Tuesday, 21 January 2025

ট্রাম্প ঝড়ের শুরু?

২১শে জানুয়ারি ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে সবচাইতে বেশি ব্যস্ত রাখবে। ডেমোক্র্যাটদের সাথে মারাত্মক দ্বন্দ্ব, লিবারাল আদর্শের ব্যাপারে মেরুকরণ (যেমন – সমকামিতা, গর্ভপাত, বিচার বিভাগের দলীয়করণ), সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক দৈন্যতা, জাতিগত দ্বন্দ্ব, অভিবাসী নিয়ে কোন্দল, বন্দুকের ব্যবহারে অপরাধ বৃদ্ধি, আত্মহননের হার বৃদ্ধি, গৃহহীন জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি, ইত্যাদি সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করেছে। ট্রাম্পের সময়ে এগুলি আরও একধাপ এগুবে। যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজের সাথেই যুদ্ধরত – ২০২৫ সালে এই সত্যটাই নতুনরূপে সামনে আসবে।


ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ফিরে আসার মাধ্যমে ২০শে জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প। ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান শিবিরের মাঝে মারাত্মক বিবাদের মাঝেই কেটেছে গত ৮ বছর। ২০২৫ সালে ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এই কোন্দলকে বৈশ্বিক অস্থিরতার শীর্ষ কারণ হিসেবে রেখেছেন। মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলেই ট্রাম্প ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তার প্রথম টার্ম ব্যাপক খাড়াই-উতড়াইএর মাঝ দিয়ে গিয়েছে। এরপর ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নিয়ে ট্রাম্প সমর্থকরা ২০২১ সালের ৬ই জুলাই ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল দখল করে প্রতিবাদ করে। জো বাইডেনের সরকার একদিকে যেমন এই রায়টকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল, তেমনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও এই রায়টের নেতৃত্ব দেবার অভিযোগে মামলা হয়েছিলো। ডেমোক্র্যাটদের ইন্ধনে বহু মামলায় জর্জড়িত হয়ে নির্বাচনের আগে ট্রাম্প সম্পদ ঘাটতির মাঝেও পড়ে যান। এরপর ট্রাম্পের জীবননাশেরও চেষ্টা করা হয় অন্ততঃ দু'বার। এতকিছুর পরেও দ্বিতীয়বারের মতো ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে আসাটা একদিকে যেমন ছিল ঐতিহাসিক ব্যাপার, অপরদিকে তা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মেরুকরণকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। অনেকেই মত দিচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পের দ্বিতীয় টার্ম খুব সম্ভবতঃ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সবচাইতে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে।

