০৯ই নভেম্বর ২০২০
গত ৬ই নভেম্বর আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আটলান্টিকের ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জে আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ানোর দ্বিশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনা দাবি করে যে, ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টিনার, যা ব্রিটিশরা জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ডসকে ‘মালভিয়ান্স’ বলে ডাকে। আর্জেন্টিনার কূটনীতিক হোজে লুইস ফার্নান্দেজ এক বার্তায় বলেন যে, এবারের এই অনুষ্ঠান আলাদা কোনকিছু নয়। আর্জেন্টিনা বহুকাল থেকেই এই দ্বীপগুলির উপর তাদের দাবির কথা জানিয়ে আসছে। ১৮১০ সালে স্পেনের রাজার কাছ থেকে আর্জেন্টিনা এই দ্বীপগুলি পায়, যা ব্রিটিশরা ১৮৩৩ সালে দখল করে নিয়েছিল। আর্জেন্টিনার মালভিয়ান্স সেক্রেটারি ড্যানিয়েল ফিলমাস বলেন যে, এই অনুষ্ঠান আর্জেন্টিনার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ আমেরিকার মিডিয়া ‘মেরকোপ্রেস’ বলছে যে, ৭ই নভেম্বর আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলিপ সোলা জার্মান দূতাবাসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২১ সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের ডেকে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে আর্জেন্টাইনরা বলে যে, ব্রিটেন যখন ইইউ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন ইউরোপিয় দেশগুলির উচিৎ ফকল্যান্ডসএর উপর আর্জেন্টিনার অধিকারকে সমর্থন করা। ব্রিটেনের সাথে আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ডস নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা এমন সময়ে শুরু হয়েছে, যখন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আর্জেন্টিনার ফাইটার জেট ক্রয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। আর্জেন্টাইন মন্ত্রী আগুস্তিন রসি লন্ডনের এহেন সিদ্ধান্তকে ‘সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিকতা’ বলে আখ্যা দেন। দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে আটলান্টিক মহাসগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাবার পথের উপর অবস্থিত ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জের কৌশলগত গুরুত্ব যথেষ্ট। ব্রিটিশরা প্রায় দু’শ বছর ধরে কৌশলগত এই দ্বীপ দখলে রেখেছে। পানামা খাল চালুর পর থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণে ম্যাজেলান প্রণালী এবং ড্রেইক প্যাসেজ দিয়ে বর্তমানে বাণিজ্যিক জাহাজ তেমন যাতায়াত করে না। তবে সামরিক জাহাজের জন্যে এই পথ আখনও গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে ভবিষ্যতের কোন সম্ভাব্য যুদ্ধে দুই মহাসাগরের মাঝে যাতায়াতের জন্যে এই পথ ব্যবহৃত হতে পারে। ইউরোপিয় দেশগুলি এই পথকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাবার বিকল্প পথ হিসেবে দেখে।
বিরোধপূর্ণ দুই শতক
ব্রিটেনের ‘দ্যা এক্সপ্রেস’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিয়ে বলছে যে, দুই দেশের মাঝে ফকল্যান্ডস নিয়ে দ্বন্দ্ব ১৮ শতক থেকেই। ১৯৮২ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জকে আর্জেন্টিনা সৈন্য পাঠিয়ে দখল করে নেয়। আর্জেন্টিনার দক্ষিণ উপকূল থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৬’শ কিঃমিঃ। ৩ হাজার ৩’শ ৫৪ জন মানুষের বাস এই দ্বীপে ১৯৮২ সালে যুদ্ধের সময় আর্জেন্টাইনরা বেশ কিছু মানুষকে সেখানে বসতি স্থাপন করতে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সেনারা সাড়ে ১২ হাজার কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে এসে দ্বীপ পুনর্দখলের পর তাদেরকে আর্জেন্টিনায় ফেরত দিয়ে আসে।
