিটিশদের কাছে 'পোলারিস' পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার সময় ১৪ মিলিয়ন ডলারের ডিসকাউন্টও দিয়েছিল। দ্বীপের আশেপাশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ব্রিটিশদের; যদিও ঘাঁটির নিরাপত্তার জন্যে মার্কিনীরা রয়েছে।

দ্বীপটার আকৃতি অনেকটা পায়ের ছাপের মতো হওয়ায় একে 'ফুটপ্রিন্ট' হিসেবেও ডাকেন অনেকে। তবে মার্কিনীরা অফিশিয়ালি এই দ্বীপকে বলে 'ফুটপ্রিন্ট অব ফ্রিডম'। মার্কিন বিমান বাহিনীর ম্যাগাজিনের এক লেখায় উল্লেখ করা হয় যে, আফগানিস্তানে 'ফ্রিডম' আনতে মার্কিন 'বি-২' বোমারু বিমানগুলি কিভাবে এই ঘাঁটির সহায়তা নিয়েছিল। আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিংএর জন্যে ট্যাঙ্কার বিমানগুলি এই ঘাঁটি থেকেই অপারেট করেছে। এছাড়াও পরবর্তীতে 'বি-৫২', ‘বি-১' এবং 'বি-২' বোমারু বিমানগুলি এই ঘাঁটি থেকে অপারেট করে আফগানিস্তান, ইরাক এবং অন্যান্য দেশের উপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। এই ঘাঁটিতে মার্কিন নৌবাহিনীর কয়েকটা পরিবহণ জাহাজ যুদ্ধ সরঞ্জাম (যেমন ট্যাংক, আর্মার্ড ভেহিকল, আর্টিলারি) এবং রসদসহ সর্বদা অবস্থান করে; যাতে করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যেকোন প্রয়োজনে তারা অতি দ্রুত সামরিক মিশন শুরু করতে পারে। এছাড়াও এই দ্বীপে রয়েছে মার্কিন স্পেস কমান্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। স্পেস কমান্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এখানে রয়েছে '২০তম স্পেস কন্ট্রোল স্কোয়াড্রন' যার অধীনে রয়েছে 'গ্রাউন্ড বেজড ইলেকট্রো অপটিক্যাল ডীপ স্পেস সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম'; যা মূলতঃ শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে আকাশে সকল স্যাটেলাইটের উপর নজর রাখে। এটা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এরকম মাত্র তিনটা স্থাপনার একটা। এছাড়াও রয়েছে '২১তম স্পেস অপারেশস স্কোয়াড্রন'; যা মূলতঃ স্যাটেলাইট 'ট্র্যাকিং স্টেশন', যার মাধ্যমে আকাশে সকল মার্কিন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা সারা বিশ্বে এরকম ৭টা মার্কিন স্থাপনার একটা। এগুলি বলে দিচ্ছে যে, মার্কিনীদের মহাকাশ নিরাপত্তার জন্যে এই ঘাঁটির গুরুত্ব কতটুকু।

এতকাল মার্কিনীরা দিয়েগো গার্সিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল না; কারণ ব্রিটিশরা চাগোস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে এবং আশেপাশের দেশেগুলির সাথে কূটনৈতিক এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংএর মাধ্যমে মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এখন চীনের সাথে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাস্তবতায় এবং তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধের শংকার মাঝে মার্কিনীরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেছে যে, তাদের দিয়েগো গার্সিয়ার ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যাপারে ব্রিটিশদের সাথে নতুন করে দরকষাকষিতে যেতে হবে।

 
দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে। কয়েকজন শ্রীলঙ্কান তামিলের অভিবাসন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কয়েক মাস চেষ্টার পর 'বিবিসি', বিচারক এবং আইনজীবিরা দিয়েগো গার্সিয়াতে যাবার সুযোগ পান। কিন্তু মার্কিনীরা শেষ পর্যন্ত ভিজিটরদের খানাদান এবং থাকার জায়গা দেয়ার বিরোধিতা করেছিলো। ভিজিটরদের সকলকে ভীষণরকম নিয়ন্ত্রণ মেনে সেই দ্বীপে যেতে হয় এবং সামরিক এসকর্ট ছাড়া এক মুহুর্ত চলতে দেয়া হয়নি। এমনকি 'বিবিসি' এই শর্তে সেখানে যেতে পারে যে, মার্কিনীরা কি কি ব্যাপারে ভিজিটরদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, সেগুলি যেনো উল্লেখ করা না হয়! এই দ্বীপে কোন বাণিজ্যিক ফ্লাইট নেই; কোন বেসামরিক জাহাজেরও এই দ্বীপের কাছাকাছি যাবার অনুমতি নেই।

চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের কাছে দিয়ে দেয়ার ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত মার্কিনীদের পছন্দ হবার কথা নয়; যদিও ওয়াশিংটনের অফিশিয়াল বার্তায় এর সমর্থনেই কথা বলা হয়েছে। অন্ততঃ মার্কিনীদের এত কাছের বন্ধুর সাথে কোনরূপ দ্বন্দ্বের খবর সামনে আসুক, সেটা কেউই চায় না। তবে 'নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে' এই দ্বন্দ্ব যে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা দুনিয়ার অপর প্রান্তে দক্ষিণ আমেরিকায় ভূরাজনৈতিক খেলায় দৃশ্যমান।
 
এপ্রিল ২০২৪; উশুআয়িয়া, আর্জেন্টিনা। দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল লরা রিচার্ডসন ম্যাজেলান প্রণালিতে অবস্থিত আর্জেন্টিনার সর্বদক্ষিণের শহর উশুআয়িয়াতে যান; যেখানে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মিলেই নিজে তাকে বরণ করেন। মিলেই ঘোষণা দেন যে, উশুআয়িয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হবে। এটা যে মার্কিন ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের অংশ, তা কারুরই বুঝতে বাকি ছিল না। কারণ গত মার্চে জেনারেল রিচার্ডসন মার্কিন সিনেটের জন্যে তৈরি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, তার অধীনে 'সাউদার্ন কমান্ড'এর একটা প্রধান লক্ষ্য হলো ল্যাটিন আমেরিকাতে চীন ও রাশিয়ার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা।


ম্যাজেলান প্রণালির উপর কর্তৃত্ব চায় যুক্তরাষ্ট্র

২০২৩এর ডিসেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনাতে সরকার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উগ্র লিবারাল অর্থনীতিবিদ জেভিয়ার মিলেই প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে দুই দশকের অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে তিনি 'শক থেরাপি' বাস্তবায়ন করছেন বলে বলেছেন। যার প্রতিবাদে মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে অনেকেই রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। ক্ষমতায় এসেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে 'নিঃশর্ত বন্ধুত্বে'র ঘোষণা দেন এবং ইউক্রেন ও ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই আর্জেন্টিনার 'ব্রিকস' জোটের বৈঠকে যোগদান বন্ধ করার ঘোষণা দেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, গত এক'শ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক লিবারালিজম ও অর্থনৈতিক ক্যাপিটালিজমে মিল থাকা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনার সরকারগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব রেখে চলেছে। গত এপ্রিল মাস থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় সর্বোচ্চ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল লরা রিচার্ডসন তিনবার আর্জেন্টিনা সফর করেছেন। এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র আর্জেন্টিনাকে একটা 'সি-১৩০এইচ' পরিবহণ বিমান অনুদান হিসেবে দেয়; যা ম্যাজেলান প্রণালি এবং এন্টার্কটিকায় আর্জেন্টিনার সামরিক উপস্থিতিতে সহায়তা করবে বলে বলা হয়। এছাড়াও জুলাই মাসে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মার্কিন 'সাউদার্ন কমান্ড'এর হেডকোয়ার্টার্স ভিজিটে যান। এর মাঝে এপ্রিল মাসে জেনারেল রিচার্ডসন ম্যাজেলান প্রণালিতে অবস্থিত আর্জেন্টিনার সর্বদক্ষিণের শহর উশুআয়িয়াতে যান; যেখানে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মিলেই নিজে তাকে বরণ করেন। মিলেই ঘোষণা দেন যে, উশুআয়িয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হবে। এটা যে মার্কিন ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের অংশ, তা কারুরই বুঝতে বাকি ছিল না। কারণ গত মার্চে জেনারেল রিচার্ডসন মার্কিন সিনেটের জন্যে তৈরি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, তার অধীনে 'সাউদার্ন কমান্ড'এর একটা প্রধান লক্ষ্য হলো ল্যাটিন আমেরিকাতে চীন ও রাশিয়ার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা।

স্প্যানিশ পত্রিকা 'এল পাইস'এর এক লেখায় আর্জেন্টিনার সাংবাদিক কার্লোস পাগনি বলছেন যে, ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের চীন-বিরোধী নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখানে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সমুদ্র বাণিজ্যের পথ। ২০১৬ সালে পানামা খালের সম্প্রসারণ করার পর সেখান দিয়ে বছরে ১৪ হাজার জাহাজ যাচ্ছে; যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৬ শতাংশ। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ সবচাইতে বেশি হলেও চীনের পণ্যবাহী জাহাজ ১৩ শতাংশ। যদি তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন সংঘাত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে পানামা খাল দিয়ে চীনা জাহাজ যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তখন চীনা জাহাজগুলি বাধ্য হবে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণে ম্যাজেলান প্রণালি হয়ে যেতে। একারণেই যুক্তরাষ্ট্র চাইছে চীনারা যাতে সর্বদক্ষিণের এই অঞ্চলে তাদের জাহাজগুলিকে সাপ্লাই এবং মেরামতের জন্যে লজিস্টিকস ঘাঁটি তৈরি করতে না পারে। প্রেসিডেন্ট মিলেই মার্কিন জেনারেলকে সরাসরিই বলেছেন যে, আর্জেন্টিনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই চীনারা এন্টার্কটিকায় তাদের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। এছাড়াও আর্জেন্টিনার নিউকুয়েন রাজ্যে আন্দিজ পর্বতমালায় পাতাগোনিয়া মরুভূমিতে চীনারা একটা মহাকাশ গবেষণাগার করেছে। মার্কিন সিনেটের সামনে জেনারেল রিচার্ডসন বলেছেন যে, চীনারা এই গবেষণাগারের মাধ্যমে মহাকাশে সকল স্যাটেলাইটের উপর নজর রাখছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে চীনারা মার্কিন সামরিক স্যাটেলাইটের উপর হামলা করতে পারে। মার্কিন দুশ্চিন্তার উপর ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট মিলেই চীনা গবেষণাগারে আর্জেন্টিনার পরিদর্শক পাঠিয়েছেন। কার্লোস পাগনি বলছেন যে, চীনারা মার্কিন স্বার্থের পক্ষে আর্জেন্টিনার এই পদক্ষেপগুলি কিভাবে দেখবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে তারা যদি আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাথে চীনের মুদ্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ রয়েছে, সেটা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মারাত্মক সমস্যা পড়ে যাবে।
 
মার্কিন 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ দূরে ব্রিটেনের ফকল্যান্ডসের বিরুদ্ধে বাস্তব কোন হুমকি তৈরি না করলেও তা ম্যাজেলান প্রণালির উপর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নের মাঝে ফেলবে। একইসাথে আর্জেন্টিনার উগ্র লিবারাল প্রেসিডেন্টের নীতি ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ প্রভাবে থাকা প্রতিবেশী দেশ চিলি এবং 'ব্রিকস'এর সদস্যদেশ ব্রাজিলের সাথে উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। নতুন বাস্তবতায় মার্কিনীদের কাছে 'নিরপেক্ষ' বলে কোন কিছুই থাকছে না; যা মূলতঃ বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ প্রভাবকেই চ্যালেঞ্জ করছে। 


