Saturday 24 August 2024

ভারত কখন বাংলাদেশকে ভয় পাবে?

২৪শে অগাস্ট ২০২৪
চীনা 'জে-১০' যুদ্ধবিমান। বাংলাদেশের ডিটারেন্স হতে হবে এমন, যাতে করে দিল্লীতে ভীতির সঞ্চার হয়। যদি এটা না হয়, তাহলে অযথা অর্থ নষ্ট করার মানে হয় না। এই ডিটারেন্সের প্রথম কাজ হতে হবে শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; যাতে করে কোন প্রকারের বিমান হামলার চিন্তাও যেন দিল্লীর কারুর মাথায় না আসে। 


ত্রিপুরা থেকে আসা পানিতে যখন বাংলাদেশের অর্ধলক্ষ মানুষ বন্যার পানিতে ভাসছে, তখন আলোচনাটা এটা নয় যে, বৃষ্টির পানিতে বন্যা হয়েছে, নাকি ত্রিপুরার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ ভেঙ্গে বন্য হয়েছে। যে ব্যাপারটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ১৯৮০এর দশকে ভারত যখন অভিন্ন নদীর উপর এই বাঁধ দিয়েছিল, তখনই খরা বা বন্যার দায়ভার ভারতের উপর চলে গেছে। তিন দশকে প্রথমবারের মতো যখন এই বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে, তখন প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে যে, ভারত কি না বুঝে এই কাজ করেছে, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের দুর্বল সময়ে রাষ্ট্রকে চাপের মাঝে ফেলতে এই ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে? প্রথমতঃ ভারত এতটা অবুঝ নয় যে, তারা বুঝবে না যে, উজানের বাঁধ খুলে দিলে বাংলাদেশে কি হবে। আর গত পাঁচ দশকে পঞ্চাশের অধিক অভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার এবং বর্ষায় বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত চরম অমানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বৃষ্টির সময়ে বাঁধের দরজা খুলে দেয়াটা ভারতের জন্যে নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। বাংলাদেশে পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত সরাসরি সমর্থন দিয়ে গিয়েছে নিজেদের স্বার্থেই; এমনকি যখন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় মারাত্মক ভাটা পড়েছিল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা চরম সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছিলো, তখনও ভারত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তাদেরকে সমর্থন দিয়ে গিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে ভারত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নতুন এক নজিরও স্থাপন করেছে। এমতাবস্থায় ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেয়াটা এমনি-এমনিই ঘটেছিল – এটা কোন সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ বিশ্বাস করবে না।

ভারত একটা দুর্বল রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকে ব্রিটিশদের ডিজাইন অনুযায়ী ভারত বিভিন্ন প্রকারের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মাঝে একটা হলো, না জানি ভারতের আশেপাশের দেশগুলি (বিশেষ করে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ) ভারতকে কয়েক খন্ডে ভাগ করে ফেলতে চেষ্টা করে। এই ভীতির উপর স্থাপিত বলেই ভারত সর্বদাই তার আশেপাশের দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতের সবচাইতে বড় ভয় হলো, বাংলাদেশে এমন কোন সরকার ক্ষমতায় আসা, যে কিনা ভারতের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করবে। তবে গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা ভারতকে শিখিয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকারগুলি বেশিরভাগ সময়েই হয় ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে, অথবা ভারত-বিরোধী কিছু বুলির মাঝেই নিজেদের কর্মসম্পাদনকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র দেয়ার চেষ্টাটাও একবার করা হয়েছিল; যার ফলাফল বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্যে নেগেটিভ উদাহরণ হয়ে রয়েছে। এই ইতিহাসই দুর্বল ভারতকে বাংলাদেশের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্তে যেতে শক্তি যুগিয়েছে। তারা বাংলাদেশে কে ক্ষমতায় থাকবে সেব্যাপারে যেমন সরব, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের ভারত নীতিকে প্রভাবিত করতেও তারা যথেষ্টই সচেষ্ট। বিশেষ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট বাঁধার পর থেকে ভারত আরও সাহসী হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাথে রাখেনি, তথাপি যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই চেষ্টা করে চলেছে দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে ভারতকে পাশে রাখতে।

দুর্বল ভারত যখন সাহসী হয়ে উঠেছে, তখন তাকে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে কি? অন্ততঃ সাম্প্রতিক সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রের যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে, সেটা পুষিয়ে উঠে ভারতকে ঠেকিয়ে দেয়ার অবস্থানে কি যেতে পেরেছে বাংলাদেশ? উত্তরটা দেয়া বাংলাদেশের যে কারুর জন্যেই কঠিন। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতের সাবভার্সন মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। বিশেষ করে ত্রিপুরার বাঁধ খুলে দেয়ার ঘটনাই বলে দেয় যে, বাংলাদেশের তৈরি করা ডিটারেন্টগুলি এই মুহুর্তে ভারতকে তার সাবভার্সন চালাতে বাধা দিতে পারছে না। তাহলে ভারতকে সাবভার্সন থেকে দূরে রাখতে বাংলাদেশ কি করতে পারে? প্রথমতঃ বাংলাদেশ যদি ভারতকে সাবভার্সন থেকে সরিয়ে সামরিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়, তাহলে এটা হবে প্রথম বিজয়। এটা করতে হলে বাংলাদেশকে তার ইন্টেলিজেন্স এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করতে হবে। আর এই প্রচেষ্টায় যে পদক্ষেপটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ (সম্ভব কিংবা অসম্ভব, তা পরে আলোচিত হয়েছে) তা হলো, বাংলাদেশ থেকে ভারতের দূতাবাস এবং কনসুলেট উঠিয়ে দেয়া। এই পদক্ষেপগুলি ঠিকমতো নিতে পারলে ভারত সাবভার্সনের লাইন থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। দ্বিতীয়তঃ সাবভার্সন কাজ না করলে ভারত বাংলাদেশের উপর সামরিক পদক্ষেপের হুমকিতে যেতে বাধ্য হবে। সামরিক পদক্ষেপের দিকে যেতে বাধ্য করতে পারলে বাংলাদেশ তার সামরিক ডিটারেন্স তৈরিতে মনোযোগী হতে পারবে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে ডিটারেন্স রয়েছে, তা ভারতের আগ্রাসন ঠেকানোতে মোটেই যথেষ্ট নয়। কাজেই বাংলাদেশকে নতুন করে মনোযোগী হতে হবে ডিটারেন্স তৈরিতে। কি করতে হবে সেটা প্রথমে আলোচিত হয়ে; আর এটা কিভাবে সম্ভব হবে, তা শেষে আলোচিত হয়েছে।
 
পাকিস্তান এবং চীনের যৌথভাবে তৈরি 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান। বাংলাদেশের বর্তমান বিমান বাহিনী মিয়ানমারকেও ভয় দেখাতে সক্ষম নয়। তবে পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জামের উপর নির্ভর করা যাবে না; কারণ তারা একদিকে যেমন সেগুলির সাপ্লাই নিয়ন্ত্রণ করবে, তেমনি সেগুলির জন্যে রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে তাদের অস্ত্র তারা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দেবে না। 


