Monday 30 September 2024

হিযবুল্লাহর নেতা নাসরাল্লাহকে হত্যা - এরপর কি?

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনাতে ইস্রাইল সংঘাতকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে। অপরদিকে ইরান যে তার নিজস্ব স্বার্থ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবরোধকে তুলে নেয়ার ব্যাপারটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, তার প্রমাণ হিসেবে খামেনির "কৌশলগত ধৈর্য্য"র নীতিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। একারণেই ইস্রাইল যখন সারা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন ইরান শান্তির কথা বলছে। হামাস নেতা হানিয়ার হত্যার পর নাসরাল্লাহর হত্যার ঘটনা ইরানের কট্টরপন্থীদের উত্তেজিত করলেও তা ইরানের বাস্তবতা-ভিত্তিক চিন্তাকে পরিবর্তন করে ফেলার মতো শক্তিশালী না-ও হতে পারে।


৩০শে সেপ্টেম্বর ভোরে ইস্রাইল ইয়েমেনে হামলা করে। 'সিএনএন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইলের 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান আকাশ-থেকে-আকাশে রিফুয়েলিংএর মাধ্যমে প্রায় দু'হাজার কিঃমিঃ দূরত্বে ইয়েমেনের হুথিদের হাতে থাকা হোদেইদা বন্দরে বোমাবর্ষণ করে। ইস্রাইলি বাহিনী যখন গাজায় হামলা বন্ধের ঘোষণা না দিয়েই লেবাননে ব্যাপক হামলা শুরু করেছে, তখন ইয়েমেনে এই হামলা সংঘাতকে আঞ্চলিক রূপ দিচ্ছে। ইস্রাইল বলছে যে, তারা সংঘাতকে ছড়িয়ে দিতে চায় না। কিন্তু কেউ যদি ইস্রাইলে হামলার চেষ্টা চালায়, তাহলে সে যেখানেই থাকুক, তার বিরুদ্ধে ইস্রাইল ব্যবস্থা নেবে। ২৮শে সেপ্টেম্বর ইস্রাইল ঘোষণা দেয় যে, তারা হিযবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে। এই ঘটনার পর থেকে অনেকেই আলোচনা করছেন যে, সামনের দিনগুলিতে ইস্রাইল, হিযবুল্লাহ এবং ইরান কে কি পদক্ষেপ নিতে পারে।

‘বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, হিযবুল্লাহ হয়তো তার নেতৃত্বের হত্যার পর কিছুটা বিচলিত থাকবে। বিশেষ করে কিছুদিন আগেই হিযবুল্লাহর যোগাযোগ যন্ত্রপাতির উপর ইস্রাইলি হামলার পর হিযবুল্লাহ নিজেদের গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিতে পারে। তাদের মাঝে অনেকেই চাইবে তাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ইস্রাইলের বোমা হামলায় ধ্বংস হবার আগেই ইস্রাইলের শহরগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। কিন্তু সেটা করলে ইস্রাইলের প্রতিশোধ হবে আরও বেশি ভয়াবহ। বিশেষ করে ইস্রাইল লেবাননের শহর এবং অবকাঠামোর উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে; এমনকি ইরানের উপরেও হামলা করে বসতে পারে।

‘বিবিসি' বলছে যে, হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার পরপরই ইরান আয়াতুল্লাহ খামেনিকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। খুব সম্ভবতঃ তাদের একটা ভয় কাজ করছে যে, ইস্রাইল হয়তো খামেনিকেও হত্যার চেষ্টা করে ফেলতে পারে। তবে প্রায় দুই মাস হয়ে গেলো, ইরান এখনও পর্যন্ত গত ৩১শে জুলাই হামাস নেতা ইসমাঈল হানিয়াকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়নি। তবে নাসরাল্লাহর হত্যার পর তেহরানে কট্টরপন্থীরা কিছু একটা করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করতে থাকবে। যদি ইরান কিছু একটা করতেই যায়, সেটা হয়তো তার আঞ্চলিক প্রক্সিদের মাধ্যমেও করতে পারে। এই প্রক্সিদের মাঝে হিযবুল্লাহ ইতোমধ্যেই যুদ্ধের মাঝে রয়েছে। ইয়েমেনের হুথিদের সাথেও থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে পশ্চিমাদের। এছাড়াও ইরাক এবং সিরিয়াতেও ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া রয়েছে। তবে 'বিবিসি' বলছে যে, ইরান যা-ই করুক না কেন, এটা ইস্রাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর চাইতে কম কিছু হবে; কারণ তারা জানে যে, সেই যুদ্ধ তারা জিততে পারবে না।

হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার কয়েকদিন আগেই ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন যে, ইরান যুদ্ধ চায় না; শান্তি চায়। ইরান পুরো অঞ্চলে অস্থিরতার কারণ হতে চায় না। তিনি বলেন যে, যুদ্ধ যদি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কেউই তা থেকে লাভবান হবে না। শুধু ইস্রাইলই চায় পুরো অঞ্চল জুড়ে যুদ্ধ হোক। একইসাথে তিনি ইস্রাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পশ্চিমা দেশগুলির দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করেন। তবে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে ইরান যে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক, তা তিনি পরিষ্কার করেছেন। পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ইরান যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলির সাথে স্বাক্ষরিত ২০১৫ সালের চুক্তিতে ফেরত যেতে চায়; যেই চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে গিয়েছিল।

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'আটলান্টিক কাউন্সিল'এর এক লেখায় বলছেন যে, হিযবুল্লাহ হলো ইরানের জন্যে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো; যার আকাশ, ভূমি এবং সমুদ্রে হামলা করার সক্ষমতা রয়েছে; এবং যা ইস্রাইলের কয়েক মাইলের মাঝে অবস্থিত। হিযবুল্লাহ হলো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা থেকে ইস্রাইল দূরে রাখার জন্যে সবচাইতে বড় ডিটারেন্স। আর এই ডিটারেন্স এখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে!

‘দ্যা আটলান্টিক' পত্রিকার এক বিশ্লেষণে আরাশ আজিজি বলছেন যে, তেহরানে হামাসের নেতা হানিয়াকে হত্যার পর থেকেই আয়াতুল্লাহ খামেনি "কৌশলগত ধৈর্য্য"-নামে এক নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছেন; যার মাধ্যমে ইরান সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে ইস্রাইলের আশেপাশের মিলিশিয়াদেরকে প্রস্তুত করছে। নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে খামেনি তার নীতি পরিবর্তন করবেন কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বৈরুতে ইরানের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে যে, ‘খেলার নিয়ম পরিবর্তন হয়ে গেছে'। কিন্তু তেহরান থেকে যেসব বার্তা আসছে, তা কিন্তু এত শক্ত নয়। তাদের মাঝে কেউ কেউ বলছেন যে, যখনই হিযবুল্লাহর কোন নেতার মৃত্যু হবে, তখনই তার স্থলে অন্য কেউ জায়গা নেবে। ইরানের পক্ষ থেকে বড় কোন হুমকি না আসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধ নেবার অপশন খুব বেশি একটা নেই। আর যদি ইস্রাইলের বেশি ক্ষতি করতেই হয়, তাহলে ইরানের নিজস্ব অবকাঠামো ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে; যা নতুন করে তৈরি করতে কয়েক দশক লেগে যাবে। দ্বিতীয়তঃ ইরানের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়ে শান্তির কথা বলেছেন। ইরান চাইছে, যেন পশ্চিমারা ইস্রাইলকে বাধা দেয়, যাতে করে ইস্রাইলিরা সংঘাতকে আঞ্চলিক রূপ দিতে না পারে। ইরানের এই কথাগুলি হিযবুল্লাহ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতার কথা থেকে বেশ আলাদা; যিনি বলেছেন যে, ইস্রাইলের সাথে সংঘাতের এখন কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না। ইরান চাইছে, যাতে ইরানের উপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে ইরান বিভিন্নভাবে পশ্চিমাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বলছে। একই লক্ষ্যে বাস্তবায়নে ইরানের বর্তমান উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানকে সমর্থন দিয়ে খামেনি তার দেশের কট্টরপন্থীদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।