মার্কিন 'এফ-১৬' বনাম ব্রিটিশ ফকল্যান্ডস

ক্ষমতা নেয়ার পাঁচ মাসের মাঝে গত এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মিলেইএর সরকার পাকিস্তানের কাছ থেকে 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে ডেনমার্কের সাথে ২৪টা পুরোনো 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান কেনার জন্যে চুক্তি করে। আর্জেন্টাইন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে 'রয়টার্স' বলছে যে, এই চুক্তির মূল্য প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। 'ডিফেন্স নিউজ' বলছে যে, পাকিস্তানের কাছ থেকে চীন-পাকিস্তানে নির্মিত 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান ক্রয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবার আশংকা করেছিলেন অনেকেই। তবে অনেকেই আর্জেন্টিনার 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সাথে ব্রিটেনের কাছ থেকে ফকল্যান্ডস পুনরুদ্ধারের বিষয়টাকে একত্রে দেখছেন। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মিলেই ক্ষমতায় এসেই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বলেন যে, এই দ্বীপগুলির উপর আর্জেন্টিনা তার দাবি কখনোই ছাড়বে না। ভারত মহাসাগরে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ মরিশাসের কাছে যাবার পর আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডায়ানা মনডিনো সোশাল মিডিয়া 'এক্স'এ লেখেন যে, নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে আর্জেন্টিনা মালভিয়ানস (ফকল্যান্ডস) দ্বীপপুঞ্জকে পুনরুদ্ধার করবে। আর্জেন্টিনায় মার্কিন দূতাবাসের গত ১৮ই এপ্রিলের এক বার্তায় বলা হচ্ছে যে, ২০০৩ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আর্জেন্টিনাকে ৪০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক অনুদান দিচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, ডেনমার্কের কাছ থেকে ২৪টা 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান কেনার মাধ্যমে দেশটা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এই যুদ্ধবিমানগুলির মাধ্যমে আর্জেন্টিনার প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হবে বলে আশা করে দূতাবাস।

‘দ্যা টেলিগ্রাফ' পত্রিকার এক লেখায় 'ইউকে ডিফেন্স জার্নাল'এর সম্পাদক জর্জ এলিসন বলছেন যে, ব্রিটেনের ভয় আর্জেন্টিনা নয়; বরং আসল ভয় হলো ব্রিটেনের নিজেদের সামরিক শক্তির অবক্ষয়। বিশেষ করে ২০১০ সালের পর থেকে ব্রিটিশ রয়াল নেভির যে ক্ষতি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ে পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা যথেষ্ট নয়। একটা শক্তিশালী ম্যারিটাইম শক্তি না থাকলে সেটাকে ব্রিটেনই বলা যাবে না। বেশিরভাগ মানুষ ঠিকই ধরতে পারছেন যে, ফকল্যান্ডসে আর্জেন্টিনার আক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। আপাততঃ মনে হতে পারে যে, রিফুয়েলিং বিমানের সহায়তায় ‘এফ-১৬' যুদ্ধবিমানের ছত্রছায়ায় আর্জেন্টিনা উভচর হামলা করলে ফকল্যান্ডসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলা সম্ভব। তবে বাস্তবতা হলো, আর্জেন্টিনার জীর্ন সরঞ্জাম, আর্থিক দুর্গতি এবং লজিস্টিক্যাল ইস্যুর কারণে এহেন মিশন খুবই কঠিন। প্রথমতঃ যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান আর্জেন্টিনা ব্যবহার করতে পারবে না। দ্বিতীয়তঃ আর্জেন্টিনার মূল ভূখন্ড থেকে সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ দূরত্বে ফকল্যান্ডসে উভচর অভিযান চালাবার মতো লজিস্টিক্যাল সক্ষমতা আর্জেন্টিনার রয়েছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আর যদি ব্রিটেন আগে থেকে ইন্টেলিজেন্স পেয়ে যায়, তাহলে ব্রিটিশ 'টাইফুন' যুদ্ধবিমানের বাধার কারণে এধরণের অপারেশন অসম্ভব হয়ে যাবে। তৃতীয়তঃ ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার 'জেনারেল বেলগ্রানো' যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশ সাবমেরিনের আক্রমণে ডুবে যাবার পর আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এই কারণেই আপাততঃ আর্জেন্টিনার জন্যে ফকল্যান্ডসকে আবার দখল করা বাস্তব নয়। তবে বর্তমানে ব্রিটেনের এটাক সাবমেরিন রয়েছে মাত্র ৬টা। উভচর অভিযানে যাবার জন্যে দু'টা জাহাজ 'এলবিয়ন' এবং 'বুলওয়ার্ক' কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলিতে একসাথে ৮টার বেশি 'এফ-৩৫' যুদ্ধবিমান কখনোই বহণ করা যায়নি। এছাড়াও এই জাহাজগুলিতে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দেয়ার মতো 'ক্রোজনেস্ট' রাডারবাহী হেলিকপ্টারগুলিও প্রস্তুত নয়। কাজেই নিজেদের নৌবাহিনীর সক্ষমতা যখন দিন দিন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, তখন ফকল্যান্ডসকে পুনর্দখল করতে পারার সক্ষমতা ব্রিটেনের রয়েছে - এমন বার্তা ব্রিটেন দিতে পারছে না।

ব্রিটেনের ভয় আর্জেন্টিনা নয়; বরং আসল ভয় হলো ব্রিটেনের নিজেদের সামরিক শক্তির অবক্ষয়। আপাততঃ মনে হতে পারে যে, রিফুয়েলিং বিমানের সহায়তায় ‘এফ-১৬' যুদ্ধবিমানের ছত্রছায়ায় আর্জেন্টিনা উভচর হামলা করলে ফকল্যান্ডসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলা সম্ভব। তবে বাস্তবতা হলো, আর্জেন্টিনার জীর্ন সরঞ্জাম, আর্থিক দুর্গতি এবং লজিস্টিক্যাল ইস্যুর কারণে এহেন মিশন খুবই কঠিন। তবে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা যখন দিন দিন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, তখন ফকল্যান্ডসকে পুনর্দখল করতে পারার সক্ষমতা ব্রিটেনের রয়েছে - এমন বার্তা ব্রিটেন দিতে পারছে না।

 
‘রুসি'র জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব হস্তান্তরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দরকষাকষির বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা যেতো। কিন্তু যে ব্যাপারটা তিনি আলোচনা করেননি তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সামরিক ঘাঁটি নিয়ে কোন দরকষাকষি হয়েছে বা হতে পারে কিনা। অন্ততঃ দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাজেলান প্রণালিতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরির সিদ্ধান্ত এবং আর্জেন্টিনাকে 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করলো যে, ‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে' বিশ্বব্যাপী সামরিক ঘাঁটি তৈরি এবং চীনা প্রভাব নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারকে মার্কিনীরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি এন্টার্কটিকায় চীনা বৈজ্ঞানিক অভিযান ও পাতাগোনিয়া মরুভূমিতে চীনা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার হয়েছে। মার্কিন 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ দূরে ব্রিটেনের ফকল্যান্ডসের বিরুদ্ধে বাস্তব কোন হুমকি তৈরি না করলেও তা ম্যাজেলান প্রণালির উপর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নের মাঝে ফেলবে। একইসাথে আর্জেন্টিনার উগ্র লিবারাল প্রেসিডেন্টের নীতি ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ প্রভাবে থাকা প্রতিবেশী দেশ চিলি এবং 'ব্রিকস'এর সদস্যদেশ ব্রাজিলের সাথে উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। নতুন বাস্তবতায় মার্কিনীদের কাছে 'নিরপেক্ষ' বলে কোন কিছুই থাকছে না; যা মূলতঃ বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ প্রভাবকেই চ্যালেঞ্জ করছে। এতকাল মার্কিনীরা দিয়েগো গার্সিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল না; কারণ ব্রিটিশরা চাগোস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে এবং আশেপাশের দেশেগুলির সাথে কূটনৈতিক এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংএর মাধ্যমে মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এখন চীনের সাথে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাস্তবতায় এবং তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধের শংকার মাঝে মার্কিনীরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেছে যে, তাদের দিয়েগো গার্সিয়ার ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যাপারে ব্রিটিশদের সাথে নতুন করে দরকষাকষিতে যেতে হবে।

Monday, 21 October 2024

‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে' পক্ষ-বিপক্ষ বা জোট নিরপক্ষতার মাপকাঠি কি?

২২শে অক্টোবর ২০২৪

ভঙ্গুর সেকুলার বিশ্বব্যবস্থায় আজকে ঠিক-বেঠিক নিয়ে কোন মতৈক্য নেই; কারণ একেক জনের কাছে মাপকাঠি একেক রকম। লিবারাল গণতন্ত্রের চিন্তা ধারণকারীদের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে; আবার যারা সার্বভৌমত্ব-কেন্দ্রিক চিন্তা ধারণ করছে, তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে স্থিতিশীল শক্তিশালী রাষ্ট্র। যারা প্রথম পক্ষে থাকছে, তারা শুধু চীন-রাশিয়ার সাথে কঠোর ভূমিকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইছে না, অন্যান্য রাষ্ট্রকেও তাদের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে বাধ্য করার পক্ষপাতি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তারা আবার বাস্তবতার কাছে হার মেনে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। আর দ্বিতীয় পক্ষের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়ার সাথে ব্যালান্সিংএর সম্পর্ক রেখে আগের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পোস্ট-কলোনিয়াল সেটআপের উপর গড়ে ওঠা তৃতীয় পক্ষ বা 'নন এলাইন্ড মুভমেন্ট' বা 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন'এর কথা বলছেন। 


বরাবরই মার্কিন বলয়ে থাকা মিশর তাদের পুরোনো মার্কিন 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমানগুলিকে প্রতিস্থাপিত করার জন্যে চীনের কাছ থেকে 'জে-১০সি' যুদ্ধবিমান কেনার চেষ্টা করছে বলে বিভিন্ন খবরে প্রকাশ। এহেন খবর ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন; বিশেষ করে ওয়াশিংটনের আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল মিশর তার সামরিক শক্তি উন্নয়নে ব্যালান্সিংএর পথে চলছে কেন, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'চ্যাটহ্যাম হাউজ'এর এসোসিয়েট ফেলো আহমেদ আবুদুহ এক লেখায় বলছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধের মতোই মিশর ব্যালান্সিংএর নীতি নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মাঝে একটা হলো ইস্রাইলের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতাকে আরব দেশগুলির উপর রাখা। এর ফলে মিশর বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দূরপাল্লার (১০০কিঃমিঃ) 'এএমআরএএএম' বা 'এমর‍্যাম' ক্ষেপণাস্ত্র পায়নি। ওয়াশিংটনকে বাইপাস করতে মিশর ফ্রান্স থেকে 'রাফাল' যুদ্ধবিমান কিনেছে; কিন্তু সেখানেও প্যারিস তাদেরকে দূরপাল্লার 'মিটিয়র' ক্ষেপণাস্ত্র দেয়নি। মিশর রাশিয়ার কাছ থেকে 'সুখোই-৩৫' যুদ্ধবিমান কেনার চেষ্টা করায় যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়েছিল; কায়রো সেই প্রচেষ্টা থেকে সরে আসে। তারা ইতালির কাছ থেকে 'ইউরোফাইটার টাইফুন' বিমানও কিনছে; যেখানে তাদের দূরপাল্লার 'মিটিয়র' ক্ষেপণাস্ত্র পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তদুপরি তারা কয়েক যুগ চেষ্টার পর যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে তাদেরকে 'এফ-১৫' যুদ্ধবিমান দিতে রাজি হয়েছে; কিন্তু সেখানেও তা আসবে 'এমর‍্যাম' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাতীত। অর্থাৎ মিশরের সেনাবাহিনী যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, তার উপর বিমানের ছত্রছায়া থাকবে ইস্রাইলের বিমান বাহিনীর চাইতে দুর্বল। এই ব্যালান্সিং প্রচেষ্টার সর্বশেষ অংশ হিসেবেই মিশর বেইজিংএর দিকে তাকিয়েছে। কায়রো হয়তো মনে করছে যে, এর ফলে তারা চীনাদের দূরপাল্লার রাডার এবং ২০০কিঃমিঃ পাল্লার 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র পেতে পারে।

