Friday 18 March 2022

ইউক্রেনের কাদায় আটকে গেছে রুশ সেনাবাহিনী?

১৯শে মার্চ ২০২২

ইউক্রেনের কাদায় আটকে যাওয়া রুশ ট্যাংক ফেলে দিয়ে গেছে রুশ সেনারা। যেহেতু পুতিন এই আবহাওয়ার সমস্যাগুলিকে একেবারেই আগ্রাহ্য করেছেন, তার অর্থ হলো তিনি নিশ্চয়ই ইউক্রেনের প্রতিরোধ করার সক্ষমতাকে একেবারেই নিচু করে দেখেছেন; আর রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সক্ষমতাকেও যথেষ্ট বড় করে দেখেছেন। রুশ সেনাবাহিনী হয়তো সামনের দিনগুলিতে সিরিয়ার অভিজ্ঞতাগুলিকেই কাজে লাগাতে চাইবেন। সেটা বাস্তবায়িত হলে শহরের ভিতরে হাতাহাতি লড়াই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধের শেষ পরিণতি কি হবে, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছে না। দেশটার পূর্বের শহর খারকিভের যুদ্ধ পরিস্থিতির বর্ণনা কঠিন সংঘাতের কথা বলছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রুশ সেনারা সেখানে আর্টিলারি শেল এবং রকেট নিক্ষেপ করছে; আর ইউক্রেনের সেনারা পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করে সেগুলির খালি বাক্স দিয়ে উঁচু স্তূপ তৈরি করছে। যুদ্ধের প্রথম ক’দিনে ইউক্রেনের সেনারা হতবিহ্বল ছিল; তারা ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে, তারা কি করবে। তবে তিন সপ্তাহ যুদ্ধের পর তারা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ইউক্রেনের সরকারি হিসেবে ১৬ই মার্চ পর্যন্ত খারকিভে মোট ২’শ ৩৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে যে ব্যাপারটা কারুরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না, তা হলো গভীর পুরু কাদার স্তর। হাঁটতে গেলেই কাদার মাঝে ডুবে যায় জুতা। শীতের শেষে বরফ গলতে শুরু করলেই এই কাদার ব্যাপারটা সামরিক অপারেশনের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, রুশ বাহিনীর অনেক গাড়ি, এমনকি ট্যাংক এবং সাঁজোয়া যানও অত্যন্ত গভীর কাদার মাঝে আটকে যাচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাদের প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই কাদার ব্যাপারটা রুশদেরকে যুদ্ধের ফলাফল নিশ্চিত করতে বাধা দিচ্ছে।

‘এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বরফ গলার পর ইউক্রেনের পাকা রাস্তা ছাড়া বাকি সকল রাস্তাই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে। গত দু’শ বছরে ন্যাপোলিয়ন এবং হিটলারের অধীনে সেনাবাহিনীকে কাদার সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বছরে দু’বার এই এলাকার রাস্তাগুলি কাদায় ভরে যায়। সাধারণ মানুষ এই কাদাকে বলে ‘রাসপুতিতসা’। পশ্চিমারা অনেকেই এই কাদাকে সন্মান করে ‘জেনারেল মাড’ বলে থাকে। যুদ্ধের আগে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছিলেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে ইউক্রেনে অপারেশনের সময় পিছিয়ে দেবেন। ২০২১এর নভেম্বরেই ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, বসন্তের কাদা রুশ অপারেশনের সময় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্লেষকেরা পুতিনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারলেও আবহাওয়ার ব্যাপারে তাদের আগাম সতর্কবার্তা পুরোপুরি সঠিক ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধের আগে ‘ইউএস ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর স্পেনসার মেরেডিথ এক লেখায় বলেন যে, ইউক্রেনের সেনারা যদি পাকা রাস্তাগুলি ধ্বংস করে ফেলে, তাহলে বসন্তের শুরুতে রুশ সেনাদের চলাচল খুবই কঠিন হবে। ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক মাইকোলা বেলেস্কভ বলছেন যে, অনেক ক্ষেত্রেই রুশ সেনারা মাঠের মাঝে তাদের ট্যাংক এবং অন্যান্য গাড়ি আটকে যাবার পর পায়ে হেঁটে রওয়া দিতে বাধ্য হয়েছে। এই অবস্থাটা আরও খারাপ হবে যখন আবহাওয়া আরও একটু উষ্ণ হবে এবং এর সাথে বৃষ্টি যুক্ত হবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, মার্চের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হয়ে তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত এই কাদার অবস্থা চলে। সাবেক ফরাসি সামরিক অফিসার মিশেল গোইয়া বলছেন যে, কাদার কারণে রুশ জেনারেলরা হয়তো বাধ্য হবে তাদের বাহিনীকে মূল রাস্তাগুলির উপর সীমাবদ্ধ রাখতে। এর ফলশ্রুতিতে রুশ গাড়িগুলির ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হামলার শিকার হবার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে।