এক্সিকিউটিভ অর্ডার বনাম বাস্তবতা

ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেবার সাথেসাথেই বেশ কয়েকটা প্রেসিডেন্সিয়াল এক্সিকিউটিভ অর্ডারে স্বাক্ষর করেন। এগুলির অনেকগুলির ব্যাপারেই তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময় অঙ্গীকার করেছিলেন। 'ডয়েচে ভেলে'র সাথে কথা বলতে গিয়ে 'আমেরিকান ইউনিভার্সিটি'র প্রফেসর মিশেল এগান বলছেন যে, মার্কিন কংগ্রেস এবং সিনেটকে বাইপাস করার জন্যে এধরণের সিদ্ধান্তগুলি প্রেসিডেন্ট নিতে পারেন। তবে এসকল আদেশকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়; আবার পরবর্তী প্রেসিডেন্টও এগুলিকে পরিবর্তন করতে পারবেন। আইন ব্যবসা 'পিলসবুরি'র সদস্য আইমী ঘোষ 'ডয়েচে ভেলে'কে বলছেন যে, ট্রাম্পের স্বাক্ষর করা আদেশগুলির কিছু এই মুহুর্ত থেকেই কার্যকর হয়ে যাবে; আর কিছু বেশ কয়েকটা স্তরের মাঝ দিয়ে যাবে এবং আরও সময় নেবে। যেমন, ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বের হয়ে যাবার আদেশ দিলেও সেটা প্রায় এক বছর লেগে যেতে পারে। 'পিলসবুরি'র ক্রেইগ স্যাপারস্টাইনএর মতে সংস্কৃতি বিষয়ক যেসকল সিদ্ধান্ত ট্রাম্প দিয়েছেন, সেগুলি প্রশাসন এবং কংগ্রেসের প্রথম দিনগুলিতে আলোচিত হবে। এগুলির মাঝে রয়েছে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পুরুষ এবং মহিলার বাইরে আর কোন জেন্ডারকে স্বীকার করবে না। জো বাইডেনের প্রশাসন মার্কিন পাসপোর্টে নিজের জেন্ডার পরিবর্তন করে ফেলা সহজ করে দিয়েছিল; যা ট্রাম্প উল্টে দিয়েছেন। এছাড়াও ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে রায়ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত ১৬'শ ব্যক্তিকে ট্রাম্প ক্ষমা করে দিয়েছেন। এই ব্যাক্তিদেরকে ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে 'জানুয়ারি ৬এর জিম্মি' বলে আখ্যা দিয়েছেন। আইমী ঘোষ বলছেন যে, এধরণের ক্ষমা সাধারণতঃ যেকোন প্রেসিডেন্ট তাদের সময়সীমার শেষের দিকে দিয়ে থাকেন; ট্রাম্পের মতো প্রথম দিনেই এরূপ সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন। তবে আইমী ঘোষ জো বাইডেনের ক্ষমতার শেষ কয়েক ঘন্টায় ক্ষমা করে দেয়া ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করেননি। ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের সকালে হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে বাইডেন জানুয়ারি ৬ কমিশনের সদস্যদেরসহ বেশ কিছু ব্যক্তির জন্যে আগাম ক্ষমা ঘোষণা করেন। এদের মাঝে রয়েছেন প্রাক্তন সর্বোচ্চ সামরিক অফিসার জেনারেল মাইক মিলি; যার বিরুদ্ধে চীনকে তথ্য দেয়ার অভিযোগে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ উঠেছে। বাইডেন এই ভেবে এটা করেছেন যে, যে ব্যক্তিরা ৬ই জানুয়ারির রায়টে অংশগ্রহণকারীদের বিচার করেছিল অথবা বিভিন্ন সময়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সময় ডেমোক্র্যাটদেরকে সহায়তা দিয়েছিল, ট্রাম্প তাদেরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন।

জ্বালানির ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা

ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলের উৎপাদন এবং রপ্তানিতে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে চায়। একইসাথে তিনি জ্বালানির ব্যাপারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে; যদিও এর অর্থ আসলে কি, সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা 'এনপিআর'কে বলেছেন যে, ট্রাম্পের এই ঘোষণার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষমতার সূচনা করা হবে; যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র খুব স্বল্প সময়ের মাঝে তেল, কয়লা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে। 'ব্রেনান সেন্টার'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মাধ্যমে ট্রাম্প একদিকে যেমন পরিবেশ বিষয়ক আইনগুলিকে বাইপাস করতে পারবেন, তেমনি অপরিশোধিত তেল রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হবেন। ১৯৭০এর দশকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রাদেশিক ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে বিভিন্ন আইনকে বাইপাস করে যুক্তরাষ্ট্রের তেলের মজুতকে উন্নীত করেছিলেন। তবে পুরো দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা তিনি ঘোষণা করেননি। যদিও সেবারের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিলো তেলের সরবরাহে ঘাটতির কারণে; তথাপি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচাইতে বেশি তেল উৎপাদন করে এবং আমদানির চাইতে বেশি রপ্তানি করে। বিপুল মার্কিন ডাটা সেন্টার এবং বর্ধিত ইন্ডাস্ট্রির চাপে সামনের দিনগুলিতে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। তখন পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে চালু রাখার জন্যে পরিবেশ আইনগুলিকে বাইপাস করতে হতে পারে। এছাড়াও ট্রাম্প সর্বদাই কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমর্থক। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে যতো সময় লাগে, পরিবেশ আইনগুলিকে বাইপাস করতে পারলে সেই সময় অনেকটাই কমে আসতে পারে। ট্রাম্প চাইছেন যে, তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে তিনি দ্রব্যমূল্য অর্ধেকে নামিয়ে আনবেন। কিন্ত ২০২০ সালে করোনা লকডাউনের সময়েই মার্কিন নাগরিকদের জ্বালানি খরচ কমেছিল মাত্র ১৯ শতাংশ। বেশি উৎপাদন করলে কিছু সময়ের জন্যে তেলের মূল্য কমে আসতে পারে। কিন্তু দাম কমে গেলেই আবারও তেলের কোম্পানিগুলি উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে চাইবে; তাতে মূল্য আবারও আগের স্থানে ফিরে যাবে। তেলের উৎপাদনকারীরা বরাবরই ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। তারা তেলের মূল্য খুব বেশি কমাটা পছন্দ করবে না। আবার ট্রাম্প যদি তেল-গ্যাস রপ্তানি বৃদ্ধি করতে চান, তাহলেও মার্কিন নাগরিকদের জন্যে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যেতে পারে।