মিশরের 'জে-১০সি' যুদ্ধবিমান কেনার খবরের মতোই নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের ব্যাপারে অনেক আলোচনা শোনা যাচ্ছে আজকাল। ‘ভোক্স'এর সাথে এক সাক্ষাতে বেইজিংএ মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নস বলছেন যে, চীনের সাথে পশ্চিমাদের নতুন প্রতিযোগিতাকে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ বললে হয়তো বেশি সরলীকরণ করা হয়ে যাবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যে ঠান্ডা যুদ্ধ হয়েছিলো, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সামরিক এবং পারমাণবিক শক্তি। অপরদিকে চীন ভিন্ন রকমের শক্তি; যা অর্থনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'নিউলাইন্স ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি'র ডিরেক্টর এবং 'ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজ'এর প্রফেসর আজীম ইব্রাহিম 'ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনের এক লেখায় নতুন ঠান্ডা যুদ্ধকে স্বীকার করে নিয়েই যারা চীনের মানবাধিকার এবং ভূরাজনৈতিক আধিপত্যবাদ নিয়ে কথা বললে চীনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যে সমস্যা হবে বলে মনে করছে, তাদের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, প্রথম ঠান্ডা যুদ্ধে সকলেই বুঝেছিলেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে কি হতে পারে। তাই তারা যুদ্ধকে ঠান্ডাই রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন; যা চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুদ্ধ ছাড়াই চীনের সাথে দ্বন্দ্ব চলতে পারে; কিন্তু চীনের কোন কাজেই কেউ বাধা দেবে না, এটা মেনে নেয়া যায় না।

কেউ কেউ অবশ্য নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে চীন এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে আরও শক্ত মাপকাঠির উপর দেখতে চাইছেন। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক 'লোয়ি ইন্সটিটিউট'এর এক লেখায় দিল্লীতে ব্রিটিশ হাইকমিশনের প্রাক্তন উপদেষ্টা এবং 'লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস'এর ফেলো সুশিল আরন ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'চ্যাটহ্যাম হাউজ'এর প্রাক্তন ডিরেক্টর রবিন নিবলেটএর লেখা বই 'দ্যা নিউ কোল্ড ওয়ার'এর বাস্তবতায় এশিয়া-প্যাসিফিকের দেশগুলির ব্যাপারে পশ্চিমাদের নীতি কেমন হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে আলোচনা করেন। আরন প্রকৃতপক্ষে নিবলেটের লিবারাল গণতান্ত্রিক চিন্তাকেই তার লেখার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের দুই পক্ষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে নিবলেট বলছেন যে, একপক্ষে রয়েছে এমন কিছু দেশ, যারা ব্যক্তিস্বাধীনতা, চেক-এন্ড-ব্যালান্স, বাকস্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে স্তম্ভ হিসেবে নিয়েছে। আর অপরপক্ষে রয়েছে এমন কিছু দেশ, যারা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে ভয় পায় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের উপর স্থান দেয়। নিবলেটের সমর্থনে আরন বলছেন যে, রাশিয়া এবং চীন পশ্চিমা দেশগুলির সামরিক জোটের ব্যাপারে যতটা না ভীত, তার চাইতে বেশি ভীত তাদের আশেপাশের দেশগুলিতে গণতন্ত্রের ব্যাপারে। পশ্চিমা দেশগুলির গণতন্ত্র রক্ষার ইতিহাস ভালো নয় উল্লেখ করেই আরন বলছেন যে, পশ্চিমাদের দোষত্রুটি থাকলেও তারা অন্ততঃ বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ দেয়, যার ফলে নীতির পরিবর্তন করা যায়; যা একনায়কদের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। নিবলেটের প্রস্তাবকে সমর্থন করে আরন বলছেন যে, অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পশ্চাদগামীতার কারণে ভারতকে 'জি-৭' জোট থেকে বের করে দিয়ে সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে ঢুকিয়ে জোটের নাম দেয়া উচিৎ 'জি-৯'।

সকলেই নিজেদের নীতিকে অন্যের নীতির চাইতে সেরা মনে করছেন; কারণ কারুর নীতিই ঐশ্বরিক নয়। সকলেই মনে করছেন যে, তাদের চিন্তায় সংঘাত এড়ানো সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মতবিরোধই নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে "পক্ষ বনাম নিরপেক্ষ" প্রক্সি সংঘাতের জ্বালানি।

তবে সকলে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে চাইছে না। অনেকেই আগের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পোস্ট-কলোনিয়াল সেটআপের উপর গড়ে ওঠা তৃতীয় পক্ষ বা 'নন এলাইন্ড মুভমেন্ট' বা 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন'এর কথা বলছেন। যার অর্থ দাঁড়ায়, নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-রাশিয়ার মাঝে ব্যালান্স করে চলার পক্ষপাতি। ভারতের দিল্লীর 'জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি'র গবেষক ভরত সিং 'লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস'এর এক লেখায় বলছেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় তারা যেমন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ভারতের উচিৎ নিজেদের স্বার্থ বুঝে আলাদা পথ অবলম্বণ করা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির উচিৎ বাইরের শক্তিশালী দেশগুলির হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সহিংস আন্দোলনের উল্লেখ করে তিনি বলছেন যে, চীনের 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' বা 'বিআরআই' প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি, বিশেষ করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক পটভূমিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে গেছে। চীনের প্রভাবকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে 'কোয়াড' সামরিক জোট এবং 'মালাবার' সামরিক মহড়ার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নেপালে 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন' নামের মার্কিন সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে 'বিআরআই'কে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। একই লক্ষ্যে কাজ করছে 'ব্লু ডট নেটওয়ার্ক' এবং 'জি-৭'এর অন্তর্ভুক্ত 'বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড' প্রকল্প। তবে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির কথা উল্লেখ করে বলছেন যে, কোন একটা বড় শক্তির সাথে যোগ দেয়ার অর্থ হলো সংঘাত ডেকে নিয়ে আসা। পশ্চিমা দেশগুলির উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখার কারণেই এই অঞ্চলে ভারতের প্রকল্পগুলি কাজ করছে না। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট 'সার্ক'ও অকার্যকর হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের দেশগুলির মাঝে যোগাযোগ যখন ভেঙ্গে পড়ছে, তখন শক্তিশালী দেশগুলির প্রতিযোগিতামূলক হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে।

নেপালের বিদ্যুৎ ভারতে রপ্তানির জন্যে ৪০০কেভির ৩১৫কিঃমিঃ বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নির্মাণে মার্কিন সাহায্য সংস্থা 'এমসিসি'র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান প্রকল্প নিয়ে নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে বামপন্থী দলগুলির মাঝে সিদ্ধান্তহীনতা চলছে বহুদিন থেকেই। ২০২২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি 'এমসিসি'র সাথে চুক্তি নেপালি পার্লামেন্টে পাস হয়। নেপালের রাস্তায় এই চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলার সময়েই দেশটার বামপন্থী দলগুলি এই চুক্তি পাস করে। এর আগে ১০ই ফেব্রুয়ারি 'কাঠমুন্ডু পোস্ট'এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারি সচিব ডোনাল্ড লু নেপালের তিনজন রাজনীতিবিদ – তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা, কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল)এর নেতা কেপি শর্মা ওলি এবং 'মাওইস্ট সেন্টার'এর প্রধান পুষ্প কমল দাহালএর সাথে ফোনালাপ করেন। একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটা বলছে যে, ডোনাল্ড লু তাদেরকে শক্ত ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, যদি ২৮শে ফেব্রুয়ারির মাঝে পার্লামেন্টে 'এমসিসি'র সাথে চুক্তি পাস না হয়, তাহলে নেপালের সাথে যুক্তরাষ্ট্র তার সম্পর্ককে নতুনভাবে দেখতে বাধ্য হবে। চুক্তি পাস হলেও দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তির বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে নেপালের রাজনৈতিক কলহের কারণে। গত জুলাই মাসে নেপালে আরেক দফা সরকার পরিবর্তন হয়; যার ফলশ্রুতিতে আবারও প্রধানমন্ত্রী হন কেপি শর্মা ওলি। কিউবা-সমর্থিত বামপন্থী পত্রিকা 'ট্রাইকন্টিনেন্টাল এশিয়া'র এক লেখায় প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি অনুদানই দেবে, তাহলে কেন এই অনুদানের চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে হুমকি দিচ্ছে? তাছাড়া এই চুক্তি নেপালের আইনের উর্ধ্বে থাকবে এবং দেশটার বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থার আওতাধীন থাকবে না। মার্কিন সংস্থা 'ইউএসএআইডি'র হিসেবে এই বিদ্যুৎ নেপালে ব্যবহৃত হলে প্রতি ইউনিটে ৮৬ সেন্টের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক লাভ হতো। অপরদিকে ভারতে রপ্তানির বিনিময়ে নেপাল মাত্র ৬ সেন্ট করে পাবে। এগুলিই শুধু নয়, এই প্রকল্প যেখানে নিজ অর্থায়নে নেপাল আরও কম খরচে করতে পারতো, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে করার কারণে মার্কিন 'ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি' বা 'আইপিএস'এর মাঝে নেপালকে ঢোকানো হলো এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় নাম লেখালো নেপাল।

মালয়েশিয়ার প্রবীন অর্থনীতিবিদ যোমো কোয়ামে সুন্দারাম 'দ্যা সান' পত্রিকার এক লেখায় এশিয়ার দেশগুলিকে পশ্চিমা বলয়ে নাম লেখাতে সাবধান করছেন। তিনি বলছেন যে, নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাইতে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। অর্থনৈতিক নীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং অন্যান্যরা কোনো দেশের উপর অবরোধ আরোপ করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছ আর যাচ্ছে না। কাজেই এই অবরোধগুলি জাতিসংঘের চার্টার এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। সুন্দারাম এই প্রকারের অবরোধকে বেআইনী বলে আখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, ন্যাটো, ‘ওইসিডি', ‘জি-৭' এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি জাতিসংঘের স্থান নিয়ে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনকে সুবিধামতো ব্যবহার করা হচ্ছে; আর অসুবিধা মনে হলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। করোনা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সমস্যার কারণে সাপ্লাইএর যে সমস্যাগুলি হয়েছিলো, তা পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধের ব্যবহারের কারণে আরও বেড়েছে। সাপ্লাই সাইড ঠিক না করেই সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ার কারণে অর্থনীতি আরও খারাপ হয়েছে। দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। একারণে সুন্দারাম মনে করছেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলির উচিৎ জোট নিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এই নিরপেক্ষতা হয়তো ১৯৫৫ সালের বানদুং বা ১৯৬১ সালের বেলগ্রেডের মতো হবে না, তবে নতুন কোন প্রকারের হতে পারে।

ভঙ্গুর সেকুলার বিশ্বব্যবস্থায় আজকে ঠিক-বেঠিক নিয়ে কোন মতৈক্য নেই; কারণ একেক জনের কাছে মাপকাঠি একেক রকম। লিবারাল গণতন্ত্রের চিন্তা ধারণকারীদের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে; আবার যারা সার্বভৌমত্ব-কেন্দ্রিক চিন্তা ধারণ করছে, তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে স্থিতিশীল শক্তিশালী রাষ্ট্র। যারা প্রথম পক্ষে থাকছে, তারা শুধু চীন-রাশিয়ার সাথে কঠোর ভূমিকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইছে না, অন্যান্য রাষ্ট্রকেও তাদের মতামতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে বাধ্য করার পক্ষপাতি। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তারা আবার বাস্তবতার কাছে হার মেনে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। আর দ্বিতীয় পক্ষের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়ার সাথে ব্যালান্সিংএর সম্পর্ক রেখে আগের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পোস্ট-কলোনিয়াল সেটআপের উপর গড়ে ওঠা তৃতীয় পক্ষ বা 'নন এলাইন্ড মুভমেন্ট' বা 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন'এর কথা বলছেন। তবে এই জোট নিরপেক্ষ গ্রুপের সকলেই বোঝেন যে দুই নৌকায় পা রাখলে কাউকেই খুশি করা সম্ভব নয়। বরং এতে প্রথম গ্রুপের চাপ সামলাতে গিয়ে সার্বভৌমত্ব যতটুকু রয়েছে, সেটাও হারাতে হতে পারে। সকলেই নিজেদের নীতিকে অন্যের নীতির চাইতে সেরা মনে করছেন; কারণ কারুর নীতিই ঐশ্বরিক নয়। সকলেই মনে করছেন যে, তাদের চিন্তায় সংঘাত এড়ানো সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মতবিরোধই নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে "পক্ষ বনাম নিরপেক্ষ" প্রক্সি সংঘাতের জ্বালানি।

Saturday, 19 October 2024

লোহিত সাগর এবং বাব-এল মান্ডেব প্রণালির বাণিজ্যপথ নিয়ে দ্বন্দ্ব কোন দিকে যাচ্ছে?

