Wednesday 24 July 2024

দ্যা লংগেস্ট উইক - জুলাই ব্যর্থ অভ্যুত্থান

২৪শে জুলাই ২০২৪
১৮ই জুলাই ২০২৪, ঢাকা। পুড়ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং এর পঞ্চাশেরও বেশি গাড়ি। গণ আন্দোলন বা গণ অভ্যুত্থান রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনার মেথড হতে পারে না। কারণ এই মেথডে এগুতে গেলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। একদিকে যেমন রাষ্ট্র ধ্বংস করে রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করার চেষ্টাটা নিতান্তই শিশুসুলভ; অন্যদিকে রাষ্ট্র ধ্বংস করার দিকে এগুলে রাষ্ট্র বাধা দেবে এটাই স্বাভাবিক।


মঙ্গলবার (১৬ই জুলাই) থেকেই যখন পরিষ্কার হচ্ছিলো যে ছাত্রদের আন্দোলন ধীরে ধীরে ছাত্রদের হাত থেকে অন্য কারো হাতে চলে যাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসেছিলো যে, সরকারের ইন্টেলিজেন্স কি এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে অবহিত কিনা। তবে কি সরকার জেনেও না জানার ভান করছে? ঘটনার শেষে অনেক প্রশ্ন যেমন সামনে আসে, তেমনি অনেক উত্তরও পাওয়া যায়; যা দু'দিন আগেও পরিষ্কার ছিল না।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর একদিন আগেই শেষ হয়ে যাওয়াটা অনেকের চোখেই ছিল দৃষ্টিকটু। কেউ কেউ বলতে থাকে যে, দেশের পরিস্থিতি ভালো নেই বলেই তিনি দ্রুত ফিরে এসেছেন। তবে দেশের পরিস্থতি কেন চীন সফর ছোট করে ফেলার মতো খারাপ হবে, সেই ব্যাখ্যা কেউ তখনও দেবার চেষ্টা করেননি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা পুরণ হয়নি বলে অনেকেই তর্ক জুড়েছেন। বিশেষ করে মাত্র ১,৬০০ কোটি টাকা সমমূল্যের ইউয়ানের আর্থিক সহায়তা অনেককেই হাসিয়েছে। ২০শে জুলাই পর্যন্ত সন্দেহ হতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সাথে কোটা আন্দোলনের কোন সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। তাহলে চীনের সাথে দহরম মহরম কি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত পছন্দ করেনি? নাকি অন্য কিছু? তবে ২১শে জুলাই নাগাদ এটা মনে হতেই পারে যে, চীন সফরের সাথে এই আন্দোলনের অনেক বড় যোগসূত্র ছিল। চীনারাও হয়তো বুঝতে পারছিলো যে, ঢাকায় কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তাই বেইজিংও ধরি মাছ না ছুই পানি নীতিতে এগিয়েছিল। হয়তো তারাও বুঝতে চাইছিলো যে, ঢাকায় আসন্ন ঘটনার ফলাফল আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে। তারাও হয়তো অপেক্ষা করছিলো রাজনৈতিক খেলার ফলাফল নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত। একারণেই তাদের সহায়তার ঝুলিটা ছিল অনেকটাই 'ওপেন-এনডেড'’; অর্থাৎ এই মুহুর্তে খুব কমই প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে; তবে ভবিষ্যতে এটা অনেক বড় হতে পারে।

পরিকল্পিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা
যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা পুড়ছে। ফ্লাইওভার এবং এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজাগুলিতে আগুন দেয়া হয়েছিল, কারণ অভ্যুত্থানকারীরা মনে করেছিলো যে, এগুলির র‍্যাম্পগুলি ব্যবহার করে পুলিশ তাদের বনানী-মহাখালী এবং যাত্রাবাড়ীর মূল অবস্থানগুলির পিছনে মোতায়েন হতে পারে। এগুলি বলে দেয় যে, এই পরিকল্পনা কতটা ডিটেলসে তৈরি করা হয়েছিল। এটা সাধারণ কারুর পরিকল্পনা নয়; এখানে নিঃসন্দেহে প্রফেশনাল লোকেরা জড়িত ছিল।

এটা ছিল একটা 'প্রি-প্ল্যানড ক্যু' বা পূর্বপরিকল্পিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। অনেকদিন আগেই এর নীল নকশা আঁকা হয়েছিল। তবে খুব সম্ভবতঃ করোনার পরেই এর ডিটেলসগুলি তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিল কিছু চিন্তা - ১) সেনাবাহিনী এখন আওয়ামী লীগ; তাই তাদেরকে নিজেদের পক্ষে আনা সম্ভব নয়; তবে ভয় দেখিয়ে তাদেরকে নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করা সম্ভব; ২) পুলিশ, বিজিবি, আনসার এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন; যদি এদের মাঝে কোন প্রকারের ভয় ঢুকিয়ে দেয়া যায়, তাহলে তারা পিছু হটবে; ৩) যদি সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা যায় এবং পুলিশ পিছু হটে, তাহলে সাধারণ জনগণকে একত্রিত করে গণভবনমুখী মার্চের মাধ্যমে সরকারের পতন সম্ভব।

এই কেন্দ্রীয় চিন্তাগুলিকে নিয়েই পরিকল্পনার ডিটেলসগুলি আঁকা হয়েছিলো। গত কয়েক বছরে বিরোধী দলকে দমাতে ঢাকাতে ঢোকার পথগুলি ক্ষমতাসীন দল বিভিন্ন সময়ে আটকে দিয়েছিল; যেকারণে বিরোধী দলের কয়েকটা আন্দোলন ভেস্তে গিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিরোধী দল শিক্ষা নিয়েছে। প্রথমতঃ তারা ঠিক করেছিল যে, যেভাবেই হোক, ঢাকায় ঢোকার অন্ততঃ একটা পথ খোলা রাখতেই হবে। এক্ষেত্রে তারা নির্বাচিত করেছিল যাত্রাবাড়ীকে। গাবতলী প্রথমেই বাদ পড়ে যায়; কারণ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে উঠতে হলে প্রথমে আরিচা এবং পাটুরিয়া ফেরি পার হতে হবে। ফেরির কারণে এই রুট বাস্তবসম্মত নয়। অপরদিকে পশ্চিমের রুট গিয়েছে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে; যেখানে সেনাবাহিনীর ক্যানটনমেন্ট রয়েছে। সেনাবাহিনীর সাথে যেহেতু কোন সংঘর্ষে যাওয়া যাবে না, তাই যমুনা সেতু পার হবার চিন্তা রাখা যাবে না। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই – ক্যানটনমেন্ট। উত্তর দিক গাজীপুর হয়ে ঢাকায় ঢোকা যায়; তবে খুব সম্ভবতঃ সেক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের জন্যে কিছু লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কাজেই একমাত্র বাস্তবসম্মত রুট হলো যাত্রাবাড়ী; কারণ এই রুটে কোন সেতুর উপর কোন ক্যানটনমেন্ট নেই এবং লজিস্টিক্যাল সুবিধা রয়েছে যথেষ্ট। যদি যাত্রাবাড়ী ধরে রাখা যায়, তাহলে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট থেকে বহু মানুষকে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব। আর বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানে গোলযোগ সৃষ্টি করলে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে অবস্থান করতে বাধ্য হবে; তাদেরকে বিক্ষোভ দমনে ঢাকায় নিয়ে আসা যাবে না।

দ্বিতীয়তঃ তারা ঢাকার কয়েকটা স্থান নির্ধারণ করেছিল; যেখান থেকে গণভবন খুব বেশি দূরে নয়। এই স্থানগুলিকে যদি নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়, এবং এসব স্থান থেকে যদি নিরাপত্তা বাহিনীকে পিছু হটানো যায়, তাহলে লাখো মানুষ বিক্ষোভকারীদের সাথে যোগ দেবে। এর মূল পুঁজি হবে একটাই – সরকারের জনপ্রিয়তার ঘাটতি।

তৃতীয়তঃ যদি সরকারি টেলিভিশন বিটিভির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া যায়, তাহলে একদিকে যেমন দেশের বেশিরভাগ মানুষকে প্রভাবিত করা সম্ভব; তেমনি সামরিক বাহিনীকে বার্তা দেয়া যায় যে, তোমরা ব্যারাকের বাইরে বের হয়ো না; অথবা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেয়ো না। একইসাথে পুলিশ বাহিনীকে প্রভাবিত করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব।

চতুর্থতঃ যদি মূল ইন্টারনেট সেবা দীর্ঘ সময়ের জন্যে বন্ধ করে দেয়া যায়, তাহলে সরকারি দফতরগুলির মাঝে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যাহত হবে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যাবে। একইসাথে বিরোধী দল এটা নিশ্চিত ছিল যে, তারা বিক্ষোভ করলে সরকার কোন একটা সময় থ্রি-জি, ফোর-জি এবং ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেবে। কাজেই যদি বিরোধী দল ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল থাকে, তাহলে তাদের যোগাযোগ পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়বে। একারণে তারা সম্ভবতঃ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তারা টু-জি সেবার (কল এবং এসএমএস) উপরেই থাকবেন। ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যাহত হলে সরকার নিজেই টু-জি সেবার উপর নির্ভরশীল থাকবে; কাজেই তখন সরকার নিজের স্বার্থেই টু-জি সেবা চালু রাখতে বাধ্য হবে। তবে টু-জি সেবা তো সরকারি মনিটরিংএর মাঝে রয়েছে; এব্যাপারে কি করা যায়? সেটারও সমাধান রয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআইএর স্থাপনাগুলিকে অকার্যকর করে দিতে পারলেই সরকারের টু-জি মনিটরিং সার্ভিস ধ্বসে পড়বে।

