০৫ই মে ২০২০
শরণার্থীদের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে রাজনীতি
বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগরের মাঝ দিয়ে পূর্ব এশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পুরোটাই যায়? বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগর পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের শরণার্থীরা মালয়েশিয়া গিয়ে আবার বাংলাদেশে আসে? বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগরকে নিয়ে বাংলাদেশের কোন মাথাব্যাথা নেই, যদিও বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম? উত্তর বঙ্গোপসাগর নয়; আন্দামান সাগর। আন্দামান সাগরের উত্তরে মিয়ানমার; পূর্বে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড; দক্ষিণে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ; পশ্চিমে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এপ্রিলের ১৬ তারিখে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে খবর আসে যে, বঙ্গোপসাগরে একটা ট্রলারে গাদাগাদি করে অমানবিক পরিবেশে সমুদ্রে ভাসছে ৩’শ ৮২ জন শরণার্থী। বাংলাদেশের কোস্ট গার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ জানাচ্ছে যে, এই শরণার্থীরা প্রায় দুই মাস ধরে সমুদ্রে ভাসছিল। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ের মাঝে নৌকাটা মার্চ থেকে মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছাবার উদ্দেশ্যে দু’বার আন্দামান সাগর পারপার করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা এই মুসলিম শরণার্থীদেরকে পাচারকারীরা পাঠিয়েছিল মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ঐ একই দিনে মালয়েশিয়ার বিমান বাহিনী মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমায় লাংকাউইএর কাছাকাছি ২’শ মানুষবাহী দ্বিতীয় ট্রলারটা দেখতে পেয়ে নৌবাহিনীকে জানালে নৌবাহিনী সেটাকে ফেরত পাঠায়। মালয়েশিয়ার সরকার বলছে যে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডও মালয়েশিয়ার মতোই শরণার্থীদেরকে দেশে ঢুকতে দেয়নি। এই দুই দেশে প্রত্যাক্ষ্যাত হয়েই ট্রলারগুলি বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালাতে থাকে। এই সময় থেকেই শুরু হয় রাজনীতি।
২৪শে এপ্রিল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশলেতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে সমুদ্রে ভাসমান পাঁচ শতাধিক শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার অনুরোধ জানান। আরেক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)এর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন যে, মিয়ানমারের গণহত্যার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে অনেক বড় বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে। কিন্তু শরণার্থী বোঝাই ট্রলারকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে সাগরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো অজুহাত নেই। ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের গ্রহণে অনুরোধ জানান। জবাবে ব্রিটিশ মন্ত্রীকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিস্তারিত তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও মানবিক কারণে ইতোমধ্যে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও বাংলাদেশকেই অনুরোধ করা হচ্ছে। অথচ ঐ ভাসমান রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থান যে এলাকায় সেই দেশগুলিকে কেউ আশ্রয় দিতে বলছে না, তারা নিজেরাও এগিয়ে আসছে না। মন্ত্রী ভাসমান রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে ব্রিটিশ রয়াল নেভিকে এগিয়ে আসতে উপদেশ দেন।
পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ১১ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু হয়েছে। একসময় এই শরণার্থীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগতভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। এখন সমুদ্রে ভাসমান শরণার্থীদের নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলা। পশ্চিমা শক্তিগুলি এই শরণার্থীদের ব্যবহার করে বাংলাদেশকে এবং বঙ্গোপসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। চীনের উত্থানের পর থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনের কিউকপিউতে চীনারা তৈরি করেছে তেলের টার্মিনাল, যেখানে ২৫ মিটার ড্রাফটের তেলের ট্যাঙ্কার ভিড়তে পারে। এখানে নামিয়ে দেয়া তেল এবং বঙ্গোপসাগর থেকে ওঠানো প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাচ্ছে। আবার অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারত রাখাইনে ‘কালাদান প্রকল্প’র নামে সিতওয়ে বন্দর এবং কালাদান নদীকে ব্যবহার করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্থলবেষ্টিত রাজ্য মিজোরামের সীমানা পর্যন্ত পরিবহণ করিডোর তৈরি করছে। ভূরাজনৈতিকভাবে এহেন প্রতিযোগিতাপূর্ণ এলাকায় পশ্চিমারা কলকাঠি নাড়ছে; আর শরণার্থীদের চাপিয়ে দিয়ে বিপদে ফেলছে বাংলাদেশকে। ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
বাংলাদেশ কি ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হয়েই থাকবে?
