Sunday 13 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ … বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ধেয়ে আসছে!

১৩ই মার্চ ২০২২

কেউ কেউ মনে করছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি মিশরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তারা একইসাথে মিশরের নিজস্ব কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছেন। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বই যখন করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মিশরসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষাকর্তা হবার ধারণাটা অবাস্তবই বটে। বাম্পার ফলনের বছরেও কোটি কোটি মানুষ যখন না খেয়ে থাকছে, তখন তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশ্বিক বন্টন ব্যবস্থার অসারতাকেই তুলে ধরে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ২০১১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ১০ই মার্চ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন কৃষি দপ্তরের হিসেবে রাশিয়া বিশ্বের সবচাইতে বড় গম রপ্তানিকারক দেশ; ইউক্রেন হলো এক্ষেত্রে চতুর্থ। ‘ওইসি’র হিসেবে ২০১৯ সালে রাশিয়া এবং ইউক্রেন মিলে বিশ্বের মোট রপ্তানিকৃত গমের সাড়ে ২৫ শতাংশ সরবরাহ করেছিল। আর এই দুই দেশ গোটা বিশ্বের গম এবং বার্লি রপ্তানি বাজারের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে থাকে। ইউক্রেন ভুট্টা এবং সূর্যমুখী তেলেরও বড় জোগানদাতা। এছাড়াও এই দুই দেশ বিশ্বের রাসায়নিক সারের একটা বড় উৎস। যুদ্ধটা যেভাবেই শেষ হোক না কেন, করোনা মহামারির ঠিক পরেই এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বের বহু দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের ‘কমিটি অন ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি’র প্রধান গ্যাব্রিয়েল ফেরেরো ডে লোমা ওসোরিও ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, করোনা আসার আগেই বিশ্বে ৬৬ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যাভাবের মাঝে ছিল। করোনার পর এটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটিতে।

ইউক্রেনের অনেক বন্দরেই অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; আজভ সাগর অঞ্চলে জাহাজ চলাচলই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওলেগ উসতেনকো ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, ইউক্রেনে গম চাষ শুরুর সময় হলো মার্চের প্রথম ১০ দিনের মাঝে; আর গমের চারা রোপণ শেষ করতে হবে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের আগেই। যুদ্ধের জন্যে যেহেতু মার্চের অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে, তাই স্বাভাবিক হিসেবে গমের চাষ এবছরে আর সম্ভব হবে না। গম চাষে সবচাইতে উপযোগী অঞ্চলগুলিতেই এখন যুদ্ধ চলছে। আর অদূর ভবিষ্যতে মাইন এবং অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ না সরিয়ে এই অঞ্চলে চাষাবাদ করা যাবে না।

জাতিসংঘের ডে লোমা ওসোরিও বলছেন যে, বাংলাদেশ তাদের মোট গম আমদানির অর্ধেকই রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে আনতো। তবে ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এর চাইতেও বড় হুমকির মাঝে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলি, যারা মূলত কৃষ্ণ সাগরের অপেক্ষাকৃত কমদামি খাদ্যশস্যের উপরেই নির্ভর করেছে এতোদিন। অত্র অঞ্চলের লেবানন, মিশর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন এবং সুদানের মতো দেশগুলিতে গম থেকে তৈরি খাদ্যই প্রধান খাদ্য। এই দেশগুলি আরও আগ থেকেই মূল্যস্ফীতি, অর্থসংকট এবং সংঘাতের কারণে খাদ্যঘাটতির মাঝে ছিল। লেবাননের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে, তাদের গমের মজুত খুব বেশি হলে একমাস টিকবে। দেশটার ৬০ শতাংশ গম আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বৈরুতের রাস্তায় অনেকেই রুটির জন্যে আটা মজুত করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য খাবার তৈরি ও বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। বৈরুতের এক গবেষণা সংস্থার প্রধান রিয়াদ সাদে মনে করছেন যে, এমন একটা সময় চলে এসেছে, যখন মানুষ রুটির জন্যে বিদ্রোহ করতে পারে। অপরদিকে ইয়েমেন তাদের চাহিদার ৯০ শতাংশ গমই আমদানি করে; তাই সেখানে মারাত্মক দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধ এবং খরার কারণে দেশটায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা চলছে কয়েক বছর ধরে। সিরিয়তে গৃহযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘের হিসেবে ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেভিড বীসলি বলছেন যে, অর্থাভাবে তারা সিরিয়াতে ৮০ লক্ষ মানুষের জন্যে খাবার রেশন অর্ধেক করেছেন; আরও কমানো হবে। ঠিক ঐ মুহুর্তেই ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলো। ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে তারা তাদের অর্ধেক গমের সরবরাহ আসতো।



মিশরে ২০২০এর এপ্রিল থেকে ২০২১এর ডিসেম্বরের মাঝে সেখানে ৮০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে গমের মূল্য ৫০ শতাংশ বেড়েছে। মিশর হলো বিশ্বের সবচাইতে বড় গম আমদানিকারক দেশ। ‘এসএন্ডপি গ্লোবাল’এর হিসেবে গত জানুয়ারিতে মিশর ৩৫ লক্ষ টন গম কিনেছে। তাদের ৮০ শতাংশ গমই ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে এসেছে। দেশটার হাতে এই মুহুর্তে ৪ মাসের গম মজুত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট সিসির সরকার ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, তারা রুটির উপর ভর্তুকি কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। অবস্থাটা মিশরের অর্থনীতির জন্যে অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে বলছেন ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর অর্থনীতিবিদ মাইকেল টানচুম। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তুরস্কে খাবার তেলের মূল্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে; আর জনগণ সূর্যমুখী তেল মজুত করতে শুরু করেছে। যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে তুরস্কের ৭০ শতাংশ খাবার তেল আসে।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, তিউনিসিয়ার প্রায় অর্ধেক আমদানিকৃত গম আসে ইউক্রেন থেকে। গমের মূল্য সেখানে ১৪ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। সেদেশে সরকার রুটির মূল্য নির্ধারণ করলেও সকলেই মনে করছেন যে, তাদের জীবনের উপর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বেই। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণের বোঝার কারণে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি আরও আগ থেকেই ধুঁকে চলছিল। ‘ডব্লিউএফপি’র মুখপাত্র আবীর এতেফা বলছেন যে, এবছরে বিশ্বে চাহিদার চাইতে বেশি গম উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে যেখান থেকে গম আসতে হবে, তাতে সময় এবং পরিবহণ খরচ উভয়ের উপরেই চাপ পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে; যার মূলেই রয়েছে ধ্বসে পড়া অর্থনীতি; বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। এতেফা বলছেন যে, খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হলে জনগণের মাঝে অস্থিরতা এবং সহিংসতার আশংকা বৃদ্ধি পাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা সংঘাতের সৃষ্টি করছে। মাইকেল টানচুম মনে করছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি মিশরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তিনি একইসাথে মিশরের নিজস্ব কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছেন। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বই যখন করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মিশরসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষাকর্তা হবার ধারণাটা অবাস্তবই বটে। বাম্পার ফলনের বছরেও কোটি কোটি মানুষ যখন না খেয়ে থাকছে, তখন তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশ্বিক বন্টন ব্যবস্থার অসারতাকেই তুলে ধরে।

No comments:

Post a Comment