রাষ্ট্রীয় ইন্টেলিজেন্সের কাছে কতটুকু ডিটেলস পৌঁছেছিল সেটা বলা মুশকিল। তারা সম্ভবতঃ প্রথম দুই অংশ সম্পর্কে অনেক আগ থেকেই ওয়াকিবহাল ছিল; যদিও তারা হয়তো স্থানগুলি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। তারপরেও এটা বলা যায় যে, এটা ইন্টেলিজেন্সের সাফল্য, যে তারা সময়মতো রাষ্ট্রকে সাবধান করতে পেরেছে। তবে তারা যে পরিকল্পনার তৃতীয় এবং চতুর্থ অংশ সম্পর্কে জানতো না, এটা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে নিশ্চিত হওয়া যায়। এটা ইন্টেলিজেন্সের একটা বড় ব্যর্থতা। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টেলিজেন্স, পুলিশ, র‍্যাব সকলেই কমিউনিকেশন মনিটরিংএর জন্যে বহু প্রযুক্তি পেয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলি তাদেরকে বহু তথ্য দিয়েছে; যার মাধ্যমে তাদের পক্ষে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা কিছুটা হলেও সহজতর হয়েছে।

নিরাপত্তা বাহিনী কতটুকু জানতো?
বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভবনের উপর থেকে কোণঠাসা হওয়া পুলিশ সদস্যদেরকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে তুলে নেয়া হচ্ছে। হয়তো ইন্টেলিজেন্সের কাছে তথ্য ছিল যে, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের লাশ চাইছে অথবা জীবন্ত পুলিশ সদস্যকে ধরে এনে মিডিয়ার সামনে কথা বলাতে চাইছে তাদের সহকর্মীদেরকে বিক্ষোভে বাধা দেয়া থেকে নিবৃত করতে। সহিংসতার ব্যাপারে ইন্টেলিজেন্স আগেভাগেই সতর্ক করতে পেরেছিলো। কিন্তু কিছু ব্যাপারে তারা একেবারেই অজ্ঞ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। 


ইন্টেলিজেন্সের সাবধানবাণীর উপর ভিত্তি করেই গত কয়েক বছর ধরেই সরকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। পুলিশ, বিজিবি এবং আনসারের জন্যে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ক্রয় করেছে সরকার; যেগুলি মূলতঃ 'ক্রাউড কনট্রোল'এ ব্যবহৃত হয়।

গত তিন বছরে 'ক্রাউড কনট্রোল' কাজে পুলিশের জন্যে কেনা হয়েছে রীতিমতো একটা অস্ত্রাগার! আশ্চর্য্যজনক এই হিসেব থেকে দেখা যায় যে, ২০২১ থেকে ২০২৩এর মাঝে পুলিশ অস্ত্র এবং গোলাবারুদের পাহাড় গড়েছে! এই তিন বছরে পুলিশ কমপক্ষে ১০,০০০ শটগান (১২-বোর), ৭,০০০ সিঙ্গেল-শট টিয়ারশেল লঞ্চার (৩৮মিঃমিঃ), ১১০টা ভেহিকল-মাউন্টেড মাল্টিব্যারেল টিয়ারশেল লঞ্চার, ১০টা ড্রোন, ১৩,০০০ এন্টি-রায়ট হেলমেট, ৩৫,০০০ বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, ১০,০০০ রায়ট শিল্ড, ৬৮,২০,০০০ শটগান কার্তুজ (রাবার এবং লেড), ২০,০০০ সফট কাইনেটিক প্রজেক্টাইল (৩৮মিঃমিঃ), ৬,৪৮,০০০ দূরপাল্লার টিয়ারশেল (৩৮মিঃমিঃ), ৪০,০০০ স্বল্পপাল্লার টিয়ারশেল, ২,৩২,০০০ থ্রি-মিউনিশন টিয়ারশেল, ১৬,৬০০ স্টান গ্রেনেড, ৭৪,০০০ সাউন্ড গ্রেনেড, ১৪,০০০ ফ্ল্যাশ-ব্যাং গ্রেনেড, ১৫,০০০ মাল্টি-ইমপ্যাক্ট টিয়ারগ্যাস গ্রেনেড, ৪০,০০০ টিয়ারগ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড। তবে এই অস্ত্রগুলি কেনা হয়েছে পুরো বাংলাদেশের পুলিশের জন্যে। ঢাকার নিরাপত্তার জন্যে রাষ্ট্রকে নির্ভর করতে হবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপর। ডিএমপি চাপের মাঝে পড়লে রিজার্ভ ডাকতে বাধ্য হবে। শটগান, টিয়ারশেল এবং স্টান-সাউন্ড গ্রেনেডের বাইরে ডিএমপির ক্রাউড কনট্রোল অস্ত্রগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটা হলো এপিসি। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিকে বিক্ষোভকারীদের দখলমুক্ত করতে এই এপিসিগুলির ছত্রছায়ায় পুলিশ অগ্রগামী হতে পারে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দলনের সময় এই এপিসির ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে। ২০২৩এর জুলাই মাসেই বিরোধী দলের সাথে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের সংঘর্ষ হয়; যেখানে অনেকগুলি এপিসি মোতায়েন হয়েছিল। ২০২৪ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে ১টা মহিলা ব্যাটালিয়ন (১১তম) সহ ঢাকার উত্তরায় রয়েছে মোট ৬টা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বা এপিবিএন (১ম, ৫ম, ৮ম, ১২তম, ১৩তম)। এপিবিএনএর মোট ১৭টা ব্যাটালিয়নের মাঝে এই ৬টা রয়েছে উত্তরায় এবং গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তায় আরও দুইটা স্পেশাল প্রোটেকশন ব্যাটালিয়ন বা এসপিবিএন (১ম ও ২য়) রয়েছে মোহাম্মদপুরে। বাকি ৯টা ব্যাটালিয়ন রয়েছে ঢাকার বাইরে। এপিবিএন সংসদ ভবন, সুপ্রীম কোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল, ডিপ্লোম্যাটিক জোন, সচিবালয়, বিমান বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা দেয়। এই ইউনিটগুলি খুবই ভালো ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তবে এরা প্রায় সকলেই বিভিন্ন স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত। রাস্তায় নিরাপত্তা দিতে এদের বেশিরভাগকেই পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ ঢাকায় সহিংসতা প্রতিরোধে এরা মূল রিজার্ভের ভূমিকায় থাকতে পারবে না। এক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের ইউনিটগুলি রিজার্ভের ভূমিকা নিতে পারে। একারণেই ঢাকার বাইরের ইউনিটগুলির সাথে নিরপদ কমিউনিকেশন বিঘ্ন করাটা বিক্ষোভকারীদের জন্যে ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ।

ডিএমপির জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রিজার্ভের ভূমিকা নিয়েছে বিজিবি। বিজিবি যাতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ঢাকার রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কাজ করতে পারে, সেজন্য বিজিবিকে আলাদাভাকে কিছু অস্ত্র দেয়া হয়েছে; যেগুলি সীমান্ত প্রতিরক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় নয়। এর মাঝে রয়েছে ২০২০ সালে ইউক্রেন থেকে আনা ১২টা স্পারটান এপিসি এবং তুরস্ক থেকে আনা ১০টা রায়ট কন্ট্রোল ভেহিকল। এগুলির সবগুলি হয়তো ঢাকায় রাখা হয়নি। এগুলিকে ২০২১ সালে নারায়নগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে; এবং এবারের ২০২৪এর ব্যার্থ অভ্যুত্থানেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে বিজিবির ঢাকা রক্ষায় সবচাইতে বড় প্রদক্ষেপ ছিল ঢাকার দুই প্রবেশ পথে গাজীপুর এবং নারায়নগঞ্জে দুইটা ব্যাটালিয়ন। এর ফলে ২০২২ সাল নাগাদ বিজিবির ঢাকা সেক্টর শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায় ৪টা ব্যাটালিয়নে – ঢাকায় ৫ম এবং ২৬তম ব্যাটালিয়ন, নারায়নগঞ্জে ৬২তম ব্যাটালিয়ন এবং গাজীপুরে ৬৩তম ব্যাটালিয়ন। নারায়নগঞ্জ এবং গাজীপুরের ইউনিটগুলি হলো বিজিবির ৬৩টা ব্যাটালিয়নের সর্বশেষ সংযোজিত ব্যাটালিয়ন। এই ব্যাটালিয়নগুলি ২০২৪ সালে ঢাকাকে রক্ষায় অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।