নতুন করে ডিটারেন্স তৈরি করা অতি জরুরি

বাংলাদেশের ডিটারেন্স হতে হবে এমন, যাতে করে দিল্লীতে ভীতির সঞ্চার হয়। যদি এটা না হয়, তাহলে অযথা অর্থ নষ্ট করার মানে হয় না। এই ডিটারেন্সের প্রথম কাজ হতে হবে শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; যাতে করে কোন প্রকারের বিমান হামলার চিন্তাও যেন দিল্লীর কারুর মাথায় না আসে। দ্বিতীয় কাজ হতে হবে সমুদ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; যাতে করে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলির উপর ভারত কোন প্রকারের অবরোধ দিতে সাহস না পায়। তৃতীয় কাজ হতে হবে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বহর গড়ে তোলা; যাতে করে ভারত জেনে যায় যে, ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে। চতুর্থ কাজ হতে হবে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা; যাতে করে ভারত বুঝে যায় যে, বাংলাদেশের সাথে সামরিক সংঘাতে যাওয়া মানে ভারতের নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মাঝে ফেলে দেয়া।

প্রথম ডিটারেন্ট - আকাশ প্রতিরক্ষা

প্রথম ডিটারেন্ট বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই মুহুর্তে ৮টা 'মিগ-২৯' এবং দুই স্কোয়াড্রন 'এফ-৭'এর মাঝেই সীমাবদ্ধ। এই বিমান বাহিনী মিয়ানমারকেও ভয় দেখাতে সক্ষম নয়। বাংলাদেশের স্থল-কেন্দ্রিক বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও শুধুমাত্র স্বল্পপাল্লার 'এফএম-৯০', অতি-স্বল্পপাল্লার কাঁধে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান-ধ্বংসী কামান ব্যবস্থার মাঝে সীমাবদ্ধ। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। তবে পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জামের উপর নির্ভর করা যাবে না; কারণ তারা একদিকে যেমন সেগুলির সাপ্লাই নিয়ন্ত্রণ করবে, তেমনি সেগুলির জন্যে রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে তাদের অস্ত্র তারা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই স্কোয়াড্রন এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটার যোগাড় করতে হবে চীন থেকে। 'জে-১০সি' একটা ভালো অপশন হতে পারে। তবে এর সাথে 'পিএল-১২' এবং 'পিএল-১৫' ক্ষেপণাস্ত্র থাকতে হবে; না হলে এই বিমানগুলি যোগাড় করা হবে অর্থহীন।

এয়ার সুপেরিয়রিটি ফাইটারের সাথে তিন থেকে চার স্কোয়াড্রন মাল্টিরোল ফাইটার প্রয়োজন। এই ফাইটারের সক্ষমতা থাকতে হবে নিজেদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার। এজন্যে মধ্যম পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য (এয়ার টু এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে; এবং প্রয়োজনমতো লেজার গাইডেড বোমা, স্যাটেলাইট গাইডেড বোমা, জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারবে আক্রমণে যাবার জন্যে। পাকিস্তান এবং চীনের যৌথভাবে তৈরি 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান এক্ষেত্রে একটা ভালো অপশন হতে পারে। কারণ এতে পশ্চিমা বিমানের মতো সক্ষমতা থাকলেও পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত কোন কম্পোনেন্ট নেই।

এছাড়াও প্রয়োজন কমপক্ষে তিন থেকে চার স্কোয়াড্রন ইন্টারসেপ্টর ফাইটার। এগুলি স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করবে; এবং শত্রুর বোমারু বিমানগুলিকে টার্গেট করবে। এগুলির ভালো ম্যানিউভার করার সক্ষমতা শত্রুর বোমারু বিমানের মিশনকে প্রভাবিত করবে। প্যাক হান্টিংএর মাধ্যমে হয় এই বিমানগুলি আক্রমণকারীদেরকে তাদের ফ্লাইট রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে, অথবা তাদেরকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের (যা সংখ্যায় স্বল্প এবং বেশি দামী) উপরে নির্ভর করতে বাধ্য করবে। এই মুহুর্তে চীনা 'এফ-৭' বিমান অনেক বড় সংখ্যায় পাওয়া সম্ভব। আর এই বিমানগুলি পরিচালনায় এবং মেইন্টেন্যান্সে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বেশ দক্ষ। কাজেই উপরের দুই প্রকারের বিমানের মতো এগুলির সংখ্যা বৃদ্ধিতে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না।

এই মুহুর্তে বাংলাদেশের আকাশ-সীমানায় রাডার কভারেজ মোটামুটি রয়েছে; যদিও আরও কিছু মোবাইল গ্যাপ ফিলার রাডার প্রয়োজন। গ্রাউন্ড-বেজড বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে মধ্য উচ্চতার (১০-১৫কিঃমিঃ উচ্চতা) বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তুরস্কের 'হিসার-ও'এর নাম আসতে পারে। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (১০০কিঃমিঃএর বেশি পাল্লা) হিসেবে তুরস্কের 'সিপার'এর নাম আসতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার জন্যে চীনা 'এফএম-৯০' এবং সুইস 'উরলিকন জিডিএফ' ৩৫মিঃমিঃ গান সিস্টেম বা এর চাইনিজ কপি 'সিএস এএ-৩' আরও অনেক বেশি পরিমাণে প্রয়োজন। কাঁধে বহণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও বাড়াতে হবে।

ফাইটার বিমানের পরিধি বৃদ্ধি করতে গেলে ট্রেনিং স্কোয়াড্রনগুলিকেও বড় করতে হবে। এক'শ থেকে দেড়'শ ট্রেনিং বিমান এক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে। এর মাঝে থাকবে বেসিক ফ্লাইং ট্রেনিং বিমান (পিটি-৬, গ্রোব জি-১২০পি, বিবিটি-২), বেসিক জেট ট্রেইনার (কে-৮ডব্লিউ), এডভান্সড ট্রেইনার (বর্তমানে শুধু 'ইয়াক-১৩০'; এর সাথে যুক্ত হতে পারে চীনা 'এল-১৫')।
 
ভারতকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশকে বাধা দেয়ার অর্থ হলো ভারতের নিজস্ব সমুদ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ঝুঁকির মাঝে পড়ে যাবে। এটা করতে হলে বাংলাদেশের প্রথমেই প্রয়োজন কমপক্ষে ১৬টা সাবমেরিন। এক্ষেত্রে চীনের তৈরি সাবমেরিন সর্বপ্রথমে সামনে আসবে। এই সাবমেরিনগুলির ৪টা অবশ্যই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বহণে উপযোগী হতে হবে; যা শত্রুর ভূমিতে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম হবে। 


দ্বিতীয় ডিটারেন্ট – সমুদ্র প্রতিরক্ষা

সাবভার্সন কাজ না করলে ভারত বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশকে অবরোধ দেয়ার পাঁয়তারা করবে। ভারতীয় নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর থেকে তাড়াতে না পারলে তারা বিভিন্নভাবে তাদের অপচেষ্টা চালিয়ে যেতেই থাকবে। বিশেষ করে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ব্রিটিশরা ভারতকে দিয়ে যাবার কারণে ভারত অনেকটা ধরেই নিয়েছে যে, বঙ্গোপসাগর তাদের পৈতৃক (অর্থাৎ ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রাপ্ত) সম্পত্তি। ভারতকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশকে বাধা দেয়ার অর্থ হলো ভারতের নিজস্ব সমুদ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ঝুঁকির মাঝে পড়ে যাবে। এটা করতে হলে বাংলাদেশের প্রথমেই প্রয়োজন কমপক্ষে ১৬টা সাবমেরিন। এক্ষেত্রে চীনের তৈরি সাবমেরিন সর্বপ্রথমে সামনে আসবে। এই সাবমেরিনগুলির ৪টা অবশ্যই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বহণে উপযোগী হতে হবে; যা শত্রুর ভূমিতে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম হবে (এটা অবশ্য তৃতীয় ডিটারেন্টের অংশ হবে)।

সাবমেরিনগুলিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যে প্রয়োজন হবে ১০টা এন্টি-সাবমেরিন ফ্রিগেট এবং ৪টা এয়ার ডিফেন্স ডেস্ট্রয়ার। এই ফ্লিটে থাকতে হবে দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী সাবমেরিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। প্রতিটা জাহাজে শক্তিশালী সোনারের সাথেসাথে এন্টি-সাবমেরিন হেলিকপ্টারসহ সার্ভেইল্যান্স ড্রোন থাকতে হবে। এছাড়াও এর বাইরেও কমপক্ষে ১২টা জাহাজে দূরপাল্লার (২৫০-৫০০কিঃমিঃ পাল্লা) জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থাকতে হবে। তুরস্কের 'কারা আতমাজা' ক্ষেপণাস্ত্র ২৮০কিঃমিঃ পাল্লা পর্যন্ত টেস্ট করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র বহণের জন্যে জাহাজগুলি ছোট বা বড়, অথবা বাণিজ্যিক জাহাজ কনভার্ট করেও হতে পারে। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটিং হবে অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ এবং সার্ভেইল্যান্স বিমানের মাধ্যমে।

তৃতীয় ডিটারেন্ট - স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র

কমপক্ষে ৪টা সাবমেরিনে দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করতে হবে। ৫০০ থেকে ১,৫০০কিঃমিঃ বা তারও বেশি পাল্লার এসব অস্ত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ ডিটারেন্ট হিসেবে থাকবে। আপাততঃ পাকিস্তানের 'বাবুর' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের নাম উল্লেখ করা যায়; যার ওয়ারহেড ৫০০কেজি এবং পাল্লা ৯০০কিঃমিঃএর মতো। ভারত অন্ততঃ এটা বুঝবে যে, ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে। ভূমি থেকে নিক্ষেপণ করা ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে তুরস্কের 'বরা' বা 'খান' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উল্লেখ করা যায়; যার পাল্লা ২৮০কিঃমিঃএর মতো। এছাড়াও তুরস্ক 'তায়ফুন' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে; যা এখনও পর্যন্ত ৫৬০কিঃমিঃ পাল্লা অতিক্রম করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।
 
সেনাবাহিনীকে এমনভাবে গোছাতে হবে, যাতে করে এই বাহিনীকে ভারত এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয় এবং কোন অবস্থাতেই এই বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়াতে সাহস না পায়। সেনাবাহিনীর উত্তরবঙ্গের ইউনিটগুলিকে আরও বড় করে দু'টা কোর সম্বলিত একটা আর্মি ফর্মেশন (উত্তরবঙ্গ আর্মি) গঠন করতে হবে। বগুড়াতে গঠন করতে হবে আরমার্ড কোর; যেখানে থাকবে একটা আরমার্ড ডিভিশন এবং দু'টা মেকানাইজড ডিভিশন। দ্বিতীয় কোরটা গঠন করতে হবে চলন বিলের পশ্চিম পাশে - নাটোর, নওগাঁ এবং রাজশাহীতে। এই কোরের (বরেন্দ্র কোর) অধীনে তিনটা বা চারটা ডিভিশন থাকতে হবে। 


চতুর্থ ডিটারেন্ট – সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি

সেনাবাহিনীকে এমনভাবে গোছাতে হবে, যাতে করে এই বাহিনীকে ভারত এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয় এবং কোন অবস্থাতেই এই বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়াতে সাহস না পায়। সেনাবাহিনীর উত্তরবঙ্গের ইউনিটগুলিকে আরও বড় করে দু'টা কোর সম্বলিত একটা আর্মি ফর্মেশন (উত্তরবঙ্গ আর্মি) গঠন করতে হবে। বগুড়াতে গঠন করতে হবে আরমার্ড কোর; যেখানে থাকবে একটা আরমার্ড ডিভিশন এবং দু'টা মেকানাইজড ডিভিশন। বর্তমানের বগুড়া এবং রংপুরএর দু'টা ডিভিশনের সাথে আরও একটা ডিভিশন এখানে যুক্ত করতে হবে পুরো কোর গঠন করতে গেলে। এছাড়াও কোর লেভেলে স্পেশাল ফোর্স, মধ্যম পাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ২১০মিঃমিঃ হেভি আর্টিলারি, ১২০মিঃমিঃ মর্টার, এবং ১০০-১২০কিঃমিঃ পাল্লার রকেট আর্টিলারি, ১৫০-২০০কিঃমিঃ পাল্লার সার্ভেইল্যান্স ড্রোন থাকতে হবে। চীনা 'এমবিটি-২০০০' ট্যাংক বাংলাদেশের নরম মাটির জন্যে কতটুকু প্রযোজ্য, সেটা আরও একবার দেখা যেতে পারে। প্রয়োজনে চীনা 'ভিটি-৫' বা ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের যৌথভাবে তৈরি 'কাপলান এমটি' বা 'হারিমাউ'এর মতো লাইট ট্যাংক টেস্ট করে দেখা যেতে পারে।

দ্বিতীয় কোরটা গঠন করতে হবে চলন বিলের পশ্চিম পাশে - নাটোর, নওগাঁ এবং রাজশাহীতে। এই কোরের (বরেন্দ্র কোর) অধীনে তিনটা বা চারটা ডিভিশন থাকতে হবে। দু'টা মেকানাইজড ডিভিশনের সাথে আরও দু'টা ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এখানে থাকতে পারে। এদের মূল শক্তি হবে এম্ফিবিয়াস এপিসি এবং রিভার ক্রসিং ইকুইপমেন্ট। কোরএর অধীনে এক বা দুই রেজিমেন্ট ট্যাংক থাকতে পারে। তবে ট্যাংক কম থাকলেও এই ইউনিটে সর্বোচ্চ সংখ্যক আর্টিলারি রাখা বাঞ্ছনীয়। পুরো ইউনিট যাতে বড় আকারের ওয়াটার বডি পার হতে পারে, সেই হিসেব করেই সরঞ্জামগুলিকে সাজাতে হবে। আর পুরো 'উত্তরবঙ্গ আর্মি' ফর্মেশনের অধীনে আরও একটা বা দু'টা ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন থাকতে পারে; যা আর্মি ফর্মেশনের কমান্ডার প্রয়োজনমতো যেকোন কোরএর সাথে যুক্ত করতে পারবেন। এছাড়াও স্বল্প পাল্লার (৩০০কিঃমিঃএর কম) ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এই আর্মির অধীনে দেয়া যেতে পারে।

তৃতীয় কোরটা গঠন করতে হবে কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী অঞ্চলে; পদ্মা নদীর ঠিক দক্ষিণে (পদ্মা কোর)। এখানে ৩টা ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন থাকতে পারে। আর কোর ফর্মেশনের সাথে দু'টা ট্যাংক রেজিমেন্ট থাকতে পারে। এই মুহুর্তে এই অঞ্চলে যশোর এবং বরিশালে দু'টা ডিভিশন করেছে; যা পদ্মা নদীর দক্ষিণে বিশাল অঞ্চলের নিরাপত্তা প্রদানের জন্যে অপ্রতুল। একারণেই এই দুই ডিভিশের পাশাপাশি 'পদ্মা কোর' গঠন করতে হবে। মোটামুটিভাবে অতিরিক্ত আরও ১০টার মতো ডিভিশন সেনাবাহিনীতে যুক্ত করতে হবে।
 