‘বিবিসি' বলছে যে, ইস্রাইল চাইছে নিজেকে হিযবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু লেবাননের অভ্যন্তরে না ঢুকে ইস্রাইল কিভাবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে, তা মোটেই বোধগম্য নয়। ইস্রাইলের সেনাবাহিনী লেবাননের সীমান্তে ট্রেনিং নিচ্ছে বলে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। হিযবুল্লাহও গত ১৮ বছর ধরে ইস্রাইলের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্যে ট্রেনিং নিচ্ছে। ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর জন্যে লেবাননে প্রবেশ করাটা সহজ; কিন্তু বের হওয়াটা খুব একটা সহজ হবে না; অর্থাৎ বেশ কয়েক মাস লেগে যেতে পারে; যেমনটা গাজার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। 'দ্যা আটলান্টিক'এর বিশ্লেষণে আরাশ আজিজি বলছেন যে, ইরান যদি হিযবুল্লাহকে রক্ষার জন্যে নিজেকে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ায়, তাহলে নেতানিয়াহু হয়তো এই সুযোগে হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরও এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতে পারেন। তবে এতে ইরানের প্রক্সিগুলি, বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের মিলিশিয়ারা হিযবুল্লাহর পক্ষে যুদ্ধে জড়াতে ইরানকে অনুরোধ করতে পারে।

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস বলছেন যে, কেউ কেউ যখন বলছেন যে, ইস্রাইল নাসরাল্লাহকে হত্যার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়নি, তখন প্রশ্ন করা উচিৎ যে, ইস্রাইল কেন জানাবে? ইস্রাইল কখনোই এই ব্যাপারগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়না। সকলেই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ করবে, যাতে ইস্রাইল সেটা না করে। এর উপর আবার রয়েছে অপারেশনাল সিকিউরিটির ব্যাপার; ইস্রাইল যুক্তরাষ্ট্রকে জানালে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইস্রাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা এমনই – যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ইস্রাইলের খুব কাছে থেকে সমর্থন দিয়ে যেতে থাকবে। পলিমেরোপলাস-এর কথাগুলি ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনাতে ইস্রাইল কিভাবে সংঘাতকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে। অপরদিকে ইরান যে তার নিজস্ব স্বার্থ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবরোধকে তুলে নেয়ার ব্যাপারটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, তার প্রমাণ হিসেবে খামেনির "কৌশলগত ধৈর্য্য"র নীতিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। একারণেই ইস্রাইল যখন সারা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন ইরান শান্তির কথা বলছে। হামাস নেতা হানিয়ার হত্যার পর নাসরাল্লাহর হত্যার ঘটনা ইরানের কট্টরপন্থীদের উত্তেজিত করলেও তা ইরানের বাস্তবতা-ভিত্তিক চিন্তাকে পরিবর্তন করে ফেলার মতো শক্তিশালী না-ও হতে পারে।

Thursday 26 September 2024

লেবাননে ইস্রাইলের 'ডিজিটাল হামলা' - যুদ্ধ-সংঘাতের নতুন ধরণের সূচনা?

২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২৪
 
ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্সের জন্যে এটা অত্যন্ত সাহসী একটা পদক্ষেপ ছিল; যার জন্যে মাসের পর মাস পরিকল্পনা প্রয়োজন; এবং একইসাথে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অনেকগুলি অংশকে একত্রে এসে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে হিযবুল্লাহর সাপ্লাই চেইন সম্পর্কে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করাটা হবে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তা-ই নয়, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে করে হিযবুল্লাহ তাদের প্রযুক্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। হয়তো মিথ্যা তথ্য ছড়াবার মাধ্যমে মোবাইল ফোন থেকে সরে আসার জন্যে হিযবুল্লাহর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা হয়ে থাকতে পারে।


গত ১৭ই সেপ্টেম্বর হঠাত করেই লেবাননে হাজার হাজার পেইজার একত্রে বিস্ফোরিত হয় এবং পরেরদিন ১৮ই সেপ্টেম্বর বহু ওয়্যারলেস ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়। সশস্ত্র সংগঠন হিযবুল্লাহ বলছে যে, তাদের সংগঠনকেই টার্গেট করা হয়েছিল; যাতে তাদের কমপক্ষে ৮ জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। পরেরদিন জানাজার নামাজের সময় ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে হিযবুল্লাহর তিনজন সদস্য নিহত হয়। পেইজার বিস্ফোরণে দুইজন শিশুসহ কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু ছাড়াও প্রায় ৩ হাজার মানুষের আহত হবার খবর পাওয়া গেছে। লেবাননে ইরানের রাষ্ট্রদূতও আহতদের মাঝে রয়েছেন। আর ওয়াকিটকি বিস্ফোরণে আরও ২০ জনসহ বেশ কয়েক'শ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। 'সিবিসি নিউজ' বলছে যে, বেসামরিক জনগণ বা শিশুরা কিভাবে হতাহত হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। তবে খুব সম্ভবতঃ বিস্ফোরিত ডিভাইসের কাছাকাছি থাকার কারণে তারা হতাহত হয়েছে। লেবাননের ডাক্তাররা বলছেন যে, বেশিরভাগ হতাহত মানুষ তাদের হাত এবং মুখমন্ডলে আঘাত পেয়েছে।


সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে বিস্ফোরক ঢোকানো হয়েছিল

'আল জাজিরা'র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে সকলেই প্রশ্ন করছেন যে, কিভাবে প্রায় ৫ হাজার ইলেকট্রনিক ডিভাইস একত্রে বিস্ফোরিত হতে পারে? খুব সম্ভবতঃ ডিভাইসগুলির ভেতরে স্বল্প পরিমাণে বিস্ফোরক ভরে দেয়া হয়েছিল। আর যখন ডিভাইসগুলির ভাইব্রেশন ফাংশন ম্যানুয়ালি বন্ধ করে দেয়া হয়, তখনই এগুলি বিস্ফোরিত হতে থাকে। এর ফলে এটা নিশ্চিত করা হয় যে, যে ব্যক্তিকে টার্গেট করা হয়েছে, তিনি ডিভাইসের পাশেই রয়েছেন। 'সিবিসি'র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, খুব সম্ভবতঃ ডিভাইসগুলিতে একটা 'বীপ' শব্দ হয়েছে ১০ সেকেন্ড ধরে; যার ফলে ব্যবহারকারী ডিভাইসটাকে হাতে নিয়ে দেখতে চেয়েছে যে, কি বার্তা এসেছে। ঠিক সেই সময়েই সম্ভবতঃ সেটা বিস্ফোরিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, হয়তো ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স ডিভাইসগুলিতে হ্যাক করে ব্যাটারি ওভারহীট করার মাধ্যমে সেগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ‘স্কাউক্রফট মিডল-ইস্ট সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ'এর ডিরেক্টর জনাথন প্যানিকফ 'সিবিসি'কে বলছেন যে, হ্যাকিংএর মাধ্যমে একসাথে এতগুলি ডিভাইসে এভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব নয়। আর বিস্ফোরণের আকারও বলে দিচ্ছে যে, এটা ব্যাটারির মাধ্যমে হয়নি; এখানে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা ফিলিপ ইনগ্রাম ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মিডিয়া 'বিএফবিএস ফোর্সেস নিউজ'কে বলছেন যে, পেইজারের মতো এত ছোট যন্ত্রের ভেতরে বিস্ফোরক ভরা সম্ভব হতে পারে। তিনি জার্মানিতে তার ইউনিটের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন যে, তারা বিভিন্ন সার্ভেইল্যান্স ডিভাইসের ভেতরে বিস্ফোরক ভরেছিলেন। আগে থেকে তৈরি করা বিস্ফোরক ডিভাইসের ভেতরে কিছুটা জায়গা করে ভরে দেয়া সম্ভব। বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদে বলা হচ্ছে যে, এই ডিভাইসগুলির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাইওয়ানের 'গোল্ড এপোলো'র নাম চলে এলে কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেন যে, লেবাননে বিস্ফোরিত জিনিসগুলি তাদের পণ্য নয়; এগুলি তাদের ব্র্যান্ডিং লাইসেন্স ব্যবহার করে হাঙ্গেরিতে 'বিএসি কনসাল্টিং' নামের একটা কোম্পানি তৈরি করেছে। কিন্তু 'বিএসি' ‘এনবিসি'কে বলছে যে, তারা এই ডিভাইসগুলি তৈরি করেনি; বরং মিডলম্যান হিসেবে কাজ করেছে। 'সিবিসি নিউজ'এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইল কখনোই কোন গোপন হামলা করলেও সেটার দায় স্বীকার করে না। এই হামলার মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন যে, ইস্রাইল তার যুদ্ধের লক্ষ্যকে আরও বড় করতে চায়; যাতে করে উত্তর ইস্রাইলের (লেবাননের সাথে সীমানায়) জনগণকে বাড়িতে ফেরত পাঠানো যায়। সাম্প্রতিক সময়ে হিযবুল্লাহর সাথে লড়াইয়ের কারণে হাজার হাজার ইস্রাইলি এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।