২০শে অক্টোবর ২০২৪

এক বছর ধরে গাজায় চলা ইস্রাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে হুথিরা পশ্চিমা বাণিজ্য জাহাজে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিমারাও ইস্রাইলকে রক্ষার্থে এবং তাদের বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে লোহিত সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। হুথিদেরকে এই হামলা থেকে বিরত করতে পশ্চিমারা ইয়েমেনে দফায় দফায় বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে। কিন্তু এই সংঘাতের কোন কূলকিনারা দেখা যাচ্ছে না।


২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়ারা ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে এবং একইসাথে লোহিত সাগর এবং বাব-এল মান্ডেব প্রণালি দিয়ে যাওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্য জাহাজে হামলা শুরু করে। এক বছর ধরে গাজায় চলা ইস্রাইলি গণহত্যার প্রতিবাদে হুথিরা পশ্চিমা বাণিজ্য জাহাজে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং পশ্চিমারাও ইস্রাইলকে রক্ষার্থে এবং তাদের বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে লোহিত সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। হুথিদেরকে এই হামলা থেকে বিরত করতে পশ্চিমারা ইয়েমেনে দফায় দফায় বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে। কিন্তু এই সংঘাতের কোন কূলকিনারা দেখা যাচ্ছে না।

মার্কিন মিডিয়া 'এবিসি নিউজ'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের আক্রমণের ফলে সুয়েজ খাল দিয়ে বাণিজ্য জাহাজ যাতায়াতে মিশর সরকারের যে আয় হতো, তা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছে। এই সংঘাত শুরুর আগে বাব-এল মান্ডেব প্রণালি দিয়ে বিশ্বের মোট কনটেইনার বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ যাতায়াত করতো। প্রধান কনটেইনার শিপিং কোম্পানিগুলি তাদের জাহাজগুলিকে ঘুরপথে নিতে বাধ্য হচ্ছে; যার ফলে পরিবহণ খরচ বেড়ে গেছে। এসকল কনটেইনারে যেসব পণ্য পরিবাহিত হতো, তার সবগুলিরই মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া কোন জাহাজ থেকে যদি তেল ছড়ায়, তাহলে তা এই এলাকার ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্টগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে; যা মরু অঞ্চলে সুপেয় পানির হাহাকার তৈরি করতে পারে। এছাড়াও এই সমুদ্রপথের নিচ দিয়ে বিশ্বের সমগ্র ইন্টারনেটের এক-তৃতীয়াংশ গিয়েছে। এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হুমকির মাঝে পড়ে যাবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'ফেডারেল রিজার্ভ'এর চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল মার্কিন টেলিভিশন 'সিবিএস'কে বলেন যে, লোহিত সাগরের এই সংঘাত সারা দুনিয়ার অর্থনীতিকে হুমকির মাঝে ফেলে দিচ্ছে। তবে স্বল্প মেয়াদে এটা যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে ইউরোপকেই বেশি প্রভাবিত করবে। 'সিবিএস'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাপ্লাই চেইনে বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে ‘টেসলা' এবং 'ভলভো' তাদের ইউরোপিয় উৎপাদন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানুয়ারি মাসে মার্কিন নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহরের প্রধান ভাইস এডমিরাল ব্র্যাড কুপার দাবি করেন যে, লোহিত সাগর দিয়ে যেসকল জাহাজ যাচ্ছে, সেগুলি যেতে পারছে মার্কিন সুরক্ষার কারণেই। তবে এডমিরাল কুপার বলেন যে, হুথিরাই হলো প্রথম শক্তি যারা যেকোন যুদ্ধে জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।
 
বাব-এল মান্ডেব প্রণালিতে হুথিদের হামলার স্থান। ২০২৩ সালেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, ইয়েমেনের সরকার কিরূপ হবে। ইয়েমেনের প্রায় ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা হুথিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথাপি হুথিদেরকে পশ্চিমাদের মাঝে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। 'ভোক্স'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের অধীনে থাকা ইয়েমেনের শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনীতি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আরব জনগণের মাঝে নিজেদের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তারা ফিলিস্তিনের ইস্যুকে নিজেদের করে নেয়; যাতে করে ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি আলোচনায় না আসে। 


হুথিরা আসলে কারা?

‘ভোক্স'এর এক প্রতিবেদনে ইয়েমেনের ইতিহাসে হুথিদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ইয়েমেনের নেতৃত্বে ছিল জাইদি শিয়ারা। ১৯৭০এর দশকে আলী আব্দুল্লাহ সালেহ ইয়েমেনের ক্ষমতা নেন। তিনি জাইদি হলেও তার বন্ধুত্ব ছিল সৌদিদের সাথে; যা হুসেইন আল-হুথি নামের একজন জাইদি নেতা তা পছন্দ করেননি। ২০০১ সালে সালেহ সরকার মার্কিনীদের নেতৃত্বে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর আল-হুথি বলেন যে, তিনি ইয়েমেনকে মার্কিন পাপেট দেখতে চান না। একইসাথে তিনি ঘোষণা দেন যে, ইহুদিরা মুসলিম দেশগুলির উপর ছড়ি ঘোরাবে, সেটা তিনি বসে বসে দেখবেন না। ২০০৪ সালে সালেহ-এর সেনাবাহিনী আল-হুথিকে হত্যা করে। তবে আল-হুথির হত্যার পরে তার অনুসারীরা আরও শক্তিশালী হয় এবং কোন একটা সময়ে ইরানের কাছাকাছি যেতে থাকে। এরপর ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় ব্যাপক জনরোষের কারণে সালেহ ক্ষমতা ছাড়াতে বাধ্য হলে সৌদি-সমর্থিত মনসুর হাদি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। প্রথমে সরকার গঠনের আলোচনায় অংশ নিলেও ২০১৪ সালে হুথিরা নিজেদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে আলোচনা ছেড়ে যায়। সেই বছরই ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

যুদ্ধের শুরুতে হুথিরা তাদের প্রাক্তন শত্রু আলী আব্দুল্লাহ সালেহর সাথে বন্ধুত্ব করে এবং ২০১৪এর সেপ্টেম্বরে রাজধানী সানা-র নিয়ন্ত্রণ নেয়। একইসাথে হুথিরা হোদেইদা সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সমুদ্রে যাবার একটা পথ পায়। ২০১৫ সালে সৌদি আরব এবং তার সমমনা দেশগুলি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। সৌদিরা হুথিদের উপর ব্যাপক বিমান আক্রমণ করে এবং ইয়েমেনকে নৌ-অবরোধের মাঝে ফেলে দেয়; যাতে করে ইরান থেকে হুথিদের জন্যে অস্ত্র আসতে না পারে। তবে এরপরেও হুথিরা ইয়েমেনের বড় একটা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। ২০১৭ সালে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের পর হুথিরা আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে হত্যা করে। ২০২০ সালে সৌদিরা যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে ইয়েমেন থেকে চলে যেতে থাকে। ২০২৩ সালেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, ইয়েমেনের সরকার কিরূপ হবে। ইয়েমেনের ৪ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ হুথিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথাপি হুথিদেরকে পশ্চিমাদের মাঝে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। 'ভোক্স'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের অধীনে থাকা ইয়েমেনের শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনীতি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আরব জনগণের মাঝে নিজেদের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তারা ফিলিস্তিনের ইস্যুকে নিজেদের করে নেয়; যাতে করে ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলি আলোচনায় না আসে। ২০২৩এর ৭ই অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরু হলে হুথিরা ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা জানিয়ে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে এবং একইসাথে লোহিত সাগরে নির্দিষ্ট কিছু বাণিজ্য জাহাজের উপর হামলা শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে হুথিদেরকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেয়। পশ্চিমারা হুথিদের উপর বিমান হামলাও শুরু করে।
 
মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার 'জেসন ডানহ্যাম' থেকে মহড়ার সময় ছোঁড়া হচ্ছে 'স্ট্যান্ডার্ড এসএম-২' আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র। হুথিদের কৌশল যথেষ্টই পরিশীলিত। তারা দেখেছেন যে, হুথিরা একটা ড্রোন উড়িয়েছে, যার মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিটের মাঝেই একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। অর্থাৎ এই ড্রোনের পাঠানো তথ্যের মাধ্যমে হুথিরা তাদের টার্গেটিংকে শক্তিশালী করেছে।হুথিদের আক্রমণ ঠেকাতে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনী ১’শটার মতো ‘স্ট্যান্ডার্ড’ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাবহার করেছে; যেগুলির একেকটার মূল্য প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। 


লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধ

‘এবিসি নিউজ'এর সাথে এক সাক্ষাতে প্রাক্তন পেন্টাগন কর্মকর্তা মাইকেল প্যাট্রিক মালরয় বলছেন যে, উড়ন্ত, পানির উপর দিয়ে চলা এবং পানির নিচ দিয়ে চলা যেকোন মনুষ্যবিহীন ড্রোন মোকাবিলায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু একইসাথে যদি কয়েক প্রকারের অনেকগুলি ড্রোন আক্রমণ করে, তাহলে তা সমস্যার জন্ম দেবে। এটা সকলেই বোঝেন যে, হুথিদের এসকল উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা নেই। অন্যকথায় হুথিরা অস্ত্র পাচ্ছে ইরান থেকে। পশ্চিমারা এক্ষেত্রে চেষ্টা করবে ইরান থেকে হুথিদের কাছে অস্ত্রের চালান বন্ধ করতে; এবং একইসাথে হুথিদের নিজেদের অস্ত্র ব্যবহারের সক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করতে। ‘বিজনেস ইনসাইডার'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেনের হুথিরা এখন যেসকল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, তার সবগুলিই ইরানের প্রযুক্তিতে তৈরি। প্রথমেই রয়েছে চীনা 'সি-৮০২' ক্ষেপণাস্ত্রের ইরানি কপি; যেগুলি মূলতঃ জাহাজ-ধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলি নিচু দিয়ে উড়ে জাহাজে হামলা করে। যুদ্ধজাহাজে এগুলির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও বাণিজ্য জাহাজ এগুলির বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। এরপর রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র; যার মাঝে সবচাইতে বেশি হুমকির হলো জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলি অনেক উপর থেকে প্রচন্ড গতিতে ভূমির দিকে পড়কে থাকে বিধায় এগুলিকে খুঁজে পাওয়া এবং ধ্বংস করা খুব কঠিন। মার্কিন ৫ম নৌবহরের তৎকালীন কমান্ডার ভাইস এডমিরাল ব্র্যাড কুপার গত জানুয়ারিতে 'সিবিএস'কে বলেন যে, ১০ বছর ধরে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের মাঝে হুথিরা ইরান থেকে প্রচুর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের চালান পেয়েছে। লোহিত সাগরে হুথিদের বেশিরভাগ টার্গেট ছিল বাণিজ্য জাহাজ; স্বল্প সংখ্যক আক্রমণ ছিল মার্কিন নৌবহরের বিরুদ্ধে।

