চাগোস দ্বীপপুঞ্জ – ভারত মহাসাগরে ব্রিটেন
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় হঠাৎ করেই ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত চাগোস দ্বীপপুঞ্জকে ব্রিটিশরা মরিশাসের হাতে তুলে দেয়। প্রায় দুই বছর ধরে চলা আলোচনার ফলাফল হিসেবে 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশান টেরিটোরি' হিসেবে পরিচিত ৫০টারও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জ এখন থেকে মরিশাসের অধীনে থাকবে। ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, গত ৩রা অক্টোবর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রাভিন্দ যুগনথএর মাঝে আলোচনার পর চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের হাতে তুলে দেয়ার যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়। একইসাথে সেখানে বলা হয় যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ ব্রিটেনের কাছে ৯৯ বছরের জন্যে লীজ দেয়া হয়েছে। এই চুক্তির পিছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সমর্থন রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে যে ব্যাপারটা সবচাইতে বেশি আলোচনায় আসছে, তা হলো দিয়েগো গার্সিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।
ব্রিটিশ কনজারভেটিভ রাজনৈতিক দল লেবার সরকারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা করলেও কেউই ভুলে যাননি যে, ২০২২ সালে কনজারভেটিভরা ক্ষমতায় থাকার সময়েই চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা হয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে দুই রাজনৈতিক দলই একই লক্ষ্যে এগিয়েছে; যদিও তারা এখন রাজনৈতিক স্বার্থে একে অপরকে দোষারোপ করছে। তবে মার্কিন রিপাবলিকান দলের অনেকেই আবার ব্রিটেনের এই চুক্তির ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। রক্ষণশীল মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'হাডসন ইন্সটিটিউট'এর সিনিয়ন ফেলো লিউক কফি 'পলিটিকো'কে বলছেন যে, এই চুক্তি নিঃসন্দেহে চীনকে সহায়তা করবে। তিনি বলছেন যে, ৯৯ বছরের লীজের মাঝে চিন্তাকে বেঁধে ফেললে হবে না। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন হংকংকে ছেড়ে দেয়ার পর এর ফলাফল কেমন ছিল সেটা দেখতে হবে। এটা লেবার সরকারের একটা বড় ভুল। যারা জিবরালটার এবং ফকল্যান্ডসকে ব্রিটেনের সাথে রাখার পক্ষপাতি, তারা যথেষ্টই চিন্তিত হবেন। 'দ্যা টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন কর্মকর্তারা লেবার সরকারকে সতর্ক করেছিল যে, দিয়েগো গার্সিয়া মরিশাসের হাতে ছেড়ে দিলে চীনারা এর আশেপাশের দ্বীপগুলিতে 'লিসেনিং পোস্ট' বা আঁড়ি পাতার যন্ত্রপাতি স্থাপনের চেষ্টা করতে পারে।
ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র এক লেখায় জ্যাক ওয়াটলিং ব্রিটিশ সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন যে, এতে একদিকে যেমন ভারত মহাসাগরে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্বার্থ সমস্যায় পড়তে পারে, তেমনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিবরালটার ও ফকল্যান্ডস নিয়েও একই রকমের দাবি উঠতে পারে। তিনি বলছেন যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব ছেড়ে দেয়ার ফলে দিয়েগো গার্সিয়ার আশেপাশের দ্বীপগুলিতে ব্রিটেনের আইনী অধিকার থাকবে না। এমতাবস্থায় এই দ্বীপগুলিকে মরিশাসের সরকার যদি অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চায়, তখন সমস্যা তৈরি হতে পারে। কারণ মরিশাসে মূল বিনিয়োগকারী সর্বদাই চীন। এছাড়াও এই দ্বীপগুলির আশেপাশের সমুদ্রে চীনা মাছ ধরার জাহাজের উপরেও ব্রিটিশদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আর এসকল মাছ ধরা জাহাজ যে চীনা নৌবাহিনীর জন্যে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহের কাজ করে, তা মোটামুটি সকলেরই জানা।
দিয়েগো গার্সিয়া - ‘ফুটপ্রিন্ট অব ফ্রিডম'