ফকল্যান্ডসএর ইতিহাস জুড়েই রয়েছে ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা। ১৭৬৪ সালে ফরাসি ক্যাপ্টেন লুই আঁতোয়া ডে বোগেনভিল ইস্ট ফকল্যান্ডসএ পোর্ট লুই নামে একটা ঘাঁটি স্থাপন করেন। এরপর ১৭৬৬ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জন ম্যাকব্রাইড সনডার্স আইল্যান্ডে পোর্ট এগমন্ট নামে একটা ঘাঁটি স্থাপন করে। তবে একই বছরেই ফরাসিরা স্পেনের কাছে তাদের ঘাঁটি হস্তান্তর করে ফেলে। পরের বছর ১৭৬৭ সালে স্প্যানিশরা এই ঘাঁটির নামকরণ করে পুয়ের্তো সলেদাদ। তবে তখনও তারা ফকল্যান্ডসে ব্রিটিশ ঘাঁটি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। ১৭৭০ সালে স্প্যানিশরা যখন বুঝতে পারে যে, সেখানে ব্রিটিশ একটা ঘাঁটি রয়েছে, তখন তারা ব্রিটিশ ঘাঁটি পোর্ট এগমন্ট দখল করে নেয়। ১৭৭১ সালে ঘাঁটিটা ব্রিটনের হাতে ছেড়ে দেবার মাধ্যমে স্প্যানিশরা সুপারপাওয়ার ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ এড়ায়। ব্রিটিশরা তাদের সার্বভৌমত্বের একটা সাইনবোর্ড রেখে দিয়ে ১৭৭৪ সালের মাঝে দ্বীপ থেকে নিজেদের ঘাঁটি সরিয়ে নেয়। ফরাসী সম্রাট ন্যাপোলিয়নের সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধ শুরুর পর স্পেন ফ্রান্সের অধীনে চলে গেলে ব্রিটিশরা রিও ডেলা প্লাটা বা আর্জেন্টিনা আক্রমণ করে। ১৮১০ সালে ব্রিটিশ সহায়তায় রিও ডেলা প্লাটাতে বিদ্রোহ শুরু হয়। এর ফলে ১৮১১ সালের মাঝে স্প্যানিশরা ফকল্যান্ডস ছেড়ে যায়। ১৮১৬ সালে আর্জেন্টিনা নামে নতুন দেশের ঘোষণা দেয়া হয়। নতুন দেশ আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আটলান্টিকে স্পেনের দখলে থাকা সকল দ্বীপই নিজের বলে দাবি করে। ১৮২৩ সালে আর্জেন্টিনা এক জার্মান নাগরিক লুই ভারনেটকে ফকল্যান্ডসের এলাকায় মৎস্য সম্পদের দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় যখন নতুন উদ্দমী দেশ যুক্তরাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করে। ১৮৩১ সালে ভারনেট দু’টা মার্কিন মাছ ধরার জাহাজ আটক করলে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন নৌবাহিনীর অফিসার সিলান ডানকানের নেতৃত্বে যুদ্ধজাহাজ ‘লেক্সিংটন’ এই দ্বীপের কর্তৃত্বকে ধ্বংস করে দ্বীপের উপর কোন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই ঘটনাই ব্রিটিশকে সরকারকে জাগিয়ে তোলে। সেবছরের ডিসেম্বরে ক্যাপ্টেন জেমস অনস্লোর নেতৃত্বে দু’টা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘ক্লিও’ এবং ‘টাইন’ এসে দ্বীপের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা ফকল্যান্ডসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নৌবাহিনীর এশিয়া স্কোয়াড্রন দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে দেশে ফেরত যাবার সময় ফকল্যান্ডসএর উপকূলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়। এই যুদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে আটলান্টিক মহাসাগরের যোগাযোগ পথ নিয়ন্ত্রণে ফকল্যান্ডসকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
আর্জেন্টিনার পুনর্জাগরণের চেষ্টা?