'সিবিএস'এর 'সিক্সটি মিনিটস' অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, হুথিদের অস্ত্রগুলির মাঝে রয়েছে 'সামাদ-৩' ড্রোন; যার পাল্লা প্রায় ১,৮০০কিঃমিঃ। তাদের জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা প্রায় সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ পর্যন্ত। মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ‘মেসন’এর কমান্ডার ‘সিবিএস’কে বলছেন যে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার পর ১ থেকে ২ মিনিট পর্যন্ত সেটাকে দেখা সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে মার্কিন জাহাজের কমান্ডারকে ৯ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মাঝে সেটাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মার্কিন নৌবাহিনীর জন্যে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে থামাতে ১০০ শতাংশ সফলতা প্রয়োজন; কিন্তু হুথিদের ক্ষেত্রে একটা ক্ষেপণাস্ত্রের সফলতাই যথেষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনী ১’শটার মতো ‘স্ট্যান্ডার্ড’ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাবহার করেছে; যেগুলির একেকটার মূল্য প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। লোহিত সাগরে একটা মার্কিন যুদ্ধজাহাজকে তাদের সর্বশেষ স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা 'ফ্যালাংস' ব্যবহার করতে হয়েছে। মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বিমান এবং ডেস্ট্রয়ার থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে হুথিদের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক হামলা করা হয়েছে। লোহিত সাগরে ইরানি ইন্টেলিজেন্স জাহাজে সাইবার হামলাও করা হয়েছে। কিন্তু হুথিদের হামলা থামেনি। মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার'এর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল মার্ক মিগেজ 'সিক্সটি মিনিটস'কে বলছেন যে, হুথিদের কৌশল যথেষ্টই পরিশীলিত। তারা দেখেছেন যে, হুথিরা একটা ড্রোন উড়িয়েছে, যার মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিটের মাঝেই একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। অর্থাৎ এই ড্রোনের পাঠানো তথ্যের মাধ্যমে হুথিরা তাদের টার্গেটিংকে শক্তিশালী করেছে।

মার্কিন মিডিয়া 'সিবিএস' মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার 'কারনি'র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানায় যে, জাহাজটা উত্তর লোহিত সাগরে থাকার সময় ৫০টা ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করেছিলো; যেগুলি হয় ইস্রাইল বরাবর যাচ্ছিলো, অথবা অন্য কোন বাণিজ্য জাহাজ লক্ষ্য করে এগুচ্ছিলো। এই ৫০টার মাঝে ৪৫টাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় বলে উল্লেখ করে তারা। তবে এর মাঝে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ছিলো সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং। কারণ এগুলি শব্দের গতির চাইতে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি দ্রুত এবং মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড সময় পাওয়া যায় এগুলিকে মোকাবিলা করার। আকাশে অনেক বেসামরিক বিমান থাকার কারণে এগুলিকে ধ্বংস করার আগে জাহাজের কমান্ডারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে টার্গেটটা আসলেই শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র। মিশনের মাঝেই 'কারনি' জাহাজটাকে বন্দরে গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়েছিলো; অন্য কথায় বলতে গেলে হাজার ডলারের ড্রোন ধ্বংস করতে গিয়ে তাদের মিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্রের স্টক ফুরিয়ে গিয়েছিলো। জাহাজের কমান্ডার বলছেন যে, তার জাহাজের খুব কাছাকাছি বা সাড়ে ৭কিঃমিঃএর মাঝে কোন ক্ষেপণাস্ত্রকে তারা আসতে দেননি।

'সিবিএস'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, 'কারনি'র সাথে বেশ কয়েকটা পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজ লোহিত সাগরে মোতায়েন থাকলেও তারা বাণিজ্য জাহাজের উপর হামলা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। রিয়ার এডমিরাল কুপার 'সিক্সটি মিনিটস'কে বলছেন যে, ইরানের সহায়তা ছাড়া হুথিরা এসকল হামলা করতে পারতো না। হুথিদেরকে সরাসরি সহায়তা করছে ইরানের 'আইআরজিসি'র সদস্যরা। কিন্তু তাদের এই সহযোগিতার বিরুদ্ধে কিছু করা হবে কিনা, সেটা সরকারের রাজনৈতিক নীতিগত সিদ্ধান্ত। 'বিজনেস ইনসাইডার' বলছে যে, মার্কিন নেতৃত্বে থাকা পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর যথেষ্ট প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একদিকে যেমন হুথিদেরকে আক্রমণ বন্ধ করার ব্যাপারে প্রভাবিত করা যায়নি; তেমনি তাদের লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা করার সক্ষমতাও বহাল রয়েছে। হুথিরা বহুদিন সৌদিদের সাথে যুদ্ধ করার পর বিমান আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছে। আর পশ্চিমাদেরও সংঘাত বাড়িয়ে ইরানকে জড়িতে করার রাজনৈতিক ইচ্ছা নেই বলেই হুথিদের বিরুদ্ধে আক্রমণগুলিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে করা হচ্ছে।
 
লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে বাণিজ্য জাহাজগুলি আফ্রিকা ঘুরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। লোহিত সাগরের সংঘাত বন্ধে মার্কিনীরা এবং ইউরোপিয়রা একে অপরকে ঠেলছে। মার্কিনীরা বলছে যে, লোহিত সাগরের সংঘাত ইউরোপের বেশি ক্ষতি করছে। কিন্তু মার্কিনীরা আবার একদিকে যেমন ইস্রাইলকে গাজা এবং লেবাননে হামলা থেকে নিবৃত করছে না, অপরদিকে সংঘাতকে ছড়িয়ে ইরানকেও সরাসরি জড়াতে চাইছে না। এক বছর হয়ে গেলো মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখতে বাধ্য হচ্ছে; অথচ ওয়াশিংটনের ধোঁয়াশা নীতির মাঝেই হুথিরা লোহিত সাগরের বাস্তবিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। 


হুথি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করার পশ্চিমা সক্ষমতা আসলে কতটুকু?

মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল 'ফক্স নিউজ'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২৪এর জানুয়ারিতে মার্কিন নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো স্বীকার করে যে, তারা হুথিদের ছোঁড়া জাহাজ-ধ্বংসী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে 'স্ট্যান্ডার্ড এসএম-৬' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। সামরিক ম্যাগাজিন 'দ্যা ওয়ার জোন'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এর আগ পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনী কেবল 'এসএম-২' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে স্বীকার করেছিলো। 'এসএম-৬' এমন একটা প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র, যা কিনা শত্রুর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে 'টার্মিনাল' বা শেষ পর্যায়ে ধ্বংস করতে পারে; অর্থাৎ যখন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিচের দিকে পড়ন্ত অবস্থায় থাকে। এই অবস্থায় একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করা বেশ কষ্টসাধ্য। ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সবচাইতে অত্যাধুনিক এবং সবচাইতে দামি। অপরদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর আরেকটা প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র হলো 'এসএম-৩', যা কিনা শুধুমাত্র মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। 'এসএম-৩' শত্রুর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে এমন পর্যায়ে ধ্বংস করে, যখন সেটা 'মিড কোর্স' বা আকাশে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। যেসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্বল্প পাল্লার বা আকাশে খুব বেশি একটা উপড়ে ওঠে না, সেগুলিকে 'এসএম-৩' দ্বারা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এধরণের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে রয়েছে জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; যেগুলি হুথিরা বাণিজ্য জাহাজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।

আর মার্কিন নৌবাহিনীর ব্যবহার করা কয়েক দশকের পুরোনো প্রযুক্তির 'এসএম-২' প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র 'টার্মিনাল' বা শেষ পর্যায়ে একটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার সীমিত ক্ষমতা রাখে। মার্কিনীরা কেন তাদের সবচাইতে দামি ক্ষেপণাস্ত্র (‘এসএম-৬') ব্যবহার করে হুথিদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে, সেটা পরিষ্কার নয়। তবে প্রশ্ন আসতেই পারে; কারণ এর আগে 'এসএম-২' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম বলেই বলা হয়েছিলো। তথাপি ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটা ডেস্ট্রয়ার রক্ষা করতে যদি এহেন অস্ত্র ব্যবহার করতেই হয়, তাতে কারুর কিছু বলার কথা নয়। 'বিজনেস ইনসাইডার'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, লোহিত সাগরেই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুদ্ধজাহাজের 'ফ্যালাংস ক্লোজ ইন ওয়েপন সিস্টেম' বা 'সিআইডব্লিউএস' ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ২০মিঃমিঃ একটা কামান, যা মিনিটে কয়েক হাজার রাউন্ড গুলিবর্ষণ করতে সক্ষম। এটা একটা যুদ্ধজাহাজের প্রতিরক্ষার সর্বশেষ স্তর। যেহেতু জাহাজের সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে হয়েছিল, কাজেই বলা যায় যে, সেটা খুবই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি ছিল। কারণ জাহাজের ক্রুরা দেখেছে যে, শেষ রক্ষার এই অস্ত্রটা তখনই ব্যবহার করতে হয়েছে, যখন জাহাজের বাকি অস্ত্রগুলি শত্রুর সেই ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মার্কিন নৌবাহিনীর 'সারফেস ওয়ারফেয়ার ডিভিশন'এর ডিরেক্টর রিয়ার এডমিরাল ফ্রেড পাইল মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সাথে এক সাক্ষাতে ইয়েমেনের উপকূলে মার্কিন নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতার ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি স্বীকার করেন যে, হুথিদের স্বল্পমূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ঠেকাতে মার্কিনীরা দশ গুণ বেশি মূল্যমানের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে। এডমিরাল পাইল বলেন যে, তার কাছে তার জাহাজের নাবিকদের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। তাই এখানে কত মূল্যের অস্ত্র দিয়ে কত মূল্যের আক্রমণ ঠেকাতে হচ্ছে, সেটা তিনি হিসেব করতে চান না। তবে তিনি এ-ও বলেন যে, স্বল্প খরচে এধরণের আক্রমণ ঠেকাবার চেষ্টা তারা করে যাচ্ছেন; যা অপারেশনাল গোপনীয়তার কারণে তিনি আলোচনা করতে চান না। মার্কিন ডেস্ট্রয়ারগুলি একেবারে শেষ প্রতিরক্ষা হিসেবে তাদের ২০মিঃমিঃ 'ফ্যালাংস ক্লোজ ইন ওয়েপন সিস্টেম' বা 'সিআইডব্লিউএস' ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে, এমন খবরের ব্যাপারে তিনি বলেন যে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলিতে অনেকগুলি প্রতিরক্ষার স্তর রয়েছে; যার মাঝে 'এসএম-৬', ‘এসএম-৩' ক্ষেপণাস্ত্র জাহাজের সবচাইতে দূরে গিয়ে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রকে ঘায়েল করে। এরপর রয়েছে 'সী স্প্যারো' ক্ষেপণাস্ত্র; এরপর রয়েছে 'রোলিং এয়ারফ্রেম মিসাইল'; আর সর্বশেষ স্তরে রয়েছে 'সিআইডব্লিউএস'। এছাড়াও মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বিমানগুলিও হুথি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছে। এখানে একটা স্তর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আরেকটা স্তর কাজ করবে। যদি হুথিদের কোন ক্ষেপণাস্ত্র শেষ স্তর পর্যন্ত চলে আসতে সক্ষম হয়, তাহলেও সমস্যা নেই; কারণ সেই হুমকিকে সফলভাবে মোকাবিলা করা গিয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করে বলেন যে, এতকাল মার্কিন নৌবাহিনী যে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়নি তা হলো, একটা জাহাজের প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শেষ হয়ে গেলে কি করতে হবে। এই ব্যাপারটা এখন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ সমুদ্রে থাকা অবস্থায় 'ভার্টিক্যাল লঞ্চ সিস্টেম'এর সেলগুলির মাঝে ক্ষেপণাস্ত্র রি-লোড হয়েছে। তবে এই পদ্ধতি এখনও অপারেশনাল হয়নি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে মার্কিন নৌবাহিনীতে মনুষ্যবিহীন যুদ্ধজাহাজের ব্যবহারের কথা তিনি উল্লেখ করেন। এসব মনুষ্যবিহীন জাহাজ অতিরিক্ত ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করবে; যেগুলি ডেস্ট্রয়ার থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ফায়ার করা যাবে। এতে সমুদ্রে বহণ করা ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
 
ইয়েমেনে ফিলিস্তিনের সাথে একাত্মতা জানিয়ে বিশাল জমায়েত। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে এবং এর ফলাফলস্বরূপ দুর্ভিক্ষে সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গৃহযুদ্ধ শেষে হুথিদের অধীনে ইয়েমেনের পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। এরপরেও হুথিরা যে সফলভাবে জনগণের আবেগকে পুঁজি করতে পেরেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুরো ইয়েমেন জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা সমর্থন করে বিশাল জনসমাবেশ দৃশ্যমান হয়। লোহিত সাগরে হামলা ইয়েমেনের জনগণের বাস্তবতাকে উন্নতির দিকে না নিলেও হুথিদের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। 


লোহিত সাগরের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাচ্ছে?