‘রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর পিটার রবার্টস বলছেন যে, এটা অত্যন্ত সাহসী একটা পদক্ষেপ ছিল; যার জন্যে মাসের পর মাস পরিকল্পনা প্রয়োজন; এবং একইসাথে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অনেকগুলি অংশকে একত্রে এসে এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে হিযবুল্লাহর সাপ্লাই চেইন সম্পর্কে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করাটা হবে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তা-ই নয়, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে করে হিযবুল্লাহ তাদের প্রযুক্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। হয়তো মিথ্যা তথ্য ছড়াবার মাধ্যমে মোবাইল ফোন থেকে সরে আসার জন্যে হিযবুল্লাহর সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা হয়ে থাকতে পারে।

'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ'এর মাইরাভ জনস্টাইন 'আল জাজিরা'কে বলছেন যে, ব্যাপারটা এমন নয় যে, ইস্রাইল বহু আগে থেকেই হিসেব করে রেখেছিল যে, এই দিনই তারা এই হামলা করবে। বরং খুব সম্ভবতঃ হিযবুল্লাহ কোন ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ হয়ে যাবার কারণে ইস্রাইলকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে, এটা করলে এখনই করতে হবে। 'রয়টার্স'এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইল খুব সম্ভবতঃ ডিভাইসের শিপমেন্টের খবর আগে থেকে পেয়ে সেখানে ৩ গ্রামের মতো বিস্ফোরক ভরে দিয়েছিল। তবে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' বলছে যে, ‘বিএসি' প্রকৃতপক্ষে একটা 'শেল কোম্পানি' বা নাম-সর্বস্ব সংস্থা। হিযবুল্লাহ পেইজার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেবার আগেই ইস্রাইলিরা পেইজার প্রস্তুতকারক হিসেবে একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। 'বিএসি' বিভিন্ন সাধারণ ক্রেতার জন্যে বিভিন্ন রকমের পেইজার তৈরি করেছে। এর অর্থ হলো, ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স শুধু সাপ্লাই চেইনের ভেতরেই ঢুকেনি; তারা নিজেরাই ছিল পেইজারের সাপ্লাই চেইন। ‘ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি'র ম্যাথিউ লেভিট 'সিবিসি'কে বলছেন যে, একটা ফ্রন্ট কোম্পানি তৈরি করে সাপ্লাই চেইনের ভেতরে ঢুকে পড়া; সেটাও আবার এমনভাবে করা যাতে করে তাদের শত্রুর চোখে ধরা না পড়ে বা তাদের শত্রু এই সাপ্লাই চেইনের উপর বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলে; এরপর ডিভাইসগুলি এমনি-এমনি বসে থাকবে সময়ের অপেক্ষায়; এরপর এগুলিকে এমনভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো, যাতে করে কে এটা করেছে সেটা বোঝা না যায় - এই পুরো কাজটা দেখিয়ে দেয় যে, এখানে ইন্টেলিজেন্সের অভিজ্ঞতা এবং সর্বশেষ প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটেছে।
 
হিযবুল্লাহ পেইজার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেবার আগেই ইস্রাইলিরা পেইজার প্রস্তুতকারক হিসেবে একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। 'বিএসি' বিভিন্ন সাধারণ ক্রেতার জন্যে বিভিন্ন রকমের পেইজার তৈরি করেছে। এর অর্থ হলো, ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স শুধু সাপ্লাই চেইনের ভেতরেই ঢুকেনি; তারা নিজেরাই ছিল পেইজারের সাপ্লাই চেইন। 


মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অবস্থান নির্ণয় – পেইজার ব্যবহারের কারণ