ডিএমপির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ রিজার্ভ হলো আনসার। আনসারের মোট ৬১ লক্ষ সদস্যের মাঝে মূল স্ট্রাইকিং ফোর্স হলো ব্যাটালিয়ন আনসার। ২০২৪এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ আনসারের নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ছিল ৪২টা (যার মাঝে ২টা মহিলা ব্যাটালিয়ন)। এই ৪২টা ব্যাটালিয়নের মাঝে ১৮টাই রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। গত নির্বাচনে মোতায়েন করা মোট ৫ লক্ষ ১৭ হাজার আনসারের মাঝে এই ৪২টা ব্যাটালিয়নের সাড়ে ৮ হাজার সদস্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। তবে এদের সকলে কিন্তু ঢাকায় মোতায়েন নেই। এছাড়াও আনসারের ৭০ হাজার সদস্য বিভিন্ন স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে; যাদেরকে অবশ্য রাস্তায় ক্রাউড কনট্রোলের জন্যে পাওয়া যাবে না। তবে ক্রাউড কনট্রোলের জন্যে স্পেশালিস্ট না হলেও আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ঢাকার সহিংসতা মোকাবিলায় পুলিশের সাথে মোতায়েন ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আনসারকে আরও বেশি ক্রাউড কনট্রোল ভূমিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই হিসেবে ২০১৮ সালে ১০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতালি, তুরস্ক এবং ব্রিটেন থেকে আনসার সদস্যদের জন্যে ৩০ হাজার শটগান এবং প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ লক্ষ শটগান কার্তুজ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এর মাধ্যমে আনসার বাহিনী পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করে পুলিশের শক্তিকে বৃদ্ধি করেছে। যদিও এটা নিশ্চিত নয় যে, চলমান ঘটনাতে কতজন আনসার সদস্যকে ঢাকায় মোতায়েন করা সম্ভব হয়েছিল, তথাপি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এবারের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় পুলিশের শক্তি বৃদ্ধিতে আনসারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তবে পুলিশ, বিজিবি এবং আনসার মিলেও ঢাকার সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যে রক্ষা করা সম্ভব নয়, তা এবারে প্রমাণিত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রিজার্ভের দিকেই তাকাতে হয়েছে - সেনাবাহিনী।

আন্দোলন থেকে সহিংতা
মিরপুর-১০। মেট্রেরোল চলছে আগুনের উপর দিয়ে। মিরপুর-১০ ছিল অভ্যুত্থানকারীদের গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটের একটা। এখান থেকে রোকেয়া সরনী পার হলেই গণভবন। মেট্রোরেলের ফার্মগেট, মিরপুর-১০ এবং কাজিপাড়া স্টেশনে হামলা করে ভাংচুর করা হয়। এই ভাংচুরের কারণ বোঝা না গেলেও এটা ধারণা করা যেতে পারে যে, হয়তো বিক্ষোভকারীরা মনে করেছিল যে, মেট্রোরেল ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনী সোয়াট, সিআরটি বা র‍্যাবের স্পেশাল ফোর্সের মতো বাহিনীকে ঝটিকা মোতায়েন করতে পারে। 


প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের উপর সংবাদ সন্মেলনে ছাত্রদের আন্দোলনের ব্যাপারে কটাক্ষ করে মন্তব্য করেন। তখন মনে হচ্ছিলো যে, হয় তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন; অথবা তিনি জানেন ঠিক কি তিনি বলতে চাচ্ছেন। ঘটনার শেষে বোঝা যাচ্ছে যে, তার এই মন্তব্যের সাথে দুই ব্যাপারই সম্পর্কিত। কারণ তিনি চীন সফরের সময়েই জেনে গেছেন যে, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ট্রিগার করা হয়ে গেছে। অর্থাৎ সংবাদ সন্মেলনের সময় তিনি তখন জানতেন যে, ছাত্রদের আন্দোলন হাইজ্যাক করার পরিকল্পনা করা হয়ে গিয়েছে। হয়তো তিনি তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি ছাত্রদের আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে বেগবান করেছিল। তবে পরবর্তীতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি যথেষ্ট নমনীয়ভাবে তার বক্তব্য পেশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে যা বলেছিলেন, সেটা আন্দোলনকারীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আন্দোলনের পিছনে যারা ছিলো, তাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি। আন্দলোনকারীদের পক্ষে মার্কিন বিবৃতি আপারেশন চালিয়ে নেবার একটা গ্রীন লাইট বলা যেতে পারে।

১৬ই জুলাই মঙ্গলবার দেশজুড়ে বিক্ষোভ দেখা দিলো এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন পুরোপুরিভাবে ব্যাহত হলো। সায়েন্স ল্যাবরেটরি রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। মহাখালী মোড়ও মানুষ পার হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এই দিনই বোঝা যাওয়া শুরু হলো যে, পেছনে কেউ রয়েছে এবং তাদের কোন একটা উদ্দেশ্য রয়েছে - যেটা তখনও পরিষ্কার নয়। তখনও ফোর-জি মোবাইল ফোন সার্ভিস এবং ইন্টারনেট চালু ছিল। তবে মোবাইল ফোনে ফেইসবুক ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিলো।

১৭ই জুলাই বুধবার ছিলো আশুরার ছুটি। এই দিনে অনেকেই বাসার বাইরে বেরিয়েছিল; অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানও ছিল এই দিনে। শুধুমাত্র সরকারের ইন্টেলিজেন্সেরই জানার কথা যে পরের দিন কি হতে পারে। তবে সেদিনও পরিষ্কার হয়নি যে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পেছনে যারা রয়েছে, তারা আসলে কি চায়। পরের দিন 'কমপ্লিট শাটডাউন' নামের একটা কর্মসূচীর ডাক এলো। তবে এর অর্থ কি হতে পারে, তা তখনও পরিষ্কার নয়। পূর্বে ক্ষমতাসীন দলের আনঅফিশিয়াল হরতালও দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ; আবার বিএনপির 'ঈদের পরের আন্দলন'ও দেখেছে তারা। তখনও পর্যন্ত ফোর-জি সার্ভিস এবং ইন্টারনেট সার্ভিস চালু ছিল। তবে টেলিনরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় যে, সরকারের নির্দেশে ১৭ই জুলাই থ্রি-জি এবং ফোর-জি সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল; শুধুমাত্র টু-জি সেবা চালু ছিল।

অকল্পনীয় ঘটনা - বৃহঃস্পতিবার
সেতু ভবনের সাথে কয়লা হয়ে যাওয়া গাড়ির বহর। ভবনে কয়েক'শ ব্যক্তি হামলা করে ব্যাপক ভাংচুর করে এবং ৫৫টা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাস্তায় রোডব্লকের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে পারেনি। একারণে গাড়িগুলি নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত জ্বলেছিলো। পরিকল্পনাকারীরা আক্রমণে অংশ নেয়া জনতাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে, এই সাহেবদের সুন্দর অফিস এবং দামী দামী গাড়িগুলিই তাদের নিজেরদের স্থবির জীবনের কারণ। এর ফলে জনগণ তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে এই ভবনের উপর ঢেলে দেয়। 


১৮ই জুলাই বৃহঃস্পতিবার যা ঘটলো, তা সাধারণ জনগণের কল্পনার বাইরে ছিল। মিডিয়ার রিপোর্টে ২০ থেকে ২২ জন মানুষের নিহত হবার খবর এলো। হতাহত যতজনই হোক না কেন, এই দিনটা যে ভয়াবহ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দেশের জনগণ বহুকাল এইরূপ সহিংতা দেখেনি। এবং এই দিনই প্রথম পরিষ্কার হলো যে, আন্দোলন এখন ছাত্রদের হাতে নেই। তবে তখনও পরিষ্কার ছিল না যে, যারা সহিংসতা করছিলো, তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল। দিনের শুরুটা হয়েছিলো যাত্রাবাড়িতে ঢাকা শহরের প্রবেশপথে। এখানকার সহিংসতা ছিল সবচাইতে ভয়ংকর। পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিক্ষোভকারীদের অন্যতম টার্গেট ছিল যাত্রাবাড়ীর নিয়ন্ত্রণ নেয়া; যাতে করে এই গেইটওয়ে ব্যবহার করে ঢাকার বাইরে থেকে আরও জনগণকে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। এছাড়াও ভৈরবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক কেটে ফেলা হয়; এবং ঢাকার অন্যান্য প্রবেশপথের উপর পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়। তবে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এবং মোড়গুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলে মূল সহিংসতা।

