১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশ নামে নতুন জন্ম নেয়া দেশটিকে পরাশক্তিরা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। সদ্য স্বাধীন দেশটিতে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি ছিল। এই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অন্য দেশগুলি বাংলাদেশের জনগণকে জিম্মি করে নিজেদের কাজ হাসিল করেছে। আর এই কাজে যুক্তরাষ্ট্রের আগে আর কেউ এগিয়ে ছিলনা। চার দশক পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের declassify করা নথিগুলি আমাদের জানান দেয় যে তারা সেসময় খাদ্য নিয়ে কি পরিমাণ রাজনীতি করেছে। খাদ্যশস্য দেবার চুক্তি করার আগে শর্ত পূরণ করিয়েছে। বামপন্থী কিউবার কাছে পাটজাত পণ্য বিক্রি করার ‘অপরাধে’ ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ তিন সপ্তাহ দেরি করিয়েছে, যা কিনা ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষে বহু মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল। কি দম্ভটাই না তাদের ছিল তখন। ঢাকায় তাদের অফিসের সামনে একটি পোস্টার কেন লাগানো হয়েছিল, তা কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছিল। সরকারের সদস্যরা কেন উমুক দেশকে সমর্থন করেছিলেন, তার জন্যে আমাদের কূটনীতিককে ডেকে শাসিয়েছে; খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছে। সরকারী দলের লোকেরা কেন আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলে, এ নিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে। এই দম্ভ আজ কোথায়? এখন নিজেদের দূরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে বিভিন্ন দেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। এক দেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে আরেক দেশের সাহায্য নিতে হচ্ছে। এজন্যেই প্রশ্ন করেছিলাম আগের এক লেখায় – আমরা হেরে যাওয়া দলের খেলোয়াড় কেন থাকবো?
মানবতার জন্যে আফ্রিকা
যাই হোক, বাংলাদেশ যে বহু দূর এসেছে, তা এখন আর বলে দিতে হবে না। ১৯৭০-এর দশকে কিসিঞ্জার সাহেবের “Basket Case” এখন খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে চাইছে। খাবারের কষ্ট কেমন, সেটা এই দেশের মানুষকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। এদেশের ভুভুক্ষু মানুষগুলিকে জিম্মি করে খাদ্যশস্যের জাহাজ নিয়ে রাজনীতি চলেছে একসময়। সারা দুনিয়াতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে শোষণ করেছে তারা। আমরা এই জঘন্য মানসিকতা তাদের কাছ থেকে শিখবো না অবশ্যই। আর এই জঘন্য চিন্তা যেহেতু এখন পুরোপুরি নিম্নমুখী, তাই আঙ্গুরের আশায় তাদের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন শেষ। আমরা বিপদের সময়ে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপকে সাহায্য করেছি; সামনের দিনগুলিতেও করবো। ভারতের চোখ রাঙ্গানিতে কাজ হবে না। আমাদের সৈন্যদের পরিশ্রমে আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ শান্তিতে ফিরেছে। জাতিসঙ্ঘের সমস্যাসঙ্কুল মিশনের কাঁটাতারে আটকে না গেলে আমরা হয়তো আরও ভালো কাজ করতে পারতাম। যা-ই হোক; কাজ আমরা করেছি; করছি। কালো মানুষগুলিকে বন্ধুর মতো নিতে আমাদের কষ্ট হয়নি। পশ্চিমা বর্ণবাদ আমাদের সৈনিকদের মাঝে কাজ করেনি। আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে। মার্কিনীরা ১৯৭০-এর দশকে থাইল্যান্ডকে যেভাবে রঙ্গিন “বৃন্দাবন” বানিয়েছিল তাদের ভিয়েতনামে যুদ্ধরত সৈন্যদের যৌন-আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে, আমরা সেটা আফ্রিকাতে করতে পারিনি আমাদের ইসলামিক বিশ্বাসের কারণে। মার্কিন ব্যবস্থাতে দুনিয়া চললেও আমাদের বিশ্বাসকে মুছে ফেলতে পারেনি তারা। তাই আফ্রিকার দেশে দেশে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে বাংলায়। কালো কালো শিশুদের মাঝে সেনারা তাদের দেশে ফেলে আসা সন্তানদের দেখতে পেয়েছেন; পশ্চিমা পাদ্রীদের মতো pedophilia কেইস আমরা হতে পারিনি। মার্কিন মুল্লুকের সাদা-কালো বৈষম্য আমাদের কখনো স্পর্শ করেনি, কারণ ইসলামে সাদা-কালো ব্যাপারটার অস্তিত্বই নেই; তাই এখানে অনেক ফেয়ার-এন্ড-লাভলি মাখিয়েও আমাদের সৈন্যদের হাতে আফ্রিকাকে ধ্বংস করানো যায়নি।
