৩০শে সেপ্টেম্বর ভোরে ইস্রাইল ইয়েমেনে হামলা করে। 'সিএনএন'এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইলের 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান আকাশ-থেকে-আকাশে রিফুয়েলিংএর মাধ্যমে প্রায় দু'হাজার কিঃমিঃ দূরত্বে ইয়েমেনের হুথিদের হাতে থাকা হোদেইদা বন্দরে বোমাবর্ষণ করে। ইস্রাইলি বাহিনী যখন গাজায় হামলা বন্ধের ঘোষণা না দিয়েই লেবাননে ব্যাপক হামলা শুরু করেছে, তখন ইয়েমেনে এই হামলা সংঘাতকে আঞ্চলিক রূপ দিচ্ছে। ইস্রাইল বলছে যে, তারা সংঘাতকে ছড়িয়ে দিতে চায় না। কিন্তু কেউ যদি ইস্রাইলে হামলার চেষ্টা চালায়, তাহলে সে যেখানেই থাকুক, তার বিরুদ্ধে ইস্রাইল ব্যবস্থা নেবে। ২৮শে সেপ্টেম্বর ইস্রাইল ঘোষণা দেয় যে, তারা হিযবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে। এই ঘটনার পর থেকে অনেকেই আলোচনা করছেন যে, সামনের দিনগুলিতে ইস্রাইল, হিযবুল্লাহ এবং ইরান কে কি পদক্ষেপ নিতে পারে।
‘বিবিসি'র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, হিযবুল্লাহ হয়তো তার নেতৃত্বের হত্যার পর কিছুটা বিচলিত থাকবে। বিশেষ করে কিছুদিন আগেই হিযবুল্লাহর যোগাযোগ যন্ত্রপাতির উপর ইস্রাইলি হামলার পর হিযবুল্লাহ নিজেদের গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিতে পারে। তাদের মাঝে অনেকেই চাইবে তাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ইস্রাইলের বোমা হামলায় ধ্বংস হবার আগেই ইস্রাইলের শহরগুলির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। কিন্তু সেটা করলে ইস্রাইলের প্রতিশোধ হবে আরও বেশি ভয়াবহ। বিশেষ করে ইস্রাইল লেবাননের শহর এবং অবকাঠামোর উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে; এমনকি ইরানের উপরেও হামলা করে বসতে পারে।
‘বিবিসি' বলছে যে, হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার পরপরই ইরান আয়াতুল্লাহ খামেনিকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে। খুব সম্ভবতঃ তাদের একটা ভয় কাজ করছে যে, ইস্রাইল হয়তো খামেনিকেও হত্যার চেষ্টা করে ফেলতে পারে। তবে প্রায় দুই মাস হয়ে গেলো, ইরান এখনও পর্যন্ত গত ৩১শে জুলাই হামাস নেতা ইসমাঈল হানিয়াকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়নি। তবে নাসরাল্লাহর হত্যার পর তেহরানে কট্টরপন্থীরা কিছু একটা করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করতে থাকবে। যদি ইরান কিছু একটা করতেই যায়, সেটা হয়তো তার আঞ্চলিক প্রক্সিদের মাধ্যমেও করতে পারে। এই প্রক্সিদের মাঝে হিযবুল্লাহ ইতোমধ্যেই যুদ্ধের মাঝে রয়েছে। ইয়েমেনের হুথিদের সাথেও থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে পশ্চিমাদের। এছাড়াও ইরাক এবং সিরিয়াতেও ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া রয়েছে। তবে 'বিবিসি' বলছে যে, ইরান যা-ই করুক না কেন, এটা ইস্রাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর চাইতে কম কিছু হবে; কারণ তারা জানে যে, সেই যুদ্ধ তারা জিততে পারবে না।
হাসান নাসরাল্লাহর হত্যার কয়েকদিন আগেই ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন যে, ইরান যুদ্ধ চায় না; শান্তি চায়। ইরান পুরো অঞ্চলে অস্থিরতার কারণ হতে চায় না। তিনি বলেন যে, যুদ্ধ যদি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে কেউই তা থেকে লাভবান হবে না। শুধু ইস্রাইলই চায় পুরো অঞ্চল জুড়ে যুদ্ধ হোক। একইসাথে তিনি ইস্রাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পশ্চিমা দেশগুলির দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করেন। তবে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে ইরান যে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক, তা তিনি পরিষ্কার করেছেন। পারমাণবিক প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ইরান যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলির সাথে স্বাক্ষরিত ২০১৫ সালের চুক্তিতে ফেরত যেতে চায়; যেই চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে গিয়েছিল।
মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক 'আটলান্টিক কাউন্সিল'এর এক লেখায় বলছেন যে, হিযবুল্লাহ হলো ইরানের জন্যে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো; যার আকাশ, ভূমি এবং সমুদ্রে হামলা করার সক্ষমতা রয়েছে; এবং যা ইস্রাইলের কয়েক মাইলের মাঝে অবস্থিত। হিযবুল্লাহ হলো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা থেকে ইস্রাইল দূরে রাখার জন্যে সবচাইতে বড় ডিটারেন্স। আর এই ডিটারেন্স এখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে!