উত্তরবঙ্গে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। শুধুমাত্র একটা বা দু'টা সেতুর উপর নির্ভর করে লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা ছেলেখেলার সামিল। মূল লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক হতে হবে নদী-কেন্দ্রিক। বর্তমানে কাজ চলা নগরবাড়ি নৌবন্দরেরের মতো আরও কয়েকটা নদীবন্দর তৈরি করতে হবে যমুনা নদীর তীরে।


লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং সামরিক প্রযুক্তির ভিত্তি

বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জামগুলির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিমান ওঠানামার রানওয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে হাইওয়েগুলির বিভিন্ন স্থানে বিমান ওঠানামা, রিফুয়েলিং এবং বিমানের ইমের্জেন্সি মেইনটেন্যান্সের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে পুরোনো বিমানবন্দরগুলি আবারও চালু করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একইসাথে বিমানের ফুয়েল এবং অন্যান্য লজিস্টিকসও শুধুমাত্র ঢাকা-কেন্দ্রিক রাখলে চলবে না।

উত্তরবঙ্গে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। শুধুমাত্র একটা বা দু'টা সেতুর উপর নির্ভর করে লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা ছেলেখেলার সামিল। মূল লজিস্টিক্যাল নেটওয়ার্ক হতে হবে নদী-কেন্দ্রিক। বর্তমানে কাজ চলা নগরবাড়ি নৌবন্দরেরের মতো আরও কয়েকটা নদীবন্দর তৈরি করতে হবে ঈশ্বরদী, পাবনার কাজিপুর, ঢালারচর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়ার কাজিপুর ও সারিয়াকান্দি, গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রামের চিলমারিতে। এছাড়াও যমুনা নদীতে ব্যাপক ড্রেজিংএর মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে যমুনার পূর্বতীরে দেওয়ানগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জেও নদীবন্দর তৈর করতে হবে। পদ্মা সেতুর কারণে যাত্রী কমে গেছে - এই ছুতোয় কেউ যাতে কোন জাহাজ কেটে ফেলতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ডিটারেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে উপরের সকল সিদ্ধান্তই হতে হবে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি হস্তান্তর করার মাধ্যমে। অর্থাৎ শুধু অস্ত্র ক্রয় নয়; অস্ত্রের সাথে কারখানাও স্থাপন করতে হবে। সামরিক সরঞ্জামের সকল কম্পোনেন্ট এবং রসদ (মিউনিশন) বাংলাদেশে তৈরি করার কারখানা স্থাপন করতে হবে। কেউ যদি বলে যে, তারা কম্পোনেন্ট নিজেরা তৈরি করে দেবে; বাংলাদেশ কম্পোনেন্ট তৈরি করতে পারবে না, তাহলে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা হবে না। যুদ্ধাবস্থার মাঝে কে কার পক্ষে থাকবে এবং কিভাবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রাখবে, সেটা কখনোই নিশ্চিত নয়। তাই কারুর মুখের কথার উপর ভিত্তি করে কাউকে অতি প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামের সাপ্লাইয়ার বানানো যাবে না। সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার সক্ষমতা থাকতেই হবে; নয়তো যুদ্ধে জড়ানোটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সামরিক ইন্ডাস্ট্রিগুলি স্থাপন করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। কয়েক হাজার প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানকে এসকল ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়োগ দিতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এবং টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটগুলিকে সরাসরি যুক্ত থাকতে হবে। একইসাথে বাংলাদেশে বর্তমানে বেসরকারি খাতে যেসকল ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প রয়েছে, বিশেষ করে কয়েক'শ প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা, টেকনিশিয়ান এবং সিএনসি মেশিনকে এই প্রসেসে যুক্ত করতে হবে।
 
বর্তমান সরকার বা এর পরবর্তী সরকারও যে এই কঠিন সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়ন করতে পারবে না, সেটা নিশ্চিত। কারণ পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় কোন রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ভারতকে ভয় দেখানো, ভারতের দূতাবাসকে বের করে দেয়া, বড় বড় চোরদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, রাষ্ট্রদ্রোহী চুক্তি বাতিল করে ডলারে পেমেন্ট বন্ধ করা, প্রযুক্তিসহ যুদ্ধাস্ত্র যোগাড় করা, ইত্যাদি কাজগুলি বর্তমান ব্যবস্থায় কোন সরকারই করতে সক্ষম হবে না। একমাত্র একটা আদর্শিক রাষ্ট্রের পক্ষেই পশ্চিমা আদর্শ ও ব্যবস্থাকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্বাধীনভাবে নিজস্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব।


ডিটারেন্ট কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব?

এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন যে, সরকার যেখানে ঋণ শোধ করতে পারছে না, সেখানে এতবড় সামরিক ব্যয় কিভাবে হ্যান্ডেল করবে? প্রথম সমাধানটা সকলের কাছেই রয়েছে - চুরির অর্থ উদ্ধার করে। প্রত্যেকেই এখন জানেন এবং সেটা বিশ্বাস করাতে কাউকে মারধর করতে হবে না যে, কি পরিমাণ চুরি গত ১৫ বছরে হয়েছে। আর এর সাথে যদি আরও প্রশ্ন করা হয় যে, কি পরিমাণ চুরি গত ৫৩ বছরে করা হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে এখানেই অর্থায়নের পুরোটাই যোগাড় হয়ে যাবে। সরকার যদি চোরদেরকে হাল্কা-পাতলা শাস্তি না দিয়ে অবৈধপথে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ফেলে, তাহলেই সকল বাজেট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দ্বিতীয় সমাধানটা অনেকের কাছেই কঠিন মনে হতে পারে - রাষ্ট্রদ্রোহী যত চুক্তি আছে, সকল চুক্তি বাতিল করে চুক্তির সাথে সম্পর্কিত সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এর ফলে সরকারকে যেসকল প্রকল্পে অযাচিতভাবে মার্কিন ডলারে পেমেন্ট দিতে হতো, সেটা আর দিতে হবে না। অর্থাৎ মার্কিন ডলারের রিজার্ভ তৈরি এবং ধরে রাখার যে চাপ সর্বদা বাংলাদেশের মাথার উপরে ঝুলে রয়েছে, সেটা আর থাকবে না। এছাড়াও অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে, চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক – এই দেশগুলি বাংলাদেশকে অস্ত্র এবং প্রযুক্তি দেবে কিনা।

বর্তমান সরকার বা এর পরবর্তী সরকারও যে এই কঠিন সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়ন করতে পারবে না, সেটা নিশ্চিত। কারণ পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় কোন রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বিশেষ করে কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়াকে পশ্চিমারা 'রেড লাইন' হিসেবে দেখে। একারণেই পশ্চিমা ব্যবস্থাকে অমান্য করে বাংলাদেশের পক্ষে এসকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ভারতকে ভয় দেখানো, ভারতের দূতাবাসকে বের করে দেয়া, বড় বড় চোরদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, রাষ্ট্রদ্রোহী চুক্তি বাতিল করে ডলারে পেমেন্ট বন্ধ করা, প্রযুক্তিসহ যুদ্ধাস্ত্র যোগাড় করা, ইত্যাদি কাজগুলি বর্তমান ব্যবস্থায় কোন সরকারই করতে সক্ষম হবে না। একমাত্র একটা আদর্শিক রাষ্ট্রের পক্ষেই পশ্চিমা আদর্শ ও ব্যবস্থাকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্বাধীনভাবে নিজস্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব।