বিশ্বব্যাপী করোনা দুর্যোগের মাঝেই কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতেছে। বিশেষ করে বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এই খেলা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এই খেলায় তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশকে তারা এমনই এই গুটি হিসেবে দেখছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি শক্তিশালী দেশগুলির ক্রীড়নক হয়েই থাকবে, নাকি নিজের শক্তির জানান দেবে? নিজের সারভাইভাল নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশকে নিজের শক্তির জানান দিতে হবে।
প্রথমতঃ আন্দামান সাগরে শরণার্থীবাহী ট্রলারগুলি ভাসছে দুই মাস ধরে। এতে দু’টা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া যায়। এক, ভারত, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার এতে কোন মাধাব্যাথা নেই। এবং দুই, এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস ধরে ঘুরলেও সেটার খবর নেবার কেউ নেই। অর্থাৎ এই সাগরে মানব পাচার ধরার জন্যে দায়িত্ব কেউ নেয়নি। সকলেই নিজের সমুদ্রসীমাটুকু পাহাড়া দিয়েই দায় সাড়ছে। আর শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার কারণে এদের দায়ভার বাংলাদেশের উপরে চাপাবার কথা বলে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চাচ্ছে শক্তিশালী দেশগুলি। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে বাংলাদেশের উদ্যোগে আন্দামান সাগরে প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়তঃ আন্দামান সাগর হয়ে বাংলাদেশের সাথে পূর্ব এশিয়ার সম্পূর্ণ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। পূর্বগামী বাংলাদেশের পরিবহণ জাহাজগুলি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং মিয়ামনারের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাঝ দিয়ে পার হয়। কোলকাতাগামী জাহাজগুলিও এই রুট ব্যবহার করে। শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যগামী জাহাজগুলি নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে যায়। আর বঙ্গোপসাগরে ভারতের পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলিতে জাহাজ যায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে। এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস এমনি এমনি ভাসতে পারলে বাণিজ্য জাহাজগুলি কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। বাংলাদেশের কৌশলগত চিন্তায় এই সমুদ্র রুটের নিরাপত্তার ব্যাপারটা কি কখনো এসেছিল? আন্দামান সাগরে প্যাট্রোল বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয়।
কিভাবে এই প্যাট্রোল হবে?
প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই হিসেবে ভারতের আন্দামান দ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডের ফুকেট, মালয়েশিয়ার কেলাং, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়ার বন্দরগুলিতে বাংলাদেশের নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের প্যাট্রোল জাহাজগুলি নিয়মিতই সফর করতে পারে। এই সবগুলি বন্দরই আন্দামান সাগরের চারিদিকে ছড়িয়ে। কাজেই এই সাগরে বাংলাদেশের নিয়মিত প্যাট্রোল একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারতো, যদি রাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তার মাঝে আন্দামান সাগর স্থান পেতো। আন্দামান সাগর থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের যে বাংলাদেশেই পাঠানো হবে, সেটা সম্পর্কে আগেভাগে তথ্য হাতে পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আন্দামান সাগর এবং এর চারিদিকের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যথেষ্ট তথ্য পাবার ব্যবস্থা থাকবে হবে বাংলাদেশের হাতে। এই তথ্যের সাথে প্যাট্রোলের সমন্বয়ের মাধ্যমে আশেপাশের দেশগুলিকে সাথে দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতকে এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সহায়তা দেবার জন্যে রাজি করাতে হবে। তারা যদি লাখো শরণার্থীর দায় নিতে না চায়, তাহলে আন্দামান সাগর টহল দিতে বাংলাদেশকে তাদের অবশ্যই লজিস্টিক্যাল এবং ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট দিতে হবে।
বাংলাদেশ যদি করোনা দুর্যোগ থেকে বৈশ্বিক পাওয়ার ব্যালান্সের ‘ভূমিকম্পসম’ পরিবর্তন বুঝতে পারে, তাহলে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, শক্তিশালী দেশগুলির খেলার গুটি হওয়াটা বাংলাদেশের জন্যে কোন অপশন নয়। বরং নিজের শক্তিকে জানান দিয়ে এটা বলে দিতে হবে যে, এদেশের সাথে ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলতে গেলে যে কারুরই হাত পুড়বে। সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আন্দামান সাগরের মতো কৌশলগত একটা সাগরকে বাংলাদেশ কতটা হাল্কাভাবে নিয়েছিল এতদিন। বাংলাদেশের ‘আন্দামান প্যাট্রোল ফোর্স’ বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থকে রক্ষায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
শরণার্থীদের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে রাজনীতি
বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগরের মাঝ দিয়ে পূর্ব এশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পুরোটাই যায়? বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগর পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের শরণার্থীরা মালয়েশিয়া গিয়ে আবার বাংলাদেশে আসে? বাংলাদেশের দক্ষিণের কোন সাগরকে নিয়ে বাংলাদেশের কোন মাথাব্যাথা নেই, যদিও বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম? উত্তর বঙ্গোপসাগর নয়; আন্দামান সাগর। আন্দামান সাগরের উত্তরে মিয়ানমার; পূর্বে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড; দক্ষিণে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ; পশ্চিমে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এপ্রিলের ১৬ তারিখে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে খবর আসে যে, বঙ্গোপসাগরে একটা ট্রলারে গাদাগাদি করে অমানবিক পরিবেশে সমুদ্রে ভাসছে ৩’শ ৮২ জন শরণার্থী। বাংলাদেশের কোস্ট গার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ জানাচ্ছে যে, এই শরণার্থীরা প্রায় দুই মাস ধরে সমুদ্রে ভাসছিল। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ের মাঝে নৌকাটা মার্চ থেকে মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছাবার উদ্দেশ্যে দু’বার আন্দামান সাগর পারপার করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা এই মুসলিম শরণার্থীদেরকে পাচারকারীরা পাঠিয়েছিল মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ঐ একই দিনে মালয়েশিয়ার বিমান বাহিনী মালয়েশিয়ার সমুদ্রসীমায় লাংকাউইএর কাছাকাছি ২’শ মানুষবাহী দ্বিতীয় ট্রলারটা দেখতে পেয়ে নৌবাহিনীকে জানালে নৌবাহিনী সেটাকে ফেরত পাঠায়। মালয়েশিয়ার সরকার বলছে যে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। থাইল্যান্ডও মালয়েশিয়ার মতোই শরণার্থীদেরকে দেশে ঢুকতে দেয়নি। এই দুই দেশে প্রত্যাক্ষ্যাত হয়েই ট্রলারগুলি বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা চালাতে থাকে। এই সময় থেকেই শুরু হয় রাজনীতি।
২৪শে এপ্রিল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশলেতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে সমুদ্রে ভাসমান পাঁচ শতাধিক শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার অনুরোধ জানান। আরেক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)এর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন যে, মিয়ানমারের গণহত্যার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশকে অনেক বড় বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে। কিন্তু শরণার্থী বোঝাই ট্রলারকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে সাগরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো অজুহাত নেই। ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের গ্রহণে অনুরোধ জানান। জবাবে ব্রিটিশ মন্ত্রীকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিস্তারিত তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও মানবিক কারণে ইতোমধ্যে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও বাংলাদেশকেই অনুরোধ করা হচ্ছে। অথচ ঐ ভাসমান রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থান যে এলাকায় সেই দেশগুলিকে কেউ আশ্রয় দিতে বলছে না, তারা নিজেরাও এগিয়ে আসছে না। মন্ত্রী ভাসমান রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে ব্রিটিশ রয়াল নেভিকে এগিয়ে আসতে উপদেশ দেন।
পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ১১ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু হয়েছে। একসময় এই শরণার্থীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগতভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। এখন সমুদ্রে ভাসমান শরণার্থীদের নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলা। পশ্চিমা শক্তিগুলি এই শরণার্থীদের ব্যবহার করে বাংলাদেশকে এবং বঙ্গোপসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। চীনের উত্থানের পর থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনের কিউকপিউতে চীনারা তৈরি করেছে তেলের টার্মিনাল, যেখানে ২৫ মিটার ড্রাফটের তেলের ট্যাঙ্কার ভিড়তে পারে। এখানে নামিয়ে দেয়া তেল এবং বঙ্গোপসাগর থেকে ওঠানো প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাচ্ছে। আবার অত্র অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারত রাখাইনে ‘কালাদান প্রকল্প’র নামে সিতওয়ে বন্দর এবং কালাদান নদীকে ব্যবহার করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্থলবেষ্টিত রাজ্য মিজোরামের সীমানা পর্যন্ত পরিবহণ করিডোর তৈরি করছে। ভূরাজনৈতিকভাবে এহেন প্রতিযোগিতাপূর্ণ এলাকায় পশ্চিমারা কলকাঠি নাড়ছে; আর শরণার্থীদের চাপিয়ে দিয়ে বিপদে ফেলছে বাংলাদেশকে। ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
বাংলাদেশ কি ভূরাজনৈতিক খেলার গুটি হয়েই থাকবে?
