Sunday 22 November 2020

ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বলি হতে চলেছে ইথিওপিয়া?

২২শে নভেম্বর ২০২০
সুদান এবং এরিত্রিয়া ইতোমধ্যেই অংশ নিচ্ছে বলে বলেন তিনি। ইথিওপিয়াসহ হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যেই কিছুদিনের মাঝেই এখানে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিরা জড়াবে।



ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা জাতিসংঘের এক গোপন ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলছে যে, ইথিওপিয়ার সেনারা দেশটার উত্তরের তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযানে ব্যাপক বাধার সন্মুখীন হচ্ছে, যদিও সরকারি বাহিনী বলছে যে, তারা হুমেরা, দানশা, শিরারো, আলামাতা এবং শিরে সহ বেশ কয়েকটা শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ইথিওপিয়ার সরকারি মুখপাত্র রেদওয়ান হুসেইন বলেন যে, সরকারি বাহিনী তিগ্রের মূল শহর মেকেল্লের অভিমুখে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সুদান ও এরিত্রিয়ার সীমান্তে পশ্চিমের শহর হুমেরাতে এবং দক্ষিণের শহর আলামাতাতে ব্যাপক সংঘাত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ইথিওপিয়ার বিমান বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে। তিগ্রেতে টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় এবং সাংবাদিকদের যেতে বাধা দেয়ায় তথ্য সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংঘাতে কয়েক’শ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ৪ঠা নভেম্বর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৩৬ হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী সুদানে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও তিগ্রে অঞ্চলের মাঝেই অনেকে ঘরছাড়া হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ঘোষণা দেন যে, ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী তিগ্রের রাজধানী মেকেল্লের দিকে রওয়ানা হয়েছে এবং তারা বিদ্রোহী ‘তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’এর নেতৃবৃন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ‘টিপিএলএফ’ ১১ কোটি মানুষের ইথিওপিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হলেও এর মূল ভিত্তি তিগ্রে অঞ্চলের ৬০ লক্ষ তিগ্রেদের মাঝে। ১৯৯১ সালে বামপন্থী মেনজিসটু হাইলেমারিয়ামএর সরকারকে উৎখাত করে ‘টিপিএলএফ’এর গেরিলারা ক্ষমতা নেয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তারা ছিল ক্ষমতাসীন দল, যাদেরকে সরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অরোমো এবং আমহারাদের নেতৃত্বে আবি আহমেদ ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করেন।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘টিপিএলএফ’ এর আগেও কয়েকবার ইথিওপিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার হুমকি দিয়েছিল। অগাস্ট মাসে ‘টিপিএলএফ’এর নেতা দেব্রেতসিওন গেব্রেমাইকেল বলেন যে, তারা কখনোই তাদের কষ্টার্জিত স্বশাসনের অধিকার ছেড়ে দেবেন না। সেপ্টেম্বর মাসে করোনা মহামারির কারণ দেখিয়ে ইথিওপিয়া সরকার জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেবার পর ‘টিপিএলএফ’এর তত্বাবধানে তিগ্রে অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই আদ্দিস আবাবা সরকারের সাথে ‘টিপিএলএফ’এর সম্পর্কের ব্যাপক অবণতি হয়। অক্টোবর মাসে ইথিওপিয়ার সরকার তিগ্রে অঞ্চলের সাথে সম্পর্ক স্থগিত করে এবং সংসদে তিগ্রের বাজেট স্থগিত করা হয়। ইথিওপিয়ার সরকার বলে যে, মেকেল্লের এক সেনা ঘাঁটিতে হামলা করে ‘টিপিএলএফ’এর সদস্যরা অস্ত্র ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করার পর থেকেই এই সামরিক মিশন শুরু করা হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দ্রুত যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা নেই; কারণ তিগ্রের সেনারা খুব শীঘ্রই মেকেল্লে শহরের পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নেবে। এই পাহাড়ি অঞ্চল রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ বলেই সেখানে ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর দ্রুত সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ইউনিটগুলি শহরগুলিকে বাইপাস করে মেকেল্লে রওয়ানা হচ্ছে। আর মিলিশিয়া এবং আধাসামরিক বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউনিটগুলি পরবর্তীতে এই শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে; এবং এরাই তিগ্রেদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনী যত এগুবে, তাদের সাপ্লাই লাইন গেরিলা আক্রমণের শিকার হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। অর্থাৎ ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী ‘টিপিএলএফ’কে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেও সংঘাত নাও থামতে পারে। 