যদি ভারত-বিরোধিতা করতেই হয়, তাহলে সেটা সঠিকভাবে করা উচিৎ। ভারতকে উদ্দেশ্য করে এমন কিছু বলা উচিৎ নয়, যেটা ভারতকে কোনপ্রকার ভীতির মাঝে ফেলে না। ভারতকে তোয়াজ করে ভারত-বিরোধিতা জনগণের বিরুদ্ধে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতকে মোকাবিলা করতে হলে সাবভার্সনের সকল পথ বন্ধ করতে হবে এবং অত্যন্ত শক্তিশালী সামরিক ডিটারেন্ট তৈরি করতে হবে, যা কিনা বাইরের কারুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। এই কাজগুলি বাস্তবায়নের জন্যে কঠিন, কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাস্তবায়ন অসম্ভব। একমাত্র আদর্শিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটা রাষ্ট্রই পারে এহেন স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে; যা বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী একটা রাষ্ট্রের সূত্রপাত ঘটাবে।

Sunday 18 August 2024

ব্যালান্সিংএর রাজনীতি এবং বাংলাদেশের ডিএনএ

১৮ই অগাস্ট ২০২৪
ব্যালান্সিংএর নীতিটা খুবই চতুর; আবার একইসাথে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এখানে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ হয় ভয়াবহ মাত্রায়। কথা এবং কাজের মাঝে পার্থক্য রাখার একটা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি এটা। যতক্ষণ এটা কাজ করে, ততক্ষণ দেখলে বুদ্ধিদীপ্তই মনে হবে; কিন্তু যখন সমস্যায় পতিত হয়, তখন কূলকিনারা থাকে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ডিএনএ হচ্ছে এটাই; যা ব্রিটিশরা রেখে গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে। 


বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে হলেও এই দেশের বেশিরভাগ বাস্তবতা কিন্তু তৈরি হয়েছে ১৯৪৭ সালে। যেমন বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকেছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ সাইরিল র‍্যাডক্লিফ। সেই মানচিত্রকে সাত দশকের মাঝে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে পড়লেও পরের বছরই তাদেরকে বের হয়ে যেতে হয়। আর এমনিতেও যুদ্ধের আগেই বাংলাদেশের প্রথম পতাকার মাঝে ১৯৪৭ সালের মানচিত্র জুড়ে দেয়া হয়েছিল। এতে ভারত স্বস্তি পেয়েছিল যে, কোন বামপন্থী আন্দোলন বাংলাদেশের যুদ্ধকে হাইজ্যাক করে নিয়ে ১৯৪৭এর সীমানাকে চ্যালেঞ্জ করবে না। ১৯৪৭এর এই সীমানা শুধু বাংলাদেশের সীমানাই নয়; এটা ভারতের সীমানাও বটে। এই সীমানায় পরিবর্তন এলে ভারতের মানচিত্রও পরিবর্তিত হয়ে যায়। একারণেই বাংলাদেশ যেমন এই সীমানার ব্যাপারে খুবই সাবধান, তেমনি ভারতও।

ব্রিটিশরা এই সীমানা তৈরির সময় নিছক একটা ডিজাইন এঁকে দিয়ে চলে যায়নি। তারা সকল প্রকারের হিসেব কষেই এই সীমানাগুলি এঁকেছিল। এই হিসেবের মূলে ছিল তাদের নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থগুলিকে সমুন্নত রাখা। সাত দশকে বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের প্রভাব অনেকাংশেই কমে গেছে। কিন্তু কেউই ব্রিটিশদের আঁকা সীমানাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে সুবিধা করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশরা মধ্যপ্রাচ্যের সীমানাগুলি এমনভাবে এঁকেছে, যাতে করে কোনভাবেই এই সীমানাকে পরিবর্তন করে নতুন করে আঁকা না যায়। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটা জাতিগত কুর্দী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেও তা ভেস্তে গেছে তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক এবং ইরানের বাধায়। অর্থাৎ ব্রিটেন নিশ্চিত করেছিল যে, কেউ যদি এই সীমানাগুলিকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে, তাহলে এই রাষ্ট্রগুলি নিজেরাই সেই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেই শিক্ষাটাই নিয়েছে; যেকারণে কুর্দীরা বুঝে গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বাস্তবায়নে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করলেও তাদের ভাগ্যে নিজস্ব জাতি রাষ্ট্র নেই। এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে অপারগ। এটাই হচ্ছে ব্রিটেনের প্রভাব। সাত দশক পরেও ব্রিটেন যেকোন আলোচনার টেবিলে হাজির থাকে এই সুবাদেই। তারাই সেই দেশের মানচিত্র এঁকেছে; তারা অনেক ক্ষেত্রেই সেই দেশের সংবিধান লিখে দিয়েছে এবং অভ্যন্তরের বিভিন্ন ইন্সটিটিউট তৈরি করেছে। তাই তাদের হাতে তৈরি হওয়া সেই রাষ্ট্রের গতিপ্রকৃতির ধরণ তাদের চাইতে বেশি আর কেউ বুঝতে পারে না।