মেক্সিকো, পানামা খাল ও কানাডা

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'আটলান্টিক কাউন্সিল'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ট্রাম্পের প্রথম দিনে বৈশ্বিকভাবে কি কি ব্যাপার আলোচনায় এসেছে। ট্রাম্প মেক্সিকোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার নিরাপত্তা শক্তিশালী করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি মেক্সিকোর সীমানায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং মেক্সিকোর মাদক ব্যবসায়ী চক্রকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে ট্রাম্প স্বাভাবিকভাবে যতটুকু শক্তিসামর্থ্য সীমানায় মোতায়েন করতে পারতেন, তার চাইতেও অনেক বেশি সক্ষম হবেন। তবে এই সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়নে তার কয়েক বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রয়োজন হবে; যা তিনি কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া পাবেন না।

ট্রাম্প পানামা খালের উপর যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র এত কষ্ট করে এই খাল তৈরি করেনি সেখানে চীনাদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যে। ট্রাম্প কিভাবে তার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবেন তা নিশ্চিত নয়। 'আটলান্টিক কাউন্সিল' বলছে যে, পানামার বর্তমান সরকার যথেষ্টই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত; যা ট্রাম্পকে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা দেবে। ট্রাম্প আরও বলেছেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর কর কমিয়ে আমদানিকৃত বিদেশী পণ্যের উপর শুল্ক দেবেন। তবে প্রথম দিনেই তিনি নির্দিষ্ট করে কোন শুল্পারোপ করেননি। কারণ তিনি জানেন যে, হঠাত করে শুল্কারোপ করলে শেয়ার বাজারে ধ্বস নামবে এবং যে দেশের পণ্যের উপর শুল্কারোপ করা হবে, সেই দেশ প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক দেবে। শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। তবে ট্রাম্প খুব শিগগিরই তার শুল্কের ঝুলি নিয়ে হাজির হবেন। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি ধারণা করছে যে, ট্রাম্প খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ৫'শ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি পণ্যের উপর শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছেন।

ট্রাম্প তার উদ্ভোধনী ভাষণেই বলেছেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আকার বৃদ্ধি করতে চান। ইতোমধ্যেই তিনি গ্রীনল্যান্ড কেনার কথা বলেছেন এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম প্রদেশ করার ইচ্ছা ব্যাক্ত করেছেন। ক্ষমতায় আসার আগেই ট্রাম্প কানাডার সরকারে পরিবর্তন এনেছেন। ‘বিবিসি' বলছে যে, ট্রাম্প যখন হুমকি দিয়েছিলেন যে, তিনি কানাডার পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন, তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সেটার কোন জবাব দেননি। ট্রাম্পের হুমকিকে গুরুত্ব না দেয়ার জন্যে ট্রুডোর অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রীল্যান্ড ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পদত্যাগ করেন। এর ফলে ট্রুডো তার নিজ রাজনৈতিক দলের সমর্থন হারান এবং তার মেয়াদ শেষ হবার আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্য