উন্নয়নের জন্যে আফ্রিকা
আফ্রিকার এই দেশগুলি অনেক সময়েই অজন্মার কারণে খাদ্যসংকটে পতিত হয়েছে। পশ্চিমা সম্পদশালীদের সম্পদ কুক্ষিগত করার কারণে, আর Consumerism-এর নামে হাজার হাজার টন খাদ্য অপচয় করার কারণে আফ্রিকাতে দুর্ভিক্ষে মারা গেছে বহু মানুষ। আমরা আমাদের উদ্ধৃত্ত খাদ্যশস্য আফ্রিকাতে পাঠালে এটা সবদিক থেকেই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। আমরা তো আর ঘুর্নিঝড় সিডরের পর ভারত আমাদের সাথে চাল নিয়ে যে কূটনীতি করেছিল, সেটা আফ্রিকার সাথে করবো না। বাংলাদেশের অনেক পণ্যই এখন বাজার খুঁজছে পৃথিবীব্যপী। গত দুই দশকে যে পরিমাণ শিল্পায়ন এই দেশে হয়েছে, তাতে অল্প কিছু অদরকারী পণ্য এবং কিছু হাই-টেক পণ্য বাদ দিলে বেশিরভাগ জিনিসই এই দেশে তৈরি হয়ে থাকে। ভারত তার নিজের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যকে ভয় পায় বলেই এখন আফ্রিকাতে এসব পণ্যের বাজার তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের কর্পোরেট গ্রুপগুলির একটা বড় রপ্তানি আয় আসছে আফ্রিকা থেকে, যা দিনে দিনে বাড়ছে। জাহাজ-ভর্তি পণ্য যাচ্ছে আফ্রিকাতে। আফ্রিকাতে ইলেকট্রনিক্স পণ্য নিয়ে ঢুকেছে ওয়াল্টন। ইথিওপিয়ার মোটসাইকেল বাজারে ঢুকেছে রানার মোটরসাইকেল। কেনিয়া, উগান্ডা, মোজাম্বিক, তাঞ্জানিয়া-সহ পূর্ব-আফ্রিকার দেশগুলি ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়াতে বাংলাদেশ তৈরি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে। আফ্রিকার অনেক দেশেই ঔষধের বিরাট ঘাটতি রয়েছে, যা আমরা মেটাতে পারি। আমাদের ঔষধে আফ্রিকার মানুষের জীবন বাঁচলে সেটা আমাদের সাফল্যের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় দিক হবে। আমাদের কৃষি প্রযুক্তি আফ্রিকার খাদ্য-সংকট মেটাতে সহায়তা করতে পারে। নির্মাণ সামগ্রী তৈরিতে আমরা অগ্রগতি করতে পেরেছি; তাই আমরা সেক্ষেত্রে আফ্রিকাকে প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে পারি। আমরা নদীর দেশের মানুষ হওয়ায় পশ্চিম আফ্রিকার নিজের নদী, মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো নদী এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার নীল নদে আমরা আমাদের নদীব্যবস্থাপনা এবং নৌ-পরিবহণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। বর্তমানে কঙ্গো নদে না থাকলেও নীল নদ (দক্ষিণ সুদান) এবং নিজের নদীতে (মালি) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দু’টি কনটিনজেন্ট কাজ করছে।
ভূগোলের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে আজকে আফ্রিকার গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের আলাদাভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে। অথচ ভূগোল পড়লে খুব সহজেই বোঝা হয়ে যেত যে আফ্রিকাকে ছাড়া আমরা সামনের দিনগুলিতে হোঁচট খাবো। |