রামপুরায় সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি ভবনে কয়েক'শ মানুষ হামলা করে বসে। তারা ভবনের ভেতর ভাংচুর করে এবং আগুন দেয়। একইসাথে তারা প্রায় ১৬টার মতো গাড়ি ভাংচুর করে এবং আগুনে পোড়ায়। এর আগে ভবনের সামনে পুরো রাস্তার নিয়ন্ত্রণ নেয় বিক্ষোভকারীরা। তারা রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে বাধা দেয়। এর ফলে বিটিভি ভবন এবং এর গাড়িগুলি নিঃশেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত জ্বলেছিলো। তবে যে ব্যাপারটা খেয়াল করার মতো তা হলো, হামলাকারীরা বিটিভি ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেছিলো কিনা, সেব্যাপারে কোন খবর প্রচারিত হয়নি। বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যার দিকে। বিকেলের দিকে এই হামলা হলেও রাত সাড়ে ৮টার আগে বিজিবি এই ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। তখন প্রচার করা হয় যে, বিজিবি এই ভবন থেকে আক্রমণকারীদের বের করে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। যদি তা-ই হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে, বিজিবি পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিটিভি ভবনের নিয়ন্ত্রণ ছিল হামলাকারীদের হাতে। ২২শে জুলাই বিটিভির মহাপরিচালক একাত্তর টিভিকে বলেন যে, দুপুর ১২টা থেকেই বিক্ষোভকারীরা ভবনের ভেতরের লোকদের বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিতে থাকে; যদিও তারা বের হননি। তার লোকেরা 'হিউম্যান শিল্ড' তৈরি করে ভবনের সম্প্রচার কক্ষগুলিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা কলাপসিবল গেট আটকে দেন, সন্ধ্যা নাগাদ সকল পাওয়ার সিস্টেম শাটডাউন করে দেন এবং টেলিফোনে বিভিন্ন এজেন্সির সহায়তা কামনা করেন। পরে রাত ৮টার দিকে তারা ভবন ত্যাগ করেন। তবে তিনি ভবনের নিরাপত্তায় কোন বাহিনীর কেউ ছিল কিনা, সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান। সাংবাদিকদের মাঝে কেউ প্রশ্ন করেছেন যে, এরকম মুহুর্তে বিটিভি ভবনে কেন কমান্ডো টিম পাঠানো হয়নি? সরকার কি 'কেপিআই-১' ক্যাটাগরির এই স্থাপনার নিরাপত্তাকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল? যদি রাত ৮টার দিকে বিটিভির কর্মকর্তারা ভবন ছেড়ে দেন, তাহলে বিজিবি কি রাত সাড়ে ৮টায় খালি ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে? যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, বিটিভি ভবন যে বিক্ষোভকারীদের একটা টার্গেট ছিল, সেটা ইন্টেলিজেন্স এবং নিরাপত্তা বাহিনী একেবারেই জানতো না।

সহিংসতার একটা কেন্দ্র ছিল মহাখালী-বনানী। বনানীর সেতু ভবনে কয়েক'শ ব্যক্তি হামলা করে ব্যাপক ভাংচুর করে এবং ৫৫টা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। রাস্তায় রোডব্লকের কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে পারেনি। একারণে গাড়িগুলি নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত জ্বলেছিলো। এখানে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, পরিকল্পনাকারীরা আক্রমণে অংশ নেয়া জনতাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো যে, এই সাহেবদের সুন্দর অফিস এবং দামী দামী গাড়িগুলিই তাদের নিজেরদের স্থবির জীবনের কারণ। এর ফলে জনগণ তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে এই ভবনের উপর ঢেলে দেয়। প্রায় চার তলা পর্যন্ত ভবনের কাঁচের জানালা ঢিল মেরে ভাঙ্গা হয়েছে। তবে এই ভবনে হামলার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়।

বিক্ষোভকারীদের আরেকটা কেন্দ্র ছিল মিরপুর-১০। এখান থেকে রোকেয়া সরনী পার হলেই গণভবন। মেট্রোরেলের ফার্মগেট, মিরপুর-১০ এবং কাজিপাড়া স্টেশনে হামলা করে ভাংচুর করা হয়। এই ভাংচুরের কারণ বোঝা না গেলেও এটা ধারণা করা যেতে পারে যে, হয়তো বিক্ষোভকারীরা মনে করেছিল যে, মেট্রোরেল ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনী সোয়াট, সিআরটি বা র‍্যাবের স্পেশাল ফোর্সের মতো বাহিনীকে ঝটিকা মোতায়েন করতে পারে। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। রাস্তার মাঝের লোহার ডিভাইডারের সবগুলি স্কায়ার পাইপ কেটে ফেলা হয়েছিলো; গাছগুলিও কেটে ফেলা হয়েছিলো। তবে লোহার ডিভাইডার কিভাবে কাটা সম্ভব হলো, সেটা সত্যিই চিন্তার উদ্রেক করে। হ্যাক-স' ব্লেড দিয়ে এগুলি কাটা সম্ভব হলেও যে সময় এতে খরচ হবে, তার মাঝে পুলিশের ধাওয়া খেতেই হবে। খুব সম্ভবতঃ গ্যাস কাটার দিয়ে এগুলি কাটা হয়েছিলো। রাস্তার মাঝে ধারালো জিনিস দিয়ে খোঁড়ার চেষ্টাও করা হয়েছিলো; যেকারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর এই স্থান দিয়ে যানবাহন চলাচল ছিল কষ্টকর। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, বিজিবি এবং আনসার বাহিনী বেশ কোণঠাসা অবস্থানে চলে যায়। এক পর্যায়ে বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভবনের উপর থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ঘিরে ফেলা ৬০ জনের বেশি পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। হয়তো ইন্টেলিজেন্সের কাছে তথ্য ছিল যে, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের লাশ চাইছে অথবা জীবন্ত পুলিশ সদস্যকে ধরে এনে মিডিয়ার সামনে কথা বলাতে চাইছে তাদের সহকর্মীদেরকে বিক্ষোভে বাধা দেয়া থেকে নিবৃত করতে।

দিনটা ছিল খুবই দীর্ঘ – প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে সহিংসতা। মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড মোড়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে সহিংসতা। এখান থেকে আসাদ গেট পার হলেই গণভবন। পুলিশ এবং বিক্ষোভকারী - দুই গ্রুপই প্রচন্ড রকমের পরিশ্রান্ত থাকার কথা। দিনের শেষে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার ছিল তা হলো, পুলিশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়গুলির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাটা খুবই কঠিন হয়ে গিয়েছে। আন্দোলনকারীরা হয়তো বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছিলো - তারা হয়তো মনে করতে থাকে যে, আর একটু চাপ দিলেই সরকার মনে হয় ধ্বসে পড়বে! অনেকে মনে করতে থাকে যে, সরকারের পতন খুব সম্ভবতঃ অনিবার্য। তবে ছাত্র আন্দোলনের প্রথম থেকেই এটাই বিরোধী দলগুলির লক্ষ্য ছিলো কিনা, সেটা সাধারণ মানুষের জানা ছিলো না। এই দিনেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু ছিলো। তবে মোবাইলে ফোর-জি এবং থ্রি-জি সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়; শুধুমাত্র টু-জি সেবা বা কল এবং এসএমএস করার সেবা চালু থাকে। ফেইসবুক তো আগে থেকেই বন্ধ ছিলো। কাজেই এই দিন থেকে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় মোবাইলে কল। তবে বাড়িতে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড চালু থাকায় অন্ততঃ বাড়িতে থেকে ব্রডব্যান্ড বা ওয়াই-ফাই-এর মাধ্যমে ইন্টারনেটে ঢোকা যাচ্ছিলো।

এত সহিংসতা মানুষ এর আগে দেখেনি
যাত্রাবাড়ীতে বিজিবি এবং তাদের রায়ট কন্ট্রোল ভেহিকল। বিজিবির ঢাকা রক্ষায় সবচাইতে বড় প্রদক্ষেপ ছিল ঢাকার দুই প্রবেশ পথে গাজীপুর এবং নারায়নগঞ্জে দুইটা ব্যাটালিয়ন। এর ফলে ২০২২ সাল নাগাদ বিজিবির ঢাকা সেক্টর শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায় ৪টা ব্যাটালিয়নে – ঢাকায় ৫ম এবং ২৬তম ব্যাটালিয়ন, নারায়নগঞ্জে ৬২তম ব্যাটালিয়ন এবং গাজীপুরে ৬৩তম ব্যাটালিয়ন। নারায়নগঞ্জ এবং গাজীপুরের ইউনিটগুলি হলো বিজিবির ৬৩টা ব্যাটালিয়নের সর্বশেষ সংযোজিত ব্যাটালিয়ন। এই ব্যাটালিয়নগুলি ২০২৪ সালে ঢাকাকে রক্ষায় অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।

১৯শে জুলাই শুক্রবার ছিল সবচাইতে ভয়াবহতম দিন। বেশিরভাগ মিডিয়াই হতাহতের সংখ্যা প্রচার করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। তবে যারা সংখ্যা দিচ্ছিলো, তার মাঝে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৯। পুলিশ এবং সরকারী দলের পান্ডাদের সাথে বিক্ষোভকারীদের মারাত্মক সংঘর্ষ হয় পুরো দেশজুড়ে। আগের দিনই বিরোধী দল বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল যে, তারা বিকেল ৩টায় ঢাকায় সমাবেশ করে সরকার পতনের ডাক দেবে। আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশের ডাক দেয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই পুলিশ ঢাকায় সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সকাল ৯টার আগেই ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু হয় সহিংসতা। যাত্রাবাড়ী, মহাখালী-বনানী, রামপুরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১০, ইত্যাদি সকল স্থান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে। জুম'আর নামাজের মাঝেই চলতে থাকে সহিংসতা। আর নামাজের পর এই সহিংসতা অন্য এক রূপ নেয়। বিকেল নাগাদ পরিষ্কার হতে থাকে যে, পুরো বাংলাদেশে অরাজকতা রাজত্ব করছে।