১৯৬৭ সালে মার্কিনীরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ৫০ বছরের জন্যে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ লীজ নেয়। 'বিবিসি' বলছে যে, ব্রিটিশরা এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জোরপূর্বক মরিশাস এবং সেইশেলে পাঠিয়ে দেয়। মূলতঃ ভারত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় এবং দ্বীপে স্বল্পসংখ্যক লোকের বাস থাকায় মার্কিনীরা এই দ্বীপের ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছিলো। এর জন্যে মার্কিনীরা ব্রিটিশদের কাছে 'পোলারিস' পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার সময় ১৪ মিলিয়ন ডলারের ডিসকাউন্টও দিয়েছিল। দ্বীপের আশেপাশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ব্রিটিশদের; যদিও ঘাঁটির নিরাপত্তার জন্যে মার্কিনীরা রয়েছে।
দ্বীপটার আকৃতি অনেকটা পায়ের ছাপের মতো হওয়ায় একে 'ফুটপ্রিন্ট' হিসেবেও ডাকেন অনেকে। তবে মার্কিনীরা অফিশিয়ালি এই দ্বীপকে বলে 'ফুটপ্রিন্ট অব ফ্রিডম'। মার্কিন বিমান বাহিনীর ম্যাগাজিনের এক লেখায় উল্লেখ করা হয় যে, আফগানিস্তানে 'ফ্রিডম' আনতে মার্কিন 'বি-২' বোমারু বিমানগুলি কিভাবে এই ঘাঁটির সহায়তা নিয়েছিল। আকাশ থেকে আকাশে রিফুয়েলিংএর জন্যে ট্যাঙ্কার বিমানগুলি এই ঘাঁটি থেকেই অপারেট করেছে। এছাড়াও পরবর্তীতে 'বি-৫২', ‘বি-১' এবং 'বি-২' বোমারু বিমানগুলি এই ঘাঁটি থেকে অপারেট করে আফগানিস্তান, ইরাক এবং অন্যান্য দেশের উপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। এই ঘাঁটিতে মার্কিন নৌবাহিনীর কয়েকটা পরিবহণ জাহাজ যুদ্ধ সরঞ্জাম (যেমন ট্যাংক, আর্মার্ড ভেহিকল, আর্টিলারি) এবং রসদসহ সর্বদা অবস্থান করে; যাতে করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যেকোন প্রয়োজনে তারা অতি দ্রুত সামরিক মিশন শুরু করতে পারে। এছাড়াও এই দ্বীপে রয়েছে মার্কিন স্পেস কমান্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। স্পেস কমান্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এখানে রয়েছে '২০তম স্পেস কন্ট্রোল স্কোয়াড্রন' যার অধীনে রয়েছে 'গ্রাউন্ড বেজড ইলেকট্রো অপটিক্যাল ডীপ স্পেস সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম'; যা মূলতঃ শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে আকাশে সকল স্যাটেলাইটের উপর নজর রাখে। এটা বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এরকম মাত্র তিনটা স্থাপনার একটা। এছাড়াও রয়েছে '২১তম স্পেস অপারেশস স্কোয়াড্রন'; যা মূলতঃ স্যাটেলাইট 'ট্র্যাকিং স্টেশন', যার মাধ্যমে আকাশে সকল মার্কিন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা সারা বিশ্বে এরকম ৭টা মার্কিন স্থাপনার একটা। এগুলি বলে দিচ্ছে যে, মার্কিনীদের মহাকাশ নিরাপত্তার জন্যে এই ঘাঁটির গুরুত্ব কতটুকু।
দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা ধারণা পাওয়া যায় 'বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে। কয়েকজন শ্রীলঙ্কান তামিলের অভিবাসন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কয়েক মাস চেষ্টার পর 'বিবিসি', বিচারক এবং আইনজীবিরা দিয়েগো গার্সিয়াতে যাবার সুযোগ পান। কিন্তু মার্কিনীরা শেষ পর্যন্ত ভিজিটরদের খানাদান এবং থাকার জায়গা দেয়ার বিরোধিতা করেছিলো। ভিজিটরদের সকলকে ভীষণরকম নিয়ন্ত্রণ মেনে সেই দ্বীপে যেতে হয় এবং সামরিক এসকর্ট ছাড়া এক মুহুর্ত চলতে দেয়া হয়নি। এমনকি 'বিবিসি' এই শর্তে সেখানে যেতে পারে যে, মার্কিনীরা কি কি ব্যাপারে ভিজিটরদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, সেগুলি যেনো উল্লেখ করা না হয়! এই দ্বীপে কোন বাণিজ্যিক ফ্লাইট নেই; কোন বেসামরিক জাহাজেরও এই দ্বীপের কাছাকাছি যাবার অনুমতি নেই।
চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের কাছে দিয়ে দেয়ার ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত মার্কিনীদের পছন্দ হবার কথা নয়; যদিও ওয়াশিংটনের অফিশিয়াল বার্তায় এর সমর্থনেই কথা বলা হয়েছে। অন্ততঃ মার্কিনীদের এত কাছের বন্ধুর সাথে কোনরূপ দ্বন্দ্বের খবর সামনে আসুক, সেটা কেউই চায় না। তবে 'নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে' এই দ্বন্দ্ব যে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা দুনিয়ার অপর প্রান্তে দক্ষিণ আমেরিকায় ভূরাজনৈতিক খেলায় দৃশ্যমান।
