২২শে মার্চ ২০২২
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর তিন দিন পর গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ জার্মান পার্লামেন্ট বুন্দেস্টাগএ নতুন প্রতিরক্ষা নীতির ঘোষণা দেন। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে জার্মানি নতুন এক যুগে প্রবেশ করলো। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জার্মান সরকারের এই অবস্থান অনেককেই অবাক করেছিল; কারণ বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই জার্মান সরকারকে সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষ না নেবার এবং আরও কঠোরভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ না করার ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। শোলজ বলেন যে, সাম্প্রতিক ঘটনা এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তার সর্বশেষ আলোচনার পর তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট একটা নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছেন; এবং এই মুহুর্তে গণতন্ত্র এবং শান্তি রক্ষার জন্যে ইউরোপের প্রয়োজন নিজেদের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা।
শোলজ এবছরেই জার্মান সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ করার জন্যে ১’শ বিলিয়ন ইউরো বা ১’শ ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেন। একইসাথে তিনি সামনের বছরগুলিতে জার্মান প্রতিরক্ষা বাজেটকে জিডিপির ২ শতাংশের উপরে তোলারও আশ্বাস দেন। ন্যাটো সদস্য হিসেবে জার্মানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করবে। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশের মতো জার্মানি সেই টার্গেটের ধারেকাছেও যায়নি। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আগের চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের ১৬ বছরের শাসনামলে জার্মানি রাশিয়ার সাথে সাবধানে সম্পর্ক রেখে চলেছে। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাপারেও দুই দেশের মাঝে সমঝোতা মার্কেলের আমলেই হয়েছিল। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় মার্কেল প্রতিরক্ষা খরচ বাড়াবার ব্যাপারে মার্কিন চাপকে উপেক্ষা করেছিলেন। মাত্র কিছুদিন আগ পর্যন্তও জার্মানি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দানে বিরত ছিল। জার্মানি বলছিল যে, তারা যেকোন যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ না করার নীতিতে অটল থাকবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানি তার সেই নীতি থেকে সরে এসে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেবার ঘোষণা দিয়েছে।
মার্কিন মিডিয়া ‘এনবিসি’ বলছে যে, মার্কেল রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে জার্মানির সামরিক বাজেট কমিয়ে রেখেছিলেন। এখন অনেকেই তার ভূমিকাকে ভিন্ন চোখে দেখছে। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন্স’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড্যানিয়েলা শোয়ার্জার বলছেন যে, ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পরে মার্কেল রাশিয়ার উপর হাইড্রোকার্বনের জন্যে নির্ভরতা কমাননি, বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনকে সমর্থন দিয়েছেন। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর হিসেবে ২০১০ সালে জার্মানির ৩৬ শতাংশ গ্যাস আসতো রাশিয়া থেকে; ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশে।
নতুন প্রতিরক্ষা নীতির মাঝে কিছু ব্যাপারকে ওলাফ শোলজ পরিষ্কার করেছেন। জার্মানি সামনের দিনগুলিতে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলিতে জার্মান সামরিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে জার্মানির যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের চুক্তি রয়েছে, সেটার আঙ্গিকে তাদের পারমাণবিক আক্রমণের জন্যে ব্যবহৃত ফাইটার বিমানের বহরকে আরও উন্নত করবে। ড্রোন ক্রয় করা ছাড়াও তার সরকার ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে ৬ষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমান এবং ট্যাংক ডেভেলপ করবে বলে বলেন তিনি। শোলজ বলেন যে, পুতিনকে অতীতে ফিরে যেতে না দিয়ে তার মতো ‘যুদ্ধবাজ’কে সীমানার মাঝে আটকে ফেলার প্রশ্ন এখন ইউরোপের সামনে। রুশ হাইড্রোকার্বনের উপর নির্ভরশীলতাকে দ্রুত কমিয়ে ফেলার জন্যে চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। বৈশ্বিক বাজার থেকে আরও গ্যাস কিনে, যত দ্রুত সম্ভব দু’টা নতুন এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করে এবং নিজেদের কয়লা এবং গ্যাসের মজুত বাড়িয়ে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। তবে এর পরেও ২০৪৫ সালের মাঝে জার্মানিকে ‘কার্বন নিউট্রাল’ করার জলবায়ুগত প্রতিশ্রুতিতে বহাল থাকতে চান তিনি।
জার্মান অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক ‘ডয়েশল্যান্ডফুঙ্ক’ রেডিওকে বলেন যে, আগামী শীতের আগে জার্মানি গ্যাসের নতুন সরবরাহকারী না পেলে এবং রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জার্মানিতে বাড়ি গরম করার জন্যে এবং কারখানা চালু রাখার জন্যে যথেষ্ট গ্যাস থাকবে না। এই লক্ষ্যেই তিনি গ্যাসের নতুন সরবরাহকারী খুঁজতে কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে এসেছেন। তরলীকৃত গ্যাস এবং ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’ নিয়ে এই দুই দেশের সাথে আলোচনায় বড় বড় জার্মান কোম্পনিগুলিও অংশ নেয়। জার্মান কোম্পানি ‘থাইসেন ক্রুপ’এর প্রধান নির্বাহী মার্টিনা মার্জ এই সফরে জার্মান মন্ত্রীর প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, কাতার বর্তমানে ইইউএর ৩০ শতাংশ তরলীকৃত গ্যাসের সরবরাহ দিলেও জার্মানি আমদানিকারক নয়। কারণ রুশ গ্যাসের উপর নির্ভর করে জার্মানি এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করেনি। হাবেক আশা করছেন যে, পাঁচ বছরের মাঝে জার্মানি দু’টা টার্মিনাল তৈরি করতে পারবে।
ড্যানিয়েলা শোয়ার্জার বলছেন যে, শোলজের নতুন প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের একটা বড় অংশ নতুন কোন নীতির জন্যে নয়, বরং এতকাল মার্কেলের সময়ে জার্মানির প্রতিরক্ষা বাজেট কম রাখার ব্যাপারটাকে ব্যালান্স করতে। এই অর্থের মাধ্যমে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় থাকা জার্মানির সামরিক বাহিনীর উন্নয়ন করা হবে। অপরদিকে এলএনজি টার্মিনালের অভাবে রুশ গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কাতার এবং আমিরাত থেকে গ্যাস এবং হাইড্রোজেন আমদানি করাও রাতারাতি সম্ভব হচ্ছে না। সেই সময় পর্যন্ত জার্মানিকে ভ্লাদিমির পুতিনের দিকেই হয়তো চেয়ে থাকতে হবে। ‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ুর উপর জোর দেয়া ‘গ্রিন পার্টি’র নেতা জার্মান মন্ত্রী হাবেক এখন জলবায়ুকে ভুলে গিয়ে হাইড্রোকার্বন আমদানি করতে এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করছেন; আর রাশিয়ার অগণতান্ত্রিক সরকারকে রুখতে কাতার ও আমিরাতের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন ভুলে গিয়ে সেখান থেকে জ্বালানি আমদানি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। চ্যান্সেলর শোলজের নতুন প্রতিরক্ষা নীতি প্রকৃতপক্ষে আলাদা কোন নীতি নয়। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জার্মানি শিশুমাত্র! ইউক্রেনের যুদ্ধ শোলজ এবং হাবেকের জন্যে বাস্তবতা পরিবর্তন করে দিয়েছে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বড় ভূমিকা নিয়েছিল এবং জার্মানি ছিল নিছক দর্শক। জার্মানি সেই পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াবার চেষ্টা করছে মাত্র।
No comments:
Post a Comment