বনানীর সেতু ভবনে দ্বিতীয় বারের মতো হামলা করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই ভবনটা কি কারণে দু'বার হামলা করা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। পাশের বিআরটিএ ভবনেও হামলা করা হয়। মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ভবনে এবং ভবনের ৫২টা গাড়ি ও ১৬টা মোটরসাইকেলে গানপাউডার ব্যবহার করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে এর চাইতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাশের খাজা টাওয়ারেও অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুর। খাজা টাওয়ারে আইজিডব্লিউ কোম্পানিগুলির সার্ভার থাকার কারণে রাত ৯টার দিকে সারাদেশে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো অজানা যে, এই ভবনটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে আরও একবার এই ভবনে আগুন লেগেছিল; তখনই প্রথম জানা গিয়েছিল যে, এই ভবনে একসাথে সবগুলি আইজিডব্লিউ কোম্পানির সার্ভার এবং ডাটা সেন্টার; এবং এখানে আগুন লাগলে সারা দেশে ইন্টারনেট থাকে না! তবে সেই অগ্নিকান্ডের পরেও এই ভবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। হামলাকারীরা নিঃসন্দেহে এই ভবনের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিল। আর এটাও এখন নিশ্চিত যে, ইন্টেলিজেন্সের কাছে এই ভবনে হামলার ব্যাপারে কোন তথ্যই ছিল না। একাত্তর টিভির সাংবাদিকই একমাত্র ভবনের ভেতরের দৃশ্যের খবর দিয়েছিলেন – ফাইবার অপটিক লাইনগুলিকে কেটে টুকরা টুকরা করা হয়েছিলো; যাতে করে এটা মেরামতে অনেক বেশি সময় লাগে। ২১শে জুলাই সরকারিভাবে বলা হয় যে, ৪০টা জায়গায় ফাইবার অপটিক ব্যাকবোন এবং আঞ্চলিক যোগাযোগের কেবল কেটে ফেলা হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, এর ফলে সরকারি দপ্তরগুলির মাঝে কমিউনিকেশন হার্ডলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অর্থাৎ সরকারের প্রধানতম সিকিউর কমিউনিকেশন লাইন সেদিন অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে সরকারের পক্ষে ঢাকার বাইরে থেকে রিজার্ভ ফোর্স ডাকা কঠিন হয়ে যাবার কথা। আর বলাই বাহুল্য যে, এর ফলে সরকারের অনেকেই টু-জি মোবাইল সার্ভিসের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। এতে করে যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, সরকার কোন অবস্থাতেই টু-জি সেবা বন্ধ করতে সক্ষম হবে না।

বিভিন্ন স্থানে বিজিবির ২৫০ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়; যার মাঝে ৭৫ প্লাটুন মোতায়েন করা হয় শুধু ঢাকায়। বিজিবির কমপক্ষে ৫২ সদস্য আহত হবার খবর জানা যায়। নারায়নগঞ্জে বিজিবির ৬২তম ব্যাটালিয়নের ব্যারাকে হামলা হয়। যেহেতু নারায়নগঞ্জের এই ব্যাটালিয়ন বিজিবির ঢাকায় রিজার্ভ ফোর্স, তাই অবশ্যই এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল বিজিবিকে নারায়নগঞ্জে আটকে রেখে মূল এলাকাগুলি থেকে দূরে রাখা। মেরুল-বাড্ডায় আনসার ক্যাম্পে হামলা করে টাকা ও খাদ্যদ্রব্য লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। তবে এখানে কোন অস্ত্র ছিল না। নারায়নগঞ্জে শীতল পরিবহণের ডিপোতে হামলা করে ২৬টা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, এই অগ্নিসংযোগের উদ্দেশ্য কি ছিল।

নরসিংদীতে জেলা প্রশাসন ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একইসাথে নরসিংদী কারাগারে কয়েক হাজার মানুষ হামলা করে বহু কয়েদীকে বের করে নিয়ে আসে এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। পরে জানা যায় যে, মোট ৮২৬ জন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী সেখান থেকে পালায় এবং ৮৫টা অস্ত্রসহ প্রায় ৭ হাজার রাউন্ড গুলিও লুট হয়। ধানমন্ডিতে বেপজা অফিসে ভাংচুর চালানো হয়। পরবর্তীতে এক রিপোর্টে বলা হয় যে, সেখান থেকে নিরাপত্তার জন্যে রাখা ৩০টা বুলেটপ্রুফ ভেস্টও চুরি হয়। এছাড়াও মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস ভবনে হামলা করে ভবনে এবং সেখানকার ২৩টা গাড়িতে গানপাউডার ব্যবহার করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মিরপুরে বিআরটিএর টেস্ট সেন্টারে হামলা করে সকল যন্ত্র ভাংচুর করা হয় এবং লুটপাট করা হয়। মিরপুরে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির ডিপোতে হামলা করে ৪০টা ময়লার গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

বিভিন্ন জায়গায় রেল লাইন উপড়ে ফেলা এবং কয়েকটা ট্রেন ভাংচুর করার পর রেল সার্ভিস অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগার বিসিএসআইআর ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বনানী এবং মহাখালীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা আগুনে ভস্মীভূত করে ফেলা হয়। যাত্রাবাড়ীতে মেয়ন হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজাও আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলির সময় ফায়ার সার্ভিস ছিল প্রায় পুরোপুরিভাবে নিষ্ক্রিয়। কারণ, ফায়ার সার্ভিসের ৪টা গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ ১৩টা গাড়ি ভাংচুর করা হয় এবং ১৮জন ফায়ার ফাইটার আহত হয়। ফায়ার ফাইটিং অকার্যকর হয়ে পড়ার কারণে বিমান বাহিনীর 'এমআই-১৭১' হেলিকপ্টার থেকে বাকেটের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদী এবং হাতিরঝিল থেকে পানি তুলে আকাশ থেকে ফেলা হয়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে র‍্যাবের হেলিকপ্টার থেকে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভকারীদের উপরে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। ড্রোনের ব্যবহার কতটুকু হয়েছিল সেটা জানা না গেলেও এবারের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে এয়ার সাপোর্ট যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। টোল প্লাজাগুলিতে কেন আগুন দেয়া হয়েছিল, সেটা সেসময় পরিষ্কার না হলেও এখন বোঝা যাচ্ছে যে, এগুলিকে ধ্বংস করা হয়েছে, যাতে করে ফ্লাইওভার এবং এক্সপ্রেসওয়েকে পুলিশ যেন ব্যবহার করতে না পারে। কারণ এই ফ্লাইওভারগুলির র‍্যাম্প মহাখালী-বনানী এবং যাত্রাবাড়ীতে বিক্ষোভকারীদের মূল অবস্থানের পিছনে ছিল। এগুলি বলে দেয় যে, এই পরিকল্পনা কতটা ডিটেলসে তৈরি করা হয়েছিল। এটা সাধারণ কারুর পরিকল্পনা নয়; এখানে নিঃসন্দেহে প্রফেশনাল লোকেরা জড়িত ছিল।

এই দিন শেষ হবার আগেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তারা সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং যারা এই কাজগুলি করছে, তারা শিক্ষার্থীদের অংশ নয়। শিক্ষার্থীদের এই ঘোষণা সরকারের জন্যে একটা বিজয় ছিল। ভয়াবহ এই দিনটার শেষ হয় রাত সাড়ে ১১টার দিকে; যখন মিডিয়াতে প্রচার শুরু হয় যে, রাত ১২টা থেকে কারফিউ ঘোষণা করা হচ্ছে এবং সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই খবরেই বিক্ষোভকারীরা ধীরে ধীরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলি ছাড়তে থাকে। শুক্রবার রাত ১২টা থেকে রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। এর মাঝে ১২ ঘন্টা পর শনিবার দুপুর ১২টায় দুই ঘন্টার জন্যে কারফিউ শিথিলের ঘোষণা দেয়া হয়।

কারফিউ এবং সেনা মোতায়েন – ‘মোস্ট ডিসাইসিভ মোমেন্ট'
ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনী। শুক্রবার রাতের পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারি দলের পান্ডারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি; যদিও তারা পুরোপুরিভাবে হেরেও যায়নি। তবে এটা বলা যায় যে, শুক্রবারের মতো শনিবারও যদি একই দ্রুতি নিয়ে জ্বলতো, তাহলে পুলিশ, বিজিবি, আনসার নিঃসন্দেহে সামাল দিতে পারতো না। কাজেই সেই হিসেবে সেনা মোতায়েন ছিল পুরো ঘটনার 'মোস্ট ডিসাইসিভ মোমেন্ট'। অর্থাৎ এই এক সিদ্ধান্তেই পুরো ঘটনাপ্রবাহের মোড় ঘুরে গেছে; যদিওবা বিক্ষোভ ঠেকাবার মূল কাজটা পুলিশ, বিজিবি, আনসার এবং সরকারি পান্ডারাই করেছে!