ম্যাজেলান প্রণালির উপর কর্তৃত্ব চায় যুক্তরাষ্ট্র
২০২৩এর ডিসেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনাতে সরকার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উগ্র লিবারাল অর্থনীতিবিদ জেভিয়ার মিলেই প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে দুই দশকের অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে তিনি 'শক থেরাপি' বাস্তবায়ন করছেন বলে বলেছেন। যার প্রতিবাদে মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে অনেকেই রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। ক্ষমতায় এসেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে 'নিঃশর্ত বন্ধুত্বে'র ঘোষণা দেন এবং ইউক্রেন ও ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই আর্জেন্টিনার 'ব্রিকস' জোটের বৈঠকে যোগদান বন্ধ করার ঘোষণা দেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, গত এক'শ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক লিবারালিজম ও অর্থনৈতিক ক্যাপিটালিজমে মিল থাকা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনার সরকারগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব রেখে চলেছে। গত এপ্রিল মাস থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় সর্বোচ্চ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল লরা রিচার্ডসন তিনবার আর্জেন্টিনা সফর করেছেন। এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র আর্জেন্টিনাকে একটা 'সি-১৩০এইচ' পরিবহণ বিমান অনুদান হিসেবে দেয়; যা ম্যাজেলান প্রণালি এবং এন্টার্কটিকায় আর্জেন্টিনার সামরিক উপস্থিতিতে সহায়তা করবে বলে বলা হয়। এছাড়াও জুলাই মাসে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মার্কিন 'সাউদার্ন কমান্ড'এর হেডকোয়ার্টার্স ভিজিটে যান। এর মাঝে এপ্রিল মাসে জেনারেল রিচার্ডসন ম্যাজেলান প্রণালিতে অবস্থিত আর্জেন্টিনার সর্বদক্ষিণের শহর উশুআয়িয়াতে যান; যেখানে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মিলেই নিজে তাকে বরণ করেন। মিলেই ঘোষণা দেন যে, উশুআয়িয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হবে। এটা যে মার্কিন ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের অংশ, তা কারুরই বুঝতে বাকি ছিল না। কারণ গত মার্চে জেনারেল রিচার্ডসন মার্কিন সিনেটের জন্যে তৈরি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, তার অধীনে 'সাউদার্ন কমান্ড'এর একটা প্রধান লক্ষ্য হলো ল্যাটিন আমেরিকাতে চীন ও রাশিয়ার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা।
স্প্যানিশ পত্রিকা 'এল পাইস'এর এক লেখায় আর্জেন্টিনার সাংবাদিক কার্লোস পাগনি বলছেন যে, ল্যাটিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের চীন-বিরোধী নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখানে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সমুদ্র বাণিজ্যের পথ। ২০১৬ সালে পানামা খালের সম্প্রসারণ করার পর সেখান দিয়ে বছরে ১৪ হাজার জাহাজ যাচ্ছে; যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৬ শতাংশ। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ সবচাইতে বেশি হলেও চীনের পণ্যবাহী জাহাজ ১৩ শতাংশ। যদি তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন সংঘাত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিঃসন্দেহে পানামা খাল দিয়ে চীনা জাহাজ যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তখন চীনা জাহাজগুলি বাধ্য হবে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণে ম্যাজেলান প্রণালি হয়ে যেতে। একারণেই যুক্তরাষ্ট্র চাইছে চীনারা যাতে সর্বদক্ষিণের এই অঞ্চলে তাদের জাহাজগুলিকে সাপ্লাই এবং মেরামতের জন্যে লজিস্টিকস ঘাঁটি তৈরি করতে না পারে। প্রেসিডেন্ট মিলেই মার্কিন জেনারেলকে সরাসরিই বলেছেন যে, আর্জেন্টিনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই চীনারা এন্টার্কটিকায় তাদের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। এছাড়াও আর্জেন্টিনার নিউকুয়েন রাজ্যে আন্দিজ পর্বতমালায় পাতাগোনিয়া মরুভূমিতে চীনারা একটা