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করার পর ব্রিটিশরা এমন একটা বাস্তবতা রেখে গিয়েছে, যাতে করে একটা বিশাল রাষ্ট্রের আশেপাশে কয়েকটা ছোট রাষ্ট্র নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে থাকে। শুধু তা-ই নয়, তারা ভারতের মানচিত্রকেও আশেপাশের ছোট রাষ্ট্রের উপরে নির্ভর করে দিয়েছে; যাতে করে ছোট রাষ্ট্রগুলি চাইলে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এতে করে এই ছোট রাষ্ট্রগুলি যদি নিজেদেরকে রক্ষা করতে অপারগ হয়, তাহলে তারা ব্রিটেন, তথা পশ্চিমাদের সহায়তা চাইবে। এক্ষেত্রে পশ্চিমারা হয় ভারতকে আগ্রাসী হবার সার্টিফিকেট দেবে, নয়তো ভারতের লাগাম টেনে ধরবে। এই মানচিত্রের সবচাইতে অদ্ভুত অংশটা হলো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্স। এই রাজ্যগুলি ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে মাত্র ১৫ মাইল চওড়া একটা করিডোরের মাধ্যমে যুক্ত। আর জাতিগত সমস্যা থাকার কারণে এই সেভেন সিস্টার্স প্রায় সর্বদাই অস্থির। অস্থির এই সাত রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দিল্লীর কর্তাব্যক্তিদের যখন ঘুম হয়না, ঠিক তখনই তাদেরকে এটা নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে যে, সেই ১৫ মাইলের করিডোর যেন কখনও হুমকির মাঝে পড়ে না যায়। এই হুমকি মোকাবিলায় ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ভারত সিকিম রাজ্যকে দখল করে নিয়েছিল; যা ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতের খাদ্য হিসেবেই রেখে গিয়েছিল। তবে সিকিম দখলের পরেও ভারতের এই ১৫ মাইলের করিডোরের নিরাপত্তা খুব একটা বাড়েনি। বর্তমানে এই ১৫ মাইলকে সকলেই 'চিকেন নেক' বলে আখ্যা দেয় এবং এটা যে ভারতের দুশ্চিন্তার একটা বড় কারণ, সেটাও এখন প্রায় সকলেই জানেন।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের সীমানা আঁকার সময় ব্রিটিশরা খুব ভালোভাবেই জানতো যে, ভারত 'চিকেন নেক'এর নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবে। এই করিডোরের উত্তরে নেপাল এবং দক্ষিণে বাংলাদেশের উপর ভারতের চাপ থাকবে ভারতের নিজস্ব বাস্তবতার কারণেই। আর এই চাপ ১৯৪৭এর অসমান ভূমি বন্টনের বাস্তবতার (বিশাল ভারতের পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র) সাথে যুক্ত হয়ে নেপাল এবং বাংলাদেশকে ভারতের ব্যাপারে আরও বেশি সাবধানী করে তুলবে। এই বাস্তবতাগুলিকে রাজনৈতিকভাবে কিভাবে দেখা হবে, তা কিন্তু ১৯৪৭-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলির রাজনীতিকেরা শিখেছিল কোলকাতা থেকেই। উপমহাদেশের প্রায় সকল রাজনীতিকেরই রাজনীতি শেখার স্কুল ছিলো কোলকাতা। পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হবার পরে কয়েক বছর ধরে নতুন এই রাষ্ট্রের প্রায় সকল উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতারা কিন্তু বেঙ্গল থেকেই এসেছিলেন; যাদের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল কোলকাতায়। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিল না; কারণ সেটা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতির একটা দূরের এলাকা মাত্র। পাকিস্তানের এই বাস্তবতাটা পরিবর্তিত হতে থাকে নতুন সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর উত্থানের পর থেকে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা, যারা কিনা ব্রিটিশদের অধীনে কোলকাতায় রাজনীতি শিখেছেন, তারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকেই সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানের বাস্তবতা থেকে ছিল ভিন্ন। ১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের শক্ত ভিত তৈরি না হলেও কোলকাতার সুবাদে সেটা কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে প্রথম থেকেই ছিল। একারণেই যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন যতটা গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল, বাংলাদেশে সেটা সেভাবে হয়নি।

শুধু তা-ই নয়, ১৯৪৭এর পর থেকে পাকিস্তানের সাথে ভারতের কয়েকবার যুদ্ধের মাঝে কাশ্মির ছিল সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু; যেখানে সীমানা নিয়ে চলেছে ব্যাপক সংঘাত। পূর্বদিকে বাংলাদেশের সীমানায় কিন্তু সংঘাতের সমাধানের কথা কেউ চিন্তা করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের কারুর পক্ষে চিন্তা করাটা কঠিন যে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার জটিলতা কতটুকু। আর যদি কোলকাতায় রাজনীতি শেখার অভিজ্ঞতা তাদের না থাকে, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সাথে তাদের চিন্তাগত পার্থক্য কখনোই ঘুচবে না। ঠিক এই ব্যাপারটাই হয়েছে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মাঝে। রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি না থাকায় পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় সেনাশাসন চলেছে। আর বাংলাদেশে সেনাশাসন থাকার পরেও রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা ব্রিটিশদের দেখিয়ে দেয়া পথেই হেঁটেছে। বাংলাদেশ ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত এবং মার্কিন দুই পক্ষের কোনটাতে নাম না লিখিয়ে নাম লিখিয়েছে ব্রিটিশদের ছত্রছায়ায় গঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা 'নন-এলাইন্ড মুভমেন্ট'এ। এই জোটে থেকে তারা কমিউনিস্টও হয়নি; আবার যুক্তরাষ্ট্রের কোলেও বসেনি। কিন্তু উভয় পক্ষ থেকেই তারা বেনেফিট নেয়ার চেষ্টা করেছে। এই চিন্তাটাই ব্রিটিশ। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের পক্ষে কোন রাষ্ট্রকে সরাসরি নিরাপত্তা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সোভিয়েত-মার্কিন সংঘাতকে রাজনৈতিক কূটচালের মাধ্যমে ব্যালান্স করে চলার নীতিতেই এগুতে হয় ব্রিটিশ প্রভাবে থাকা দেশগুলিকে। ১৯৭২ থেকে সোভিয়েত সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দরকে কার্যক্ষম করা হয় এবং বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর ডিটারেন্স তৈরি হয়। ব্রিটিশ সহায়তায় তৈরি হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। খাদ্য সহায়তার জন্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের উপরে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ না হলেও কিউবার সাথেও বাণিজ্য করেছে বাংলাদেশ। অপরিদকে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে থাকা দেশগুলি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে থাকা অন্যান্য দেশের সাথেই সম্পর্ক রেখেছে; বাকিদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হয়নি।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ইন্সটিটিউট; যেখানে ১৯৪৭ এবং এর আগে থেকে শেখা রাজনৈতিক চিন্তাগুলিকে লালন পালন করা হয়। সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনীর একাডেমিগুলি, সরকারি কর্মকর্তাদের ট্রেনিং একাডেমি, কূটনীতিকদের একাডেমি, পুলিশের ট্রেনিং একাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইন্সটিটিউট, ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু রাষ্ট্রচিন্তাকে শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। একারণেই বাংলাদেশে যত সরকারই আসুক না কেন, সেটা সেনা-সমর্থিত বা বেসামরিকই হোক, রাষ্ট্রের মূল চিন্তাতে খুব বেশি একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ সর্বদাই সকলের সাথে সম্পর্ক রাখার নীতিতে এগিয়েছে। একদিকে এর অর্থ যেমন দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশ শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বলয়েই থাকবে না; তেমনি এর অর্থ এ-ও দাঁড়ায় যে, বাংলাদেশ ভারতকেও ব্যালান্স করে চলবে। মুখে ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার কথা বাংলাদেশের সকল সরকারই বলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক ডিটারেন্ট তৈরি করার প্রচেষ্টাটা ছিল শুধুমাত্র ভারতকে মাথায় রেখে। কারণ ১৯৪৭এ ব্রিটিশদের তৈরি করা বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের চিন্তার কেন্দ্রে থাকবে 'বিশাল' ভারত।

বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ভারত-বিরোধিতা বৃদ্ধি পাওয়াটা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-চিন্তার সংস্কৃতির একটা অংশ; ঠিক যেমনটা ভারতে বাংলাদেশের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ড চালানোর ব্যাপারে। ব্রিটিশদের তৈরি করা চিন্তার এই ফাঁদ থেকে বের হতে না পেরেছে ভারত, না পেরেছে বাংলাদেশ। ব্যালান্স করার চিন্তাটা বাংলাদেশের চিন্তার মাঝে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভারতের চিন্তাতেও। পাকিস্তানের রাজনৈতিক চিন্তাতে ব্যালান্স শব্দটাই নেই। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা ব্যালান্সের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা। তিনি তুরস্কের এরদোগান এবং মালয়েশিয়ার মাহাথিরের সাথে একত্রে বসে 'ইসলামোফোবিয়া'কে নিয়ন্ত্রণে একটা গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির সূচনা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাকে শিখিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তানে ব্যালান্সিংএর ব্রিটিশ নীতি চলবে না; পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রই সর্বেসর্বা থাকবে।