সরকারি বাহিনী তিগ্রের মূল শহর মেকেল্লের অভিমুখে রয়েছে।  তারা হুমেরা, দানশা, শিরারো, আলামাতা এবং শিরে সহ বেশ কয়েকটা শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সুদান ও এরিত্রিয়ার সীমান্তে পশ্চিমের শহর হুমেরাতে এবং দক্ষিণের শহর আলামাতাতে ব্যাপক সংঘাত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ইথিওপিয়ার বিমান বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে।


‘বিবিসি’ বলছে যে, ইথিওপিয়ার প্রতিবেশী এরিত্রিয়া মূলতঃ তিগ্রেদের পছন্দ করে না। তিগ্রেরা বলছে যে, এরিত্রিয়ার বাহিনী ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে। ১৯৯৮ সালে এরিত্রিয়ার সাথে ইথিওপিয়ার সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা যুদ্ধ মূলতঃ তিগ্রের সাথে সীমানা নিয়েই। তিগ্রের আঞ্চলিক সরকারের অসহযোগিতার কারণে সীমান্তবর্তী শহর বাদমে নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্বের সুরাহা হয়নি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল রেইনর প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ এবং ‘টিপিএলএফ’এর নেতা দেব্রেতসিওন গেব্রেমাইকেলএর সাথে কথা বলার পর উভয় পক্ষেরই সামরিক ফলাফল পাবার দিকে আশাবাদী হবার আশংকা রয়েছে বলে মতামত দেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, পূর্ব আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইথিওপিয়া। এবং এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আবি আহমেদের সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ১৯শে নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আফ্রিকা বিষয়ক সহকারি সচিব তিবর নাগি সাংবাদিকদের বলেন যে, ইথিওপিয়ার এই সংঘাত দুই দেশের মাঝে সংঘাত নয়; বরং একটা দেশের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। তাই এর ফলাফল হিসেবে যা তারা আশা করেছিল, সেটাই হচ্ছে।

তিগ্রেদের নেতা গেব্রেমাইকেল বলছেন যে, তারা যুদ্ধ চান না। তবে তাদের সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া এবং স্পেশাল ফোর্স যুদ্ধ জয়ের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এখানে বাইরের শক্তিদের জড়িত হবার সম্ভাবনা বাড়বে। বিশেষ করে নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার ‘গ্র্যান্ড রেনেসাঁস ড্যাম’ প্রকল্প এবং নদীর পানির হিস্যা নিয়ে ইথিওপিয়ার সাথে মিশর এবং সুদানের যখন দ্বন্দ্ব চলছে, তখন ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ কলহ আঞ্চলিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। ‘দ্যা ইস্ট আফ্রিকান’ বলছে যে, ২০শে নভেম্বর আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা মোজাম্বিক, লাইবেরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার তিনজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে সদস্য করে একটা মিশন ইথিওপিয়াতে পাঠাবার ঘোষণা দেবার পরদিন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে বলা হয় যে, ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মধ্যস্ততা করতে আফ্রিকান ইউনিয়নের মিশনের ইথিওপিয়া আসার খবরটা বানোয়াট। হর্ন অব আফ্রিকা বিশ্লেষক রশিদ আবদি 'বিবিসি’কে বলছেন যে, এই যুদ্ধ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক। সুদান এবং এরিত্রিয়া ইতোমধ্যেই অংশ নিচ্ছে বলে বলেন তিনি। ইথিওপিয়াসহ হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যেই কিছুদিনের মাঝেই এখানে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিরা জড়াবে। আবদি আরও বলেন যে, ইথিওপিয়া যদি তিগ্রের কারণে সোমালিয়ার যুদ্ধ থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়, তাহলে সোমালিয়াতেও এর প্রভাব পড়বে। এছাড়াও জাতিগত কারণে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকলে জাতিরাষ্ট্র ইথিওপিয়ার অস্তিত্বই হুমকির মাঝে পড়ে যাবে। অপরদিকে জাতিসংঘ বলছে যে, ইথিওপিয়ার ৭০ লক্ষ মানুষ খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল, যার মাঝে তিগ্রের ৬ লক্ষ। এই অঞ্চল পঙ্গপালের আক্রমণেও জর্জরিত। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দুর্বল মানুষগুলিই সবচাইতে ঝুঁকিতে পড়ছে। 

No comments:

Post a Comment