ট্রাম্প সরাসরি ইউক্রেন নিয়ে কোন কথা না বললেও উল্লেখ করেছেন যে, ট্রাম্পের আগের প্রশাসন অন্য দেশের সীমান্ত রক্ষায় সীমাহীন অর্থ ব্যয় করেছে। 'বিবিসি' বলছে যে, প্রথমদিকে ট্রাম্প ২৪ ঘন্টার মাঝে যুদ্ধ শেষ করার যে কথাগুলি বলেছিলেন, তা তার প্রতিনিধি অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল কীথ কেলগ ১০০ দিনে এনে দাঁড় করিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আলোচনার টেবিলে বসলে ইউক্রেনকে দুর্বল অবস্থানে থেকেই আলোচনা করতে হবে। এই মুহুর্তে ইউক্রেনের ২০ শতাংশ ভূমি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর যেহেতু রাশিয়া এখন যুদ্ধে জয়ের ধারায় রয়েছে, সেহেতু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ বন্ধ করার তেমন ইচ্ছাও থাকার কথা নয়।

‘বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ফিলিস্তিনে অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়নে ট্রাম্প ক্রেডিট নিতেই পারেন। ক্ষমতায় আরোহণের আগেই তিনি এই কাজটা করে দেখিয়েছেন। আমেরিকা যে অস্ত্রবিরতি মেনে নেয়ার জন্যে ফিলিস্তিনিদের উপর চাপ প্রয়োগ করবে, সেটা সর্বদাই জানা ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন ইস্রাইলের উপর কোনরূপ চাপ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে; যেকারণে ইস্রাইলিরা নানাভাবে টালবাহানা করে সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করছিলো। ট্রাম্প ইস্রাইলিদের উপর চাপ সৃষ্টি করার মতো কাজটা করে দেখিয়েছেন। 'বিবিসি' তার এক সূত্র থেকে বলছে যে, ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রীরা ট্রাম্পের আসন্ন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গোপনে বেশ কয়েকবার বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার, অর্থসচিব রেচেল রীভস, পররাষ্ট্রসচিব ডেভিড ল্যামি এবং ব্যবসা-বিষয়ক সচিব জনাথন রেইনল্ডস। ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন গবেষণাপত্র তৈরি করিয়েছে, যার মাধ্যমে ট্রাম্পের নীতিগত সম্ভাব্য সিদ্ধান্তগুলিকে বিশ্লেষণ করা ছাড়াও সেগুলিকে ব্রিটিশরা কিভাবে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা তার পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্যের সাথে যায়। নিঃসন্দেহে ট্রাম্প চীনের দিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্যেই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ চেয়েছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের যে ইচ্ছা তিনি ব্যাক্ত করেছেন, সেটাও চীনকে মাথায় রেখেই। ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড এবং পানামা খালের নিয়ন্ত্রণও চাইছেন চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে। যখন ট্রাম্প বলছেন যে, তিনি মার্কিন জনগণের উপর কর কমিয়ে বিদেশী পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করতে চাইছেন, তখন যতগুলি দেশ এতে বিচলিত হবে, তার মাঝে শীর্ষে থাকবে চীন। ট্রাম্প নিঃসন্দেহেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধকে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে নিয়ে আসবেন এবং আগে থেকেই চলে আসা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একে অপরের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলার প্রসেসকে আরও এগিয়ে নেবেন। তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে সবচাইতে বেশি ব্যস্ত রাখবে। ডেমোক্র্যাটদের সাথে মারাত্মক দ্বন্দ্ব, লিবারাল আদর্শের ব্যাপারে মেরুকরণ (যেমন – সমকামিতা, গর্ভপাত, বিচার বিভাগের দলীয়করণ), সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক দৈন্যতা, জাতিগত দ্বন্দ্ব, অভিবাসী নিয়ে কোন্দল, বন্দুকের ব্যবহারে অপরাধ বৃদ্ধি, আত্মহননের হার বৃদ্ধি, গৃহহীন জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি, ইত্যাদি সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করেছে। ট্রাম্পের সময়ে এগুলি আরও একধাপ এগুবে। যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজের সাথেই যুদ্ধরত – ২০২৫ সালে এই সত্যটাই নতুনরূপে সামনে আসবে।