ব্যালান্সিংএর নীতিটা খুবই চতুর; আবার একইসাথে অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এখানে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ হয় ভয়াবহ মাত্রায়। কথা এবং কাজের মাঝে পার্থক্য রাখার একটা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি এটা। যতক্ষণ এটা কাজ করে, ততক্ষণ দেখলে বুদ্ধিদীপ্তই মনে হবে; কিন্তু যখন সমস্যায় পতিত হয়, তখন কূলকিনারা থাকে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ডিএনএ হচ্ছে এটাই; যা ব্রিটিশরা রেখে গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ১৯৭১ সালে এর নতুন নামকরণ হয়েছে এবং পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে আলাদা হয়ে ব্যালান্সিংএর রাষ্ট্র-চিন্তাকে বাস্তবায়িত করতে কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছে। ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়নি। কারণ ১৯৭১ সালের মতো এখনও বাংলাদেশের সীমানা সেই ১৯৪৭ সালেরটাই রয়ে গেছে। বাস্তবতা তো বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হয়নি। আর এই বাস্তবতার উপরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইন্সটিটিউটগুলি গড়ে উঠেছে। যেই ছাত্ররা চাকরির দাবিতে কোটা আন্দোলন করেছে, তারাও এই রাষ্ট্রীয় ইন্সটিটিউটগুলিতেই প্রশিক্ষিত হবে এবং নিজেদের মাঝে ১৯৪৭এর বাস্তবতাকে ধারণ করবে।

Monday 5 August 2024

০৫ই অগাস্ট রেভোলিউশন – ফলাফল যেন 'নতুন বোতলে পুরনো মদ' না হয়

০৫ই অগাস্ট ২০২৪

মাত্র ১৬ দিনের মাঝে দ্বিতীয়বার প্রমাণ হলো যে, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের 'মোস্ট ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর'। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজকে রাস্তায়। এ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য! বহু মানুষ সেনা সদস্যদেরকে আলিঙ্গন করছে। তারা বিজয় পেয়েছে - তারা একনায়ককে সরিয়েছে। কিন্তু এরপর কি হবে? তারা কি তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে, সেটা নির্ধারণ করতে পারবে? নাকি আবারও সেই বিদেশীরাই নির্ধারণ করে দেবে কি ধরণের সরকার হবে এবং কিভাবে দেশ চলবে? আবারও কি অনেক বছর পরে কেউ বলবে যে, ২০২৪ সালে কোন শর্ত মেনে নিয়ে তাকে ক্ষমতায় যেতে হয়েছিল? 


২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সাল। বিডিআর সদর দপ্তর, পিলখানা, ঢাকা।

১) বিডিআরএর বিদ্রোহ শুরু হবার আগেই দরবার হলের রেস্টরুমে রাখা ছিল ত্রিকোণাকৃতির লাল কাপড়। এই কাপড়গুলি আনা হয়েছিল প্যারেডের সময় মাঠের আশেপাশে বাউন্ডারির নিশানা হিসেবে। এই লাল কাপড়গুলিই বিদ্রোহীদের মাঝে একটা অংশ ব্যবহার করেছিল তাদের নিজেদের মুখ ঢাকার জন্যে। তখন অনেকেই এই ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি; কেন এই মানুষগুলি মুখের উপরে মুখোশ পড়বে। কারণ এটা একটা ডিসিপ্লিন্ড ফোর্স; এর মাঝে কারা কারা রয়েছে, সেই হিসেব তো ফাঁকি দেয়ার কোন পদ্ধতিই নেই। তাহলে বিদ্রোহীরা কি ভেবেছিল যে, তারা তাদের মুখ ঢেকে ফেললেই তাদেরকে চেনা যাবে না; এবং কোন এক সময় তারা পিলখানার দেয়াল টপকে বাইরে চলে গেলে তাদেরকে আর কেউ চিনতে পারবে না? এটা তো অসম্ভব! কারণ এরকম একটা ফোর্সের ব্যক্তিরা ট্রেনিংএর মাঝে একে অপরের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে যায় যে, তারা অন্ধকারের মাঝেও একে অপরকে চিনে ফেলতে পারে; মুখে মুখোশ পড়লেও! তাহলে তারা কেন মুখোশ পড়েছিল? আর মিডিয়া রিপোর্টে দেখা যায় যে, অনেকেই সেই বরাদ্দ রাখা লাল কাপড়ের মুখোশগুলি পায়নি। তারা এদের দেখাদেখি নিজেরাও মুখোশ খুঁজতে থাকে। না পেয়ে সাধারণ কাপড় দিয়েই নিজেদের মুখ ঢাকে। তারা প্রকৃতপক্ষে জানতোও না যে, তারা কেন মুখ ঢাকছিল! শুধুমাত্র অন্যদের দেখাদেখি তারা মুখোশ পড়েছে।

২) যাদের জন্যে লাল কাপড় রাখা ছিল, তারা নিশ্চিত ছিল যে, মুখোশ খুলে তারা যদি পিলখানা থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে কেউ তাদেরকে চিনতে পারবে না। কিন্তু সেটা কেন? তাহলে তারা কি বিডিআরএর ফোর্সের অংশ নয়? কারণ বিডিআরএর অংশ কেউ তো নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে পারবে না; হাজার মুখোশ পড়লেও নয়! এটাই আসল আলোচ্য বিষয়। যারা আগে থেকে লাল কাপড় এনে নিজেদের পরিচয় গোপন করেছে, তারা প্রকৃতপক্ষে বিডিআরএর কেউ নয়; এরা বাইরের লোক!! কিন্তু বাইরে থেকে কেউ পিলখানায় ঢুকলে তো তাদের হিসেব থাকার কথা। সেই হিসেব থেকেই তো বের করে ফেলা যায় যে, ভেতরে বহিরাগত কারা কারা ছিল। একারণেই পিলখানার রেকর্ড অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল!

৩) ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, ৮ জন বিদ্রোহী এবং ১৭ জন বেসামরিক লোক এই দিন নিহত হয়। আহত হবার কোন খবর কোন মিডিয়াতে সেদিন আসেনি। কোন হাসপাতালে কোন আহত নেয়া না হলেও অনেক এম্বুল্যান্স সেই রাতে বিডিআর সদর দপ্তরে ঢুকেছে এবং বের হয়েছে। সাংবাদিকরা সকলেই সেই এম্বুল্যান্সগুলিকে দেখেছেন। কেউ কেউ সর্বোচ্চ ২৪টা পর্যন্ত এম্বুল্যান্স গুণেছিলেন সেই রাতে। কিন্তু এই এম্বুল্যান্সগুলি কাদেরকে ভেতর থেকে বের করে নিয়ে গেল এবং কোন হাসপাতালে গেল, সেটার হিসেব কেউ তখন নেয়নি। হয়তো কেউ কেউ জানতেন; কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস তাদের হয়নি।