মহাকাশ গবেষণাগার করেছে। মার্কিন সিনেটের সামনে জেনারেল রিচার্ডসন বলেছেন যে, চীনারা এই গবেষণাগারের মাধ্যমে মহাকাশে সকল স্যাটেলাইটের উপর নজর রাখছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে চীনারা মার্কিন সামরিক স্যাটেলাইটের উপর হামলা করতে পারে। মার্কিন দুশ্চিন্তার উপর ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট মিলেই চীনা গবেষণাগারে আর্জেন্টিনার পরিদর্শক পাঠিয়েছেন। কার্লোস পাগনি বলছেন যে, চীনারা মার্কিন স্বার্থের পক্ষে আর্জেন্টিনার এই পদক্ষেপগুলি কিভাবে দেখবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে তারা যদি আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাথে চীনের মুদ্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ রয়েছে, সেটা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মারাত্মক সমস্যা পড়ে যাবে।
মার্কিন 'এফ-১৬' বনাম ব্রিটিশ ফকল্যান্ডস
ক্ষমতা নেয়ার পাঁচ মাসের মাঝে গত এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মিলেইএর সরকার পাকিস্তানের কাছ থেকে 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে ডেনমার্কের সাথে ২৪টা পুরোনো 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান কেনার জন্যে চুক্তি করে। আর্জেন্টাইন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে 'রয়টার্স' বলছে যে, এই চুক্তির মূল্য প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। 'ডিফেন্স নিউজ' বলছে যে, পাকিস্তানের কাছ থেকে চীন-পাকিস্তানে নির্মিত 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান ক্রয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবার আশংকা করেছিলেন অনেকেই। তবে অনেকেই আর্জেন্টিনার 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সাথে ব্রিটেনের কাছ থেকে ফকল্যান্ডস পুনরুদ্ধারের বিষয়টাকে একত্রে দেখছেন। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মিলেই ক্ষমতায় এসেই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থাকা ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বলেন যে, এই দ্বীপগুলির উপর আর্জেন্টিনা তার দাবি কখনোই ছাড়বে না। ভারত মহাসাগরে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ মরিশাসের কাছে যাবার পর আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডায়ানা মনডিনো সোশাল মিডিয়া 'এক্স'এ লেখেন যে, নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে আর্জেন্টিনা মালভিয়ানস (ফকল্যান্ডস) দ্বীপপুঞ্জকে পুনরুদ্ধার করবে। আর্জেন্টিনায় মার্কিন দূতাবাসের গত ১৮ই এপ্রিলের এক বার্তায় বলা হচ্ছে যে, ২০০৩ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আর্জেন্টিনাকে ৪০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক অনুদান দিচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, ডেনমার্কের কাছ থেকে ২৪টা 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান কেনার মাধ্যমে দেশটা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। এই যুদ্ধবিমানগুলির মাধ্যমে আর্জেন্টিনার প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হবে বলে আশা করে দূতাবাস।
‘দ্যা টেলিগ্রাফ' পত্রিকার এক লেখায় 'ইউকে ডিফেন্স জার্নাল'এর সম্পাদক জর্জ এলিসন বলছেন যে, ব্রিটেনের ভয় আর্জেন্টিনা নয়; বরং আসল ভয় হলো ব্রিটেনের নিজেদের সামরিক শক্তির অবক্ষয়। বিশেষ করে ২০১০ সালের পর থেকে ব্রিটিশ রয়াল নেভির যে ক্ষতি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ে পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা যথেষ্ট নয়। একটা শক্তিশালী ম্যারিটাইম শক্তি না থাকলে সেটাকে ব্রিটেনই বলা যাবে না। বেশিরভাগ মানুষ ঠিকই ধরতে পারছেন যে, ফকল্যান্ডসে আর্জেন্টিনার আক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। আপাততঃ মনে হতে পারে যে, রিফুয়েলিং বিমানের সহায়তায় ‘এফ-১৬' যুদ্ধবিমানের ছত্রছায়ায় আর্জেন্টিনা উভচর হামলা করলে ফকল্যান্ডসের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলা সম্ভব। তবে বাস্তবতা হলো, আর্জেন্টিনার জীর্ন সরঞ্জাম, আর্থিক