২০শে জুলাই শনিবার কারফিউএর প্রথম দিনে সহিংসতা থামেনি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পরেও মোবাইলে টু-জি সার্ভিস ব্যবহার করেই গুজব ছড়ানো হয় যে, খালেদা জিয়া মারা গেছেন। সহিংস আন্দোলন থেকে ছাত্রদের সড়ে যাবার পর আন্দোলন কতটা এগুবে তা নিয়ে যেমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়, তেমনি কারফিউ ভেঙ্গে সহিংস আন্দোলন করার জন্যে যথেষ্ট জ্বালানি পাওয়া যাবে কিনা, সেব্যাপারেও ছিল সন্দেহ। হয়তো নিজেদের কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতেই অভ্যুত্থানকারীদের নেতৃত্ব খালেদা জিয়ার মারা যাবার গুজবটা ছড়িয়েছিল। আর এই ব্যাপারটা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, ইন্ডেপেন্ডেন্ট টিভিতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসকের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করা হয় যে, খালেদা জিয়া মারা যাননি।

তবে এই দিনেই মিডিয়াতে প্রশ্ন উঠতে থাকে যে, সরকার যদি ছাত্রদের দাবিদাওয়া মেনে নেয়ার ঘোষণাটা দু'দিন আগে দিতো, তাহলে তো এতগুলি প্রাণহানি হতো না। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করতে থাকে যে, ছাত্রদের আন্দোলন আরেকটা পক্ষ যে হাইজ্যাক করছে, সেটা সরকারের ইন্টেলিজেন্সের অবশ্যই জানার কথা। তাহলে সরকার কেন আগেভাগে কোন ব্যবস্থা নিলো না? কেউ কেউ আবার বলতে থাকেন যে, সরকার এই সমস্যাটাকে 'মিসম্যানেজ' করেছে। ঘটনার শেষে সরকারের ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করার একটা সম্ভাব্য কৌশল সামনে দিয়ে ঘুরপাক খায়। হয়তো সরকার এই ঘটনাগুলি ঘটতে দিয়েছিল বিরোধী পক্ষগুলিকে খোলা ময়দানে আনার জন্যে। এতে করে কে কে এই পরিকল্পনার সাথে জড়িত, তা যথেষ্ট প্রমাণসহ সকলের সামনে হাজির হয়ে যাবে। তবে এই কৌশল অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ একবার বিটিভি ভবনের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেলে এবং সরকারি টেলিভিশন ব্যবহার করে যদি বিরোধীরা কোন সম্প্রচার করে ফেলতে সক্ষম হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় টিকে থাকা অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কাজেই খুব সম্ভবতঃ সরকার এটা হতে দেয়নি; বরং রাষ্ট্রের উপদেষ্টারা বলেছে যে, ১৯শে জুলাইএর ধ্বংসযজ্ঞের আগে যদি পুলিশ বেশি কঠোর হয়, বা কারফিউ বলবত করা হয় বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়, তাহলে ছাত্ররা বিএনপি-জামাতের বিক্ষোভের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে। একারণেই পুলিশের কঠোর হওয়া বা কারফিউ দেয়া বা সেনা মোতায়েনসহ সকল কিছুই দু'দিন দেরিতে করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। ২২শে জুলাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, তিনি সেনাবাহিনীকে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মোতায়েন করতে চাননি। এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল নিতান্ত বাধ্য হয়েই।

কারফিউএর প্রথম দিনে নিঃসন্দেহেই পুরো মিডিয়াতে সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। একে তো বাসার বাইরে যেতে না পারা; তার উপর ইন্টারনেট না থাকা এবং টেলিভিশনে সকল চ্যানেলে জাবর কাটা সংবাদ প্রচারে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। ইন্টারনেটের উপরে নির্ভরশীল সকল সার্ভিস ব্যাহত হয় এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। মোবাইল ফোনে টু-জি সার্ভিস চালু থাকলেও মোবাইল রিচার্জ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার সার্ভিসে ধ্বস নামে এবং লাখো মানুষের মাঝে হাহাকার পড়ে যায়।

কারফিউ ছিল অনেকটাই ঢিলেঢালা। কারণ পাড়া-মহল্লায় মানুষ বাইরে বের হচ্ছিলো এবং রিক্সা, গাড়ি এবং মোটরসাইকেলও চলেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং প্রধান সড়কে যেকোন চলাচলে বাধা দেয়া হয়। এমনকি যারা হাসপাতালের কর্মী, তাদেরকেও যথেষ্ট প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়েছে। সেনাসদস্যরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ, বিজিবি এবং আনসার সদস্যদের সহায়তায় মোতায়েন হয়। একইসাথে আকাশে সেনাবাহিনীর 'বেল-২০৬/৪০৭' এবং 'এমআই-১৭১এসএইচ' হেলিকপ্টারের আনাগোণা দেখা যায়। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল হলে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং শুক্রবারের সহিংসতার চিহ্নগুলি অবলোকন করে। তবে দুপুর ২টায় কারফিউ পুনরায় বলবত করার সময় থেকে পুনরায় শুরু হয় সহিংসতা। এই সহিংসতার খবর মিডিয়াতে একেবারেই প্রচার করা হয়নি।

তবে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের থেকে জানা যায় যে, যথেষ্ট সহিংসতা হয়েছে এই দিনে। শনিবার মোহাম্মদপুর এবং যাত্রাবাড়ী মোড়ে হয়েছে সহিংসতা। দিনের বেলায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার আকাশে দেখা গেলেও রাতের বেলায় বিমান বাহিনীর 'বেল-২১২' হেলিকপ্টারের আনাগোণা ছিল উল্লেখযোগ্য। দুপুর ২টা থেকে শুরু সহিংসতা সন্ধ্যা পর্যন্ত লাগামহীনভাবে চলে। বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দেয়া হয় এবং রোডব্লক তৈরি করা হয়। বিভিন্ন এলাকায় শতশত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়; যেগুলি ছিলো শটগান, টিয়ার শেল, স্টান গ্রেনেড বা ককটেলের শব্দ। কারণ ক্রাউড কনট্রোল রোলে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এগুলিই ছিল প্রধান অস্ত্র। তবে বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর কাছে থাকা রাইফেল এবং মেশিন গানের কোন ব্যবহার হয়েছে কিনা, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কারফিউএর প্রথম দিনে সহিংসতা হলেও তা শুক্রবারের মতো ছিল না। রাস্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং দেখামাত্র গুলির নির্দেশ বিক্ষোভকে যথেষ্টই দুর্বল করেছে। শুক্রবার রাতের পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারি দলের পান্ডারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি; যদিও তারা পুরোপুরিভাবে হেরেও যায়নি। তবে এটা বলা যায় যে, শুক্রবারের মতো শনিবারও যদি একই দ্রুতি নিয়ে জ্বলতো, তাহলে পুলিশ, বিজিবি, আনসার নিঃসন্দেহে সামাল দিতে পারতো না। কাজেই সেই হিসেবে সেনা মোতায়েন ছিল পুরো ঘটনার 'মোস্ট ডিসাইসিভ মোমেন্ট'। অর্থাৎ এই এক সিদ্ধান্তেই পুরো ঘটনাপ্রবাহের মোড় ঘুরে গেছে; যদিওবা বিক্ষোভ ঠেকাবার মূল কাজটা পুলিশ, বিজিবি, আনসার এবং সরকারি পান্ডারাই করেছে!

ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের এপিসি থেকে ছোঁড়া হচ্ছে টিয়ার শেল। শটগান, টিয়ারশেল এবং স্টান-সাউন্ড গ্রেনেডের বাইরে ডিএমপির ক্রাউড কনট্রোল অস্ত্রগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটা হলো এপিসি। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিকে বিক্ষোভকারীদের দখলমুক্ত করতে এই এপিসিগুলির ছত্রছায়ায় পুলিশ অগ্রগামী হতে পারে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন আন্দলনের সময় এই এপিসির ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে। ২০২৩এর জুলাই মাসেই বিরোধী দলের সাথে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের সংঘর্ষ হয়; যেখানে অনেকগুলি এপিসি মোতায়েন হয়েছিল। ২০২৪ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।


২১শে জুলাই রোববার কারফিউএর দ্বিতীয় দিনে সকাল ১০টার পরিবর্তে বিকেল ৩টায় দুই ঘন্টার জন্যে কারফিউ শিথিল করা হয়। এতে ধারণা করা যায় যে, নিরাপত্তা বাহিনী আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বকে পাকড়াও করতে যতটা সময় লাগবে বলে ধারণা করেছিল, তার চাইতে বেশি সময় লাগছে। এছাড়াও কারফিউএর মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্যে থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ইন্টারনেট সংযোগ ফিরিয়ে দেয়ার কথাগুলিও আগের মতোই ধোঁয়াশা রেখে ঘোষণা দেয়া হতে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভের সাথে সম্পৃক্ত সন্দেহে গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে বলে মিডিয়াতে খবর আসতে থাকে।

কারফিউএর মাঝেই বিদ্যুৎ প্রি-পেইড মিটার এবং মোবাইল রিচার্জের জন্যে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাজারে যেকোন পণ্য তোলার সাথেসাথেই বিক্রি হয়ে যায়; যদিওবা মূল্য ছিল আকাশচুম্বী। ব্যাংকের এটিএমগুলি অকার্যকর হয়ে পড়ে; অনেকেই অর্থের কষ্টে পড়ে যান। যে মোড়গুলিতে শনিবার সেনা মোতায়েন করা হয়নি, সেই মোড়গুলিতে রোববার সেনাসদস্যদের দেখা যেতে লাগলো। মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে পুলিশ, বিজিবি এবং আনসারের সহযোগিতায় দেখা গেছে। মোহাম্মদপুর আসাদ গেটে রেজর ওয়্যার এবং বালুর বস্তা দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। মূলতঃ মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড বা ধানমন্ডির দিক থেকে কেউ যাতে গণভবনের দিকে যেতে না পারে, সেজন্যেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এই মোড়ে কোন সহিংসতার চিহ্ন না থাকলেও মোহাম্মদপুর আসাদ এভিনিউএ টাউন হল থেকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাবার পথে ধ্বংসযজ্ঞ এবং পোড়ানো গাড়ি ছিল লক্ষ্যনীয়। যদিও মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডের মূল সংঘর্ষ ছিল বসিলার দিক থেকে আক্রমণ করা বিক্ষোভকারীদের সাথে, তথাপি আসাদ এভিনিউ এবং আশেপাশের সকল ছোট ছোট রাস্তা এবং গলি থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা হয়; যা ঠেকাতে বাহিনীর সদস্যদের হিমসিম খেতে হয়েছে।