ব্রিটিশ সামরিক বিশ্লেষক মাইকি কে 'বিবিসি'কে বলছেন যে, পশ্চিমারা এখনও বহু ড্রোন একত্রে হামলা করলে সেগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সক্ষমতা রাখে না। ইয়েমেনের হুথিদের ছোঁড়া ড্রোন ধ্বংস করতে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের 'টাইফুন' যুদ্ধবিমান দু'টা 'এএসআরএএএম' বা 'এসর‍্যাম' ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল; যেগুলির একেকটার মূল্য আড়াই লক্ষ ডলারের বেশি। এই বিমানগুলি হয়তো একত্রে ৪টার বেশি এই ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারবে না। কিন্তু আকাশে যদি ২০টা ড্রোন থাকে, তাহলেই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। তিনি 'কাউন্টার রকেট আর্টিলারি মর্টার' বা 'সি-র‍্যাম' নামের এক প্রকারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন; যা সেকেন্ডে অনেকগুলি বুলেট ছুঁড়ে দেয়ার মাধ্যমে আকাশে আক্রমণকারী বস্তুকে ধ্বংস করতে সক্ষম। তবে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার প্রতিরক্ষার জন্যেই মোতায়েন করা সম্ভব; সকল স্থানে নয়। তবে সামনের দিনে লেজার অস্ত্র বেশি গুরুত্ব পাবে। কারণ লেজারের মাধ্যমে একসাথে বহু ড্রোনকে টার্গেট করা সম্ভব।

লোহিত সাগরের সংঘাত বন্ধে মার্কিনীরা এবং ইউরোপিয়রা একে অপরকে ঠেলছে। মার্কিনীরা বলছে যে, লোহিত সাগরের সংঘাত ইউরোপের বেশি ক্ষতি করছে। কিন্তু মার্কিনীরা আবার একদিকে যেমন ইস্রাইলকে গাজা এবং লেবাননে হামলা থেকে নিবৃত করছে না, অপরদিকে সংঘাতকে ছড়িয়ে ইরানকেও সরাসরি জড়াতে চাইছে না। এক বছর হয়ে গেলো মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখতে বাধ্য হচ্ছে; অথচ ওয়াশিংটনের ধোঁয়াশা নীতির মাঝেই হুথিরা লোহিত সাগরের বাস্তবিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ‘ভোক্স'এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে এবং এর ফলাফলস্বরূপ দুর্ভিক্ষে সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গৃহযুদ্ধ শেষে হুথিদের অধীনে ইয়েমেনের পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। এরপরেও হুথিরা যে সফলভাবে জনগণের আবেগকে পুঁজি করতে পেরেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুরো ইয়েমেন জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং লোহিত সাগরের জাহাজে হামলা সমর্থন করে বিশাল জনসমাবেশ দৃশ্যমান হয়। লোহিত সাগরে হামলা ইয়েমেনের জনগণের বাস্তবতাকে উন্নতির দিকে না নিলেও হুথিদের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ‘বিজনেস ইনসাইডার'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, লোহিত সাগরের সংঘাতে ব্যালান্স অব পাওয়ারে এগিয়ে রয়েছে হুথিরাই। কারণ কৌশলগত অবস্থানের কারণে হুথিরা নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতাও রয়েছে যথেষ্ট। আর হুথিদের সক্ষমতাকে ধ্বংস করতে হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে; যার রাজনৈতিক সদিচ্ছা পশ্চিমাদের কারুরই নেই।

Sunday, 13 October 2024

ইউক্রেন যুদ্ধ - ভুহলেদার শহর রুশদের হাতে চলে যাবার কৌশলগত গুরুত্ব

১৩ই অক্টোবর ২০২৪

ভুহলেদার শহরটা দুই বছর ধরে ইউক্রেনিয় সেনারা রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। রুশরা তাদের যুদ্ধকৌশলকে অনেকটাই বদলে ফেলেছে। তাদের সেনারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণে যাচ্ছে এবং সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে একত্রে ব্যবহার করছে; যা তাদের সামরিক সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। গ্লাইড বোমা, ড্রোন এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগের ব্যবহার তাদের সাফল্যের বড় কারণ ছিল। 


গত ১লা অক্টোবর ইউক্রেনের ছোট্ট শহর ভুহলেদার রুশ সামরিক বাহিনীর দখলে চলে যায়। এই শহরটা দুই বছর ধরে ইউক্রেনিয় সেনারা রক্ষা করে চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। ‘আল-জাজিরা' বলছে যে, পাহাড়ের উপরে অবস্থিত মাইনিং শহর ভুহলেদার রুশদের হাতে চলে যাওয়ায় রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনিয় হামলার আঘাতটাকে মস্কো কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারে। অপরদিকে এই হার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির পরিকল্পনাকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে হামলার সাথে সাথে জেলেন্সকি চাইছিলেন যে, পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার ভেতরে হামলা করতে। ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক 'চ্যাটহ্যাম হাউজ'এর 'ইউক্রেন ফোরাম'এর প্রধান ওরিসিয়া লুটসেভিচ 'আল-জাজিরা'কে বলছেন যে, জেলেন্সকি ইউক্রেনিয় জনগণের কাছে বার্তা দিতে চাইছিলেন যে, তার পরিকল্পনা মোতাবেকই যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে; যদিও তিনি সরাসরি বলছেন না যে, ইউক্রেনিয়রা কুর্স্ক-এ হামলা করে রাশিয়ার এলাকা দখলে নিয়েছে। জেলেন্সকি তার নিজের জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধে জয়ের ধারায় রয়েছেন। ‘কিংস কলেজ লন্ডন'এর গবেষক মারিনা মিরন 'ডয়েচে ভেলে'র সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, যদি ন্যাটো ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়ও, সেটা ডনবাসের যুদ্ধক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আনবে না। কারণ এসব ক্ষেপণাস্ত্র যে সংখ্যায় ইউক্রেনের কাছে আসছে, তা খুব একটা বড় নয়। তাছাড়াও রাশিয়ার ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এবং অর্থনৈতিক টার্গেটের ইন্টেলিজেন্স ন্যাটোকেই দিতে হবে।

মারিনা মিরন বলছেন যে, ভুহলেদার একটা গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রথমতঃ শহরটা কিছুটা উঁচু যায়গায় অবস্থিত। দ্বিতীয়তঃ এই শহরটা কুরাখোভে নামের আরেকটা শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। কুরাখোভের ঠিক উত্তরে রয়েছে নদী। কাজেই এই শহরটার নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে দক্ষিণ থেকে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ভুহলেদারকে রুশরা ব্যবহার করতে পারবে। তৃতীয়তঃ ভুহলেদারকে ব্যবহার করে গ্রেটার ঝাপোরিঝঝিয়া এলাকায় রুশদের ঢুকে পড়াটা সহজ হবে। আর ভুহলেদার হারানোটা ইউক্রেনিয়দের জন্যে সামরিক হার হলেও তা ইউক্রেনিয় মনোবলেও বেশ বড় আঘাত করবে।

মারিনা মিরন বলছেন যে, রাশিয়ার কুর্স্ক-এ ইউক্রেনিয় আক্রমণের কারণে ইউক্রেনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে সদস্যসংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়েছিল। ইউক্রেনের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে আর্টিলারি শেলও নেই; যে শূণ্যস্থান তারা ড্রোনের মাধ্যমে পূরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়াও রুশরাও তাদের কৌশলকে পরিবর্তন করেছে; যার কারণে রুশরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। রুশরা সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে একত্রে ব্যবহার করছে; যা তাদের সামরিক সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। 'দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রুশরা তাদের যুদ্ধকৌশলকে অনেকটাই বদলে ফেলেছে। তাদের সেনারা ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগেও তারা ইউক্রেনের একটা শক্ত অবস্থানকে আক্রমণ করতে ১০ থেকে ২০ জন সেনাকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এখন তারা হয়তো মাত্র ৪ জন সেনা দিয়ে একই মিশন পরিচালনা করছে। স্বল্প সংখ্যক সেনারা অনেক বড় এলাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে একদিকে যেমন তাদেরকে খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে, তেমনি তাদেরকে ড্রোন বা আর্টিলারি দিয়েও টার্গেট করা যাচ্ছে না। এর আগের শরৎকালে ইউক্রেনিয়রা একই কৌশল অবলম্বন করেছে; কিন্তু রুশরা এই কৌশলের সাথে যুক্ত করেছে তাদের ব্যাপক আর্টিলারি সক্ষমতা এবং ক্ষতি পুষিয়ে নেবার মানসিকতা। এছাড়াও রুশরা স্যাটেলাইট যোগাযোগ সরঞ্জামের মাধ্যমে তাদের নিজেদের মাঝে যোগাযোগ যথেষ্ট উন্নত করেছে; যা তাদের সেনাদের সাথে ড্রোনের সমন্বয়ে আক্রমণকে সহজ করেছে। যদিও রুশদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক; তথাপি সংখ্যার দিক থেকে বেশি থাকায় রুশরা ইউক্রেনিয়দের উপর চাপ বহাল রাখতে পারছে। অপরদিকে ইউক্রেনিয়দের যা ক্ষতি হচ্ছে, পশ্চিমা সহায়তা তার চাইতে তুলনামূলক কম। ইউক্রেনের ৭২তম মেকানাইজড ব্রিগেডের সেনারা বলছে যে, রুশ বিমান বাহিনীর গ্লাইড বোমার আঘাতে একেকটা পরিখার বড় একটা অংশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ইউক্রেনিয়দের ১টা আর্টিলারি শেলের বিপরীতে রুশরা ১০টা শেল ব্যবহার করছে। ইউক্রেনিয়রা যদি পিছিয়ে না আসতো, তাহলে রুশরা তাদেরকে ঘিরে ফেলতো এবং তাদের সকল সৈন্য এবং সরঞ্জাম হারাতে হতো।
 
পশ্চিমা সরকারগুলি যে মুহুর্তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের সহায়তা দিতে গরিমসি করছে, ঠিক তখনই রাশিয়া ডোনেটস্ক অঞ্চলে একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে। জেলেন্সকি রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে আক্রমণের মাধ্যমে কৌশলগত যে সাফল্য আশা করেছিলেন, তা যে আসছে না, সেটা নিশ্চিত। উল্টো, কুর্স্ক অপারেশনের কারণে ইউক্রেনিয়রা ডোনেটস্ক অঞ্চলে হারতে বসেছে।