১৯৮২ সালের এপ্রিলে আর্জেন্টিনার সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন রোজারিও’এর মাধ্যমে ফকল্যান্ডস দখল করে নেয়। সেসময় ফকল্যান্ডসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ১’শ জনেরও কম সেনা এবং নাবিক। ফকল্যান্ডসএর বেসামরিক নাবিকদের মাঝ থেকে ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত ছিল নিরাপত্তার জন্যে। ব্রিটিশরা সাড়ে ১২ হাজার কিঃমিঃ পথ পেরিয়ে ফকল্যান্ডসে এসে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে। তবে যুদ্ধে আর্জেন্টাইন বিমান বাহিনীর আক্রমণে ব্রিটিশদের বেশ কয়েকটা জাহাজ ধ্বংস হয়। বিমান আক্রমণকে আটকাবার জন্যে ব্রিটিশ রয়াল নেভি তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের ‘হ্যারিয়ার’ ফাইটার বিমানগুলিকে ব্যবহার করেছিল। তবে আর্জেন্টিনার হাতে ফরাসি নির্মিত সুপারসনিক ‘মিরাজ’ যুদ্ধবিমান ছাড়াও ছিল মার্কিন নির্মিত ‘এ৪ স্কাইহক’ এবং ফরাসি নির্মিত ‘সুপার এটেনডার্ড’ যুদ্ধবিমান। ‘সুপার এটেনডার্ড’ যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপিত ফরাসি ‘এক্সোসেট’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কয়েকটা ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস হয়। এই যুদ্ধের ফলে একটা ব্যাপার সবসময়ের জন্যে পরিবর্তন হয়ে যায়; আর তা হলো, ব্রিটিশরা আর কখনোই ফকল্যান্ডসের নিরাপত্তাকে হাল্কাভাবে নিতে পারবে না। ফকল্যান্ডসে ব্রিটিশরা একদিকে যেমন বেশি সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখছে, তেমনি তারা নিশ্চিত করছে যে, আর্জেন্টিনার হাতে যেন ১৯৮২এর মতো বিমান শক্তি না যায়। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ব্রিটেনের রয়েছে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা; আর সেই নিষেধাজ্ঞা কতটা সফল, তা পরবর্তী ঘটনাগুলিই বলে দেয়।
তিন দশক আগের আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনী আজ মৃতপ্রায়। নতুন যুদ্ধবিমান কেনার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরলেও কেউই আর্জেন্টিনাকে বিমান দিতে চাইছে চাইছে না। ব্রিটেনের ‘দ্যা এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ২০১৩ সালে আর্জেন্টিনা স্পেনের কাছ থেকে ১৬টা পুরোনো ফরাসি নির্মিত ‘মিরাজ এফ১’ সুপারসনিক ফাইটার বিমান কেনার চুক্তি করে। স্পেনের দক্ষিণে ব্রিটিশ অধিকৃত জিব্রালটার নিয়ে স্পেনের যে নীতি রয়েছে, সেই নীতির মতোই আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ডস নীতি। তবে এই চুক্তি ব্রিটেনের কূটনৈতিক চাপে বাতিল হয়ে যায়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মাঝে আর্জেন্টিনা ইস্রাইল থেকে ১২টা পুরোনো ‘কাফির সি১’ ফাইটার বিমান ক্রয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই বিমানে ব্যবহৃত ‘জে৭৯’ ইঞ্জিন আর্জেন্টিনার কাছে বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় এটাও ভেস্তে যায়। যুক্তরাষ্ট্র চায়নি ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ককে খারাপ করে ফেলতে। তবে তা নিঃসন্দেহে মার্কিনীদের কূটনৈতিক দিক থেকে সুবিধা দিয়েছে। ‘রয়টার্স’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনা সুইডেন থেকে ২৪টা অত্যাধুনিক ‘সাব জেএএস৩৯ গ্রিপেন’ ফাইটার বিমান কেনার চেষ্টা করলেও তা তেমন কোন আলোচনা ছাড়াই বাতিল হয়ে যায়। এই বিমানে রাডারসহ ৩০ শতাংশ যন্ত্রাংশ ব্রিটিশদের হবার কারণে এই বিমান আর্জেন্টিনায় রপ্তানিতে ব্রিটিশ সরকারের বাধা নিশ্চিত ছিল। বিমানের ব্রিটিশ যন্ত্রাংশ অন্য দেশের যন্ত্রাংশ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রশ্নও আসেনি। ২০১৭ সালে ফরাসিরা আর্জেন্টিনার কাছে ফরাসি নৌবাহিনী থেকে রিটায়ার করা ৫টা ‘সুপার এটেনডার্ড’ ফাইটার বিক্রি করছে বলে ঘোষণা দেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে হেনরি গুইনার্দ। কিন্তু ২০১৮ সালের মাঝে কয়েকটা বিমান দেবার কথা থাকলেও ২০১৯ সালের মে মাসে প্রায় দুই বছর পরে বিমানগুলি আর্জেন্টিনা পৌঁছে; তাও আবার আধুমিকায়ন ছাড়া।