দুর্গতি এবং লজিস্টিক্যাল ইস্যুর কারণে এহেন মিশন খুবই কঠিন। প্রথমতঃ যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান আর্জেন্টিনা ব্যবহার করতে পারবে না। দ্বিতীয়তঃ আর্জেন্টিনার মূল ভূখন্ড থেকে সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ দূরত্বে ফকল্যান্ডসে উভচর অভিযান চালাবার মতো লজিস্টিক্যাল সক্ষমতা আর্জেন্টিনার রয়েছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আর যদি ব্রিটেন আগে থেকে ইন্টেলিজেন্স পেয়ে যায়, তাহলে ব্রিটিশ 'টাইফুন' যুদ্ধবিমানের বাধার কারণে এধরণের অপারেশন অসম্ভব হয়ে যাবে। তৃতীয়তঃ ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার 'জেনারেল বেলগ্রানো' যুদ্ধজাহাজ ব্রিটিশ সাবমেরিনের আক্রমণে ডুবে যাবার পর আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এই কারণেই আপাততঃ আর্জেন্টিনার জন্যে ফকল্যান্ডসকে আবার দখল করা বাস্তব নয়। তবে বর্তমানে ব্রিটেনের এটাক সাবমেরিন রয়েছে মাত্র ৬টা। উভচর অভিযানে যাবার জন্যে দু'টা জাহাজ 'এলবিয়ন' এবং 'বুলওয়ার্ক' কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলিতে একসাথে ৮টার বেশি 'এফ-৩৫' যুদ্ধবিমান কখনোই বহণ করা যায়নি। এছাড়াও এই জাহাজগুলিতে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দেয়ার মতো 'ক্রোজনেস্ট' রাডারবাহী হেলিকপ্টারগুলিও প্রস্তুত নয়। কাজেই নিজেদের নৌবাহিনীর সক্ষমতা যখন দিন দিন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, তখন ফকল্যান্ডসকে পুনর্দখল করতে পারার সক্ষমতা ব্রিটেনের রয়েছে - এমন বার্তা ব্রিটেন দিতে পারছে না।
‘রুসি'র জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব হস্তান্তরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দরকষাকষির বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা যেতো। কিন্তু যে ব্যাপারটা তিনি আলোচনা করেননি তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় সামরিক ঘাঁটি নিয়ে কোন দরকষাকষি হয়েছে বা হতে পারে কিনা। অন্ততঃ দক্ষিণ আমেরিকার ম্যাজেলান প্রণালিতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরির সিদ্ধান্ত এবং আর্জেন্টিনাকে 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করলো যে, ‘নতুন ঠান্ডা যুদ্ধে' বিশ্বব্যাপী সামরিক ঘাঁটি তৈরি এবং চীনা প্রভাব নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারকে মার্কিনীরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি এন্টার্কটিকায় চীনা বৈজ্ঞানিক অভিযান ও পাতাগোনিয়া মরুভূমিতে চীনা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার হয়েছে। মার্কিন 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমান সাড়ে ৪'শ কিঃমিঃ দূরে ব্রিটেনের ফকল্যান্ডসের বিরুদ্ধে বাস্তব কোন হুমকি তৈরি না করলেও তা ম্যাজেলান প্রণালির উপর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নের মাঝে ফেলবে। একইসাথে আর্জেন্টিনার উগ্র লিবারাল প্রেসিডেন্টের নীতি ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ প্রভাবে থাকা প্রতিবেশী দেশ চিলি এবং 'ব্রিকস'এর সদস্যদেশ ব্রাজিলের সাথে উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। নতুন বাস্তবতায় মার্কিনীদের কাছে 'নিরপেক্ষ' বলে কোন কিছুই থাকছে না; যা মূলতঃ বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ প্রভাবকেই চ্যালেঞ্জ করছে। এতকাল মার্কিনীরা দিয়েগো গার্সিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল না; কারণ ব্রিটিশরা চাগোস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে এবং আশেপাশের দেশেগুলির সাথে কূটনৈতিক এবং ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংএর মাধ্যমে মার্কিন ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এখন চীনের সাথে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাস্তবতায় এবং তাইওয়ান নিয়ে যুদ্ধের শংকার মাঝে মার্কিনীরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেছে যে, তাদের দিয়েগো গার্সিয়ার ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যাপারে ব্রিটিশদের সাথে নতুন করে দরকষাকষিতে যেতে হবে।