এটা নিশ্চিত যে, পিলখানা হত্যাকান্ড ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সবচাইতে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের একটা। এই ষড়যন্ত্র কেন হয়েছিল, তা প্রকৃত তদন্ত না হলে বলা সম্ভব নয়। তবে ধারণা করা যেতেই পারে যে, এই ঘটনা ছিল বিডিআরএর উপর ভারতের আক্রোশের ফলাফল। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে সিলেটের পাদুয়া সীমান্তে এবং রৌমারির বড়াইবাড়ি সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বিডিআরএর হাতে অপমানিত এবং নাস্তানাবুদ হয়েছিল। খুব সম্ভবতঃ সেই আক্রোশের ঝাল মেটাতেই ভারত বিডিআরকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। হয়তো এর চাইতেও ভয়বহ কিছু কেউ কেউ চেয়েছিল – সেনাবাহিনীতেও একই বিদ্রোহ ঘটানো। তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং খুব সম্ভবতঃ রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দৃঢ়তায় সেটা থামানো গিয়েছিলো।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, তিনি ২০০১ সালে গ্যাস রপ্তানি করতে রাজি হননি বলে বিদেশীরা তাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। কিন্তু কেউ কি তাকে প্রশ্ন করেছিল যে, ২০০৯ সালে তিনি বিদেশীদেরকে কি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যেতে পেরেছিলেন? সেটা পরিষ্কারভাবে না বলতে পারলেও একটা ধারণা করা যায় যে, সেই প্রতিশ্রুতিগুলির একটা ছিল বিডিআরএর হত্যাকান্ড ঘটতে দেয়া! এখানে শুধু একটা বাহিনীকেই ধ্বংস করা হয়নি; যে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তারা ছিলেন সেনাবাহিনীর সবচাইতে চৌকশ অফিসারদের মাঝের কয়েকজন। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ; যিনি ২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের মাঝে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগের তৈরি জেএমবি-বাংলা ভাইকে নির্মূল করতে সবচাইতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার সাথেসাথেই কর্নেল গুলজারকে বিডিআরএ বদলি করা হয়; যেখানে এক মাসের মাঝে তাকে জীবন দিতে হয়।

পিলখানা ষড়যন্ত্রে সরকার এবং সরকারের বাইরে অনেকেই জড়িত ছিল। আর অনেকেই ঘটনা জেনেও না জানার ভান করে ছিল। রাজনৈতিক দলের সদস্যরা হয় এর সাথে জড়িত ছিল, নয়তো দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখেছে। কারণ ২০০৮ সালের শেষে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের এক্সিটের সময়ে এটাই ছিল এগ্রিমেন্ট – দেখলেও, বুঝলেও, মনের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হলেও – কিছু বলা যাবে না! রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এতবড় ষড়যন্ত্রের বিচার না করেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই যাত্রার পথে পথে যে অবাধ হত্যাকান্ড থাকবে, তা যেন জানাই ছিল। সবচাইতে দুঃখজনক হলো, রাষ্ট্রযন্ত্র বিদেশীদের এতবড় এই ষড়যন্ত্রকে থামাতে তো পারেইনি, বরং দাঁত চেপে মেনে নিয়েছে। একটা অন্যায় যে আরও অন্যায়কে ডেকে নিয়ে আসবে, সেটা মানুষ কল্পনা করতে পারে না। কারণ মানুষের বর্তমান চিন্তা শর্ট-টার্মের; হ্রস্ব-দৃষ্টির – "পরেরটা পরে দেখা যাবে" ধরণের চিন্তা। এই চিন্তাটাই ১৫ বছর পর মানুষকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে - ১৫ বছর আগে বিচার করলে কি ২০২৪ সালের ৫ই অগাস্টের প্রয়োজন হতো?
 
পিলখানা ষড়যন্ত্রে সরকার এবং সরকারের বাইরে অনেকেই জড়িত ছিল। আর অনেকেই ঘটনা জেনেও না জানার ভান করে ছিল। রাজনৈতিক দলের সদস্যরা হয় এর সাথে জড়িত ছিল, নয়তো দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখেছে। কারণ ২০০৮ সালের শেষে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের এক্সিটের সময়ে এটাই ছিল এগ্রিমেন্ট – দেখলেও, বুঝলেও, মনের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হলেও – কিছু বলা যাবে না! রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এতবড় ষড়যন্ত্রের বিচার না করেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই যাত্রার পথে পথে যে অবাধ হত্যাকান্ড থাকবে, তা যেন জানাই ছিল। 


০৫ই অগাস্ট। ঢাকা।

মাত্র ১৬ দিনের মাঝে দ্বিতীয়বার প্রমাণ হলো যে, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের 'মোস্ট ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর'। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজকে রাস্তায়। এ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য! বহু মানুষ সেনা সদস্যদেরকে আলিঙ্গন করছে। তারা বিজয় পেয়েছে - তারা একনায়ককে সরিয়েছে। কিন্তু এরপর কি হবে? তারা কি তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে, সেটা নির্ধারণ করতে পারবে? নাকি আবারও সেই বিদেশীরাই নির্ধারণ করে দেবে কি ধরণের সরকার হবে এবং কিভাবে দেশ চলবে? আবারও কি অনেক বছর পরে কেউ বলবে যে, ২০২৪ সালে কোন শর্ত মেনে নিয়ে তাকে ক্ষমতায় যেতে হয়েছিল? ১৯৯০ সালেও একনায়ক এরশাদের সরকারের পতন হয়েছিলো (সেখানেও বিদেশীদের সরাসরি ইন্ধন ছিলো)। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবস্থার তো উন্নতি হয়নি। জনগণ এখনও গরীব; কারণ স্বল্প কিছু মানুষের হাতে বেশিরভাগ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছে; ঠিক যেমনটা হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলিতে। চরম বেকারত্বের কারণে সরকারি চাকুরিতে ঢোকার কোটা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। শ্রমিকরা বারংবার রাস্তায় নেমেছে তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্যে; কারণ ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে তাদের আয় দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। সামাজিক অবক্ষয় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ এলজিবিটি-র মতো মারাত্মক ব্যাধিকে 'রংধনু' নামে ইনজেকশের মাধ্যমে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে এই সমাজে। আইএমএফ-এর মতো মাফিয়া সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে শর্ত হিসেবে জ্বালানির উপর থেকে ভর্তুকি তুলে দিয়ে, ব্যাপকভাবে ট্যাক্স বৃদ্ধি করে, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে ফেলা হয়েছে। বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে সকল পণ্যের কারণ ছাড়া মূল্য-বৃদ্ধি যেন প্রতিদিনের ইস্যু। দুর্নীতির সাগরে সাঁতড়ে অনেকেই হয়েছেন হাজার কোটিপতি। এই মারাত্মক সমস্যাগুলি সরিয়ে ফেলা নিয়ে কেউ কথা বলে না। অনেকেই বলবে যে, “এগুলি সরানো অনেক কঠিন কাজ", অথবা "এগুলি ধীরে ধীরে সরাতে হবে", অথবা "এগুলি সরাবার কথা বলা অবাস্তব", অথবা অন্য কিছু।

সরকার আসবে; যাবে। কিন্তু রাষ্ট্র এখনও দুর্বলই রয়ে গেল। সকলেরই চিন্তা সরকারকে নিয়ে; রাষ্ট্র নিয়ে নয়। সমস্যায় পড়লে সকলেই সরকার পরিবর্তন চায়; এগুলি যে রাষ্ট্রের সমস্যা, সেটা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। একারণেই নতুন বোতলে পুরনো মদের চালান আসতেই থাকে। সমস্যা চিরকালই রয়ে যায়; আর বিদেশীরা এই সমস্যাগুলি জিইয়ে রেখে রাষ্ট্রের নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা একটা 'ভিশাস সার্কেল'; যার মাঝে বাংলাদেশ ঘুরপাক খাচ্ছে জন্মের পর থেকে। রোগ হলো ক্যান্সার; আর সকলে ক্যান্সারের জন্যে হওয়া জ্বরের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত। প্যারাসিটামল দিয়ে কি আর জ্বরের চিকিৎসা হয়?