আর্জেন্টিনার সর্বশেষ চেষ্টাটা ছিল দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ‘এফএ৫০’ সুপারসনিক ফাইটার জেট ক্রয়। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইআইচএস জেন্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার এটাও আটকে দিয়েছে। কোরিয়ান কোম্পানি ‘কেএআই’এর এক চিঠিতে বলা হয় যে, এই বিমানে ব্রিটিশ নির্মিত ছয়টা যন্ত্রাংশ রয়েছে; যেকারণে কোরিয়ার পক্ষে এই বিমান আর্জেন্টিনার কাছে বিক্রি করা সম্ভব নয়। আর্জেন্টিনা ২০১৫ সাল থেকেই চীন থেকে যুদ্ধবিমান কিনতে পারে বলে শোনা যাচ্ছিলো; কিন্তু সেটাও এতদিনে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
সাড়ে ১২ হাজার কিঃমিঃ পেরিয়ে নিরাপত্তা
ব্রিটিশরা ফকল্যান্ডসের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ১৯৮২ সালের যুদ্ধের পর থেকে সেখানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ১ হাজারের বেশি সৈন্য এবং নাবিক এখন সেখানকার নিরাপত্তা দিচ্ছে বলে বলছে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ম্যাগাজিন ‘ফোর্সেস নেটওয়ার্ক’। ১৯৯০এর দশক থেকে সেখানে ৪টা ‘টর্নেডো এফ৩’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন ছিল। ১৭ বছর পর ২০০৯ সালে এই বিমানগুলিকে প্রতিস্থাপন করে ৪টা অত্যাধুনিক ‘টাইফুন’ ফাইটার। দক্ষিণ আমেরিকার মিডিয়া ‘মেরকোপ্রেস’ বলছে যে, এই বিমানগুলিকে ফকল্যান্ডসে পৌঁছাতে সহায়তা দেয় ১০টা বিমান; যার মাঝে ছিল ৬টা রিফুয়েলিং বিমান, ৩টা সার্চ রেসকিউ বিমান এবং ১টা ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান। স্প্যানিশ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রিটিশ এসেনশন দ্বীপ থেকেও বিমানগুলি সহায়তা নেয়। ১৮ ঘন্টার এই ফ্লাইটে মোট ৭ বার আকাশে জ্বালানি নিতে হয়েছিল বিমানগুলিকে। ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লীডার পিট মরগান বলেন যে, ‘টাইফুন’ বিমানগুলি মোতায়েন করার মিশন ‘অপারেশন টাইফুন টেম্পেস্ট ট্রেইল’ ব্রিটেনের সামরিক বাহিনীর বিশাল দূরত্বে কৌশলগত মিশনে যাবার সক্ষমতাকে তুলে ধরে।
ফকল্যান্ডসের বর্তমান নিরাপত্তায় রয়েছে রয়াল নেভির একটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল। বছরের ছয় মাস ব্রিটিশ এন্টার্কটিক প্যাট্রোল জাহাজ ‘প্রোটেক্টর’ এই অঞ্চলে থাকে। একটা ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ার এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ মাঝে মাঝে দক্ষিণ আটলান্টিকে প্যাট্রোল দিতে আসে। ১৯৮২এর যুদ্ধের পর দ্বীপে ‘মাউন্ট প্লিজ্যান্ট’ নামে একটা নতুন বিমান ঘাঁটি তৈরি করা হয়। সেখানে ১৬টা ফাইটার বিমান রাখার জন্যে দুর্ভেদ্য বাঙ্কার নির্মাণ করা হয়েছে। এই ঘাঁটিতে একটা ‘এ৪০০এম’ পরিবহণ বিমান সর্বদা থাকছে, যা দ্বীপের আশেপাশে আকাশ প্যাট্রোল দেয়। আর প্রতি সপ্তাহে দুইবার একটা ‘ভয়েজার’ ট্যাঙ্কার পরিবহণ বিমান ফকল্যান্ডস এবং ব্রিটেনের মাঝে যাতায়াত করে। এই বিমান পথিমধ্যে পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালের দাকারে জ্বালানি নিলেও বিরতি না নিয়েই ফকল্যান্ডসে অবতরণ করার রেকর্ডও রয়েছে। সামরিক ঘাঁটির দক্ষিণেই নতুন একটা বন্দরও নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে বড় বাণিজ্যিক জাহাজও ভিড়তে পারে। দ্বীপের বিমান প্রতিরক্ষা নিশ্চিতে একটা বিমান ধ্বংসী ‘র্যাপিয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্রের ইউনিটও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, ব্রিটিশ ‘এসটিউট ক্লাস’এর পারমাণবিক সাবমেরিনগুলি দক্ষিণ আটলান্টিকে টহল দেয়; যদিওবা সেই তথ্য নিশ্চিতভাবে জানা দুষ্কর। ১৯৮২ সালে ব্রিটিশ সাবমেরিনের টর্পেডোর আঘাতে আর্জেন্টিনার যুদ্ধজাহাজ ‘জেনারেল বেলগ্রানো’ ডুবে গেলে ৩’শ ২৩ জন নাবিক প্রাণ হারায়। এরপর আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী আর ব্রিটিশদের চ্যালেঞ্জ দিতে বন্দর থেকে বের হয়নি। সেই ইতিহাস এখনও ব্রিটিশদের শক্তি যোগায়।