বিশ্লেষকেরা মত দিচ্ছেন যে, রুশদের গ্লাইড বোমা ডোনেটস্কএর যুদ্ধে বড় প্রভাব ফেলছে; বিশেষ করে ইউক্রেনিয়দের শক্তিশালী অবস্থানগুলিকে দুর্বল করতে এই গ্লাইড বোমা বড় ভূমিকা রাখছে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২৪এর শুরু থেকেই রুশরা হাজারো সাধারণ বোমার সাথে স্যাটেলাইট গ্যাইড্যান্স কিট এবং ডানা লাগিয়ে সেগুলিকে 'গ্লাইড বোমা' হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে। এই বছরে রুশদের সফলতার একটা বড় কারণ এই গ্লাইড বোমা। একটা শহর রক্ষা করতে গিয়ে ইউক্রেনিয় সেনারা হয়তো একটা ভবনের নিচে বেইজমেন্টে তাদের থাকার জায়গা তৈরি করতো। আর্টিলারি শেল হয়তো বেইজমেন্টের ক্ষতি করতে পারতো না। কিন্তু এই গ্লাইড বোমাগুলি সেনাদের উপর পুরো ভবনকেই ধ্বসিয়ে ফেলতে সক্ষম। এই বোমাগুলি চলমান টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা না গেলেও স্থায়ী পরিখা, দুর্গ বা শক্তিশালী অবস্থানের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবহার করা যায়। এই বোমাগুলি খুব সহজেই তৈরি করা যায়; যা রুশদের দামি সব অস্ত্র থেকে ভিন্ন। তাছাড়া এই বোমাগুলি আকাশে থাকা অবস্থায় সহজে গুলি করে ধ্বংস করা যায় না। আর এখন ইউক্রেন যুদ্ধ এমন একটা অবস্থানে এসেছে, যখন অর্থনৈতিক দিকটা যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। রুশরা আগের চাইতে অপেক্ষাকৃত বড় গ্লাইড বোমাও তৈরি করছে; যার কিছু কিছু ৩টন পর্যন্ত। ইউক্রেনিয়দের হিসেবে রাশিয়া ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ২০২৩এর তুলনায় ১৬গুণ বেশি গ্লাইড বোমা ব্যবহার করেছে। অনেকেই মনে করছেন যে, এই বছরের শুরুতে আভদিভকা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেবার পিছনে গ্লাইড বোমার অবদান ছিল যথেষ্ট। তারা ছোট এক জায়গায় একসাথে এতো বেশি গ্লাইড বোমা ব্যবহার করেছে, যার কারণে ইউক্রেনিয়রা বাধ্য হয়েছে সেই স্থান ছেড়ে আসতে। গ্লাইড বোমা থেকে বাঁচতে গেলে ইউক্রেনিয়দের হয় রুশ বোমারু বিমানগুলিকে আমেরিকান 'এফ-১৬' বিমান দিয়ে ধ্বংস করতে হবে; অথবা আমেরিকান 'প্যাট্রিয়ট' আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফ্রন্টলাইনের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে হবে। অথবা ইলেকট্রনিক জ্যামিংএর মাধ্যমে এই বোমাগুলির স্যালেটাইট টার্গেটিং সিস্টেম অকার্যকর করতে হবে। এই কাজগুলির কোনটাই সহজ নয়।

ফিনল্যান্ডের ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপ'এর পাসি পারোইনেন 'দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট'কে বলছেন যে, গত অগাস্ট এবং সেপ্টেম্বরে রুশরা যত দ্রুততার সাথে এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তা গত দুই বছরে দেখা যায়নি। ঠিক এই সময়টাতেই ইউক্রেনিয়রা রাশিয়ার ভেতর কুর্স্ক অঞ্চলে হামলা চালিয়েছে। দক্ষিণ ডোনেটস্ক এলাকায় রুশরা ৩১৮বর্গমিঃমিঃ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে; যার মাঝে ২৬৮বর্গকিঃমিঃ ছিল বাখমুত এবং ভুহলেদারের মাঝামাঝি। কুর্স্ক আক্রমণে ইউক্রেনিয়রা ৩০ হাজার সেনা ব্যবহার করেছে। তারা আশা করেছিল যে, রুশরা ডোনেটস্ক অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে কুর্স্ক অঞ্চলে মোতায়েন করবে; কিন্তু সেটা হয়নি। ইউক্রেনের যে ইউনিটগুলি কুর্স্ক আক্রমণে গিয়েছে, সেগুলি ছিল তাদের অপেক্ষাকৃত ভালো ইউনিট এবং সেই ইউনিটগুলি রসদ পাবার ক্ষেত্রে ডোনেটস্ক অঞ্চলের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক 'ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট'এর সিনিয়র ফেলো রব লী 'দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট'কে বলছেন যে, আরও আগে থেকেই ইউক্রেনিয়দের মানবসম্পদের সমস্যা ছিল; যা কুর্স্ক আক্রমণে আরও খারাপ হয়েছে। অভিজ্ঞ সেনাদের মাঝে হতাহত বেড়ে যাবার কারণে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেনাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করতে হচ্ছে। এগুলি তাদের মূল সমস্যা; যেগুলি রয়েই যাচ্ছে; যদিও তারা হয়তো সামনের দিনগুলিতে আরও 'অপারেশনাল সারপ্রাইজ' নিয়ে আসবে। এই যুদ্ধে সেই পক্ষই হয়তো জিতবে, যে কিনা শেষ পর্যন্ত ক্ষতি সহ্য করে টিকে থাকবে পারবে।

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে রুশরা তাদের যুদ্ধকৌশলকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করেছে। তারা যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিচ্ছে এবং প্রযুক্তিকে যথাসম্ভব ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ড্রোন, গ্লাইড বোমা এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগের ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। আর সংখ্যাগত দিক থেকে ইউক্রেনের চাইতে অনেক এগিয়ে থাকায় রুশরা ব্যাপকভাবে আক্রমণে যেতে সক্ষম হচ্ছে। পশ্চিমা সরকারগুলি যে মুহুর্তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে নিজেদের সহায়তা দিতে গরিমসি করছে, ঠিক তখনই রাশিয়া ডোনেটস্ক অঞ্চলে একের পর এক শহর নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে। জেলেন্সকি রাশিয়ার অভ্যন্তরে কুর্স্ক অঞ্চলে আক্রমণের মাধ্যমে কৌশলগত যে সাফল্য আশা করেছিলেন, তা যে আসছে না, সেটা নিশ্চিত। উল্টো, কুর্স্ক অপারেশনের কারণে ইউক্রেনিয়রা ডোনেটস্ক অঞ্চলে হারতে বসেছে।

Saturday, 12 October 2024

লেবাননে ইস্রাইলি আক্রমণ এবং গাজা গণহত্যার এক বছর – মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ কি?

১২ই অক্টোবর ২০২৪

হিযবুল্লাহ বুঝতে পেরেছে যে, ইস্রাইলের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ-প্রচেষ্টা বড্ড দেরি হয়ে গেছে। গাজায় ইস্রাইলি হামলার সময় সাইডলাইনে বসে থেকে হিযবুল্লাহ কত বড় ভুল করেছে, সেটা এখন পরিষ্কার। বিশেষ করে হিযবুল্লাহর নেতৃত্ব এবং পুরো কমান্ড-কন্ট্রোল কাঠামো যখন ইস্রাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তখন ইরানও তাদের নিজেদের ভূমিতে ইস্রাইলি হামলার বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় ডিটারেন্টকে দুর্বল হতে দেখেছে। 


ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মাইকেল ক্লার্ক 'স্কাই নিউজ'কে দেয়া সাক্ষাতে বলছেন যে, গত ২৭শে জুলাই ইস্রাইলের দখলকৃত গোলান মালভূমি এলাকার মাযদাল শামস শহরে হিযবুল্লাহর রকেট হামলা (যাতে ১২ জন নিহত হয়) হবার পর ইস্রাইল লেবাননে ব্যাপকভাবে হামলা শুরু করে। ইস্রাইল এমনভাবে জবাব দেয়া শুধু করে যেন মাযদাল শামসের ঘটনার জন্যেই তারা অপেক্ষা করছিলো। ইস্রাইলের লেবাননে হামলা নিয়ে প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন 'জেনস'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বর্তমানে লেবাননে ইস্রাইলের হামলার শুরুতে ৩০শে জুলাই হিযবুল্লাহর সিনিয়র নেতা ফুয়াদ শুকরকে হত্যা করা হয়। হিযবুল্লাহ প্রায় এক মাস পর ২৫শে অগাস্ট উত্তর ইস্রাইলে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ রকেট এবং শেল নিক্ষেপ করে এই হত্যার জবাব দেয়। তবে এই জবাবের কথা চিন্তা করে আগেভাগেই ইস্রাইলিরা পুরো লেবানন জুড়ে হিযবুল্লাহর রকেটের অবস্থান এবং অবকাঠামোর উপর বিমান হামলা করে। ইস্রাইল দাবি করে যে, এই হামলায় হিযবুল্লাহর ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রকেট এবং শেল নিক্ষেপ সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে। তথাপি ১লা সেপ্টেম্বর থেকে 'জেনস'এর হিসেবে ইস্রাইলে হিযবুল্লাহর হামলা প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে; এবং কমপক্ষে একই হারে লেবাননে ইস্রাইলের হামলাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর লেবাননে পেইজার এবং ওয়াকিটকি হামলার মাধ্যমে কমপক্ষে ৩২ জনকে হত্যা এবং আরও প্রায় ৩ হাজার জনকে আহত করার পর ইস্রাইলের লেবানন অপারেশন এক ধাপ এগিয়ে যায়। এই হামলা নিঃসন্দেহে হিযবুল্লাহর কমান্ড-কন্ট্রোল অবকাঠামোকে দুর্বল করে ফেলে। যে ব্যাপারটা ইস্রাইলের এই অপারেশনের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে তা হলো, ইস্রাইল এখন আর হিযবুল্লাহর কোন প্রতিশোধমূলক হামলা নিয়ে ভয়ে নেই; বরং তারা নিজেরাই বড় কোন হামলার প্রস্তুতি হিসেবে আগে থেকেই স্বাধীনভাবে কোন অপারেশন চালাতে পারে। পেইজার হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ২০শে সেপ্টেম্বর হিযবুল্লাহ ইস্রাইলি অবস্থানের উপর কমপক্ষে ২৯০টা রকেট এবং শেল নিক্ষেপ করে। তবে ইস্রাইল আবার এর জবাবে বৈরুতে হামলা করে হিযবুল্লাহর স্পেশাল অপারেশনসএর 'রেদওয়ান ফোর্স'এর কমান্ডার ইব্রাহিম আকীলকে হত্যা করে। এর জবাবে হিযবুল্লাহ ২০২৩এর অক্টোবরের পর প্রথমবারের মতো ২২শে সেপ্টেম্বর 'ফাদি-১' (৮০কিঃমিঃ পাল্লা) এবং 'ফাদি-২' (১০৫কিঃমিঃ পাল্লা) ক্ষেপণাস্ত্র এবং ২৫শে সেপ্টেম্বর তেল আভিভ লক্ষ্য করে 'ক্বদর-১' ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, হিযবুল্লাহ তার নীতি অনুযায়ী ইস্রাইলি হামলার পরিধি বৃদ্ধির জবাবে নিজেদের হামলার পরিধিও বৃদ্ধি করেছে। তবে ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বরের মাঝে ইস্রাইল লেবাননে কমপক্ষে ২ হাজার টার্গেটে বোমাবর্ষণ করে; যার মাঝে ছিল রকেট লঞ্চার, মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, সামরিক অবকাঠামো, এবং ইন্টেলিজেন্স অবকাঠামো। এর মাঝে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২৭শে সেপ্টেম্বর হিযবুল্লাহর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কমান্ড বাংকারে হামলা; যেখানে তাদের সর্বোচ্চ নেতা হাসান নাসরাল্লাহসহ কমপক্ষে ২০ জন নেতা নিহত হন; যাদের মাঝে ছিলেন হিযবুল্লাহর দক্ষিণ লেবাননের কমান্ডার আলী খারাকি। এই বিমান হামলার মাধ্যমে হিযুবুল্লাহর যুদ্ধ সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন পর্যন্ত ইস্রাইলি হামলায় বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত এবং কয়েক লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুত হবার খবর পাওয়া যায়।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, ইস্রাইলিরা দাবি করছে যে, তারা হিযবুল্লাহর নেতা হাশিম শাফিউদ্দিনকে হত্যা করেছে। এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও দেখা যাচ্ছে যে, ইরানও এমনভাবে কথা বলছে যেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। ইস্রাইলিরা যে কৌশলটা নিয়ে এগুচ্ছে তা হলো, তারা হিযবুল্লাহকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করছে না; তবে হিযবুল্লাহর নেতৃত্ব এবং সক্ষমতাকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইছে, যাতে করে হিযবুল্লাহ অনেক লম্বা সময় ধরে ব্যাকফুটে চলে যায়। আর এই সময়ের মাঝে ইস্রাইলিরা গাজা এবং লেবাননের সামরিক বাস্তবতাকে পরিবর্তন করে ফেলতে চেষ্টা করবে। আর যদি ইরান কিছু করতে চায়, তাহলে তারা হয়তো বাস্তবতার কারণে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হবে। দক্ষিণ লেবাননের লিটানি নদীর দক্ষিণের বাসিন্দাদেরকে ইস্রাইল সরে যেতে বলছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এরও উত্তরে আওয়ালি নদীর দক্ষিণেও অনেক বাসিন্দাদেরকে সরে যেতে বলেছে। এর অর্থ এটা হতে পারে যে, হয়তো তারা লিটানি নদী এবং আওয়ালি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বোমা হামলা করবে, অথবা এই অঞ্চলকে সেনাবাহিনীর হামলার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে; যা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
 