'ফোর্সেস নিউজ'এর সাথে কথা বলতে গিয়ে 'রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট' বা 'রুসি'র প্রাক্তন ডিরেক্টর পিটার রবার্টস বলছেন যে, হিযবুল্লাহ এবছরের শুরুতেই বলেছিল যে, মোবাইল ফোন দ্বারা খুব সহজেই অবস্থান বের করে ফেলা যায়। একারণেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, মোবাইল ফোনের স্থলে পেইজার ব্যবহার করবে। 'গ্লোবাল সাইবার রিস্ক'এর জোডি ওয়েস্টবি 'আল জাজিরা'কে বলছেন যে, মোবাইল ফোনের চাইতে পেইজার-এর অবস্থান জানা এবং সেগুলি থেকে হ্যাক করে তথ্য চুরি করা অপেক্ষাকৃত কঠিন। হয়তো তারা নিজেদের যোগাযোগকে আরও শক্তিশালী করতেই পেইজারের মতো পুরোনো প্রযুক্তিতে গিয়েছিলো। নিঃসন্দেহে ইস্রাইল তাদের শত্রুর 'লাইন অব কমিউনিকেশন'এর উপর এই আক্রমণ করেছে। এটা একটা 'ডিজিটাল ওয়ারফেয়ার' এবং এটা বহুদিন ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটাকে একটা 'অটোনমাস' বা স্বচালিত আক্রমণও বলা যেতে পারে। তবে যেহেতু এর মাধ্যমে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন, তাই এটা যুদ্ধের নিয়মের মাঝে পরে কিনা, সেব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ফিলিপ ইনগ্রাম মনে করছেন যে, খুব সম্ভবতঃ হিযবুল্লাহর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নতুন ডিভাইস বাকিদের আগে পেয়ে থাকবেন। কাজেই হয়তো এই কর্মকর্তাদের মাঝেই অনেকে হতাহত হয়ে থাকতে পারে। তবে এখন মোবাইল ফোনের পর পেইজার এবং ওয়াকিটকির উপর যদি হামলা হয়ে থাকে, তাহলে হিযবুল্লাহর নেতৃত্ব এখন কোন প্রযুক্তির উপরেই ভরসা রাখতে পারবে না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের আলোচনাগুলি সামনা-সামনি বসে করতে চাইবেন। অপরদিকে ইস্রাইলিরা লেবানন এবং লেবাননের বাইরেও সকল হাসপাতালের উপর খেয়াল রাখবে। তারা নিঃসন্দেহে হাসপাতাল রেকর্ডের উপরে নজরদারি করে থাকে। এই রেকর্ডগুলি থেকে ইস্রাইলিরা হিযবুল্লাহর নেতৃত্বের কে কার সাথে যোগাযোগ রাখছে সেটা বের করতে পারবে এবং সিগনালস ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগের উপর নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে পারবে। অর্থাৎ ইস্রাইলিরা একটা সমস্যা তৈরি করে এখন দেখছে যে কে কোথায় রয়েছে এবং সেই হিসেবে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
 
এমন কিছু ব্যাকআপের দিকে অনেকেই ঝুঁকতে পারে, যেগুলি ডিজিটাল যুগে প্রবেশের আগে মানুষের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল; অথবা যেসব প্রযুক্তি দুনিয়া থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। সেগুলি হয়তো দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম না-ও হতে পারে; কিন্তু অন্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডিজিটাল ডিভাইসের সাপ্লাই চেইনের বাইরে হবার কারণে সেগুলি অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পাবে। লেবাননের এই ঘটনা মানুষের সন্দেহপ্রবণতা বাড়াবে এবং ষড়যন্ত্র থিউরির প্রসার ঘটাবে; যা একদিকে যেমন স্বল্প পরিসরে হলেও 'ডি-ডিজিটাইজেশন' ঘটাবে, তেমনি বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থাকে আরও বেশি করে উস্কে দেবে।


যুদ্ধ-সংঘাতের নতুন ধরণ

ফিলিপ ইনগ্রাম মনে করছেন যে, এই ঘটনার পর বিশ্বের সকল নিরাপত্তা বাহিনী এবং ইন্টেলিজেন্স সংস্থা চিন্তা করতে বাধ্য হবে যে, তাদের ডিভাইসের সাপ্লাই চেইন তাদের নিয়ন্ত্রণে কিনা, অথবা অন্য কেউ এর মাঝে ঢুকে কোনকিছু পরিবর্তন করে দিচ্ছে কিনা। সাপ্লাই চেইনের স্বল্প সংখ্যক ডিভাইসের উপর হামলা খুব বেশি একটা না হলেও এটা এর আগে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। কিন্তু এতবড় আকারে এর আগে কখনোই হয়নি। বিশেষ করে একটা ডিভাইসকে এভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ঘটনা সত্যিই নতুন কিছু। পিটার রবার্টস বলছেন যে, বাণিজ্যিক উৎস থেকে বিভিন্ন ডিভাইস সংগ্রহ করার সময় কতটা বিবেচনা, বাছাই বা তদন্ত করা হয়েছে সেটা এখন একটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যাপারটাকে হয়তো এতকাল খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর মাঝে খুব সম্ভবতঃ প্রক্রিয়াগত কিছু পরিবর্তন আসতে পারে; যার মাধ্যমে এরূপ আক্রমণ থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা হবে। বিশেষ করে নতুন কোন ডিভাইসের ভেতর প্রযুক্তিগত দিকগুলিকে আরও বেশি করে খুঁটিয়ে দেখা হবে এবং এর মাঝে কোন দুর্বলতা রয়েছে কিনা, সেটা খুঁজে দেখা হবে। তবে যে ব্যাপারটা নিয়ে সকলে বেশি চিন্তিত হবে তা হলো, এর আগে এরূপ বিস্ফোরণ ঘটানো ছিল কোন এক ব্যক্তিকে হত্যার জন্যে। কিন্তু এভাবে যদি বিশাল আকারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তাহলে সেটাকে 'পার্সোনালাইজড ওয়ারফের'এর নতুন একটা যুগ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। তবে একবার এরূপ ঘটনা ঘটে যাবার পর নতুন করে আবারও এটা ঘটানো বেশ কঠিন হবে।