আর আমাদের যেগুলি নেই, তা আফ্রিকাতে রয়েছে ভুরি ভুরি। বাংলাদেশ আস্তে আস্তে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতের দিকে যাচ্ছে। আফ্রিকা এক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক হতে পারে কয়লা সরবরাহ করে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মোজাম্বিক থেকে কয়লা আমদানির বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। আর আমাদের নতুন গঠিত ভারী শিল্পগুলিতে লোহা সরবরাহ করার জন্যে গিনি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হতে পারে ভালো একটি উতস। ছোট্ট দেশ গিনিতে রয়েছে ১৮০ কোটি টন লোহার খনি! উপরন্তু সারা দুনিয়ার ২৫% বক্সাইট (এলুমিনিয়ামের খনি) রয়েছে এই দেশেই! গিনির প্রতিবেশী দেশ সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া এবং আইভোরি কোস্টে আমাদের সৈন্যরা শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করছে বহু বছর ধরে। এছাড়াও আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর খনি আফ্রিকাতে প্রচুর রয়েছে, যেমন কঙ্গো ও জাম্বিয়ার কপার (তামা), কঙ্গোর জিঙ্ক (দস্তা), দক্ষিণ আফ্রিকার নিকেল ও ক্রোমিয়াম, কঙ্গো, জাম্বিয়া এবং ক্যামেরুনের কোবাল্ট, ইত্যাদি। বাংলাদেশ সামনের দিনগুলিতে যেদিকে এগুতে চাইছে, তাতে আফ্রিকার খনিগুলি আমাদের জন্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় হবে। বাংলাদেশের বাইরে কোন এলাকায় যদি বিনিয়োগ করতে হয়, সেক্ষেত্রে আফ্রিকা হওয়া উচিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকায় বিনিয়োগই পারবে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে কৌশলগত পণ্যগুলির সরবরাহ নিশ্চিত করতে।
এক মহাদেশ; অনেক করণীয়……
১. সামনের দিনগুলিকে চিন্তা করে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা ডেস্ককে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আফ্রিকাতে আমাদের মিশনগুলিকে সকল দিক থেকে শক্তিশালী করতে হবে। ভালো নেগোশিয়েটরদেরকে আফ্রিকায় পোস্টিং দিতে হবে। আফ্রিকায় পূর্ব অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত লোকদের প্রাধান্য দিতে হবে।
২. বহু বছর যাবত আফ্রিকাতে বাংলাদেশের আট থেকে নয় হাজার সৈন্য মোতায়েন রয়েছে, কিন্তু আমাদের সামরিক বাহিনীতে কোন ‘আফ্রিকা কমান্ড’ নেই। আফ্রিকাতে কর্মরত আমাদের সৈন্য এবং সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং লজিস্টিক্যাল ব্যাকআপ দেবার ব্যবস্থা করতে এর কোন বিকল্প নেই।
৩. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা ডেস্ক, সামরিক বাহিনী আফ্রিকা কমান্ড এবং শিল্পক্ষেত্রে আফ্রিকাতে বাণিজ্য করতে ইচ্ছুক কর্পোরেটদের কৌশলগতভাবে এক লক্ষ্যের ছত্রছায়ায় বিবেচনা করে ঢালাওভাবে সাজাতে হবে। এই কাজটাকে শক্ত ভিত্তি দিতে ‘আফ্রিকা স্টাডি গ্রুপ’ তৈরি করতে হবে, যেখানে থাকবে আফ্রিকা থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা নেয়া সামরিক সদস্যরা, কূটনীতিকেরা, বাণিজ্য প্রতিনিধিরা, শিক্ষাবিদেরা এবং আরও অনান্য সদস্যরা। এরা আফ্রিকা আফ্রিকার উপরে গবেষণা ছাড়াও আমাদের অভিজ্ঞতাকে আরও তীক্ষ্ণ করবেন এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে পরামর্শ দেবেন। আফ্রিকা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাকে তারা মানুষের মাঝে ছড়াবেন বই-পুস্তকের মাধ্যমে, পত্র-পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারের মাধ্যমে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নীতিনির্ধারণী সংগঠন এবং ব্যবসায়িক সংগঠনে তারা কথা বলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবেন।
৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভূগোল না পড়ার দৈন্যদশা নিয়ে এর আগেও লিখেছি। আফ্রিকার ভূগোলকে নখদর্পনে আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আফ্রিকা সম্পর্কে পড়াতে হবে। বিজনেস স্কুলগুলিতে ছাত্রদের Strategic Perspective দিতে হবে; বোঝাতে হবে যে আফ্রিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকা নিয়ে কেইস স্টাডি দিতে হবে ছাত্রদের; শিখতে হবে আফ্রিকায় ব্যবসা এগিয়ে নিতে কি করতে হবে। সোশাল সাইন্সে আফ্রিকা সম্পর্কে পড়াতে হবে। আফ্রিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। আফ্রিকায় অভিজ্ঞতাসম্পন্নদেরকে গেস্ট লেকচারার হিসেবে নিয়ে আসতে হবে; সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে হবে আফ্রিকা নিয়ে।
