২০২১এর ২০শে ডিসেম্বর ইথিওপিয়ার তিগ্রে বিদ্রোহীরা ঘোষণা দেয় যে, তারা সরকারি আক্রমণের মুখে কিছু এলাকা ছেড়ে দিচ্ছে। একইসাথে তারা জাতিসংঘের কাছে তিগ্রে অঞ্চলের উপর যুদ্ধবিমান এবং ড্রোনের জন্যে একটা ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করার জন্যে আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ তিগ্রে অঞ্চলে মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে তদন্ত করতে একটা কমিশন গঠন করলেও ইথিওপিয়ার সরকার এর বিরোধিতা করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন সরকার ঘোষণা দেয় যে, যারা ইথিওপিয়ার যুদ্ধে সামরিক সহায়তা দেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসছে যে, ইথিওপিয়াকে বিভিন্ন দেশ অস্ত্র সরবরাহ করছে; যাদের মাঝে সর্বাগ্রে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর এক বিশ্লেষণে উইলিয়াম ডেভিডসন বলছেন যে, তিগ্রে সেনাদের পিছু হটার কারণ হয়তো আবি আহমেদের ইথিওপিয় সরকারের জন্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিদেশী সামরিক সহায়তা; বিশেষ করে অস্ত্রবাহী ড্রোন।
ডাচ প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’এর এক বিশ্লেষণে স্টাইন মিতজার এবং জুউস্ট ওলিমান্স বলছেন যে, ইথিওপিয়ার অস্ত্র বহণকারী ড্রোন ফ্লিটের মাঝে রয়েছে ৯টা চীনে নির্মিত ‘উইং লুং ১’, ২টা ইরানে নির্মিত ‘মোহাজের ৬’; এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে তৈরি কয়েকটা ‘ভার্টিক্যাল টেইক অফ এন্ড ল্যান্ডিং’ বা ‘ভিটিওএল’ ড্রোন। এছাড়াও ইস্রাইলে নির্মিত দুই প্রকারের গোয়েন্দা ড্রোনও রয়েছে এগুলিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যে। ইথিওপিয়া তার প্রথম ৩টা ‘উইং লুং ১’ ড্রোন চীন থেকে পায় ২০২১এর সেপ্টেম্বরে। এরপর নভেম্বর মাসে আমিরাত থেকে একই ধরনের আরও ৬টা ড্রোন আসে। এছাড়াও কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, যুদ্ধের শুরু থেকেই এরিত্রিয়ার আসাব বন্দরে অবস্থিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক ঘাঁটি থেকে ড্রোন হামলা হয়েছে তিগ্রেদের উপর। এব্যাপারে কেউ সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তবে ‘ওরিক্স’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, এর মানে এই নয় যে, আমিরাতের ঘাঁটি থেকে কোন হামলা হয়নি। বরং যেসময় ইথিওপিয়ার কাছে কোন ড্রোন ছিল না, সেসময় তিগ্রেদের হাতে থাকা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং বড় ক্যালিবারের রকেটের উপর নিখুঁতভাবে হামলা সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।
তিগ্রে অঞ্চলের মাইচিউ এলাকায় ইথিওপিয়দের হাতে আমিরাতে তৈরি প্রথম ‘ভিটিওএল’ ড্রোনগুলিকে দেখা যায় ২০২১এর মাঝামাঝি। তবে তিগ্রেদের দ্রুত স্থানান্তরযোগ্য বাহিনীর বিরুদ্ধে এহেন ড্রোনের কর্মক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। ইথিওপিয়ার পক্ষে আমিরাতের সবচাইতে বড় সহায়তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২১এর নভেম্বরে যখন ইথিওপিয়ার হারার মেদা বিমান ঘাঁটিতে ‘উইং লুং ১’ ড্রোনগুলিকে দেখা যেতে থাকে। ইথিওপিয়ার রাজধানী অভিমুখে বিদ্রোহী বাহিনীর রওয়ানা হবার খবরেই হয়তো আমিরাত জরুরি ভিত্তিতে তাদের নিজেদের বিমান বাহিনী থেকে ড্রোনগুলি ইথিওপিয়াতে পাঠিয়েছে। ড্রোনগুলির অপারেটরও নিঃসন্দেহে আমিরাতেরই ছিল। চীন থেকে আনা ‘উইং লুং ১’ ড্রোনগুলি প্রথম থেকেই ‘টিএল ২’ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করেনি। কিন্তু আমিরাতি ড্রোনগুলি প্রথম থেকেই প্রচুর ক্ষেপণাস্ত্রসহ মোতায়েন হয়েছে।