‘দ্যা আটলান্টিক' পত্রিকার এক বিশ্লেষণে আরাশ আজিজি বলছেন যে, তেহরানে হামাসের নেতা হানিয়াকে হত্যার পর থেকেই আয়াতুল্লাহ খামেনি "কৌশলগত ধৈর্য্য"-নামে এক নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছেন; যার মাধ্যমে ইরান সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে ইস্রাইলের আশেপাশের মিলিশিয়াদেরকে প্রস্তুত করছে। নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে খামেনি তার নীতি পরিবর্তন করবেন কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বৈরুতে ইরানের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে যে, ‘খেলার নিয়ম পরিবর্তন হয়ে গেছে'। কিন্তু তেহরান থেকে যেসব বার্তা আসছে, তা কিন্তু এত শক্ত নয়। তাদের মাঝে কেউ কেউ বলছেন যে, যখনই হিযবুল্লাহর কোন নেতার মৃত্যু হবে, তখনই তার স্থলে অন্য কেউ জায়গা নেবে। ইরানের পক্ষ থেকে বড় কোন হুমকি না আসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ ইস্রাইলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধ নেবার অপশন খুব বেশি একটা নেই। আর যদি ইস্রাইলের বেশি ক্ষতি করতেই হয়, তাহলে ইরানের নিজস্ব অবকাঠামো ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে; যা নতুন করে তৈরি করতে কয়েক দশক লেগে যাবে। দ্বিতীয়তঃ ইরানের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়ে শান্তির কথা বলেছেন। ইরান চাইছে, যেন পশ্চিমারা ইস্রাইলকে বাধা দেয়, যাতে করে ইস্রাইলিরা সংঘাতকে আঞ্চলিক রূপ দিতে না পারে। ইরানের এই কথাগুলি হিযবুল্লাহ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতার কথা থেকে বেশ আলাদা; যিনি বলেছেন যে, ইস্রাইলের সাথে সংঘাতের এখন কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না। ইরান চাইছে, যাতে ইরানের উপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে ইরান বিভিন্নভাবে পশ্চিমাদের সাথে আলোচনায় বসার কথা বলছে। একই লক্ষ্যে বাস্তবায়নে ইরানের বর্তমান উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানকে সমর্থন দিয়ে খামেনি তার দেশের কট্টরপন্থীদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।
‘বিবিসি' বলছে যে, ইস্রাইল চাইছে নিজেকে হিযবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু লেবাননের অভ্যন্তরে না ঢুকে ইস্রাইল কিভাবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে, তা মোটেই বোধগম্য নয়। ইস্রাইলের সেনাবাহিনী লেবাননের সীমান্তে ট্রেনিং নিচ্ছে বলে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। হিযবুল্লাহও গত ১৮ বছর ধরে ইস্রাইলের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্যে ট্রেনিং নিচ্ছে। ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর জন্যে লেবাননে প্রবেশ করাটা সহজ; কিন্তু বের হওয়াটা খুব একটা সহজ হবে না; অর্থাৎ বেশ কয়েক মাস লেগে যেতে পারে; যেমনটা গাজার ক্ষেত্রে দেখা গেছে। 'দ্যা আটলান্টিক'এর বিশ্লেষণে আরাশ আজিজি বলছেন যে, ইরান যদি হিযবুল্লাহকে রক্ষার জন্যে নিজেকে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ায়, তাহলে নেতানিয়াহু হয়তো এই সুযোগে হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আরও এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতে পারেন। তবে এতে ইরানের প্রক্সিগুলি, বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাকের মিলিশিয়ারা হিযবুল্লাহর পক্ষে যুদ্ধে জড়াতে ইরানকে অনুরোধ করতে পারে।
মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা 'সিআইএ'র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলাস বলছেন যে, কেউ কেউ যখন বলছেন যে, ইস্রাইল নাসরাল্লাহকে হত্যার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়নি, তখন প্রশ্ন করা উচিৎ যে, ইস্রাইল কেন জানাবে? ইস্রাইল কখনোই এই ব্যাপারগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়না। সকলেই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ করবে, যাতে ইস্রাইল সেটা না করে। এর উপর আবার রয়েছে অপারেশনাল সিকিউরিটির ব্যাপার; ইস্রাইল যুক্তরাষ্ট্রকে জানালে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইস্রাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা এমনই – যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ইস্রাইলের খুব কাছে থেকে সমর্থন দিয়ে যেতে থাকবে। পলিমেরোপলাস-এর কথাগুলি ব্যাখ্যা করে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনাতে ইস্রাইল কিভাবে সংঘাতকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে। অপরদিকে ইরান যে তার নিজস্ব স্বার্থ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবরোধকে তুলে নেয়ার ব্যাপারটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, তার প্রমাণ হিসেবে খামেনির "কৌশলগত ধৈর্য্য"র নীতিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। একারণেই ইস্রাইল যখন সারা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে, তখন ইরান শান্তির কথা বলছে। হামাস নেতা হানিয়ার হত্যার পর নাসরাল্লাহর হত্যার ঘটনা ইরানের কট্টরপন্থীদের উত্তেজিত করলেও তা ইরানের বাস্তবতা-ভিত্তিক চিন্তাকে পরিবর্তন করে ফেলার মতো শক্তিশালী না-ও হতে পারে।