ফকল্যান্ডসে অবস্থিত ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর ‘টাইফুন’ ফাইটার বিমানগুলিকে এড়িয়ে দ্বীপের উপর হামলা করার সামরিক ক্ষমতা থেকে আর্জেন্টিনা এখন বহুদূরে। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইট’ বলছে যে, আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ডস দাবি করে তার জনগণকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে দৃষ্টি সড়াবার চেষ্টা করছে মাত্র। অপরদিকে ১৯৮২ সালের ঘটনা থেকে ব্রিটেন শিক্ষা নিয়েছে; কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালী এবং ড্রেইক প্যাসেজের পাহাড়াদার ফকল্যান্ডসের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটেন দ্বিতীয়বার ছাড়তে রাজি নয়। তবে এজন্য ব্রিটেন খুব বেশি একটা শক্তি খরচ করতে রাজি নয়। যুদ্ধবিমানের জন্যে আর্জেন্টিনা সারা বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কিন্তু ব্রিটেনের কূটনৈতিক দক্ষতাকে পাশ কাটাবার মতো সক্ষমতার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি না করার শর্ত যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইস্রাইল বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলিকে ব্রিটেনের সাথে কূটনৈতিক দরকষাকষির সুযোগ দিয়েছে। তথাপি এই ঘটনাগুলি বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের রাজনৈতিক প্রভাবের একটা উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। এই মুহুর্তে দক্ষিণ আটলান্টিকে দৃষ্টি দেবার মতো সময় ব্রিটেনের নেই। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ এখন ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত মহাসাগর এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব এশিয়া নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত; কারণ চীনের উত্থানের পর থেকেই সেখানেই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বেশি। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ব্রিটেন ফাঁকা স্থানগুলিকে পূর্ণ করতে মরিয়া; দক্ষিণ আটলান্টিকের মতো এলাকায় আটকে থাকার সময় কোথায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর?
রাশিয়া কি চাইছে এখানে। আজেন্টটিনা কি রাশিয়া থেকে বিমান কিনতে পারে না
ReplyDeleteদক্ষিণ আমেরিকায় এখন রাশিয়ার প্রভাব খুবই কম; সোভিয়েত সময়ে ছিল বেশ। এখন কিউবা এবং ভেনিজুয়েলার কারণে সেই দেশগুলিকে প্রভাব রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কোন লক্ষ্য নেই। তাই কিছু আশা করাটা বোকামি। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনতে গেলে এর অর্থায়ন কে করবে? গত তিন বছরে আর্জেন্টিনার জিডিপি ২২০ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে; যা ইথিওপিয়ার জিডিপির তিন গুণ!! দেশটা বিদেশী ঋণে চলছে। বাস্তবতা দেখতে হবে আগে।
Deleteআর্জেন্টিনা মাঝখানে জে-১০ কেনার অফার পেয়েছিল। সেটাও কি আটকে গেছে?
ReplyDeleteআর্জেন্টিনা একটা দুর্বল দেশ। এক দশকের বেশি সময় ধরে নিজেদের অর্থনীতি যখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে, তখন অস্ত্র কেনাটা এমনিতেই কঠিন। তার উপর আবার বিদেশী ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে চলতে হচ্ছে। ঋণদাতা পশ্চিমা সংস্থাগুলি আর্জেন্টিনার অস্ত্র কেনতে এমনিতেই বাধা দেবে। আর যখন অস্ত্র কেনাটা ব্রিটিশ স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে, তখন অনেকেই দুইবার চিন্তা করবে।
Deleteঅপরদিকে যারা আর্জেন্টিনাকে অস্ত্র বিক্রি করতে চাইবে, তারা কেউই ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। যদি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রই না চায়, তাহলে অন্য আর কারুর জন্যে ব্যাপারটা কতটা কঠিন, সেটা বোধগম্য। ১৯৮২ সালের আর্জেন্টিনাকে যুক্তরাষ্ট্রই পিছন থেকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সরাসরি সমর্থন দেয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও কঠিন ছিল। ব্রিটনের প্রভাব সরাসরি দেখা যায়না বলেই বেশিরভাগ মানুষ এই ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হয় না। বিরাট বাহিনী ছাড়াই ব্রিটেন এই কাজটা হাসিল করে নিচ্ছে - এটাই ব্রিটেনের প্রভাবের নমুনা।