৩১শে জানুয়ারি ২০২৩
২৮শে জানুয়ারি ২০২৩। ইরানের ইসফাহান শহরে অস্ত্রের কারখানায় ড্রোন হামলা। এই হামলার মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিলো নিঃসন্দেহে। |
গত ২৮শে জানুয়ারি ইরানের মধ্যাঞ্চলের শহর ইসফাহানের একটা ‘ওয়ার্কশপে’ ড্রোন হামলা হয়েছে বলে ইরানের সরকারি গণমাধ্যমে বলা হয়। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, মোট তিনটা ড্রোন কারখানায় হামলা করে; যার মাঝে দু’টাকে ভূপাতিত করা হয়। একটা ড্রোন তার বহনকৃত বোমা কারখানার উপরে ফেলতে সক্ষম হয়। তবে এতে কারখানার ছাদের উপর সামান্য ক্ষতি ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইরানের টেলিভিশনে কারখানার ছাদের ভিডিও প্রকাশ করে হাল্কা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয় এবং একইসাথে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়; যেগুলি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ড্রোনের সদৃশ। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘ইরনা’ জানাচ্ছে যে, ড্রোনগুলি ছিল ‘কোয়াড কপ্টার’; যেগুলি হলো চারটা পাখা দ্বারা ওড়া ছোট আকারের ড্রোন। এগুলি সাধারণতঃ স্বল্প দূরত্ব থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চালানো হয়। অর্থাৎ এই ড্রোনগুলি ইরানের বাইরে থেকে উড়ে আসেনি। কেউ এখন পর্যন্ত হামলার দায় স্বীকার না করলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ইস্রাইল এই হামলা করেছে। অনেকেই ধারণা করছেন যে, ইসফাহানের এই কারখানায় খুব সম্ভবতঃ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করা করা।
‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২২এর অক্টোবরে ইরানের টেলিভিশনে কিছু ব্যক্তির বক্তব্য প্রকাশ করা হয়; যেখানে বলা হয় যে এই বক্তব্য ছিল আটককৃত কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘কোমালা’র সদস্যদের, যারা কিনা ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘মোসাদ’এর ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং তারা ইসফাহান শহরে সামরিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছিলো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে এরূপ ঘটনার গুরুত্ব বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইরানের কুর্দী বংশোদ্ভূত মহিলা মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো ইরানজুড়ে চলছে সহিংসতা। আর ইতোমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ইরান সুইসাইড ড্রোন সরবরাহ করায় ইরানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং পারমাণবিক প্রকল্পে কাজ করা গবেষকদের হত্যার জন্যে অনেকেই ইস্রাইলকেই দায়ী মনে করছেন। ইরানের সরকার পারমাণবিক প্রকল্পে ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ইস্রাইলের পক্ষ থেকে ইরান-বিরোধী বক্তব্য যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইস্রাইলের যৌথ মহড়ার পরিধিও বেড়েছে। এখানে আজেরবাইজানের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজেরবাইজান ইরানের প্রতিবেশী দেশ এবং ইস্রাইলের সাথে আজেরবাইজানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ইরানিরা বারংবার অভিযোগ করেছে যে, ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স আজেরবাইজানকে ব্যবহার করে ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালাচ্ছে।