কারফিউএর দ্বিতীয় দিনে যে ব্যাপারটা সকলের সামনে পরিষ্কার হচ্ছিলো তা হলো, বিক্ষোভকারীরা টার্গেট নিয়েই কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করেছে। বাকি এলাকাগুলিতে কাউকে দেখাই যায়নি। একাত্তর টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক ২০শে জুলাই রাতে এই ব্যাপারটাকে তুলে ধরে বলেছিলেন যে, তাদের অভিজ্ঞতা বলছে যে, বিক্ষোভকারীরা পরিকল্পনা করেই নেমেছে। তারা যে জায়গাগুলি নিয়ন্ত্রন নেবার চেষ্টা করেছিল, সেই জায়গাগুলি তারা কিছুতেই ছেড়ে যায়নি। তারা পিছু হঠলেও কাছেই অবস্থান করেছে। এমনকি রাতের বেলাতেও তারা সেই স্থান পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। পরের দিন শুরু হলেই মানুষের সংখ্যা বাড়িয়েছে এবং আক্রমণে গিয়েছে।

রোববার সন্ধ্যার পর মিডিয়াতে ধীরে ধীরে কারফিউএর মাঝে চলা সহিংসতার খবর প্রচার করা শুরু হয়। প্রথমে সরাসরি না বললেও এটা বোঝা যায় যে, মিডিয়া রিপোর্টগুলি ছিল শনিবার এবং রবিবারের; অর্থাৎ কারফিউ চলার সময়ের। যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার নাম উল্লেখ করা হতে থাকে। রোববার সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো যাত্রাবাড়ীতে ধারণকৃত সেই দিনের দুপুর ১টার রিপোর্ট প্রচার করা হয়। সেখানে দেখা যায় যে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝে কংক্রিটের ডিভাইডারের মতো ভারি বস্তু রাস্তার মাঝে এনে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও বাস এনে ৬০ ডিগ্রি আড়াআড়ি রেখে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই ব্যারিকেডের নিয়ন্ত্রণ হারাবার সময় বাসটাতে আগুন দিয়ে দেয় তারা। সরাসরি না বললেও বোঝা যায় যে, এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল কারফিউএর মাঝে। এবং যেকোন হতাহতের খবর তখন পুরোপুরিভাবে সেন্সর করা হয়।

রোববার কারফিউ চলাকালীন সময়ে সারাদিনে বহু মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছে তাদের জরুরি কর্মসম্পাদনের জন্যে। এই মানুষগুলিকে রাস্তায় বের হলেও পুলিশ এদের কাউকে বাধা দেয়নি - যতক্ষণ পর্যন্ত তারা গুরুত্বপূর্ণ মোড় থেকে দূরে থেকেছে। অর্থাৎ এই কারফিউ মূলতঃ ১৪৪ ধারার মতো কাজ করেছে। পাড়া-মহল্লায় কোন পুলিশের টহল দেখা যায়নি। পুলিশ-বিজিবি-সেনাবাহিনীকে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতেই দেখা গিয়েছে। মূলতঃ অভ্যুত্থানকারীরা যে জায়গাগুলিকে টার্গেট করেছিল, নিরাপত্তা বাহিনী ঠিক সেই জায়গাগুলিকেই নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

রোববার সন্ধ্যার পর থেকে রিপোর্ট আসতে থাকে বিএনপি, জামাতে ইসলামি এবং তাদের সমমনা দলগুলির নেতাকর্মীদের মাঝে কাকে কাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কতদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এর আগে শনিবারেও বেশকিছু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে কারফিউ তুলে না দেয়ায় বোঝা যাচ্ছিলো যে, মূল বা আঞ্চলিক সমন্বয়কদের অনেকেই তখনও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া কেউ যাতে সহজে ঢাকা ত্যাগ করে সটকে পড়তে না পারে, অথবা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্যেই হয়তো কারফিউ বলবত রাখা হয়েছে। তথাপি রোববার রাতে ঘোষণা আসে যে, কারফিউ থাকবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত অনেকটাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে আঞ্চলিক জেলা প্রশাসকের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর এবং নরসিংদীর কারফিউএর সিদ্ধান্ত দেয়া হবে কেন্দ্রীয়ভাবে। আর পরদিন কারফিউ শিথিল হচ্ছে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তিন ঘন্টার জন্যে। এই সিদ্ধান্তগুলি বলে দেয় যে, পরিস্থিতি নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের মাঝেই চলে এসেছে।

রোববার শেষেও ইন্টারনেট চালুর কোন ঘোষণা আসেনি। কারণ হিসেবে ফাইবার অপটিক কেবলের ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়। আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০টা পয়েন্টে ফাইবার অপটিক কেবল কেটে ফেলা হয়েছে। এই খবরে প্রশ্ন করতেই হয় যে, যারা এই কাজটা করেছে, তারা ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখে এবং কোন উদ্দেশ্য হাসিলে তারা এই কাজটা সম্পাদনে অগ্রণী হয়েছিল? তবে এই ঘটনায় বাংলাদেশের ইন্টারনেট সার্ভিস এবং ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের মারাত্মক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।

আনুগত্যের শপথ অনুষ্ঠান


২২শে জুলাই সোমবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করার কথা বলা হলেও মানুষ সারাদিনভরই রাস্তায় ছিলো। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের কাউকেই বাধা দেয়নি। আসলে বিক্ষোভের মূল কেন্দ্রগুলি ব্যাতীত অন্য কোথাও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দেখাই যায়নি। ইন্টারনেট বন্ধে মানুষের ভোগান্তি বাড়তেই থাকে। সকল রাস্তায় রিক্সা চলেছে এবং সকল বাজার কারফিউএর মাঝেই চলমান ছিল। দিনের বেলায় এবং সন্ধ্যায় বিমান বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর 'বেল-২১২' এবং 'বেল-২০৬/৪০৭' হেলিকপ্টারের টহল চলে। সন্ধ্যায় একনাগারে ৫০ মিনিট সেনাবাহিনীর 'বেল-২০৬/৪০৭' হেলিকপ্টারের নিচু দিয়ে টহল ছিল উল্লেখ করার মতো। রাত ৮টার পরেও অবশ্য বিমান বাহিনীর 'বেল-২১২' এবং 'আমআই-১৭১' হেলিকপ্টারের আনাগোণা চলতে থাকে। এতে প্রমাণ হয় যে, পরিস্থিতি এখনও শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নরসিংদীর কারাগার থেকে লুট হওয়া ৮৫টা অস্ত্রের মাঝে ৭০টা তখনও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও ৮২৬ জন কয়েদির বেশিরভাগেরই তখন পর্যন্ত হদিস পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে পালিয়ে যাওয়া ৯জন এবিটি এবং জেএমবি সদস্য তখনও একটা হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। এই দিনের মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয় যে, ৬ শতাধিক রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এই দিনে বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ব্যবসায়ীদের বিশাল এক গ্রুপকে ডেকে নিয়ে আসা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল সরকারের প্রতি ব্যবসায়ীদের আনুগত্যের শপথ অনুষ্ঠান। ব্যবসায়ীদের মাঝ থেকে কয়েকজনকে কথা বলতে দেয়া হয়; যারা মূলতঃ আনুগত্য প্রকাশের বক্তব্যগুলি দেন। আর সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো 'আন্দোলন'এর সাথেসাথে 'ষড়যন্ত্র' শব্দটা ব্যবহার করা হয়। ব্যবসায়ীদের মাঝ থেকে শেষ বক্তা হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এই ঘটনায় জড়িতদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের প্রস্তাব দেয়ার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী তার কথাগুলিকে প্রতিফলিত করে ঘোষণা দেন যে, এর আগে বারংবার জামাতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীদেরকে লঘু দন্ড দেয়া হলেও এবার সেটা করা হবে না। কাজেই এটা মোটামুটিভাবে ধরেই নেয়া যায় যে, আইনী পদক্ষেপগুলি এবারে রাষ্ট্রদ্রোহীতার দিকেই যাবে। সরকার এই অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে কঠোর পদক্ষেপে যাবার এপ্রুভাল হিসেবে। এই অনুষ্ঠানে তথ্য মন্ত্রণালয় ৭ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি দেখায় এবং একইসাথে তথ্য প্রতিমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী সহিংসতার কিছু অজানা তথ্যও তুলে ধরেন। উভয়েই পুলিশের উপর অত্যাচার এবং পুলিশ হত্যার কথা উল্লেখ করেন। একই দিনে পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, সহিংসতায় ৩ জন পুলিশের প্রাণহানি ঘটেছে এবং বর্তমানে আরও ৩ জন পুলিশ হাসপাতালের আইসিইউতে আশংকাজনক অবস্থায় রয়েছেন। সর্বমোট ১,১১৭ জন পুলিশ এই ক'দিনে আহত হয়েছেন। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, গত কয়েকদিনে কোন মিডিয়াতে পুলিশ হত্যার কথা প্রচার করা হয়নি। খুব সম্ভবতঃ পুলিশ সদস্যদের মনোবলে যাতে কোন আঘাত না লাগে, সেটা নিশ্চিত করতেই এই খবর সেন্সর করা হয়েছিল।

গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার


২৩শে জুলাই মঙ্গলবার ঢাকা, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ এবং নরসিংদীতে কারফিউ শিথিল করা হয় দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বাকি অঞ্চলগুলিতে মোটামুটিভাবে সকাল বা দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এটা নিশ্চিত যে, মূলতঃ ধরপাকড়ের জন্যেই কারফিউ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন আবাসিক অঞ্চলে, বিশেষ করে বস্তিগুলিতে চিরুনি অভিযান এবং ব্লক রেইড চলছে। চেহারা দেখে দেখে প্রতিটা মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং সন্দেহজনক হলে বা চিনে ফেললে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাদেরকে চেনা সম্ভব হচ্ছে, তারা নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তৎক্ষণাৎ ভয়াবহ মারধরের শিকার হচ্ছে। গত কয়েক দিনের মাঝে এদের মধ্যেই অনেকে সুযোগ পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের এক হাত দেখে নিয়েছে। এখন নিরাপত্তা বাহিনী এদেরকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে এই মানুষগুলিকে যারা নির্দেশ দিয়েছে বা অর্থায়ন করেছে, তাদেরকে খোঁজা হচ্ছে। দুপুরে মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয় যে, ঢাকায় ১,২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; বগুড়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯০০ জনকে। সারা দেশে প্রায় ২,৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল কমিউনিকেশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে যে, কারা তাদেরকে নির্দেশনা দিচ্ছিলো।

সকাল থেকে সেনাবাহিনীর 'বেল-২০৬/৪০৭' হেলিকপ্টার নিচু দিয়ে উড়ে টহল দিয়েছে। এই দিনে সারা দিন শেষে রাতের বেলাতেও আকাশে হেলিকপ্টার টহল দিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে 'বেল-২০৬/৪০৭'এর রাতের বেলায় টহল ছিল অস্বাভাবিক। প্রথমবারের মতো ঘোষণা দেয়া হয় যে, ২২শে জুলাই রাত থেকে পরীক্ষামূলকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া শুরু করা হবে। তবে সোশাল মিডিয়ার একসেস পেতে জনগণকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। আপাততঃ গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস, ব্যাংক, রপ্তানি পণ্য এবং সার্ভিস নিয়ে কাজ করে এমন সেক্টর, মিডিয়া, ইত্যাদি সেক্টর ইন্টারনেট লাইন পেতে প্রাধান্য পাবে। তবে ইতোমধ্যেই ইন্টারনেট না থাকায় সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। ইন্টারনেট না দিতে পারার ব্যাপারটা জনগণ একেবারেই মেনে নিতে পারেনি; যা ব্যাপক জনরোষের কারণ হতে পারতো। শুধুমাত্র অভ্যুত্থানকারীদের বেশিরভাগ গ্রেপ্তার হবার কারণেই হয়তো পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যায়নি।

জুলাই ব্যর্থ অভ্যুত্থান – কার জন্যে কি শিক্ষা


এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে যে ব্যাপারগুলি পুরো দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হতে হবে তা হলো -

১) সরকার এবং রাষ্ট্র দু'টার দু'টা আলাদা 'সোউল' বা আত্মা রয়েছে। এর প্রথমটা অস্থায়ী; পরেরটা মোটামুটিভাবে স্থায়ী। একটা পরিবর্তন হলেও অপরটা থেকে যায়। উদাহরণ – ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পরেও রাষ্ট্র আগেরটাই রয়েছে। মিশরের হোসনি মুবারক সরকার পতনের পরেও মিশর রাষ্ট্র রয়ে গেছে।

২) গণ আন্দোলন বা গণ অভ্যুত্থান রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনার মেথড হতে পারে না। কারণ এই মেথডে এগুতে গেলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। একদিকে যেমন রাষ্ট্র ধ্বংস করে রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করার চেষ্টাটা নিতান্তই শিশুসুলভ; অন্যদিকে রাষ্ট্র ধ্বংস করার দিকে এগুলে রাষ্ট্র বাধা দেবে এটাই স্বাভাবিক।

৩) রাষ্ট্রের 'মোস্ট ডিসাইসিভ' ফ্যাক্টর সবসময়ই সেনাবাহিনী।

৪) যেকোন ইস্যু-ভিত্তিক আন্দোলনের ব্যাপারে সাবধান; আন্দোলনকারীরা অন্য কারুর দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে; এবং জেনে বা না জেনেই অন্য কারুর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে ফেলবে। আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করলে আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্র ধ্বংসের কারণও হতে পারে।



রাষ্ট্রের কাছে যে ব্যাপারগুলি পরিষ্কার হতে হবে তা হলো -

১) বুদ্ধিবৃত্তিক স্তম্ভের উপর স্থাপিত না হওয়ায় রাষ্ট্র দুর্বল। তাকে বারংবার ইমার্জেন্সি ফায়ার সার্ভিসের কাজ করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেই কুকি-চিন দমনে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। আবার মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবি, কোস্ট গার্ড ছাড়াও সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে। আফ্রিকার উপকূলে জলদস্যুদের হাত থেকে নিজেদের জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।

২) ভূরাজনৈতিক এবং ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের উপর অনেকের ঈগল-দৃষ্টি রয়েছে; এবং তারা সুযোগ বুঝে এই দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করতেই থাকবে; বারবার আগুন লাগবে; বারবার রাষ্ট্র ফায়ার সার্ভিসের কাজ করতে থাকবে। কুকি-চিনের উত্থানের পর সরকার মাউন্টেন পুলিশ গঠন করেছে। এর আগে সন্ত্রাস দমনে সরকার র‍্যাব, সোয়াট, র‍্যাবের স্পেশাল ফোর্স, আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন, সিআরটি, কিউআরটি, পিবিআই, সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো ব্রিগেডের এন্টি-টেররিজম ইউনিট গঠন করেছে। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে অর্থনীতিবিদরূপী পশ্চিমা দালালদের প্রভাবে আইএমএফ-এর মতো মাফিয়া সংস্থা থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে; কারণ তারা বলা শুরু করেছিল যে, বাংলাদেশ বুঝি শ্রীলংকা হয়ে গেল!

৩) ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়তে থাকবে, বাংলাদেশের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তত বেশি বেশি করে আসতে থাকবে। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের উপর চাপ পড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর চাপ পড়েছে। একই যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য হুমকির মাঝে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের উত্তেজনার কারণে বাংলাদেশ এবং চীনের সম্পর্ক চাপের মাঝে পড়ছে।

৪) রাষ্ট্র যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক স্তম্ভ না তৈরি করে ফায়ার সার্ভিসের কাজ করে যাচ্ছে, তাই পরবর্তী আগুন কোথায় লাগতে পারে, সেটাই হয়ে যাবে আলোচনা। যেমন – এবারে বাংলাদেশের ইন্টারনেট এবং ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক কতটা দুর্বল, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কাজেই সামনে হ্যাকিংএর মতো কিছু আসতেই পারে। হয়তো কোন হ্যাকিং গ্রুপ দেশের বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট সংযোগ আটকে রেখে অর্থ দাবি করবে। এক সপ্তাহ ইন্টারনেট না থাকলে কি হতে পারে, সেটা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। এটা যদি এক মাস হয়, তাহলে কি হতে পারে ভেবে দেখুন তো! এরকম একটা কাজ দেখে মনে হবে যে, এই হ্যাকিং গ্রুপ কোন প্রাইভেট গ্রুপ; প্রকৃতপক্ষে এরা কোন রাষ্ট্র দ্বারা পুষ্ট। আরও একটা ক্রাইসিস হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে। কুকি-চিনকে সবাই দেখেছে; এরা খুবই ক্ষুদ্র। কিন্তু যদি বড় কোন গ্রুপ আবারও সহিংস হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র কি করবে? আবার, কারুর উস্কানিতে যদি ধর্মীয় সহিংসতা শুরু হয় (যেমন, কুকি-চিন ছিল খ্রিস্টান গ্রুপ)? যদি পার্শ্ববর্তী ভারতে হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি হয়, তখন বাংলাদেশ কি করবে?

৫) ভারত এবং চীনের মাঝে যদি সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তখন বাংলাদেশ কি করবে? যদি ভারত বাংলাদেশের পদ্মা সেতু এবং মাতারবাড়ি বন্দর সামরিক রসদ পরিবহণে ব্যবহার করতে চায়, তখন বাংলাদেশ কি চীনের বিরুদ্ধে যাবে? যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে (যেমন বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গার্মেন্টস রপ্তানি অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া), তাহলে বাংলাদেশ কি চীনের বিপক্ষে গিয়ে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে ভারতকে সামরিক ট্রানজিট দেবে? বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে, তাহলে এর ফলাফল হজম করার সক্ষমতা কি বাংলাদেশের রয়েছে? প্রশ্নগুলির উত্তর কঠিন হবে যতক্ষণ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক স্তম্ভের উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হবে।