০১লা অগাস্ট ২০২২
শুধু বাইডেন এবং এরদোগানই নয়, এবারে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁও সৌদি যুবরাজ এবং সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসনকর্তা মোহাম্মদ বিন সালমানকে কাছে টেনে নিলেন। বিন সালমানের প্যারিস সফরকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়াতে ব্যাপক সমালোচনা চলমান রয়েছে; যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং বিন সালমানের ইস্তাম্বুল সফরের পর থেকে অব্যাহত রয়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ২৮শে জুলাই প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ এবং বিন সালমানের নৈশভোজের ফাঁকে আলোচনার পটভূমি ছিল জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা এবং ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে মধ্যপ্রাচের দেশগুলির দুশ্চিন্তা। ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটের ভেতরে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড নিয়ে পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলির হাহাকারের মাঝেই পশ্চিমা নেতৃত্ব বিন সালমানের সাথে বৈঠক করে যাচ্ছেন। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর বেনেডিক্টে জনেরদ বলছেন যে, প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ মানবাধিকারের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান না নিয়ে বিন সালমানের চরিত্রকে ‘হোয়াইটওয়াশ’ করে তাকে আন্তর্জাতিকভাবে পুনর্বাসনের ঝুঁকি নিচ্ছেন! ফ্রান্সের অবস্থানকে যুক্তিযুক্ত করতে গিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেন যে, সৌদি যুবরাজের সাথে আলোচনায় মানবাধিকার ইস্যুকে সাধারণভাবে আলোচনা করা হলেও পুরো ইউরোপের সমস্যা সমাধানে ফ্রান্সের সকল বন্ধুদের সাথেই আলোচনায় বসতে হচ্ছে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্ন বলছেন যে, তিনি মনে করেন না যে, ফরাসি জনগণ সরকারের এই ব্যাপারটাকে অনুধাবন করতে পারবে; এমনকি রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দেবার হুমকির মাঝে প্রেসিডেন্ট যদি তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির সাথে বৈঠক নাও করেন।
‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিন সালমানের প্যারিস সফরের মূলে রয়েছে সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্যে প্রভাবিত করা; যে উদ্দেশ্যে ম্যাক্রঁ এবং জো বাইডেন উভয়েই চেষ্টা চালাচ্ছেন। ফ্রান্স এবং ইইউ চাইছে তাদের জ্বালানির উৎসকে আরও প্রসারিত করতে। পশ্চিমা দেশগুলি এখন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আদর্শের উপরে স্থান দিচ্ছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর স্কলার ফাতিমা আবি আল-আসরার ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে বলছেন যে, পশ্চিমা নেতারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির কাছে ধর্না দিয়ে তেলের বাজারের অস্থিরতা কাটাতে চাইছেন মূলতঃ তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থকে মাথায় রেখেই। সর্বক্ষেত্রেই দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চীন এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রেই শুধু নয়; যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম অনুসরণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘন, অভিবাসী নিয়ে বৈরী নীতি, আর বর্ণবাদী সমস্যা তো রয়েছেই। এমতাবস্থায় সৌদিদের সাথে আলোচনা করাটা পশ্চিমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসা নয়; কারণ ঐতিহাসিকভাবেই সৌদি আরবের সাথে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। কাজেই সৌদি আরবকে বিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখার কিছুই নেই।
সৌদি যুবরাজের অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ফরাসি প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়ার কারণে বিন সালমান তার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আলোচনার ফলে দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতা আরও নিশ্চয়তা পেলো। আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে উভয় দেশের সাধারণ স্বার্থকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে এই আলোচনা ভূমিকা রাখবে। ‘আল আরাবিয়া’র এক প্রতিবেদনে ‘সৌদি প্রেস এজেন্সি’ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিসের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, দুই দেশের মাঝে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ এবং হাইড্রোজেন শক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় যে, উভয় নেতা বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে স্থিতি ফিরিয়ে আনার গুরুত্ব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গমের সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি বিশ্বের উপর ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে দুই দেশের মাঝে সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলির জ্বালানির উৎস বাড়ানোর বিষয়টার উপরেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে উভয় দেশের স্বার্থের প্রতি হুমকির বিষয়গুলিকে আলোচনায় এনে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়; বিশেষ করে লেবাননের সমস্যা নিরসরণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য ছাড়াও সেখানে দুই দেশের যৌথ কর্মপদ্ধতির সফলতা যাচাই করা হয়। ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হতে না দেয়ার বিষয়ে আলোচনার অগ্রগতি এবং সিরিয়ায় শান্তির ফিরিয়ে আনার ব্যাপারও দুই দেশের মাঝে আলোচিত হয়েছে। ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রগতি নিয়েও তারা আলোচনা করেছেন।
বিন সালমানের প্যারিস সফরের আরেকটা দিক ছিল ইরানের সাথে পশ্চিমাদের পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা। আল-আসরার বলছেন যে, গত চার বছর ধরে বিন সালমানকে পশ্চিমারা বয়কট করে এসেছে। কাজেই যুবরাজ নিশ্চয়ই তার এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে উৎসুক ছিলেন; বিশেষ করে তিনি আঞ্চলিক দিক দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে সৌদিদের অবস্থানকে সুসংহত করতে চাইছেন এবং বাকি বিশ্বের কাছে তার এই অবস্থানকে জানান দিতে চাইছেন। আর ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবকে, বিশেষ করে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলিকে সামরিক দিক থেকে হারাতে না পেরে বিন সালমান এখন পশ্চিমাদের কাছ থেকে কূটনৈতিক সমর্থন আদায় করতে চাইছেন; যাতে ইরান ইচ্ছামতো তার নীতি বাস্তবায়ন করতে না পারে। ফ্রান্স সর্বদাই ইরানের সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল; তবে সৌদিরা এতে আগ্রহী নয়। সৌদিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, পশ্চিমারা যদি ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করে, সেক্ষেত্রে পশ্চিমারা হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মতামত না নিয়েই সেদিকে ধাবিত হতে পারে। সৌদিরা চাইছে না যে, পশ্চিমারা যে চুক্তি করবে, সেটা তাদেরকে চুপচাপ মেনে নিতে হবে।
বিন সালমানের প্যারিস সফর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ইস্যুগুলিতে আরব দেশগুলির পশ্চিমমুখীতাকে আবারও তুলে ধরলো। লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান ইস্যুতে সৌদিরা প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। নিঃসন্দেহে ম্যাক্রঁ মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপের অবস্থান ধরে রাখার নেতৃত্ব চাইছেন। অপরদিকে আবারও প্রমাণ হলো যে, মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মাঝে জ্বালানি বিপর্যয় মোকাবিলা করাটা ফ্রান্স, তথা ইউরোপের যেকোন দেশের ক্ষমতাসীনদের জন্যেই বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠিন বাস্তবতায় নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে আদর্শকে জ্বলাঞ্জলি দেয়ার ঘটনাটা পশ্চিমাদের আদর্শিক দেউলিয়াত্বকে আরও একবার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
Sunday, 31 July 2022
Friday, 29 July 2022
রুশ গ্যাস ছাড়া শীতকাল পার হতে পারবে জার্মানি?