জানুয়ারির শুরুতে অরোমিয়া অঞ্চলের গিদামি শহরে ইরানে নির্মিত ‘ঘানেম ৫’ আকাশ থেকে নিক্ষেপিত অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবার পর ধারণা করা হচ্ছে যে, ইথিওপিয়া সরকার ইরানে নির্মিত ‘মোহাজের ৬’ ড্রোনগুলিকে অরোমিয়া অঞ্চলের কাছাকাছি মোতায়েন করেছে। স্যাটেলাইট ছবি বলছে যে, খুব সম্ভবতঃ আসোসা বিমানবন্দরেই এগুলিকে মোতায়েন করা হয়েছে। সেখান থেকে অরোমিয়া অঞ্চলের বেশিরভাগটাই ড্রোনগুলির ২’শ কিঃমিঃ পাল্লার মাঝে চলে আসবে। ২০২১এর অগাস্টে অরোমো অঞ্চলের বাহিনী ‘অরোমো লিবারেশন আর্মি’ বা ‘ওএলএ’ ‘তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’এর সাথে জোট বেঁধে আবি আহমেদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এর আগ পর্যন্ত সেমেরা এবং হারার মেদা বিমান ঘাঁটি থেকে তিগ্রে অঞ্চলে ড্রোন হামলা করা গেলেও অরোমিয়া ছিল ড্রোনের পাল্লার বাইরে। ডাচ এনজিও ‘প্যাক্স’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কে তৈরি ড্রোনও ইথিওপিয়া ব্যবহার করছে। তুর্কি সরকার অবশ্য তা অস্বীকার করেছে।
‘ওরিক্স’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ইথিওপিয়া বিমান বাহিনীর ড্রোন হামলার ফলস্বরূপ এখন তিগ্রেদের হাতে তেমন কোন বড় অস্ত্র নেই। ড্রোন হামলার ব্যাপারটা তিগ্রে সেনাদের মনোবলের উপরেও হয়তো আঘাত হেনেছে। অন্ততঃ ট্যাংক বা আর্টিলারির মতো বড় ক্যালিবারে অস্ত্র না থাকায় তিগ্রেদের সামনে অগ্রসর হবার সক্ষমতা কমে যেতে পারে। একারণেই হয়তো তিগ্রেরা আক্রমণে না গিয়ে নিজেদের অঞ্চলকে রক্ষা করতে বেশি যত্নবান হচ্ছে। তবে ‘উইং লুং ১’ ড্রোনগুলি একইসাথে বেসামরিক টার্গেটে হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে বলে তথ্য মিলছে। কিছুদিন আগেই তিগ্রে অঞ্চলের আলামাতা শহরে ড্রোন হামলায় ৪২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং দেড়শতাধিক আহত হয়। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে চীনে নির্মিত ‘ব্লু এরো ৭’ ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষের দেখা মেলে; যা কিনা ‘উইং লুং ১’ ড্রোন ব্যবহার করে।
যুদ্ধের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসনের শেষ দিনগুলিতে যুক্তরাষ্ট্র আবি আহমেদের সরকারকে সমর্থন দিলেও জো বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সেই নীতির উপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র ইথিওপিয়া সরকারের কাছে তুর্কি ড্রোন বিক্রির রিপোর্টের ব্যাপারে চিন্তিত। গত ডিসেম্বরে হর্ন অব আফ্রিকার জন্যে মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি জেফরি ফেল্টম্যান তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময়ে ইথিওপিয়াতে সশস্ত্র ড্রোন ব্যবহারের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন বলে বলছে ‘রয়টার্স’ এবং ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’। ‘এক্সপোর্টার্স এসেম্বলি’র হিসেবে ২০২১ সালের ১১ মাসে ইথিওপিয়াতে তুরস্ক ৯৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক পণ্য রপ্তানি করেছে। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, ইথিওপিয়া সরকারের ইরানি ড্রোন ব্যবহারের ব্যাপারেও মার্কিন কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন।
বাইডেন প্রশাসন ইথিওপিয়ার যুদ্ধ বন্ধে তেমন কোন পদক্ষেপ না নিলেও ইথিওপিয়ার সরকার যাতে সহজে যুদ্ধজয়ের পথে এগুতে না পারে, সেজন্য ইথিওপিয়ার উপর বিভিন্ন অবরোধের হুমকি দিচ্ছে। তবে এটা মনে করার কারণ নেই যে, এই যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ করার অপরাধে যুক্তরাষ্ট্র আমিরাত বা তুরস্কের উপর অবরোধ দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন ইথিওপিয়ার সরকারের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার চেষ্টাকে সমর্থন দিলেও বাইডেন প্রশাসন সেখানে ইথিওপিয়া সরকারের মানবাধিকার লংঘনকে হাইলাইট করতে চাইছে। অর্থাৎ ইথিওপিয়ার অখন্ডতা রক্ষা এখন মার্কিন সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
No comments:
Post a Comment