বিশ্বব্যাপী করোনা দুর্যোগের মাঝেই কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতেছে। বিশেষ করে বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এই খেলা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। এই খেলায় তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশকে তারা এমনই এই গুটি হিসেবে দেখছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি শক্তিশালী দেশগুলির ক্রীড়নক হয়েই থাকবে, নাকি নিজের শক্তির জানান দেবে? নিজের সারভাইভাল নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশকে নিজের শক্তির জানান দিতে হবে।
প্রথমতঃ আন্দামান সাগরে শরণার্থীবাহী ট্রলারগুলি ভাসছে দুই মাস ধরে। এতে দু’টা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া যায়। এক, ভারত, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার এতে কোন মাধাব্যাথা নেই। এবং দুই, এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস ধরে ঘুরলেও সেটার খবর নেবার কেউ নেই। অর্থাৎ এই সাগরে মানব পাচার ধরার জন্যে দায়িত্ব কেউ নেয়নি। সকলেই নিজের সমুদ্রসীমাটুকু পাহাড়া দিয়েই দায় সাড়ছে। আর শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার কারণে এদের দায়ভার বাংলাদেশের উপরে চাপাবার কথা বলে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চাচ্ছে শক্তিশালী দেশগুলি। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে বাংলাদেশের উদ্যোগে আন্দামান সাগরে প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়তঃ আন্দামান সাগর হয়ে বাংলাদেশের সাথে পূর্ব এশিয়ার সম্পূর্ণ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। পূর্বগামী বাংলাদেশের পরিবহণ জাহাজগুলি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ এবং মিয়ামনারের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মাঝ দিয়ে পার হয়। কোলকাতাগামী জাহাজগুলিও এই রুট ব্যবহার করে। শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যগামী জাহাজগুলি নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে যায়। আর বঙ্গোপসাগরে ভারতের পূর্ব উপকূলের বন্দরগুলিতে জাহাজ যায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে। এই সাগরে একটা ট্রলার দুই মাস এমনি এমনি ভাসতে পারলে বাণিজ্য জাহাজগুলি কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। বাংলাদেশের কৌশলগত চিন্তায় এই সমুদ্র রুটের নিরাপত্তার ব্যাপারটা কি কখনো এসেছিল? আন্দামান সাগরে প্যাট্রোল বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয়।
কিভাবে এই প্যাট্রোল হবে?