৩০শে জুলাই ২০২২
রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম ১’ গ্যাস পাইপলাইনে রুশ কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’ গ্যাস সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেবার পরপরই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ইইউ সমঝোতায় পৌঁছে যে, তারা আগামী শীতের মাঝে অগাস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় তাদের গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাবে। আর রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে গ্যাস ব্যবহার কমাতে হবে। তবে এই জরুরি অবস্থা কখন কিভাবে ঘোষণা হতে পারে, সেব্যাপারে সমঝোতা হয়নি। তথাপি ইইউএর গ্যাস নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত নয় বা এই নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীলতা কম, এমন দেশগুলি এই সমঝোতার বাইরে থাকতে পারবে; যার মাঝে পড়বে দ্বীপ দেশ আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস এবং মাল্টা; তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া; এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশ স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও গ্রিস। প্রস্তাবের পক্ষে জোরেসোরে কাজ করা চেক রিপাবলিকের মন্ত্রী জোসেফ সিকেলা সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সমঝোতা বেশ কঠিন ছিল; তবে এর দরকার সকলেই বুঝতে পেরেছে। এখন সকলে মিলে কষ্ট ভাগাভাগি করে নেবে তারা। জার্মান মন্ত্রী রবার্ট হাবেক স্বীকার করেন যে, রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে জার্মানি কৌশলগত ভুল করেছে। তবে এখন এটা শুধু জার্মানির সমস্যা নয়। ফরাসি মন্ত্রী আগনেস পানিয়ে-রানুশে বলেন যে, এখানে পুরো ইউরোপের অর্থনীতির স্বাস্থ্য প্রশ্নের মুখে পড়েছে; কারণ ইইউএর শিল্পগুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। জার্মানির কেমিক্যাল শিল্পে সমস্যা হলে সারা ইউরোপের শিল্পই সমস্যায় পড়ে যাবে।
ইইউএর মাঝে হাঙ্গেরি এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারা এর আগেও রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধের ইইউ সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়নি। স্পেনের মন্ত্রী তেরেসা রিবেরা জার্মানিকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তারা তাদের জ্বালানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় তো অন্য কারুর উপদেশ নেয়নি; তাহলে স্পেন কেন তাদের জন্যে কষ্ট সহ্য করবে? তিনি এই ভাষা ব্যবহার করেছেন, কারণ স্পেন তার বেশিরভাগ গ্যাস আফ্রিকা থেকে আমদানি করে।
ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এক দশক আগে দক্ষিণ ইউরোপের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় জার্মানি সেই দেশগুলির ঋণে জর্জরিত হয়ে যাবার সমালোচনায় বলেছিল যে, তারা তাদের নিজেদের ঘরের কাজগুলি করেনি। এখন রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমাবার ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, জার্মানি ক্লাসের সবচাইতে খারাপ ছাত্র। স্পেনের মন্ত্রী রিবেরা এবার জার্মানিকে ঐ একই কথাগুলি ফেরত দিয়ে বলেছেন যে, এলএনজি আমদানির অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে স্পেন নিজেদের ঘরের কাজগুলি করেছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সমালোচনাই করেছেন; কারণ জার্মানি রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল থেকে এলএনজি আমদানির কোন অবকাঠামোই তৈরি করেনি। জার্মান পত্রিকা ‘সুডশে জাইটুং’ প্রায় একইভাবে বলছে যে, একসময় কিছু দেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে জার্মানির লেকচার শুনেছে। এখন এই দেশগুলিকেই অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে জার্মানিকে ‘গ্যাসের দেউলিয়াত্ব’ থেকে উদ্ধার করে! আরেক জার্মান পত্রিকা ‘ফ্রাংকফুটার আলেমাইনে’ বলছে যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ১’ পাইপলাইন তৈরি করার সময় জার্মানরা পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপের বাকি দেশগুলির জ্বালানি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নকে উপেক্ষা করেছিল। আর জার্মানরা সর্বদাই দাবি করেছে যে, তারা বাকিদের চাইতে বেশি জানে!
‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, জার্মানি কি কি পদ্ধতিতে এই সংকট কাটাবার চেষ্টা করতে পারে। প্রথমতঃ এলএনজিএর মাধ্যমে অন্যান্য সূত্র থেকে সমুদ্রপথে গ্যাস আমদানি করতে পারে তারা। দ্বিতীয়তঃ নিজ দেশে গ্যাসের ব্যবহার কমাতে চেষ্টা করতে পারে। তৃতীয়তঃ কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে পারে। চতুর্থতঃ তারা ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনে থাকা ছোট দল ‘ফ্রি ডেমোক্র্যাট’এর কথা শুনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে আরও বেশি সময়ের জন্যে সার্ভিসে রাখার চেষ্টা করতে পারে। ২০২২ সালের মাঝেই জার্মানির সর্বশেষ তিনটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার কথা রয়েছে। জার্মানি ইতোমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে; নতুন করে কিনতে গেলে সেটা ২০২৩ সালের শরতকালের আগে সম্ভব হবে না। শীতকালে চালু রাখলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি থেকে কম উৎপাদন আসবে। এছাড়াও সমস্যা হলো পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে ইউরেনিয়ামের ২০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে; আরও ২০ শতাংশ আসে রাশিয়ার বন্ধু দেশ কাজাখস্থান থেকে। তথাপি পারমাণবিক বিদ্যুৎ জার্মানির মোট বিদ্যুতের তুলনায় তেমন কিছুই নয়; বায়ুশক্তি থেকেই আসে এর চাইতে তিনগুণ বিদ্যুৎ। আর গ্রীষ্মে বেশি গরম পড়লে নদীর উষ্ণ পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লি ঠান্ডা করার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বায়ুশক্তি বৃদ্ধি করার ১০ হাজার মেগাওয়াটের প্রকল্প রয়েছে জার্মানির; তবে প্রথম টার্বাইন থেকে বিদ্যুৎ আসতেও ৬ বছর লেগে যাবে। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষার আইনের কারণে সোলার এবং বায়োগ্যাস থেকে দ্রুতই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আশা করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় পরিবেশ রক্ষার ব্রতকে আপাততঃ ভুলে গিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্যাসের ব্যবহার কমানোই জার্মানির সামনে খোলা পথ।
রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধের কাছাকাছি চলে যাওয়ার পর জার্মানির হ্যানোভার শহর সরকারি ভবনগুলিতে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরম পানির সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করেছে। ঝরণাগুলি বন্ধ থাকবে; রাতের বেলায় সরকারি ভবনগুলিতে আলো জ্বলবে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তাপমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ব্যবস্থাগুলি আসছে শীতকালের আগে গ্যাসের মজুত বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। জার্মানির জ্বালানি কোম্পানিগুলিকে দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচাতে জার্মান পরিবারগুলিকে বছরে অতিরিক্ত ৫’শ ইউরো গুণতে হতে পারে। ইইউএর মাঝে থেকেও জার্মানি নিজস্ব নীতিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে; প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে জার্মানির তৈরি করে দেয়া নীতি অনুসরণ করতে বাধ্যও করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউরোপের বাকি দেশগুলির সাথে জার্মানির নীতিগত সংঘর্ষ আরও প্রবল হয়েছে। জাতীয়তাবাদের উত্থানের বাস্তবতার মাঝে ইইউএর চিন্তাটাই যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হবার পরেও জার্মানির অসহায়ত্ব এখন সকলের সামনে পরিষ্কার। এহেন দুর্বলতা জার্মানির জাতীয় গর্বের উপর আঘাত; যা দেশটার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার বীজ হতে পারে।
রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম ১’ গ্যাস পাইপলাইনে রুশ কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’ গ্যাস সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেবার পরপরই জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ইইউ সমঝোতায় পৌঁছে যে, তারা আগামী শীতের মাঝে অগাস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় তাদের গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাবে। আর রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে গ্যাস ব্যবহার কমাতে হবে। তবে এই জরুরি অবস্থা কখন কিভাবে ঘোষণা হতে পারে, সেব্যাপারে সমঝোতা হয়নি। তথাপি ইইউএর গ্যাস নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত নয় বা এই নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীলতা কম, এমন দেশগুলি এই সমঝোতার বাইরে থাকতে পারবে; যার মাঝে পড়বে দ্বীপ দেশ আয়ারল্যান্ড, সাইপ্রাস এবং মাল্টা; তিনটা বল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া; এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশ স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও গ্রিস। প্রস্তাবের পক্ষে জোরেসোরে কাজ করা চেক রিপাবলিকের মন্ত্রী জোসেফ সিকেলা সাংবাদিকদের বলেন যে, এই সমঝোতা বেশ কঠিন ছিল; তবে এর দরকার সকলেই বুঝতে পেরেছে। এখন সকলে মিলে কষ্ট ভাগাভাগি করে নেবে তারা। জার্মান মন্ত্রী রবার্ট হাবেক স্বীকার করেন যে, রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে জার্মানি কৌশলগত ভুল করেছে। তবে এখন এটা শুধু জার্মানির সমস্যা নয়। ফরাসি মন্ত্রী আগনেস পানিয়ে-রানুশে বলেন যে, এখানে পুরো ইউরোপের অর্থনীতির স্বাস্থ্য প্রশ্নের মুখে পড়েছে; কারণ ইইউএর শিল্পগুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। জার্মানির কেমিক্যাল শিল্পে সমস্যা হলে সারা ইউরোপের শিল্পই সমস্যায় পড়ে যাবে।
ইইউএর মাঝে হাঙ্গেরি এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারা এর আগেও রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধের ইইউ সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়নি। স্পেনের মন্ত্রী তেরেসা রিবেরা জার্মানিকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, তারা তাদের জ্বালানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় তো অন্য কারুর উপদেশ নেয়নি; তাহলে স্পেন কেন তাদের জন্যে কষ্ট সহ্য করবে? তিনি এই ভাষা ব্যবহার করেছেন, কারণ স্পেন তার বেশিরভাগ গ্যাস আফ্রিকা থেকে আমদানি করে।
ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এক দশক আগে দক্ষিণ ইউরোপের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় জার্মানি সেই দেশগুলির ঋণে জর্জরিত হয়ে যাবার সমালোচনায় বলেছিল যে, তারা তাদের নিজেদের ঘরের কাজগুলি করেনি। এখন রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমাবার ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, জার্মানি ক্লাসের সবচাইতে খারাপ ছাত্র। স্পেনের মন্ত্রী রিবেরা এবার জার্মানিকে ঐ একই কথাগুলি ফেরত দিয়ে বলেছেন যে, এলএনজি আমদানির অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে স্পেন নিজেদের ঘরের কাজগুলি করেছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে জার্মানির সমালোচনাই করেছেন; কারণ জার্মানি রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীল থেকে এলএনজি আমদানির কোন অবকাঠামোই তৈরি করেনি। জার্মান পত্রিকা ‘সুডশে জাইটুং’ প্রায় একইভাবে বলছে যে, একসময় কিছু দেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে জার্মানির লেকচার শুনেছে। এখন এই দেশগুলিকেই অনুরোধ করা হচ্ছে, তারা যেন গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে জার্মানিকে ‘গ্যাসের দেউলিয়াত্ব’ থেকে উদ্ধার করে! আরেক জার্মান পত্রিকা ‘ফ্রাংকফুটার আলেমাইনে’ বলছে যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ১’ পাইপলাইন তৈরি করার সময় জার্মানরা পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপের বাকি দেশগুলির জ্বালানি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নকে উপেক্ষা করেছিল। আর জার্মানরা সর্বদাই দাবি করেছে যে, তারা বাকিদের চাইতে বেশি জানে!
‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে, জার্মানি কি কি পদ্ধতিতে এই সংকট কাটাবার চেষ্টা করতে পারে। প্রথমতঃ এলএনজিএর মাধ্যমে অন্যান্য সূত্র থেকে সমুদ্রপথে গ্যাস আমদানি করতে পারে তারা। দ্বিতীয়তঃ নিজ দেশে গ্যাসের ব্যবহার কমাতে চেষ্টা করতে পারে। তৃতীয়তঃ কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে পারে। চতুর্থতঃ তারা ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনে থাকা ছোট দল ‘ফ্রি ডেমোক্র্যাট’এর কথা শুনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে আরও বেশি সময়ের জন্যে সার্ভিসে রাখার চেষ্টা করতে পারে। ২০২২ সালের মাঝেই জার্মানির সর্বশেষ তিনটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার কথা রয়েছে। জার্মানি ইতোমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে; নতুন করে কিনতে গেলে সেটা ২০২৩ সালের শরতকালের আগে সম্ভব হবে না। শীতকালে চালু রাখলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি থেকে কম উৎপাদন আসবে। এছাড়াও সমস্যা হলো পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্যে ইউরেনিয়ামের ২০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে; আরও ২০ শতাংশ আসে রাশিয়ার বন্ধু দেশ কাজাখস্থান থেকে। তথাপি পারমাণবিক বিদ্যুৎ জার্মানির মোট বিদ্যুতের তুলনায় তেমন কিছুই নয়; বায়ুশক্তি থেকেই আসে এর চাইতে তিনগুণ বিদ্যুৎ। আর গ্রীষ্মে বেশি গরম পড়লে নদীর উষ্ণ পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লি ঠান্ডা করার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বায়ুশক্তি বৃদ্ধি করার ১০ হাজার মেগাওয়াটের প্রকল্প রয়েছে জার্মানির; তবে প্রথম টার্বাইন থেকে বিদ্যুৎ আসতেও ৬ বছর লেগে যাবে। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষার আইনের কারণে সোলার এবং বায়োগ্যাস থেকে দ্রুতই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আশা করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় পরিবেশ রক্ষার ব্রতকে আপাততঃ ভুলে গিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্যাসের ব্যবহার কমানোই জার্মানির সামনে খোলা পথ।
রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধের কাছাকাছি চলে যাওয়ার পর জার্মানির হ্যানোভার শহর সরকারি ভবনগুলিতে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরম পানির সরবরাহ বন্ধ ঘোষণা করেছে। ঝরণাগুলি বন্ধ থাকবে; রাতের বেলায় সরকারি ভবনগুলিতে আলো জ্বলবে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও তাপমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ব্যবস্থাগুলি আসছে শীতকালের আগে গ্যাসের মজুত বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। জার্মানির জ্বালানি কোম্পানিগুলিকে দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচাতে জার্মান পরিবারগুলিকে বছরে অতিরিক্ত ৫’শ ইউরো গুণতে হতে পারে। ইইউএর মাঝে থেকেও জার্মানি নিজস্ব নীতিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে; প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিকে জার্মানির তৈরি করে দেয়া নীতি অনুসরণ করতে বাধ্যও করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউরোপের বাকি দেশগুলির সাথে জার্মানির নীতিগত সংঘর্ষ আরও প্রবল হয়েছে। জাতীয়তাবাদের উত্থানের বাস্তবতার মাঝে ইইউএর চিন্তাটাই যখন প্রশ্নবিদ্ধ, তখন বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হবার পরেও জার্মানির অসহায়ত্ব এখন সকলের সামনে পরিষ্কার। এহেন দুর্বলতা জার্মানির জাতীয় গর্বের উপর আঘাত; যা দেশটার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার বীজ হতে পারে।
Sunday, 24 July 2022
মধ্যপ্রাচ্য সফরে কি পেলেন জো বাইডেন?
২৫শে জুলাই ২০২২
জুলাইয়ের প্রথমভাগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের কেন্দ্রে ছিল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠক। মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘সিবিএস’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাইডেন সৌদি যুবরাজের সাথে দেখা করার জন্যে রাজি ছিলেন না মোটেই। বিশেষ করে যেখানে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স প্রতিবেদনই বলেছে যে, ২০১৮ সালে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার সিদ্ধান্ত খুব সম্ভবতঃ বিন সালমানই দিয়েছিলেন। এখন তুমুল সমালোচনার মুখে বাইডেনকে বিন সালমানের সাথে বৈঠকের যুক্তিযুক্ততা তুলে ধরতে হচ্ছে। বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে তেলের বাজারে অস্থিরতা কমাতে সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে রাজি করানো, ইস্রাইলের সাথে আরব দেশগুলির সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়াও ইস্রাইলের জন্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করা; এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ধরে রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিকে আস্বস্ত করার ব্যাপারগুলি বিশ্লেষকেরা আলোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার ইস্যুগুলিকে সকলেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন।
জো বাইডেন জেদ্দায় ‘জিসিসি’র শীর্ষ বৈঠকে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবে না; এবং রাশিয়া, চীন ও ইরানের মতো দেশের কাছে শূন্যস্থান পূরণের সুযোগও তারা দেবে না। ‘আল জাজিরা’র জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগের পর এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের চীন ও রাশিয়া কেন্দ্রিক বক্তব্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রগুলির মাঝে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। একারণেই বাইডেনকে নতুন করে আশ্বাস দিতে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব কমে যায়নি; বরং আফগানিস্তান থেকে সরে আসার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু সম্পদ এখন মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা সম্ভব হবে। বিশারা বলছেন যে, বাইডেন বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে থাকবে তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্যে। এর জন্যে দরকার হলে মানবাধিকারের মতো আদর্শিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র ছাড় দেবে; সেটা সৌদি আরব, মিশর বা ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তবে বিশারা আশংকা করছেন যে, মার্কিন জাতীয় স্বার্থের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে একটা নতুন ঠান্ডাযুদ্ধ শুরু হতে পারে; যার একপক্ষে থাকবে রাশিয়া, চীন ও ইরান; অপরপক্ষে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ইস্রাইল এবং আরও কিছু দেশ।
সৌদি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী শিহাবি ‘দ্যা গার্ডিয়ান’কে বলছেন যে, বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা বললেও তিনি মূলতঃ বিন সালমানের সাথে দেখা করতেই এসেছিলেন। তেল নিয়ে কথা বলা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে চীন এবং রাশিয়ার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন তিনি। বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে যেকোন কিছু করতে গেলে সৌদি আরবকে বাদ দিয়ে এগুনো যাবে না। বাইডেনের সফর বিন সালমানের জন্যে একটা বড় বিজয় ছিল।
বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার উপর অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সহায়তায় যতটা সম্ভব পূরণের চেষ্টা করা। তবে সৌদিরা ব্যাপারটাকে মার্কিনীদের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। ‘সিবিএস’এর সাথে এক সাক্ষাতে সৌদি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল বিন আহমেদ আল জুবাইর বলছেন যে, অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ বাড়ানোটাই সমাধান নয়; কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহুর্তে অতিরিক্ত তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা নেই। ‘সিবিএস’ বলছে যে, বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইস্রাইলি বিমানের জন্যে সৌদি আকাশসীমা খুলে দেয়া, ফিলিস্তিনে ফোর-জি প্রযুক্তি চালু, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, লোহিত সাগরে একটা দ্বীপের উন্নয়ন, ইত্যাদি বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছেন। এই বিষয়গুলি মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা মার্কিন জনগণের জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না। মানবাধিকার এবং জ্বালানির মূল্যের ব্যাপারেই মার্কিনীর বেশি আগ্রহী।
‘আল জাজিরা’ বলছে যে, মধ্যপ্রাচ্য সফরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাতের পর বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে বেশ খানিকটাই সমস্যা সামলাতে হচ্ছে। বিন সালমানের সাথে বাইডেনের সাক্ষাৎকে কেউই সহজভাবে নিতে পারেনি। এখন উল্টো সৌদি যুবরাজই বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রই তার আদর্শিক অবস্থানকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি ইরাকে মার্কিন সামরিক হামলা, আবু ঘরাইব জেলখানায় মার্কিনীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অতি সম্প্রতি ইস্রাইলে মার্কিন সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর হত্যার পর মার্কিন প্রশাসনের চুপচাপ থাকার কথা মনে করিয়ে দেন। মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই বাইডেন নিজ দেশে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে ছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্য সফর করার পরেও তার অবস্থান খুব একটা সংহত হয়নি। কাজেই এই মুহুর্তে এটা চিন্তা করা কঠিন যে, মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগেই বাইডেনের জনসমর্থন হঠাত করেই বেড়ে যাবে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে থাকার সময় তার যথেষ্ট কম জনসমর্থন ছিল; আর এই মুহুর্তে বাইডেনের জনসমর্থনও প্রায় একই রকম; প্রায় ৩০ শতাংশের আশেপাশে; যা যথেষ্ট আশংকাজনক। মধ্যপ্রাচ্যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কোন বিজয় না পেয়েই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছেন; যেখানে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও খাদ্যমূল্যের চরম বৃদ্ধির কারণে জনগণ প্রেসিডেন্টের উপর ক্ষেপে রয়েছে।
ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, বাইডেন ক্ষমতায় আসার সময় বলেছিলেন যে, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দের একনায়কদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময়েই সৌদি যুবরাজের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন বলে বলেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিন সালমানের সাথে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকি খাশোগি হত্যাকান্ডে বিন সালমানের জড়িত থাকার ব্যাপারে মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টও তিনি সনসমক্ষে আনার ব্যবস্থা করেছেন। এখন বিন সালমানই বাইডেনকে মার্কিন দ্বিমুখী নীতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তদুপরি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা বাইডেনকে বিন সালমানের কাছে টেনে এনেছে। মার্চ মাসে অপরিশোধিত তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১’শ ৩৯ ডলারে পৌঁছে; আর যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ; যার ফলশ্রুতিতে ডেমোক্র্যাটরা নভেম্বরের নির্বাচনে আসন হারাবে। অথচ বাইডেন তেল উৎপাদন বৃদ্ধির কোন বড় ঘোষণা ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করেছেন; যদিও আসন্ন ওপেক বৈঠকে বাইডেনের জন্যে ভালো খবর থাকতে পারে। বাইডেন যা কিছুই বলেন না কেন, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করছে।
জুলাইয়ের প্রথমভাগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের কেন্দ্রে ছিল সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠক। মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘সিবিএস’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাইডেন সৌদি যুবরাজের সাথে দেখা করার জন্যে রাজি ছিলেন না মোটেই। বিশেষ করে যেখানে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স প্রতিবেদনই বলেছে যে, ২০১৮ সালে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার সিদ্ধান্ত খুব সম্ভবতঃ বিন সালমানই দিয়েছিলেন। এখন তুমুল সমালোচনার মুখে বাইডেনকে বিন সালমানের সাথে বৈঠকের যুক্তিযুক্ততা তুলে ধরতে হচ্ছে। বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে তেলের বাজারে অস্থিরতা কমাতে সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে রাজি করানো, ইস্রাইলের সাথে আরব দেশগুলির সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়াও ইস্রাইলের জন্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করা; এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ধরে রাখার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিকে আস্বস্ত করার ব্যাপারগুলি বিশ্লেষকেরা আলোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার ইস্যুগুলিকে সকলেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন।
জো বাইডেন জেদ্দায় ‘জিসিসি’র শীর্ষ বৈঠকে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবে না; এবং রাশিয়া, চীন ও ইরানের মতো দেশের কাছে শূন্যস্থান পূরণের সুযোগও তারা দেবে না। ‘আল জাজিরা’র জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগের পর এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের চীন ও রাশিয়া কেন্দ্রিক বক্তব্যের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রগুলির মাঝে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। একারণেই বাইডেনকে নতুন করে আশ্বাস দিতে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব কমে যায়নি; বরং আফগানিস্তান থেকে সরে আসার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু সম্পদ এখন মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা সম্ভব হবে। বিশারা বলছেন যে, বাইডেন বেশ পরিষ্কার করেই বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে থাকবে তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্যে। এর জন্যে দরকার হলে মানবাধিকারের মতো আদর্শিক ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র ছাড় দেবে; সেটা সৌদি আরব, মিশর বা ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তবে বিশারা আশংকা করছেন যে, মার্কিন জাতীয় স্বার্থের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে একটা নতুন ঠান্ডাযুদ্ধ শুরু হতে পারে; যার একপক্ষে থাকবে রাশিয়া, চীন ও ইরান; অপরপক্ষে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ইস্রাইল এবং আরও কিছু দেশ।
সৌদি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী শিহাবি ‘দ্যা গার্ডিয়ান’কে বলছেন যে, বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যে অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা বললেও তিনি মূলতঃ বিন সালমানের সাথে দেখা করতেই এসেছিলেন। তেল নিয়ে কথা বলা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে চীন এবং রাশিয়ার প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন তিনি। বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে যেকোন কিছু করতে গেলে সৌদি আরবকে বাদ দিয়ে এগুনো যাবে না। বাইডেনের সফর বিন সালমানের জন্যে একটা বড় বিজয় ছিল।
বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার উপর অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে যে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সহায়তায় যতটা সম্ভব পূরণের চেষ্টা করা। তবে সৌদিরা ব্যাপারটাকে মার্কিনীদের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। ‘সিবিএস’এর সাথে এক সাক্ষাতে সৌদি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল বিন আহমেদ আল জুবাইর বলছেন যে, অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ বাড়ানোটাই সমাধান নয়; কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহুর্তে অতিরিক্ত তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা নেই। ‘সিবিএস’ বলছে যে, বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইস্রাইলি বিমানের জন্যে সৌদি আকাশসীমা খুলে দেয়া, ফিলিস্তিনে ফোর-জি প্রযুক্তি চালু, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, লোহিত সাগরে একটা দ্বীপের উন্নয়ন, ইত্যাদি বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছেন। এই বিষয়গুলি মধ্যপ্রাচ্যের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা মার্কিন জনগণের জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না। মানবাধিকার এবং জ্বালানির মূল্যের ব্যাপারেই মার্কিনীর বেশি আগ্রহী।
‘আল জাজিরা’ বলছে যে, মধ্যপ্রাচ্য সফরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাতের পর বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে বেশ খানিকটাই সমস্যা সামলাতে হচ্ছে। বিন সালমানের সাথে বাইডেনের সাক্ষাৎকে কেউই সহজভাবে নিতে পারেনি। এখন উল্টো সৌদি যুবরাজই বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রই তার আদর্শিক অবস্থানকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি ইরাকে মার্কিন সামরিক হামলা, আবু ঘরাইব জেলখানায় মার্কিনীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অতি সম্প্রতি ইস্রাইলে মার্কিন সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর হত্যার পর মার্কিন প্রশাসনের চুপচাপ থাকার কথা মনে করিয়ে দেন। মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই বাইডেন নিজ দেশে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে ছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্য সফর করার পরেও তার অবস্থান খুব একটা সংহত হয়নি। কাজেই এই মুহুর্তে এটা চিন্তা করা কঠিন যে, মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগেই বাইডেনের জনসমর্থন হঠাত করেই বেড়ে যাবে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে থাকার সময় তার যথেষ্ট কম জনসমর্থন ছিল; আর এই মুহুর্তে বাইডেনের জনসমর্থনও প্রায় একই রকম; প্রায় ৩০ শতাংশের আশেপাশে; যা যথেষ্ট আশংকাজনক। মধ্যপ্রাচ্যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কোন বিজয় না পেয়েই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছেন; যেখানে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও খাদ্যমূল্যের চরম বৃদ্ধির কারণে জনগণ প্রেসিডেন্টের উপর ক্ষেপে রয়েছে।
ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, বাইডেন ক্ষমতায় আসার সময় বলেছিলেন যে, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দের একনায়কদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময়েই সৌদি যুবরাজের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবেন বলে বলেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিন সালমানের সাথে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকি খাশোগি হত্যাকান্ডে বিন সালমানের জড়িত থাকার ব্যাপারে মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টও তিনি সনসমক্ষে আনার ব্যবস্থা করেছেন। এখন বিন সালমানই বাইডেনকে মার্কিন দ্বিমুখী নীতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তদুপরি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা বাইডেনকে বিন সালমানের কাছে টেনে এনেছে। মার্চ মাসে অপরিশোধিত তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১’শ ৩৯ ডলারে পৌঁছে; আর যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ; যার ফলশ্রুতিতে ডেমোক্র্যাটরা নভেম্বরের নির্বাচনে আসন হারাবে। অথচ বাইডেন তেল উৎপাদন বৃদ্ধির কোন বড় ঘোষণা ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করেছেন; যদিও আসন্ন ওপেক বৈঠকে বাইডেনের জন্যে ভালো খবর থাকতে পারে। বাইডেন যা কিছুই বলেন না কেন, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করছে।
Friday, 22 July 2022
তেহরানে ইরান-রাশিয়া-তুরস্কের শীর্ষ বৈঠকের গুরুত্ব কতটুকু?