Friday, 17 January 2025

ইস্রাইলের জন্য নতুন হুমকি - সিরিয়াতে তুরস্কের আবির্ভাব

১৮ই জানুয়ারি ২০২৫

ইস্রাইল যদি তার নিরাপত্তাহীনতার কারণে সিরিয়ার অভ্যন্তরে তার সামরিক আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়; অথবা ওয়াশিংটনের সমর্থনে সিরিয়ার অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করে 'এসডিএফ'এর পক্ষাবলম্বণ করে, তাহলে তুরস্কের সাথে ইস্রাইলের সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়াটা অমূলক নয়। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প প্রশাসনের আবির্ভাব ইস্রাইল এবং তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।


‘তুর্কি টুডে'র এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স' আগামী ২৩শে জানুয়ারি থেকে দামাস্কাসে তাদের ফ্লাইট শুরু করতে যাচ্ছে। তবে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই ফ্লাইটগুলির মাধ্যমে ইস্রাইলি এবং ইরানি নাগরিকদেরকে সিরিয়াতে ঢুকতে দেয়া হবে না। 'টারকিশ এয়ারলাইন্স'এর জেনারেল ম্যানেজার বিলাল একসি সোশাল মিডিয়ার এক বার্তায় লেখেন যে, তিনি হাজার বছর ধরে দামাস্কাসকে চেনেন। তিনি শহরটাকে তার মায়ের দুধের সাথে তুলনা করেন। একসির এই বার্তায় সিরিয়ার সাথে তুরস্কের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথাই সামনে চলে আসে; বিশেষ করে উসমানি খিলাফতের সময়ে সিরিয়া ছিল ইস্তাম্বুলের সুলতানের অধীনে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সিরিয়ার বাশা আল-আসাদ সরকারের পতনের পর সকলেই একমত যে, সিরিয়ার পরিবর্তনে সবচাইতে বেশি লাভবান হয়েছে তুরস্ক। তবে সিরিয়ার আশেপাশের দেশগুলি সিরিয়ার পরিবর্তনকে এখনও সন্দেহের চোখে দেখছে; বিশেষ করে ইস্রাইল। ১৫ই জানুয়ারিতেও ইস্রাইলের বিমান বাহিনী সিরিয়ার অভ্যন্তরে বোমাবর্ষণ করে। ইস্রাইল বলছে যে, এর টার্গেট ছিল বাশার আল-আসাদের পক্ষে থাকা বিভিন্ন গ্রুপ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ইস্রাইলকে তার বিমান হামলা বন্ধের অনুরোধ করেছেন। সিরিয়ার ক্ষমতা নেয়া মিলিশিয়া গ্রুপগুলির সন্মুখে রয়েছে আবু মুহাম্মদ আল-জুলানি নামে পরিচিত আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বে 'হায়াত আত-তাহরির আল-শাম' বা 'এইচটিএস'। ডিসেম্বর মাসে আল-শারাও ইস্রাইলকে বিমান হামলা বন্ধ করার জন্যে বলেছেন।

সিরিয়ায় ইস্রাইলের নীতি এখন স্পটলাইটে রয়েছে। বিশেষ করে আলোচিত হচ্ছে সিরিয়ার সামরিক ঘাঁটিগুলিতে ইস্রাইলের বিমান হামলা, সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর ভূমি দখল এবং অধিকৃত গোলান মালভূমিতে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল'এর সাথে সাক্ষাতে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ' বা 'সিএসআইএস'এর সিনিয়র ফেলো নাতাশা হল বলছেন যে, সিরিয়াতে পরিবর্তনের অর্থ হলো ইস্রাইলের সীমানায় তুর্কি-সমর্থিত গ্রুপের আবির্ভাব। 'এইচটিএস'এর অনেক সদস্যই একসময় 'আল-কায়েদা'র সাথে ছিল। এই গ্রুপটা 'বাস্তবতা'কেন্দ্রিক চিন্তার মাঝে রয়েছে। 'এইটিএস' এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞায় সন্ত্রাসী সংগঠন; তথাপি তারা চেষ্টা করছে, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে। তবে এই পরিবর্তন হতে হলে 'এইটিএস'কে অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে। 'এইচটিএস' ছাড়াও সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে 'সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি' বা 'এসএনএ'; যার পেছনে রয়েছে তুরস্ক। আর জাতিগত কুর্দিদের থেকে গঠন করা 'সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস' বা 'এসডিএফ'এর সমর্থনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক 'এসডিএফ'কে 'কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি' বা 'পিকেকে'এর অঙ্গসংগঠন বলে থাকে। 'পিকেকে' তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সংজ্ঞায় সন্ত্রাসী সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সাথে একমত নয় যে 'পিকেকে' এবং 'এসডিএফ' একই সংগঠন। ওয়াশিংটনের মতে 'এসডিএফ' হলো আইসিসের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। একারণে 'এসডিএফ'এর অধীনে আইসিসের বহু বন্দীকে আটক রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক সমর্থিত 'এসএনএ' অনেকদিন ধরেই 'এসডিএফ'এর সাথে সংঘাতরত অবস্থায় রয়েছে।
 