'গ্লোবাল সাইবার রিস্ক'এর জোডি ওয়েস্টবি বলছেন যে, হাঙ্গেরির যে কোম্পানির নাম এই ঘটনায় এসেছে, সেই কোম্পানির সাথে আর কার কার যোগাযোগ রয়েছে, সেটা হয়তো খতিয়ে দেখা জরুরি। যদি 'গোল্ড এপোলো' এখানে জড়িত না-ও থাকে, তাহলেও এটা যে একটা দুর্বল জায়গা, যেটাকে কেউ ব্যবহার করতে পারে, সেটা নিশ্চিত। তবে এরকম সাইবার হামলা কিন্তু একেবারে নতুন নয়। এক্ষেত্রে 'স্ট্রাক্সনেট'এর কথা বলা যেতে পারে। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, তারা সাইবার 'ব্যাকডোর' ব্যবহার করে ইরানের পারমাণবিক সেন্ট্রিফিউজ ধ্বংস করেছিল। এর আগে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ১৯৮২ সালে কানাডা থেকে সাইবার ব্যাকডোর ব্যবহার করে বিস্ফোরণের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের 'ট্রান্স সাইবেরিয়ান পাইপলাইন' অকার্যকর করে ফেলা হয়েছিল। তবে এর আগেও এই ঘটনাগুলি ঘটানো হলেও সেগুলি এবারের মতো মানুষ এবং বিশেষ করে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ঘটানো হয়নি। 'সিবিসি' মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ১৯৯৬ সালে ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স একটা ফোনের ভেতর ১৫ গ্রামের বিস্ফোরক ঢুকিয়ে সেটাকে হামাসের বোমা নির্মাতা ইয়াহিয়া আয়াশকে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তার ফোনে একটা কল এসেছিল; তিনি কল রিসিভ করার সাথেসাথেই ইস্রাইলের একটা গোয়েন্দা বিমান থেকে ফোনের কথা শুনে নিশ্চিত করা হয়েছিল যে, এটা ইয়াহিয়া। তখনই ফোনটা বিস্ফোরিত হয় এবং ইয়াহিয়া মারা যান।

হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইস্রাইলের এই 'ডিজিটাল ওয়ারফেয়ার' বা 'পার্সোনালাইজড ওয়ারফেয়ার' নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে, যা শুধুমাত্র লেবাননের সংঘাতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। সামনের দিনে সকল রাষ্ট্রই যেমন যোগাযোগের বিভিন্ন ডিভাইসের নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান থাকবে বা সেগুলির সাপ্লাই চেইনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে, তেমনি একটামাত্র ডিভাইসের উপর নির্ভর করার প্রবণতাও কমে আসবে। এমন কিছু ব্যাকআপের দিকে অনেকেই ঝুঁকতে পারে, যেগুলি ডিজিটাল যুগে প্রবেশের আগে মানুষের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল; অথবা যেসব প্রযুক্তি দুনিয়া থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। সেগুলি হয়তো দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম না-ও হতে পারে; কিন্তু অন্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা ডিজিটাল ডিভাইসের সাপ্লাই চেইনের বাইরে হবার কারণে সেগুলি অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পাবে। লেবাননের এই ঘটনা মানুষের সন্দেহপ্রবণতা বাড়াবে এবং ষড়যন্ত্র থিউরির প্রসার ঘটাবে; যা একদিকে যেমন স্বল্প পরিসরে হলেও 'ডি-ডিজিটাইজেশন' ঘটাবে, তেমনি বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থাকে আরও বেশি করে উস্কে দেবে।