২৩শে জুলাই ২০২২
জুলাইয়ের মাঝামাঝি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রথমবারের মত প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলের বাইরে কোন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তেহরানে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে তার বৈঠককে অনেককেই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। এই বৈঠক এমন সময়ে হলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাত্রই মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন।
বৈরুতের ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর আলী ফাতহুল্লাহ নেজাদ ‘ইউরোনিউজ’কে বলছেন যে, ইরান এতকাল ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কোন পক্ষ নেয়নি। কারণ নিজেদের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করাটা ইরানের একটা প্রধান লক্ষ্য। তবে রুশরা ইরানের সমর্থন আদায়ের জন্যে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করছিলো। পশ্চিমাদেরকে বাইপাস করে চীন এবং রাশিয়ার মতো শক্তির সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে ইরান নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্ত ভিতের উপর রাখতে চাইছে। ইরান চীনের সাথে ২৫ বছরের চুক্তি করেছে; এখন রাশিয়ার সাথেও ২০ বছরের চুক্তির কথা হচ্ছে। এই চুক্তিগুলির শর্তসমূহ খুব একটা পরিষ্কার না হওয়ায় অনেকেই আশংকা করছেন যে, ইরানের নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বাইরের শক্তির কাছ থেকে নিশ্চয়তা আদায় করতে গিয়ে তাদের জাতীয় স্বার্থ বা সম্পদকে জ্বলাঞ্জলি দেবার ঝুঁকি নিতে পারে।
‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ডিরেক্টর আলী ভাইজ ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, পুতিনের তেহরান সফরের মাধ্যমে এই দুই দেশ প্রমাণ করতে চাইছে যে, পশ্চিমা অবরোধের মাঝে তারা একা হয়ে যায়নি; এবং তারা এই অবরোধের মাঝেও বেঁচে থাকতে পারে। প্রয়োজনই ইরান এবং রাশিয়াকে একত্রিত করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া পশ্চিমা অবরোধ এড়াতে ইরানের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে চাইছে। অপরদিকে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সমস্যার মাঝে ইরান তার নিজেদের ডেভেলপ করা অস্ত্রগুলিকে একটা বড় শক্তির কাছে বিক্রি করার সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে। ইরান যেহেতু এর আগেই লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াতে তাদের সমর্থিত মিলিশিয়াদেরকে ড্রোন প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে, কাজেই রাশিয়ার কাছে ড্রোন বিক্রি করতে ইরানের কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এছাড়াও পশ্চিমাদের সাথে পারমাণবিক চুক্তির ব্যাপারে ইরান মোটামুটি সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে যে, তাদেরকে মার্কিন অবরোধ কাঁধে নিয়েই এগুতে হবে। এমতাবস্থায় ইরান বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, অবরোধের মাঝেও তারা বেঁচে থাকতে পারে। এই পরিস্থিতি ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে ফেলছে। আর যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বৃদ্ধি করতে ইরানের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে সেটার ফলাফল আরও খারাপ হতে পারে। প্রফেসর আলী ফাতহুল্লাহ নেজাদ বলছেন যে, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে রাশিয়া বরাবরই সুযোগসন্ধানী থেকেছে। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়া পারমাণবিক চুক্তির আলোচনার বিরোধিতাই করেছে। কাজেই ইরানের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত জোট কোন বাস্তব বিষয় নয়।
আলী ভাইজ বলছেন যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র সীমিত; কারণ উভয় দেশই তেল বিক্রি করে আয় করে; বিশেষ করে চীনের জ্বালানির বাজার ধরার ক্ষেত্রে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়ার সাথে ইরানের বাণিজ্য এখন প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার; যা খুব বেশি বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা কম। অপরপক্ষে চীনের সাথে ইরানের বাণিজ্য প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবিকপক্ষে রাশিয়ার সাথে ইরানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির অনেকটাই কথাসর্বস্ব। জার্মান থিংকট্যাঙ্ক ‘কারপো’র আদনান তাবাতাবাই ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইরান এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনার সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের কঠোর অবরোধের কারণেই এখন ইরানের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্য রুবলে হবার কথা হচ্ছে; যা কিনা এই আলোচনার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর জেফরি ম্যানকফ ‘সিএনবিসি’কে বলছেন যে, যে ব্যাপারটা তিন দেশের স্বার্থের সাথে জড়িত, তা হলো সিরিয়ার সংঘাত। তুরস্ক চাইছে উত্তর সিরিয়াতে কুর্দিদের বিরুদ্ধে আরেকটা সামরিক মিশন শুরু করতে। সিরিয়ার সরকারকে রাশিয়া এবং ইরান সমর্থন দিচ্ছে; এবং সিরিয়ার কুর্দিরাও অনেক ক্ষেত্রেই একই স্বার্থের সাথে যুক্ত। রাশিয়া এবং ইরান উভয়েই তুরস্কের সামরিক মিশনের বিরোধী।
আলী ভাইজ বলছেন যে, তেহরান বৈঠকে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সময় খুব একটা ভালো কাটেনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি মোটামুটি সরাসরিই উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের প্রস্তাবিত সামরিক মিশনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি এই মিশনের ফলাফল ভালো হবে না বলে হুমকিও দিয়েছেন। তবে কৃষ্ণ সাগর ব্যবহার করে ইউক্রেনের জমে থাকা শস্যকে বিদেশে রপ্তানি করার ব্যাপারে রুশ সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে এরদোগান যে চেষ্টাটা করছেন, সেটা তার সিরিয়ার ব্যাপারে ব্যর্থতাকে ঢাকতে সহায়তা করবে।
জেফরি ম্যানকফ বলছেন যে, এমতাবস্থায় তুরস্কের সামনে ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি পুনরায় চালু করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের শস্যের ব্যাপারটা সারা দুনিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা এরদোগানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থানের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্কের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই; আর আগামী বছরের নির্বাচনের আগে এরদোগানের রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ দুর্বল। কাজেই তুরস্কের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে পারলে এরদোগান সেটার সুবিধা পেতে পারেন। তবে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিতে রুশ সম্মতি আদায় করতে এরদোগানের সামনে উত্তর সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক অপারেশনের ইচ্ছা ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কাজেই ইউক্রেন এবং সিরিয়ার সংঘাত বেশ অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত।
তেহরান বৈঠকের মাধ্যমে রাশিয়া এবং ইরান তাদের পারস্পরিক বাণিজ্যকে খুব বেশি এগিয়ে নিতে না পারলেও নিজেদের কঠিন সময়ে তারা একে অপরকে কাছে টেনে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সামনে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে; তবে এই প্রশ্ন কৌশলগত কোন জোটের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে না; কারণ উভয়ের স্বার্থ যথেষ্টই ভিন্ন। অপরদিকে কঠিন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এরদোগান কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্যে রাশিয়ার সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করে আগামী নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে সংহত করতে চাইছেন। বিনিময়ে তিনি হয়তো সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক মিশনকে আপাততঃ মুলতুবি করতে রাজি হবেন; যদিও এই সিদ্ধান্ত হয়তো তিনি আগেই নিয়েছেন। তেহরান বৈঠক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের একটা প্রত্যুত্তর হিসেবে এলেও এর ভূরাজনৈতিক ফায়দা লোটার সক্ষমতা সকলের সামনেই সীমিত।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রথমবারের মত প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলের বাইরে কোন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তেহরানে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে তার বৈঠককে অনেককেই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। এই বৈঠক এমন সময়ে হলো, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাত্রই মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন।
বৈরুতের ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর আলী ফাতহুল্লাহ নেজাদ ‘ইউরোনিউজ’কে বলছেন যে, ইরান এতকাল ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কোন পক্ষ নেয়নি। কারণ নিজেদের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করাটা ইরানের একটা প্রধান লক্ষ্য। তবে রুশরা ইরানের সমর্থন আদায়ের জন্যে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করছিলো। পশ্চিমাদেরকে বাইপাস করে চীন এবং রাশিয়ার মতো শক্তির সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে ইরান নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্ত ভিতের উপর রাখতে চাইছে। ইরান চীনের সাথে ২৫ বছরের চুক্তি করেছে; এখন রাশিয়ার সাথেও ২০ বছরের চুক্তির কথা হচ্ছে। এই চুক্তিগুলির শর্তসমূহ খুব একটা পরিষ্কার না হওয়ায় অনেকেই আশংকা করছেন যে, ইরানের নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বাইরের শক্তির কাছ থেকে নিশ্চয়তা আদায় করতে গিয়ে তাদের জাতীয় স্বার্থ বা সম্পদকে জ্বলাঞ্জলি দেবার ঝুঁকি নিতে পারে।
‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ডিরেক্টর আলী ভাইজ ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, পুতিনের তেহরান সফরের মাধ্যমে এই দুই দেশ প্রমাণ করতে চাইছে যে, পশ্চিমা অবরোধের মাঝে তারা একা হয়ে যায়নি; এবং তারা এই অবরোধের মাঝেও বেঁচে থাকতে পারে। প্রয়োজনই ইরান এবং রাশিয়াকে একত্রিত করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া পশ্চিমা অবরোধ এড়াতে ইরানের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে চাইছে। অপরদিকে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সমস্যার মাঝে ইরান তার নিজেদের ডেভেলপ করা অস্ত্রগুলিকে একটা বড় শক্তির কাছে বিক্রি করার সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে। ইরান যেহেতু এর আগেই লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াতে তাদের সমর্থিত মিলিশিয়াদেরকে ড্রোন প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে, কাজেই রাশিয়ার কাছে ড্রোন বিক্রি করতে ইরানের কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। এছাড়াও পশ্চিমাদের সাথে পারমাণবিক চুক্তির ব্যাপারে ইরান মোটামুটি সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে যে, তাদেরকে মার্কিন অবরোধ কাঁধে নিয়েই এগুতে হবে। এমতাবস্থায় ইরান বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, অবরোধের মাঝেও তারা বেঁচে থাকতে পারে। এই পরিস্থিতি ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে ফেলছে। আর যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বৃদ্ধি করতে ইরানের উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে সেটার ফলাফল আরও খারাপ হতে পারে। প্রফেসর আলী ফাতহুল্লাহ নেজাদ বলছেন যে, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ব্যাপারে রাশিয়া বরাবরই সুযোগসন্ধানী থেকেছে। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়া পারমাণবিক চুক্তির আলোচনার বিরোধিতাই করেছে। কাজেই ইরানের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত জোট কোন বাস্তব বিষয় নয়।
আলী ভাইজ বলছেন যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্র সীমিত; কারণ উভয় দেশই তেল বিক্রি করে আয় করে; বিশেষ করে চীনের জ্বালানির বাজার ধরার ক্ষেত্রে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়ার সাথে ইরানের বাণিজ্য এখন প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার; যা খুব বেশি বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা কম। অপরপক্ষে চীনের সাথে ইরানের বাণিজ্য প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবিকপক্ষে রাশিয়ার সাথে ইরানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির অনেকটাই কথাসর্বস্ব। জার্মান থিংকট্যাঙ্ক ‘কারপো’র আদনান তাবাতাবাই ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইরান এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনার সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের কঠোর অবরোধের কারণেই এখন ইরানের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্য রুবলে হবার কথা হচ্ছে; যা কিনা এই আলোচনার গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর জেফরি ম্যানকফ ‘সিএনবিসি’কে বলছেন যে, যে ব্যাপারটা তিন দেশের স্বার্থের সাথে জড়িত, তা হলো সিরিয়ার সংঘাত। তুরস্ক চাইছে উত্তর সিরিয়াতে কুর্দিদের বিরুদ্ধে আরেকটা সামরিক মিশন শুরু করতে। সিরিয়ার সরকারকে রাশিয়া এবং ইরান সমর্থন দিচ্ছে; এবং সিরিয়ার কুর্দিরাও অনেক ক্ষেত্রেই একই স্বার্থের সাথে যুক্ত। রাশিয়া এবং ইরান উভয়েই তুরস্কের সামরিক মিশনের বিরোধী।
আলী ভাইজ বলছেন যে, তেহরান বৈঠকে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সময় খুব একটা ভালো কাটেনি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি মোটামুটি সরাসরিই উত্তর সিরিয়াতে তুরস্কের প্রস্তাবিত সামরিক মিশনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি এই মিশনের ফলাফল ভালো হবে না বলে হুমকিও দিয়েছেন। তবে কৃষ্ণ সাগর ব্যবহার করে ইউক্রেনের জমে থাকা শস্যকে বিদেশে রপ্তানি করার ব্যাপারে রুশ সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে এরদোগান যে চেষ্টাটা করছেন, সেটা তার সিরিয়ার ব্যাপারে ব্যর্থতাকে ঢাকতে সহায়তা করবে।
জেফরি ম্যানকফ বলছেন যে, এমতাবস্থায় তুরস্কের সামনে ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি পুনরায় চালু করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের শস্যের ব্যাপারটা সারা দুনিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা এরদোগানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থানের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্কের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই; আর আগামী বছরের নির্বাচনের আগে এরদোগানের রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ দুর্বল। কাজেই তুরস্কের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে পারলে এরদোগান সেটার সুবিধা পেতে পারেন। তবে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিতে রুশ সম্মতি আদায় করতে এরদোগানের সামনে উত্তর সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক অপারেশনের ইচ্ছা ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কাজেই ইউক্রেন এবং সিরিয়ার সংঘাত বেশ অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত।
তেহরান বৈঠকের মাধ্যমে রাশিয়া এবং ইরান তাদের পারস্পরিক বাণিজ্যকে খুব বেশি এগিয়ে নিতে না পারলেও নিজেদের কঠিন সময়ে তারা একে অপরকে কাছে টেনে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমাদের সামনে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে; তবে এই প্রশ্ন কৌশলগত কোন জোটের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে না; কারণ উভয়ের স্বার্থ যথেষ্টই ভিন্ন। অপরদিকে কঠিন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এরদোগান কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্যে রাশিয়ার সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করে আগামী নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে সংহত করতে চাইছেন। বিনিময়ে তিনি হয়তো সিরিয়াতে তুরস্কের সামরিক মিশনকে আপাততঃ মুলতুবি করতে রাজি হবেন; যদিও এই সিদ্ধান্ত হয়তো তিনি আগেই নিয়েছেন। তেহরান বৈঠক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের একটা প্রত্যুত্তর হিসেবে এলেও এর ভূরাজনৈতিক ফায়দা লোটার সক্ষমতা সকলের সামনেই সীমিত।
Wednesday, 13 July 2022
শিনজো আবে জীবন দিয়ে জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়ে গেলেন
১৩ই জুলাই ২০২২
গত ৮ই জুলাই জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। আবের হত্যাকান্ডের মাত্র দু’দিনের মাথায় জাপানের ক্ষমতাসীন ‘লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘এলডিপি’ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে বড় বিজয় পেয়েছে। অনেকেই বলছেন যে, এর ফলে জাপানের রাজনীতিতে বহুদিনের আলোচিত বিষয় সাংবিধানিক পরিবর্তন একটা ফলাফল দেখবে। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আবের হত্যাকান্ড ক্ষমতাসীনদের বিজয়ের ব্যবধানকে বাড়িয়ে দিতে পারে; নির্বাচনের ফলাফল এখন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪৯ শতাংশ মানুষ ভোট দিলেও এবারে দিয়েছে ৫২ শতাংশ মানুষ। জাপানের ‘কিয়োদো’ বার্তা সংস্থা বলছে যে, এটা ২০১৩ সালের পর থেকে ‘এলডিপি’র সবচাইতে বড় বিজয় ছিল। বিরোধী দল ‘কন্সটিটিউশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান’, যারা সংবিধান পরিবর্তনের বিরোধী, তারা ৬টা আসন হারিয়েছে। দলের নেতা ইউকো মোরি বলছেন যে, শান্তিবাদী সংবিধানের মাধ্যমে আশেপাশের দেশগুলির সাথে জাপানের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। এই সংবিধান পরিবর্তন করলে বিশেষ করে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। আঞ্চলিকভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এখানকার শান্তি বিনষ্ট করবে।
জাপানের সাংবিধানিক পরিবর্তন আঞ্চলিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে মার্কিন সামরিক নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় জাপানের সংবিধান লেখা হয়েছিল; যেখানে বলা হয়েছে যে, জাপান অস্বীকার করছে যে, যুদ্ধ করতে পারাটা একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে আঞ্চলিকভাবে চীনের বহির্মুখী পররাষ্ট্রনীতি এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষণের প্রেক্ষিতে জাপানে সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছিলেন। এর সপক্ষে জনমতও গড়ে উঠছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই।
জাপানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনের আগে সকলেই মোটামুটিভাবে জানতেন যে, ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ছিল বিজয়ের ব্যবধান নিয়ে। অর্থাৎ কত বেশি আসন নিয়ে তারা পাস করবে। কারণ এর উপরেই নির্ভর করবে জাপানের শান্তিবাদী সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে কিনা। সংবিধান পরিবর্তনে উচ্চকক্ষের ২’শ ৪৮ আসনের মাঝে দুই তৃতীয়াংশ বা প্রায় ১’শ ৬৬টা আসনের সমর্থন প্রয়োজন হবে। জাপানের ‘কিয়োদো’ সংবাদ সংস্থা বলছে যে, এবারের নির্বাচন সংবিধান পরিবর্তনের জন্যে সবচাইতে বড় বিজয় এনে দিয়েছে। কারণ ক্ষমতাসীন ‘এলডিপি’ দল এবং তাদের কোয়ালিশন দল ‘কোমেইতো’ নতুন করে মোট ৭৬টা আসন পেয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের জোট ছাড়াও সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে বিরোধী দল ‘জাপান ইনোভেশন পার্টি’ এবং ‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্যা পিপল’ মিলে মোট আসন হবে ১’শ ৭৯টা; যা কিনা দুই তৃতীয়াংশের চাইতে অনেক বেশি। এই দলগুলির ইতোমধ্যেই পার্লামেন্টের নিম্নপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সংগরিষ্ঠতা রয়েছে। ‘কোমেইতো’ একটা শান্তিবাদী দল হলেও মাত্র কিছুদিন আগেই তারা জাপানের সামরিক বাহিনীর সাংবিধানিক ভিত্তি পরিবর্তনের ব্যাপারে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের সাথে শুধু পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনই নয়, সামরিক বাজেটের পরিবর্তনের কথাও উঠেছে। সামরিক বাজেট বৃদ্ধির পক্ষে জাপানে একটা শক্ত জনমত গড়ে উঠেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ‘এলডিপি’র নিগাতা প্রদেশের রাজনীতিবিদ কাজুহিরো কোবাইয়াশি ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’কে বলছেন যে, একসময় সংবিধান পরিবর্তনের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলাই যেতো না; এখন মানুষ মনোযোগ দিয়েই শোনে। আপাততঃ জাপানের প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের মতো থাকলেও সরকার চাইছে তা দ্বিগুণ করে ২ শতাংশে উন্নীত করতে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর রবার্ট ওয়ার্ড ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, এখন প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সামরিক বাজেট বৃদ্ধির জন্যে একটা সবুজ সংকেত পেলেন।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, কাজটা সহজ হবে না। জাপানের ‘রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ইয়োইচিরো সাতো ‘আল জাজিরা’র এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন যে, জাপানের সামরিক বাজেট বৃদ্ধিটা সম্ভবতঃ ধীরে ধীরেই হবে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই হঠাৎ বাজেট বৃদ্ধি করাটা কঠিন। শুধু সামরিক বাজেট নয়, জাপানের বৃদ্ধ জনগণের পেনশন, করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন ভর্তুকি, অর্থনীতিতে গতি আনার লক্ষ্যে নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া, ইত্যাদি ক্ষেত্রের জন্যেও অনেক অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। এই অর্থায়ন দ্রুত আনার একটা পদ্ধতি হলো ‘কনজাম্পশন ট্যাক্স’ বা মানুষের খরচের উপর কর; যা মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব যেহেতু ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে, কাজেই এই অর্থায়নগুলিকে তারা হয়তো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের পক্ষেই থাকবে।
জাপানের অনেকগুলি অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে; যার মাঝে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মানুষের আয়ে স্থবিরতা অন্যতম। কিছুদিন আগেই জাপানের সরকারি টেলিভিশন ‘এনএইচকে’র এক জরিপে বলে হয় যে, দেশের ৪২ শতাংশ জনগণই দেশের অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারে বেশি খেয়াল রাখছে; মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ দেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাকে চিন্তার কেন্দ্রে রেখেছে। তদুপরি জাপানে ধীরেধীরে জনমত পরিবর্তিত হচ্ছে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জাপানের জনমত অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে। একসময় কেউই বিশ্বাস করতো না যে চীন তাইওয়ানকে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু ইউক্রেনের উপর রুশ হামলার পর অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, চীন এহেন কোন কর্মকান্ডে জড়ালে জাপান কিছু করার জন্যে প্রস্তুত কিনা। ‘এলডিপি’ জাপানের সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া ছাড়াও আক্রান্ত হবার আগেই শত্রুর উপর সামরিক হামলা করার অধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা পক্ষপাতি। জাপানের রাজনৈতিক পত্রিকা ‘ইনসাইডলাইন’এর প্রধান সম্পাদক তাকাও তোশিকাওয়ার মতে, দুই দশকের মাঝে এবারের নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হয়েছে। তবে জাপানের নিরাপত্তা চিন্তার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় প্রভাবক হলো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে, বিশেষ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে, জাপানকে আরও কর্মক্ষম দেখতে ইচ্ছুক। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রচিত জাপানের সংবিধান দেশটাকে শান্তিকামী করে রেখেছে। এখন সেই একই সংবিধানকে পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শিনজো আবের মৃত্যু জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের প্রচেষ্ঠাটাকে এগিয়ে নিলেও এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই অনেকের ধারণা।
গত ৮ই জুলাই জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। আবের হত্যাকান্ডের মাত্র দু’দিনের মাথায় জাপানের ক্ষমতাসীন ‘লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘এলডিপি’ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে বড় বিজয় পেয়েছে। অনেকেই বলছেন যে, এর ফলে জাপানের রাজনীতিতে বহুদিনের আলোচিত বিষয় সাংবিধানিক পরিবর্তন একটা ফলাফল দেখবে। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আবের হত্যাকান্ড ক্ষমতাসীনদের বিজয়ের ব্যবধানকে বাড়িয়ে দিতে পারে; নির্বাচনের ফলাফল এখন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪৯ শতাংশ মানুষ ভোট দিলেও এবারে দিয়েছে ৫২ শতাংশ মানুষ। জাপানের ‘কিয়োদো’ বার্তা সংস্থা বলছে যে, এটা ২০১৩ সালের পর থেকে ‘এলডিপি’র সবচাইতে বড় বিজয় ছিল। বিরোধী দল ‘কন্সটিটিউশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান’, যারা সংবিধান পরিবর্তনের বিরোধী, তারা ৬টা আসন হারিয়েছে। দলের নেতা ইউকো মোরি বলছেন যে, শান্তিবাদী সংবিধানের মাধ্যমে আশেপাশের দেশগুলির সাথে জাপানের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। এই সংবিধান পরিবর্তন করলে বিশেষ করে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। আঞ্চলিকভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এখানকার শান্তি বিনষ্ট করবে।
জাপানের সাংবিধানিক পরিবর্তন আঞ্চলিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে মার্কিন সামরিক নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় জাপানের সংবিধান লেখা হয়েছিল; যেখানে বলা হয়েছে যে, জাপান অস্বীকার করছে যে, যুদ্ধ করতে পারাটা একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে আঞ্চলিকভাবে চীনের বহির্মুখী পররাষ্ট্রনীতি এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষণের প্রেক্ষিতে জাপানে সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছিলেন। এর সপক্ষে জনমতও গড়ে উঠছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই।
জাপানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনের আগে সকলেই মোটামুটিভাবে জানতেন যে, ক্ষমতাসীন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ছিল বিজয়ের ব্যবধান নিয়ে। অর্থাৎ কত বেশি আসন নিয়ে তারা পাস করবে। কারণ এর উপরেই নির্ভর করবে জাপানের শান্তিবাদী সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে কিনা। সংবিধান পরিবর্তনে উচ্চকক্ষের ২’শ ৪৮ আসনের মাঝে দুই তৃতীয়াংশ বা প্রায় ১’শ ৬৬টা আসনের সমর্থন প্রয়োজন হবে। জাপানের ‘কিয়োদো’ সংবাদ সংস্থা বলছে যে, এবারের নির্বাচন সংবিধান পরিবর্তনের জন্যে সবচাইতে বড় বিজয় এনে দিয়েছে। কারণ ক্ষমতাসীন ‘এলডিপি’ দল এবং তাদের কোয়ালিশন দল ‘কোমেইতো’ নতুন করে মোট ৭৬টা আসন পেয়েছে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের জোট ছাড়াও সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে বিরোধী দল ‘জাপান ইনোভেশন পার্টি’ এবং ‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্যা পিপল’ মিলে মোট আসন হবে ১’শ ৭৯টা; যা কিনা দুই তৃতীয়াংশের চাইতে অনেক বেশি। এই দলগুলির ইতোমধ্যেই পার্লামেন্টের নিম্নপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সংগরিষ্ঠতা রয়েছে। ‘কোমেইতো’ একটা শান্তিবাদী দল হলেও মাত্র কিছুদিন আগেই তারা জাপানের সামরিক বাহিনীর সাংবিধানিক ভিত্তি পরিবর্তনের ব্যাপারে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের সাথে শুধু পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনই নয়, সামরিক বাজেটের পরিবর্তনের কথাও উঠেছে। সামরিক বাজেট বৃদ্ধির পক্ষে জাপানে একটা শক্ত জনমত গড়ে উঠেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ‘এলডিপি’র নিগাতা প্রদেশের রাজনীতিবিদ কাজুহিরো কোবাইয়াশি ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’কে বলছেন যে, একসময় সংবিধান পরিবর্তনের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলাই যেতো না; এখন মানুষ মনোযোগ দিয়েই শোনে। আপাততঃ জাপানের প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের মতো থাকলেও সরকার চাইছে তা দ্বিগুণ করে ২ শতাংশে উন্নীত করতে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর রবার্ট ওয়ার্ড ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, এখন প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সামরিক বাজেট বৃদ্ধির জন্যে একটা সবুজ সংকেত পেলেন।