 

মার্কিন মিডিয়া ‘এনবিসি’ বলছে যে, ইউক্রেনের দক্ষিণের শহর মারিউপোলে একটা ভবনের উপর বড় করে লেখা ছিল ‘চিলড্রেন’, যা স্যাটেলাইট ছবিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু গত ১৬ই মার্চ এই ভবনটা রুশরা বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। শহরের নেতৃস্থানীয়রা বলছে যে, ভবনে অনেক নারী এবং শিশু ছিল। বিশ্লেষকেরা কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন যে, হয়তো তার সেনাবাহিনী যখন কাদায় আটকে গেছে, খাদ্য ও জ্বালানি স্বল্পতার মাঝে পতিত হচ্ছে, এবং সেনাদের মাঝে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তখন ইউক্রেনের জনগণের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে পুতিন চেচনিয়া এবং সিরিয়ার অমানবিক কৌশলের দিকেই দৃষ্টি দেবেন।

‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোন একটা দেশের জন্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ট্যাংক ধ্বংসী অস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেন। এর মাঝে রয়েছে ব্রিটিশদের সরবরাহ করা ৩ হাজার ৬’শ ১৫টা ‘এনএলএডব্লিউ’ বা ‘এন’ল’ স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র; জার্মানি দিচ্ছে ১ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র; নরওয়ে ২ হাজার; সুইডেন ৫ হাজার; আর যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে অজানা সংখ্যক জ্যাভেলিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। এর বাইরেও আরও দেশ ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়েছে। ব্রিটেনের ‘এন্ড্রুজ ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ফিলিপস ওব্রায়েন বলছেন যে, অনেক দেশই নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত খালি করে ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে। এগুলি যোগ হয়েছে ইউক্রেনের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে। ‘এন’ল’ এবং ‘জ্যাভেলিন’ উভয় ক্ষেপণাস্ত্রই ট্যাঙ্কের উপর থেকে হামলা করে, যেখানে বর্ম সবচাইতে কম থাকে। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের উপর ভর করে প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’ বলছে যে, রুশরা কমপক্ষে ২’শ ১৪টা ট্যাংক হারিয়েছে; সব ধরনের মিলিয়ে গাড়ি হারিয়েছে ১২’শ ৯২টা। ইউক্রেন হারিয়েছে কমপক্ষে ৬৫টা ট্যাংক এবং মোট ৩’শ ৪৩টা গাড়ি।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডার্টমাউথ কলেজ’এর প্রফেসর জেসন লাইল এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, যুদ্ধে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর চারটা ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা রয়েছে – ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, কাদার প্রতিরোধ ‘রাসপুতিতসা’ এবং সোশাল মিডিয়া দিয়ে প্রচারণা চালনার জন্যে ‘টিকটক’। ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর পাভেল ফেলগেনহাউয়ার বলছেন যে, ইউক্রেনে কেউ কেউ ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘সেইন্ট জ্যাভেলিন’ ডাকতে শুরু করেছে! আর অনেকেই মনে করছেন যে, যেহেতু পুতিন এই আবহাওয়ার সমস্যাগুলিকে একেবারেই আগ্রাহ্য করেছেন, তার অর্থ হলো তিনি নিশ্চয়ই ইউক্রেনের প্রতিরোধ করার সক্ষমতাকে একেবারেই নিচু করে দেখেছেন; আর রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সক্ষমতাকেও যথেষ্ট বড় করে দেখেছেন। ফেলগেনহাউয়ার বলছেন যে, রুশ সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ জেনারেল সিরিয়াতে যুদ্ধ করেছেন। সেখানে আলোপ্পো এবং হমস শহরে মারাত্মক বোমা হামলার পাশাপাশি শহরের ভিতরে যুদ্ধ করার জন্যে সেনাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তারা হয়তো সামনের দিনগুলিতে সেই অভিজ্ঞতাগুলিকেই কাজে লাগাতে চাইবেন। সেটা বাস্তবায়িত হলে শহরের ভিতরে হাতাহাতি লড়াই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।

No comments:

Post a Comment