নিরাপত্তাহীনতা থেকেই ইস্রাইল গাজা এবং লেবাননে সামরিক অভিযান চালিয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে। সিরিয়ার আকৃতি গাজা বা লেবাননের তুলনায় বহুগুণে বড়; যেকারণে সিরিয়াতে যেকোন পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত থাকবে ইস্রাইল। একইসাথে ইস্রাইল চায় না যে, তাদের আশেপাশের দেশগুলি সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হোক। 'সিএসআইএস'এর নাতাশা হল-এর মতে, তুর্কি-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সহায়তায় তুরস্ক এখন ইস্রাইলের প্রতিবেশী। 


গত ৬ই জানুয়ারি ইস্রাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক একটা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ইস্রাইলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রাক্তন প্রধান ইয়াকভ নাগেলের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল সামনের দিনগুলিতে ইস্রাইলের নিরাপত্তা হুমকিগুলির ব্যাপারে একটা ধারণা দেয়া। রিপোর্টে বলা হয় যে, সিরিয়াতে নতুন গঠিত সরকারের পিছনে তুরস্কের সমর্থন থাকার কারণে ভবিষ্যতে তুরস্কের সাথে ইস্রাইলের সংঘর্ষ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইস্রাইলিরা 'এইচটিএস'এর সাথে 'আল-কায়েদা'র সম্পর্কের ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। কারণ তাদের ধারণা সিরিয়ার নতুন সুন্নি নেতৃত্ব কোন এক সময় ইস্রাইলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে। এমনকি এতদিন ইরানের সমর্থনে যে হুমকি ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ছিল, সেটার চাইতেও বড় হুমকি হতে পারে সুন্নি সিরিয়া। কারণ ইরানের প্রক্সিগুলি বর্তমানে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, যদি দামাস্কাসে তুর্কি প্রক্সি ক্ষমতায় বসে, তাহলে তা তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানি খিলাফত পুনপ্রতিষ্ঠার উচ্চাকাংক্ষার অংশ হিসেবে কাজ করতে পারে। সিরিয়ার সামরিক শক্তির পুনরুত্থানকে ইস্রাইল তার নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হিসেবে দেখছে। নাগেল কমিশনের রিপোর্টে করণীয় হিসেবে বলা হয়েছে যে, ইস্রাইল যেন আগেভাগেই হুমকি হয়ে ওঠার আগেই তার নিরাপত্তার প্রতি আসন্ন হুমকিগুলিকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। তবে রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, সিরিয়ার মাটিতে তুর্কি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সিরিয়ার সেনাবাহিনীর পুনরুত্থানকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এছাড়াও, আঞ্চলিক অস্থিরতা ইস্রাইলের সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলতে পারে; এমনকি মিশর এবং ইস্রাইলের মাঝেও উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।