৫. কর্পোরেটদের মাঝে আফ্রিকার গুরুত্বটা ছড়াতে হবে, যাতে তাদের অফিসেও ‘ম্যানেজার, আফ্রিকা বিজনেস’ নামে কেউ একজন থাকেন, যার কাজই হবে আফ্রিকার পেছনে ছোটা।
আফ্রিকার বন্দরে আমাদের জাহাজের প্রতিযোগিতা নিয়ে লিখেছিলাম। ২০১৬ সালের শেষে এসে যদি আমরা আমাদের জাহাজগুলি অর্ডার করতে না পারি, তাহলে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলি চালু হবার সময়ে আমাদের হাতে কোন জাহাজ থাকবে না। এই বিদ্যুতকেন্দ্রগুলিতে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা লাগবে; যা আনতে লাগবে প্রচুর জাহাজ। কয়লা আনা-নেয়ার জন্যে ২০ থেকে ৫০ হাজার টনের জাহাজ যেমন লাগবে, তেমনি এগুলি থেকে কয়লা খালাশ করে নদীতে পরিবহণ করতেও লাগবে শত শত লাইটার জাহাজ। এগুলির জন্যে কাজ এখনই শুরু করতে হবে, নাহলে অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে।
৭. বাংলাদেশে অনেক আফ্রিকান লোকেরা বসবাস করছেন। তারা পড়াশোনা করতেই হোক, আর ফুটবল খেলতেই হোক, তাদের কিছু অভিজ্ঞতা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সামরিক একাডেমিগুলিতেও আফ্রিকান সামরিক সদস্যরা ট্রেনিং পাচ্ছেন। এই লোকগুলিকে আফ্রিকার সাথে ব্রিজ হিসেবে ব্যবহার করার একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। এদেশের রাস্তায় আফ্রিকার কালো মানুষগুলিকে বাংলাদেশের মানুষ দূরের মহাদেশের মানুষ হিসেবেই দেখে; ভারতীয়দের মতো রাস্তায় বর্ণবাদী আচরণ করে না। মুসলিম হবার কারণে আমরা এব্যাপারে সাংস্কৃতিক দিক থেকে এগিয়ে আছি। আমাদের জন্যে কালোদের সাথে মেশাটা অপেক্ষাকৃত সহজ।
৮. আফ্রিকা সাথে নেটওয়ার্ককে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে দরকার হবে শক্তিশালী নৌবাহিনী, এবং দরকার বিশেষে সেনা ও বিমান বাহিনী। নিরাপত্তা দিতে না পারলে যে কেউ আমাদের কৌশলগত এই লাইফলাইন কেটে ফেলতে পিছপা হবে না। আফ্রিকা মিশনগুলিরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর বলাই বাহুল্য যে শক্তিশালী ইন্টেলিজেন্সের উপস্থিতি ছাড়া উপরের কোনটিই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আফ্রিকার কৌশলগত গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হলে আমাদের সামনের দিনগুলিতে অনেক বাজে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। একুশ শতকে পৃথিবীর কোন স্থান আর দূরে নেই; আর আমরা বটমলেস বাস্কেট নই যে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কি? আসলে ব্রিটিশদের ঢুকিয়ে দেয়া সেই চিন্তা আজ আর খাটেনা। আদার ব্যাপারীও খোঁজ রাখে দুনিয়ার কোথায় আদার মূল্য কত।
আফ্রিকার কাছে আমরা অনুকরণীয়, পশ্চিমা বিশ্ব নয়। আফ্রিকানরা জানে পশ্চিমারা কিভাবে যুগের পর যুগ সেই মহাদেশে যুদ্ধ বাধিয়ে রেখে খণিজ সম্পদ শোষণ করেছে। আফ্রিকানরা বরং হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতেই বেশি আগ্রহী। তারা আমাদেরকেই অনুসরণ করতে চায়। আমাদের সৈন্যরা সেই মহাদেশে আমাদের একটা দিককে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে এসেছে, যেখান থেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের সকলের। কর্পোরেট হাউজগুলির কাছে আফ্রিকার গুরুত্ব আরও বাড়তে হবে; কৌশলগত দিকটা না ধরতে পারলে ব্যবসা করবেন কি করে তারা? অন্যের বাড়িয়ে বুয়া হিসেবে খাটার সময় আমাদের আর নেই; একুশ শতক আমাদেরকে সেই ভুলকে শোধরানোর সুযোগ দেবে না। আমাদের প্রতিবেশীরা আফ্রিকাতে আমাদের আগে ঢুকে সেখানকার দরজা আমাদের জন্যে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করবে। তাই আমাদের শক্তি দিয়েই ঢুকতে হবে।