প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই হিসেবে ভারতের আন্দামান দ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডের ফুকেট, মালয়েশিয়ার কেলাং, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়ার বন্দরগুলিতে বাংলাদেশের নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের প্যাট্রোল জাহাজগুলি নিয়মিতই সফর করতে পারে। এই সবগুলি বন্দরই আন্দামান সাগরের চারিদিকে ছড়িয়ে। কাজেই এই সাগরে বাংলাদেশের নিয়মিত প্যাট্রোল একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারতো, যদি রাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তার মাঝে আন্দামান সাগর স্থান পেতো। আন্দামান সাগর থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের যে বাংলাদেশেই পাঠানো হবে, সেটা সম্পর্কে আগেভাগে তথ্য হাতে পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আন্দামান সাগর এবং এর চারিদিকের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে যথেষ্ট তথ্য পাবার ব্যবস্থা থাকবে হবে বাংলাদেশের হাতে। এই তথ্যের সাথে প্যাট্রোলের সমন্বয়ের মাধ্যমে আশেপাশের দেশগুলিকে সাথে দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতকে এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সহায়তা দেবার জন্যে রাজি করাতে হবে। তারা যদি লাখো শরণার্থীর দায় নিতে না চায়, তাহলে আন্দামান সাগর টহল দিতে বাংলাদেশকে তাদের অবশ্যই লজিস্টিক্যাল এবং ইন্টেলিজেন্স সাপোর্ট দিতে হবে।
বাংলাদেশ যদি করোনা দুর্যোগ থেকে বৈশ্বিক পাওয়ার ব্যালান্সের ‘ভূমিকম্পসম’ পরিবর্তন বুঝতে পারে, তাহলে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, শক্তিশালী দেশগুলির খেলার গুটি হওয়াটা বাংলাদেশের জন্যে কোন অপশন নয়। বরং নিজের শক্তিকে জানান দিয়ে এটা বলে দিতে হবে যে, এদেশের সাথে ‘ক্যারট এন্ড স্টিক’ খেলতে গেলে যে কারুরই হাত পুড়বে। সাম্প্রতিক শরণার্থী সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আন্দামান সাগরের মতো কৌশলগত একটা সাগরকে বাংলাদেশ কতটা হাল্কাভাবে নিয়েছিল এতদিন। বাংলাদেশের ‘আন্দামান প্যাট্রোল ফোর্স’ বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থকে রক্ষায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
এক্ষেত্রে দুর্জয় ক্লাস এলপিসিগুলি ব্যাবহারই যথেষ্ট হবে, নাকি হামিল্টন ক্লাসের জাহাজগুলিও নিয়োজিত করতে হবে? অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে এই টহলের ব্যাবস্হা বাংলাদেশ কোষ্টগার্ডের উপর নস্ত থাকবে নাকি বাংলাদেশ নেভির উপর?
ReplyDeleteবিশেষ কোন ক্লাসের জাহাজই সেখানে মোতায়েন করা যাবে; বাকিগুলি যাবে না - এরকম কোন বিষয় সম্ভবতঃ এখানে নেই। কারণ এই স্থানটা বাংলাদেশ থেকে খুব একটা দূরে নয়; মাত্র কয়েকদিনের পথ। কাজেই অনেক জাহাজই এখানে প্যাট্রোলের জন্যে ব্যবহৃত হতে পারে।
Deleteডীপ সী-তে প্যাট্রোল দেয়ার মতো জাহাজ রয়েছে অনেকগুলি। ৪টা দুর্জয়-ক্লাস ছাড়াও আইল্যান্ড-ক্লাসের ওপিভি রয়েছে ৫টা; বিএনএস মধুমতিও রয়েছে; ছয়টা ফ্রিগেট ছাড়াও কর্ভেট রয়েছে ৬টা (যার ১টা অবশ্য লেবাননে রয়েছে)। এছাড়াও কোস্ট গার্ডের ওপিভি রয়েছে ৪টা। এর বাইরেও ৪টা মাইনসুইপার আর একটা সার্ভে জাহাজ মহাসমুদ্রে প্যাট্রোলের জন্যেই ব্রিটিশরা ডিজাইন করেছিল। কাজেই গোটা ত্রিশেক জাহাজ রয়েছে যেগুলি সেখানে ছয় সপ্তাহের মিশনে যেতে পারে। এর মাঝে একটা বা দুইটা শুভেচ্ছা সফর থাকবে আশেপাশের বন্দরগুলিতে। এর ফলে লজিস্টিক্যাল কোন সমস্যা হবার কথা নয়।
BN may replace island class patrol vessels with the newly purchase/ordered LPCs. However, I still have doubt on logistic issues.
DeleteKicking down doors open is an American policy, which requires forcefully acquiring basing rights from other nations... We have to move away from that sort of thinking if we want to increase our influence... Can't follow Western thought leadership..
Delete