ইসফাহানে ড্রোন হামলার একদিন আগেই তেহরানে আজেরবাইজানের দূতাবাসে হামলা হয়। আজেরবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ২৭শে জানুয়ারি সকাল ৮টার সময় এক ব্যাক্তি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের মাধ্যমে দূতাবাসে হামলা করে। এতে দূতাবাসের নিরাপত্তা প্রধান নিহত হন এবং এবং আরও দু’জন নিরাপত্তারক্ষী আহত হন। সোশাল মিডিয়া ‘টেলিগ্রাম’এ প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা যায় যে, এক অস্ত্রধারী ব্যক্তি হঠাৎ করেই দূতাবাসের মুখে গাড়ি পার্ক করে বন্দুক নিয়ে হামলা করে। পরবর্তীতে দূতাবাসের ভেতরে তার সাথে কর্মকর্তারা তাকে ধরে ফেলে। ভিডিওতে কোন শিশু দৃশ্যমান না হলেও তেহরানের পুলিশ প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন রাহিমি ইরানি বার্তা সংস্থা ‘তাসনিম’কে বলেন যে, আক্রমণকারী ব্যক্তি তার দু’জন শিশু সন্তানকে নিয়ে দূতাবাসে এসেছিলেন। তিনি বলেন যে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, ব্যাপারটা ছিল ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক কলহ। তবে আজেরবাইজানের বিবৃতি বলছে যে, এই ঘটনা মোটেই পারিবারিক কলহ ছিল না। ঘটনার অনেক আগে থেকেই ইরানের অভ্যন্তরে আজেরবাইজান-বিরোধী কর্মকান্ডের ফলে আজেরবাইজানের পক্ষ থেকে তেহরানে তাদের দূতাবাসের নিরাপত্তা বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছিল। ইরানিরা সেই দাবি আমলে না নেয়ায় এখন আজেরবাইজান দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তেহরানের হামলার পর যে দেশগুলি আজেরবাইজানকে সমবেদনা জানিয়েছে, তার মাঝে ইস্রাইল ছিল সর্বাগ্রে।
‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তেহরানে হামলার কয়েক ঘন্টার পরেই বাকুতে ইস্রাইলের রাষ্ট্রদূত জর্জ ডীক এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, তার সাথে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিকমাত হাজিইয়েভের সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তেহরানে আজেরি দূতাবাসে হামলার আগে থেকেই আজেরবাইজান-ইরান সম্পর্কে উত্তেজনা চলছিল। ২০২০ সালে নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধের সময় আজেরবাইজান অভিযোগ করে যে, ইরান আর্মেনিয়াকে জ্বালানি এবং অন্যান্য সহায়তা দেয়। অপরদিকে তেহরান দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, আজেরবাইজান তাদের নাখচিভান ছিটমহলকে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করার জন্যে যে করিডোর আর্মেনিয়ার কাছে দাবি করছে, সেটা ইরানের সাথে আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার স্থলযোগাযোগের পথকে হুমকির মাঝে ফেলতে পারে। এছাড়াও ইরানের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে আজেরি হওয়ায় তা তেহরান এবং বাকুর মাঝে দড়িটানাটানির কারণ হয়েছে। তেহরানে আজেরবাইজানের দূতাবাসে হামলার পর আজেরবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বলা হয় যে, এই ঘটনার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও চাপের মাঝে পড়বে। ২০২২এর নভেম্বরে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ এক অনুষ্ঠানে বলেন যে, তার সরকার আজেরবাইজান এবং আজেরবাইজানের বাইরে সকল আজেরিদের সেকুলার জীবনযাত্রাকে রক্ষার চেষ্টা করবে; এমনকি ইরানের অভ্যন্তরে যে আজেরিরা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও। আলিইয়েভ ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদেরকে ‘আজেরবাইজানের জনগণ’ বলে আখ্যা দেন।
তেহরানে আজেরি দূতাবাসে হামলার পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, আজেরবাইজান কখনও একা নয়। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ঐতিহাসিকভাবেই আজেরবাইজান তুরস্কের সবচাইতে কাছের বন্ধু। নাগোর্নো কারাবাখ যুদ্ধে আজেরিদের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল তুরস্ক এবং ইস্রাইল। তুরস্ক আবার আঞ্চলিকভাবে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী। তদুপরি, ইরান সর্বদাই অভিযোগ করে আসছে যে, আজেরবাইজান ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের মাঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাকে উস্কে দিচ্ছে। একইসাথে ইরান সন্দেহ করে যে, ইরানের অভ্যন্তরে ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স কাজ করার জন্যে আজেরবাইজানকে ব্যবহার করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসফাহান অস্ত্র কারখানায় হামলা মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিলো নিঃসন্দেহে।