দক্ষিণ লেবাননের লিটানি নদীর দক্ষিণের বাসিন্দাদেরকে ইস্রাইল সরে যেতে বলছে। শুধু তা-ই নয়, তারা এরও উত্তরে আওয়ালি নদীর দক্ষিণেও অনেক বাসিন্দাদেরকে সরে যেতে বলেছে। এর অর্থ এটা হতে পারে যে, হয়তো তারা লিটানি নদী এবং আওয়ালি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বোমা হামলা করবে, অথবা এই অঞ্চলকে সেনাবাহিনীর হামলার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে


প্রাক্তন ইস্রাইলি কর্মকর্তা এবং ব্রিটিশ-ইস্রাইলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লেভি 'মিডলইস্ট আই'কে দেয়া এক সাক্ষাতে বলছেন যে, লেবাননে ইস্রাইলের পেইজার আক্রমণে এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইস্রাইল এখন লেবাননে তার আক্রমণকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করবে। এটা ইস্রাইলের পক্ষে সম্ভব হয়েছে কারণ এক বছর ধরে গাজায় হামলা চালিয়ে যাবার সময় তার মার্কিনীদের কাছ থেকে কোন বাধার সন্মুখীন হওয়া তো দূরে থাক, ইস্রাইলিরা দেখেছে যে, মার্কিনীরা ইস্রাইলের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। এর ফলে ইস্রাইলিরা নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা যা কিছুই করুক না কেন, সেটা ওয়াশিংটন সমর্থন করে যাবে। ইস্রাইলে এখন কোন কূটনীতি নেই; সেখানে সকল চিন্তাই এখন সামরিক। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একদিকে যেমন নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে চাইছেন, তেমনি তিনি ইস্রাইলের আদর্শিক ব্যাপারগুলিকে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে ইস্রাইলের পার্লামেন্টে যারা নেতানিয়াহুর বিরোধী তাদেরকেও লেবানন অপারেশনের জন্যে গ্রিন লাইট দিতে দেখা গিয়েছে।

‘আল-জাজিরা'র সাথে সাক্ষাতে প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক এবং 'দ্যা এরাব সেন্টার'এর সিনিয়র ফেলো নাবীল খৌরি বলছেন যে, ইস্রাইলিরা হয়তো হামাসের সক্ষমতাকে কমাতে চাইছে এবং লেবাননের দক্ষিণে লিটানি নদীর কিছুটা উত্তর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা একটা কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে; যার মাধ্যমে তারা পুরো ফিলিস্তিনের এলাকায় ভৌগোলিক পরিবর্তন আনতে চাইছে। যেমন, সকল জনগণকে সরিয়ে দিয়ে তারা গাজার পুরো এলাকা দখলে নিয়ে ইহুদিদের বসবাসের ব্যবস্থা করতে চাইছে। একইসাথে তারা ধীরে ধীরে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। হয়তো লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের ব্যাপারেও তাদের এধরণেরই কোন পরিকল্পনা থাকতে পারে। ২০০৬ সালে ইস্রাইল হিযবুল্লাহর সক্ষমতাকে কমাতে চেষ্টা করেছিল; কিন্তু সেই কাজে তারা ব্যর্থ হয়। এবারে লেবাননে তাদের হামলা অনেক বেশি ভয়াবহ। হয়তো তারা একইসাথে লেবাননের নেতৃত্বের কাঠামোকেও পরিবর্তন করে ফেলতে চাইছে। এই মুহুর্তে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে লেবাননে কোন প্রেসিডেন্ট নেই; একটা কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে কর্মকান্ড চলছে। হয়তো এই সুযোগে ইস্রাইল এমন কাউকে লেবাননের সরকারে দেখতে চাইতে পারে, যে ইস্রাইলের বন্ধুও যদি না হয়, অন্ততঃ ইস্রাইলের বিরোধিতা করবে না। আর যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো ইস্রাইল কোন প্রকারের অস্ত্রবিরতি মানবে না; সেটা অতি স্বল্প সময়ের জন্যেও যদি হয়। কোন স্থিতিশীল শান্তিতেও ইস্রাইল আগ্রহী নয়। নেতানিয়াহু সরকারের বিরোধীরাও যুদ্ধবিরতি না করার জন্যে এবং জিম্মিদের উদ্ধার না করার জন্যে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছে। হোয়াইট হাউজে বাইডেন প্রশাসন এব্যাপারে সকল কিছুই জানে; কিন্তু কিছুই করেনি।

এক বছর ধরে গাজায় ৪১ হাজার মানুষ হত্যায় যুক্তরাষ্ট্র শুধু সম্মতিই দিয়ে যায়নি; সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে ইস্রাইলকে সুরক্ষা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সকল পশ্চিমা দেশও ইস্রাইলের সুরক্ষায় সামরিক শক্তি পাঠিয়ে সরাসরি অংশ নিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক এবং ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল রাষ্ট্র ইস্রাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে কিছুই করেনি। ইস্রাইল, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব এক পক্ষে এসে গণহত্যাকে সার্টিফিকেট দেয়াটা একদিকে যেমন দেউলিয়া হওয়া বিশ্বব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়, তেমনি তা মুসলিম বিশ্বে বড় আকারের পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেও আগের চাইতে অনেক বৃদ্ধি করে।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, এক বছর আগে হামাসের হামলার মাধ্যমে গাজায় ইস্রাইলের বোমাবর্ষণ শুরু হয়। হামাসের নেতৃত্ব গাজার বাইরেও আঞ্চলিকভাবে ইস্রাইল-বিরোধী একটা সংঘাত শুরু করতে চাইছিলো। এবং এক বছর পর ইস্রাইল গাজা, লেবানন, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়াতে যুদ্ধ করছে; এমনকি ইরানেও হামলা করা পরিকল্পনা করছে। তবে আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো, এক বছর পর এই সংঘাত আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হলেও সেখানে ইস্রাইল ব্যাকফুটে নেই; তারা আক্রমণে রয়েছে। তারা হামাসের ১৭ হাজারের বেশি সদস্যকে হত্যা করেছে বলে দাবি করছে; এবং হামাসের ২৪টা ব্যাটালিয়নের কাঠামোকে ধ্বংস করেছে। তবে এর মাধ্যমে ইস্রাইল কত হাজার মানুষকে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করবে, তার হিসেব নেই। তথাপি এর মাধ্যমে ইস্রাইল এখন হিযবুল্লাহর দিকে নজর দিতে পারছে। এবং তারা হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে সেটাই করছে, যারা তারা হামাসের বিরুদ্ধে করেছিলো - হিযুবুল্লাহর সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দুই স্তরের প্রায় সকলকেই তারা হত্যা করেছে। ইস্রাইল বলছে যে, তারা ইস্রাইলের উপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নেবে। ইস্রাইলি মিডিয়া বলছে যে, আমেরিকানরা ইস্রাইলকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিতে চাইছে, যদি ইস্রাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিকে হামলা করা থেকে বিরত থাকে। তবে ইস্রাইল যদি ইরানের তেলের স্থাপনায় (যেমন খারগ দ্বীপ) হামলা করে বসে, তাহলে এর ফলাফল হবে মারাত্মক। ইস্রাইল বলছে যে, এটা তাদের জন্যে মধ্যপ্রাচ্যকে পরিবর্তন করার একটা অভূতপূর্ব সুযোগ; আর আরবের অনেক নেতাই ইস্রাইলের সাথে একমত। তবে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ২০২৩এর অক্টোবরের ৭ তারিখের আগে যা ছিলো, সেখানে ফেরত যাবে না।

প্রায় দশ মাস ধরে ইস্রাইল যখন গাজায় ব্যাপক বোমা হামলা করছিলো, তখন হিযবুল্লাহ ইস্রাইলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকারে সংঘাতে জড়িয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র গত অগাস্ট মাস থেকেই হিযবুল্লাহ ইস্রাইলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হামলা শুরুর চেষ্টা করেছে; যখন ইস্রাইল গাজার যুদ্ধকে গুছিয়ে নিয়ে হিযবুল্লাহর সক্ষমতাকে ধ্বংস করার জন্যে পুরো শক্তিকে নিয়োজিত করেছে। হিযবুল্লাহ বুঝতে পেরেছে যে, ইস্রাইলের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ-প্রচেষ্টা বড্ড দেরি হয়ে গেছে। গাজায় ইস্রাইলি হামলার সময় সাইডলাইনে বসে থেকে হিযবুল্লাহ কত বড় ভুল করেছে, সেটা এখন পরিষ্কার। বিশেষ করে হিযবুল্লাহর নেতৃত্ব এবং পুরো কমান্ড-কন্ট্রোল কাঠামো যখন ইস্রাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তখন ইরানও তাদের নিজেদের ভূমিতে ইস্রাইলি হামলার বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় ডিটারেন্টকে দুর্বল হতে দেখেছে। এক বছর ধরে গাজায় ৪১ হাজার মানুষ হত্যায় যুক্তরাষ্ট্র শুধু সম্মতিই দিয়ে যায়নি; সামরিক সহায়তা পাঠিয়ে ইস্রাইলকে সুরক্ষা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সকল পশ্চিমা দেশও ইস্রাইলের সুরক্ষায় সামরিক শক্তি পাঠিয়ে সরাসরি অংশ নিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক এবং ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল রাষ্ট্র ইস্রাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে কিছুই করেনি। এহেন পরিস্থিতিতে ইস্রাইল যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ইচ্ছামতো চলবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এর ফলশ্রুতিতে ইস্রাইলকে যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের যে সরকারগুলির মাধ্যমে ইস্রাইলের সীমান্তগুলি নিরাপদে থাকছে, সেই সরকারগুলি ইস্রাইলের পক্ষে তাদের নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ইস্রাইল, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব এক পক্ষে এসে গণহত্যাকে সার্টিফিকেট দেয়াটা একদিকে যেমন দেউলিয়া হওয়া বিশ্বব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়, তেমনি তা মুসলিম বিশ্বে বড় আকারের পরিবর্তনের সম্ভাবনাকেও আগের চাইতে অনেক বৃদ্ধি করে।