গত ৩রা জুলাই ফ্রান্স আলজেরিয়ায় ঔপনিবেশিক সময়ে হত্যা করা ২৪ জন বিদ্রোহীর মস্তক ফেরত দিয়েছে। ১৮৩০ সাল থেকে ১৯৬২ সালের মাঝে ফরাসীরা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ব্যক্তিদের হত্যা করে তাদের মস্তক ফ্রান্সে নিয়ে যায় এবং সেগুলিকে প্যারিসের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’তে সাজিয়ে রাখে। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আব্দেলমাজিদ তেবুনে এক ভাষণে বলেন যে, ১৭০ বছর ধরে এই বিদ্রোহীদেরকে কবর পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। পরদিন ৪ঠা জুলাই ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে এক সাক্ষাতে তেবুনে বলেন যে, ঔপনিবেশিক সময়ের অপরাধের জন্যে আলজেরিয়ার কাছে ফ্রান্সের পুরো ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিৎ; এখন পর্যন্ত অর্ধেকের মতো ক্ষমা প্রার্থনা পাওয়া গিয়েছে। তিনি বলেন যে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বর্তমান অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে আরও অগ্রগামী হতে পারেন। কিন্তু এতো বছর পরে কেন ঔপনিবেশিক সময়ের অত্যাচারের কাহিনীগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে? ‘সিএনএন’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর পশ্চিমা দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক সময়ের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। এতকাল পর ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সাথে এই আন্দোলনের সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে ‘সিএনএন’এর বিশ্লেষণের বাইরেও আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাওয়া যাবে উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন থেকে। এর মাঝে আলজেরিয়ায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য।
গত বছরের ২৩শে ডিসেম্বর আলজেরিয়ার সেনাপ্রধান জেনারেল আহমেদ গাইদ সালাহ ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই মনে করেন যে, গত দুই দশক ধরে প্রেসিডেন্ট আব্দেলআজিজ বুতাফ্লিকার হাতে দেশের ক্ষমতা থাকার পিছনে জেনারেল গাইদ সালাহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ২০০৪ সালে বুতাফ্লিকা তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। ২০১৩ সালে তিনি উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গত বছরের এপ্রিল মাসে বুতাফ্লিকা ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও আন্দোলনকারীরা ক্ষমতায় থাকা সকলের পদত্যাগ দাবি করছিল। কারণ বুতাফ্লিকা ক্ষমতাচ্যুত হবার পর আলজেরিয়ার নিয়ন্ত্রণ মূলতঃ জেনারেল গাইদ সালাহর হাতেই ছিল। সালাহ ১৭ বছর বয়সে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া নেতৃবৃন্দের হাতেই আলজেরিয়ার ক্ষমতা ছিল এতকাল। বুতাফ্লিকা এবং গাইদ সালাহ ছিলেন সেই জেনারেশনের শেষ নেতৃবৃন্দ। সালাহর মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগে বুতাফ্লিকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আব্দেলমাজিদ তেবুনে আলজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহন করেন। সালাহর স্থলাভিষিক্ত হন ৭৪ বছর বয়সী জেনারেল সাঈদ চেংরিহা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তেবুনে এবং চেংরিহা উভয়েই আলজেরিয়ার এতকালের ক্ষমতাধর নেতৃত্বের অংশ হলেও তাদের অধীনে দেশটার রাষ্ট্রীয় নীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিসের এক বার্তায় বলা হয় যে, গত ২৬শে ডিসেম্বর দেশটার শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয় যে, বিশ্বে আলজেরিয়ার অবস্থানকে পুনর্জাগরিত করতে লিবিয়া, মালি, সাহারা মরুভূমির সাহেল অঞ্চল এবং আফ্রিকাতে আলজেরিয়ার ভূমিকাকে পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত পহেলা জুন আলজেরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেসিডেন্ট তেবুনের পরিদর্শনের সময় জেনারেল চেংরিহা তার ভাষণে বলেন যে, আলজেরিয়ার সংবিধান পরিবর্তনের যে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, সেটাকে সেনাবাহিনী যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি নতুন সংবিধানে আলজেরিয়ার সীমানার বাইরে সেনাবাহিনীর অংশ নেয়ার ব্যাপারটাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। লন্ডনকেন্দ্রিক মিডিয়া ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, আলজেরিয়ার সংবিধান পরিবর্তনের পিছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন দেশটার সামরিক বাহিনীর চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। ‘দ্যা এরাব উইকলি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সংবিধানের নতুন পরিবর্তনে আলজেরিয়ার নিরাপত্তা চিন্তাকেই পরিবর্তন করে ফেলা হচ্ছে। নিজ সীমানার ভেতর থেকেই বাইরের হুমকি মোকাবিলা করার এতকালের চিন্তাটাকে এখন পরিবর্তন করা হচ্ছে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলজেরিয়া এখন তার পূর্বে অবস্থিত লিবিয়া এবং দক্ষিণের মালিতে সহিংসতাকে নিষ্ক্রিয় অবস্থান থেকে না-ও দেখতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, একারণেই সংবিধান পরিবর্তনে আলজেরিয়ার সেনাবাহিনীর সমর্থন শক্তিশালী দেশগুলির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।
৬ই জানুয়ারি লিবিয়ার ত্রিপোলি-কেন্দ্রিক ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা ‘জিএনএ’এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজ এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু আলজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের পরপরই তুরস্ক লিবিয়াতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে সেখানকার যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফ্রান্স লিবিয়াতে জেনারেল হাফতারের অধীনে ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কে সমর্থন দিচ্ছে; এবং তারা লিবিয়াতে তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপের যারপরনাই বিরোধী। ফ্রান্স এবং তুরস্ক উভয় পক্ষই লিবিয়ার যুদ্ধে আলজেরিয়ার সমর্থন চাইছে। উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকায় আলজেরিয়ার রয়েছে সবচাইতে শক্তিধর সামরিক বাহিনী। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আলজেরিয়ার শাসকরা আলজেরিয়ার সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের সাথে বড় ধরণের বাণিজ্য সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলতে চাননি তারা। বুতাফ্লিকা এবং জেনারেল গাইদ সালাহর প্রস্থানের পর অনেক কিছুই নতুন করে হিসেব কষতে হচ্ছে। লিবিয়াতে তুরস্কের অবস্থান শক্ত হতে শুরু করায় ফ্রান্স শুধু উত্তর আফ্রিকা নয়, ভূমধ্যসাগরেও তার প্রভাবকে হুমকির মুখে দেখতে পাচ্ছে। ‘মিডলইস্ট মনিটর’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টে ফ্রান্সের কাছ থেকে ঔপনিবেশিক অত্যাচারের জন্যে ক্ষমা চাইবার আইন পাস করা না গেলেও আলজেরিয়া কিন্তু সেই পথে হাঁটছে না। আলজেরিয়ার দক্ষিণে মালিতে ফ্রান্স সাত বছর ধরে এক ‘শেষ না হওয়া’ যুদ্ধে আটকে রয়েছে। এমতাবস্থায় এই অঞ্চলে নতুন শক্তি হিসেবে আলজেরিয়ার আবির্ভাব ফ্রান্সকে বিচলিত করেছে। ফ্রান্স আলজেরিয়াকে আর যা-ই হোক, তুরস্কের পক্ষে দেখতে চাইছে না। এই ব্যাপারটাই ফ্রান্সের সাথে দরকষাকষিতে আলজেরিয়াকে শক্তিশালী করেছে। অপরদিকে আলজেরিয়া তুরস্ককে সরাসরি সমর্থন না দিলেও নিজের অবস্থানকে জানান দিতে তার সীমানার বাইরে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করলে তা উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে হুমকির মাঝে ফেলবে। ফ্রান্সের ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা তখন লোক দেখানোই মনে হতে পারে।
ফান্স কি কারনে লড়াই করছে ভোগৌলিক অখণ্ডতা নাকি আদর্শিক।
ReplyDeleteফ্রান্সের লক্ষ্য আদর্শিক হলেও সেখানে আবার জাতীয়তাবাদী কিছু ব্যাপার রয়েছে। ফরাসীরা তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে সবচাইতে উন্নত বলে মনে করে। কিন্তু তা ব্রিটিশদের ভাষা এবং সংস্কৃতির কাছে হার মেনেছে বহু আগেই। তারপরেও ফরাসীরা তাদের নিজেদের বাস্তবতার সাথে নিজেদের আকাংক্ষার সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। সক্ষমতার বাইরে উদ্দেশ্য সেট করার কারণে জাতি হিসেবে ফ্রান্স দিকনির্দেশনা হারাচ্ছে; এবং একইসাথে নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যদের উপর চাপিয়ে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একারণেই ফ্রান্সে অশ্বেতাঙ্গদের উপর ক্রমেই নেমে আসছে অত্যাচার; উচ্চাকাংক্ষার বাজেটের ঘাটতি পূরণে মানুষের উপর নেমে আসছে করের বোঝা; পুরোনো চিন্তাকে বিসর্জন দিতে না পারার কারণে সাধ্য না থাকলেও সেগুলির সাথে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তারা।
Deleteআমার তৃতীয় বই "যুক্তরাষ্ট্রের পর..."এ ফ্রান্স নিয়ে একটা অংশ পাবেন; যেখানে ফ্রান্সের এই চ্যালেঞ্জগুলি আলোচিত হয়েছে।