গ্রাহাম ফুলার প্রায় দুই দশক ধরে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি' বা 'সিআইএ'র কর্মকর্তা ছিলেন এবং 'সিআইএ'এর মধ্যপ্রাচ্য ডিভিশনের প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন। 'ডায়ালগ ওয়ার্কস' পডকাস্টে তার মতামত দিতে গিয়ে তিনি বলছেন যে, তিনি আশা করছেন যে, ইস্রাইল যা বলছে, সেটা শুধুই হুমকি-ধামকি। তবে তিনি ইস্রাইলের সাথে তুরস্কের সম্ভাব্য সংঘাতকে মারাত্মক পরিণতি হিসেবে দেখছেন। তিনি বলছেন যে, ইরানের সামরিক শক্তি ইস্রাইলের জন্যে হুমকি হলেও তুরস্কের সামরিক বাহিনী হবে ইস্রাইলের এতদকালে মোকাবিলা করা সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। ইস্রাইল লেবানন এবং সিরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে অবস্থান করার যে নীতিতে এগুচ্ছে, তা হয়তো ইস্রাইলের সক্ষমতার বাইরে। ইস্রাইল হয়তো তুরস্কের সাথে সংঘাত চাইবে না; কিন্তু নেতানিয়াহু সরকারের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই আগে থেকে বলা যায় না। এরদোগানের অধীনে তুরস্কের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে ঠান্ডা-গরমের মাঝ দিয়ে গিয়েছে; যদিও সাধারণভাবে সেই সম্পর্ক ভালোই ছিল। তথাপি রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক যে ইস্রাইলকে ভালো চোখে দেখে না, সেটা ইস্রাইল সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছে।

তুরস্কের সামরিক শক্তি ইস্রাইলের বিপক্ষে ব্যবহৃত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর; যা ইস্রাইলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এরদোগানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে ইস্রাইল ভীত নয়। গাজায় ইস্রাইলের এক বছরের বেশি সময়ের বর্বরতার মাঝে এরদোগান কিছু বক্তব্য দেয়া ছাড়া কিছুই করেননি। তথাপি নাগেল কমিশনের রিপোর্টে পরিষ্কার যে, ইস্রাইল তার সীমানায় উসমানি খিলাফতের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। আর 'সিআইএ'র গ্রাহাম ফুলারের কথায়, ইস্রাইল জানে যে রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক ইস্রাইলকে শত্রু মনে করে।
 

তবে তুর্কি সাংবাদিক রাগিপ সোইলু 'মিডলইস্ট আই'এর এক লেখায় বলছেন যে, তুরস্ক ইস্রাইলের সাথে সংঘাত চায়না। এর প্রধান কারণ হলো উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রের খুব কাছের বন্ধু। এছাড়াও আঞ্চলিক অস্থিরতার মাঝে তুরস্ক ইস্রাইলের সাথে কোন সংঘর্ষে যাবে না। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, তুরস্ক এমন একটা সিরিয়া দেখতে চায়, যা কিনা অন্য রাষ্ট্রের জন্যে হুমকি হবে না। তুরস্কের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটা সিরিয়া গড়া, যা হবে গণতান্ত্রিক, অবিভক্ত এবং অসামরিক; যেখানে সকল সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দেখা হবে, যার মাঝে কুর্দিরাও থাকবে। এর মাধ্যমে তুরস্ক নিশ্চিত করতে চায় যে, ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি' বা 'পিকেকে'এর নেতৃত্বে কোন আলাদা কুর্দি রাষ্ট্র যেন গঠিত না হয়। এই লক্ষ্যে তুরস্ক বহুবার সিরিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। এই লক্ষ্যের সাথে ইস্রাইলের কোন সম্পর্ক নেই। বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের পরপর ইস্রাইল পুরো সিরিয়া জুড়ে সামরিক স্থাপনার উপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে। তুরস্ক তখন চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। তবে ইস্রাইল তাদের টার্গেটগুলিকে আরও ছড়িয়ে দেয়ার পর তুরস্ক ইস্রাইলকে হামলা বন্ধ করতে বলে। সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের ভান্ডারের উপর ইস্রাইলি হামলার ব্যাপারে তুরস্কের কোন প্রতিবাদ ছিল না। আর ইস্রাইলও 'এইটিএস'এর স্থাপনাগুলিকে হামলার মাঝে আনেনি। তুরস্কের ইন্টেলিজেন্স ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্সের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রাখছে; যাতে করে দুই দেশের মাঝে কোন সংঘাতের সূচনা না হয়। 'এইটিএস'এর নেতৃত্বও বলেছে যে, তারা ইস্রাইলের সাথে সংঘাত চায়না। যদিও সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে নতুন করে তৈরি করার ক্ষেত্রে তুরস্কের সেনাবাহিনী নেতৃত্ব দিতে চাইছে, তথাপি তুরস্ক নিশ্চিত করতে চাইছে যে এই ব্যাপারটাকে ইস্রাইল যেন হুমকি হিসেবে না দেখে। তবে যে ইস্যুটার ব্যাপারে তুরস্ক ছাড় দেবে না তা হলো সিরিয়ার ভৌগোলিক অখন্ডতা।রাগিপ সোইলু বলছেন যে, ইস্রাইলকে মেনে নিতেই হবে যে, কুর্দিদের জন্যে আলাদা কোন রাষ্ট্র তুরস্ক সমর্থন করবে না। ইস্রাইলের বিভিন্ন থিংকট্যাঙ্ক সিরিয়ার বিভক্তি চাইছে। তারা বলছে যে, বিভক্ত সিরিয়া ইস্রাইলের নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করবে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, ইস্রাইলের নেতৃত্ব তার আশেপাশের দেশগুলিতে একনায়ক পছন্দ করে। ইস্রাইল তার অত্যাচারের যে নীতিতে রয়েছে, তাতে এসকল একনায়কের সাথে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক বজায় রেখে ইস্রাইল তার নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। রাগিপ সোইলু মনে করছেন যে, সিরিয়ার পরিবর্তনে তুরস্কের ব্যাপক সুবিধা হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন না যে, সিরিয়ার নতুন সরকার তুরস্কের প্রক্সি হিসেবে কাজ করবে।

নিরাপত্তাহীনতা থেকেই ইস্রাইল গাজা এবং লেবাননে সামরিক অভিযান চালিয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে। সিরিয়ার আকৃতি গাজা বা লেবাননের তুলনায় বহুগুণে বড়; যেকারণে সিরিয়াতে যেকোন পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত থাকবে ইস্রাইল। একইসাথে ইস্রাইল চায় না যে, তাদের আশেপাশের দেশগুলি সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হোক। 'সিএসআইএস'এর নাতাশা হল-এর মতে, তুর্কি-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সহায়তায় তুরস্ক এখন ইস্রাইলের প্রতিবেশী। আর এটাই ইস্রাইলকে বিচলিত করেছে। তুরস্কের সামরিক শক্তি ইস্রাইলের বিপক্ষে ব্যবহৃত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর; যা ইস্রাইলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এরদোগানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে ইস্রাইল ভীত নয়। গাজায় ইস্রাইলের এক বছরের বেশি সময়ের বর্বরতার মাঝে এরদোগান কিছু বক্তব্য দেয়া ছাড়া কিছুই করেননি। তথাপি নাগেল কমিশনের রিপোর্টে পরিষ্কার যে, ইস্রাইল তার সীমানায় উসমানি খিলাফতের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। আর 'সিআইএ'র গ্রাহাম ফুলারের কথায়, ইস্রাইল জানে যে রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক ইস্রাইলকে শত্রু মনে করে। ইস্রাইলের জন্যে হিসেবেটা আরও জটিল হয়ে গিয়েছে; কারণ ইস্রাইলের জন্যে তুরস্কের সামরিক শক্তি মোকাবিলা করা ইরানকে মোকাবিলার চাইতেও কঠিন হবে। ইস্রাইল যদি তার নিরাপত্তাহীনতার কারণে সিরিয়ার অভ্যন্তরে তার সামরিক আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়; অথবা ওয়াশিংটনের সমর্থনে সিরিয়ার অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করে 'এসডিএফ'এর পক্ষাবলম্বণ করে, তাহলে তুরস্কের সাথে ইস্রাইলের সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়াটা অমূলক নয়। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প প্রশাসনের আবির্ভাব ইস্রাইল এবং তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।