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, কাজটা সহজ হবে না। জাপানের ‘রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ইয়োইচিরো সাতো ‘আল জাজিরা’র এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন যে, জাপানের সামরিক বাজেট বৃদ্ধিটা সম্ভবতঃ ধীরে ধীরেই হবে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই হঠাৎ বাজেট বৃদ্ধি করাটা কঠিন। শুধু সামরিক বাজেট নয়, জাপানের বৃদ্ধ জনগণের পেনশন, করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন ভর্তুকি, অর্থনীতিতে গতি আনার লক্ষ্যে নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া, ইত্যাদি ক্ষেত্রের জন্যেও অনেক অর্থায়ন প্রয়োজন হবে। এই অর্থায়ন দ্রুত আনার একটা পদ্ধতি হলো ‘কনজাম্পশন ট্যাক্স’ বা মানুষের খরচের উপর কর; যা মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব যেহেতু ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে, কাজেই এই অর্থায়নগুলিকে তারা হয়তো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের পক্ষেই থাকবে।
জাপানের অনেকগুলি অভ্যন্তরীণ সমস্যা রয়েছে; যার মাঝে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মানুষের আয়ে স্থবিরতা অন্যতম। কিছুদিন আগেই জাপানের সরকারি টেলিভিশন ‘এনএইচকে’র এক জরিপে বলে হয় যে, দেশের ৪২ শতাংশ জনগণই দেশের অর্থনৈতিক নীতির ব্যাপারে বেশি খেয়াল রাখছে; মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ দেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাকে চিন্তার কেন্দ্রে রেখেছে। তদুপরি জাপানে ধীরেধীরে জনমত পরিবর্তিত হচ্ছে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জাপানের জনমত অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে। একসময় কেউই বিশ্বাস করতো না যে চীন তাইওয়ানকে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু ইউক্রেনের উপর রুশ হামলার পর অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, চীন এহেন কোন কর্মকান্ডে জড়ালে জাপান কিছু করার জন্যে প্রস্তুত কিনা। ‘এলডিপি’ জাপানের সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া ছাড়াও আক্রান্ত হবার আগেই শত্রুর উপর সামরিক হামলা করার অধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা করা পক্ষপাতি। জাপানের রাজনৈতিক পত্রিকা ‘ইনসাইডলাইন’এর প্রধান সম্পাদক তাকাও তোশিকাওয়ার মতে, দুই দশকের মাঝে এবারের নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হয়েছে। তবে জাপানের নিরাপত্তা চিন্তার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় প্রভাবক হলো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে, বিশেষ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণে, জাপানকে আরও কর্মক্ষম দেখতে ইচ্ছুক। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রচিত জাপানের সংবিধান দেশটাকে শান্তিকামী করে রেখেছে। এখন সেই একই সংবিধানকে পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শিনজো আবের মৃত্যু জাপানের সংবিধান পরিবর্তনের প্রচেষ্ঠাটাকে এগিয়ে নিলেও এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই অনেকের ধারণা।
Tuesday, 12 July 2022
উজবেকিস্তানের সহিংসতার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
১২ই জুলাই ২০২২
গত ১লা জুলাই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের কারাকালপাকস্তান অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮ জন নিহত হয় এবং আরও কয়েক’শ আহত হয়। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওইয়েভের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তন কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তন মূলতঃ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াবার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু এখানে কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারেও কিছু থাকতে পারে, তা অনেকেই চিন্তা করেননি। সোভিয়েত সময় থেকেই এই অঞ্চল উজবেকিস্তানের সাথে যুক্ত রয়েছে শায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে। সংবিধানের নতুন প্রস্তাবে দেশের কোন অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হবার ক্ষমতাকে বন্ধ করা হয়েছে। তবে বড় কোন সহিংসতা এখানে এবারই প্রথম। উজবেক সরকার বলছে যে, বিদেশী ইন্ধনে বহুদিনের পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে; যার উদ্দেশ্য হলো উজবেকিস্তানের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং জাতিগত বৈষম্যের জন্ম দেয়া।
‘আল জাজিরা’র এক লেখায় মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ফেলো ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস বলছেন যে, উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওইয়েভ ২০১৬ সালে ক্ষমতা নেবার পর থেকে অনেক ধরণের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেদেশে রুশ প্রভাব নিয়ন্ত্রণের সাথেসাথে তিনি পশ্চিমা দেশগুলি এবং চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছেন। তিনি সেদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন এবং সংবাদপত্রগুলিকে বেশকিছুটা স্বাধীনতাও দিয়েছেন। হেস দুশ্চিন্তা করছেন যে, কারাকালপাকস্থানের এই সহিংসতার কারণে উজবেকিস্তানের সংস্কারগুলি বুঝি আবারও বন্ধ হতে চললো। মিরিজিওইয়েভ যেভাবে বিদ্রোহ দমন করেছেন, তাতে তিনি তার পূর্বসুরী ইসলাম কারিমভের কঠোর শাসনকেই হয়তো অনুসরণ করতে যাচ্ছেন।
তবে এখানে কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের বাস্তবতা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের সংস্কার নীতির আলোচনা যুক্তিযুক্ত নয়। কারাকালপাকস্তান অঞ্চল উজবেকিস্তানের সবচাইতে কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির একটা। দেশের সাড়ে ৩ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ২০ লক্ষ থাকে এই অঞ্চলে। প্রধানতঃ মরু এই অঞ্চল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ আরল সাগরের জন্যে পরিচিত। কিন্তু এখানকার পরিবেশ এবং অর্থনীতি গত কয়েক দশকের মাঝে মারাত্মক সমস্যার মুখে পতিত হয়েছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে নরওয়ের ‘অসলো ইউনিভার্সিটি’ এবং ‘দ্যা জার্নাল অব দ্যা নরওয়েজিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন’এর যৌথ প্রচেষ্টায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় যে, মধ্য এশিয়ার বিশাল হ্রদ আরল সাগর এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সোভিয়েত সময় থেকে আরল সাগরে পতিত হওয়া নদীগুলি থেকে পানি প্রত্যাহার করে তুলার চাষ করা হয়েছে। অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের ফলে এখন আরল সাগর প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। আর এর স্থলে এখন রয়ে গেছে লবণ এবং কীটনাশকের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটা বিষাক্ত পরিবেশ; যা মানুষের শরীরে ক্যান্সার, যক্ষ্মা এবং রক্তশূণ্যতার মতো নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারাকালপাকস্তান বর্তমানে একটা অর্থনৈতিক দুর্দশার নাম। উজবেকিস্তানের সবচাইতে বেশি নবজাতক মৃত্যুর হার হলো এই অঞ্চলে। এছাড়াও শিশুদের মাঝে বক্ষব্যাধি এবং কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব অত্যধিক বেশি।
কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্দোলন করলেও বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাঁচার সম্ভাবনা তাদের যথেষ্টই কম। পুরো অঞ্চলের জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ হলো জাতি হিসেবে কারাকালপাক; বাকিরা কাজাখ এবং উজবেক। কারাকালপাকদের নিজস্ব ভাষা, লাইব্রেরি এবং সংস্কৃতিও রয়েছে। তবে উজবেক সরকার এই অঞ্চলকে ভুলে যায়নি। ২০২২ সালেই সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কারাকালপাকস্তান অঞ্চলে এবছরের মাঝেই ৭’শ ৩১টা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সেখানে ২’শ ৫৬টা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৮ হাজার ৬’শ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২১ সালে কারাকালপাকস্তান এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল খোরেজমে ৭’শ ৬৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে মোট ৮৩টা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; যার মাঝে একটা বড় অংশ ছিল বিদেশী বিনিয়োগ। এর আগে ২০১৭ সালে ১’শ কিঃমিঃ পাইপলাইনের মাধ্যমে সেখানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের জন্যে বিশুদ্ধ্ব খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। উজিবেক পত্রিকা ‘গ্যাজেটা’র এক খবরে বলা হয় যে, দৈনিক ৭ হাজার কিউবিক মিটার পানির সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে শুকিয়ে যাওয়া আমু দড়িয়া নদী এবং কূপগুলির পানিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। ২০২০ সালের অগাস্টে ‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, উজবেক সরকার কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের শহর ময়নাকের সাথে ৩০ বছর পর বিমান যোগাযোগ চালু করেছে; যার মাধ্যমে সরকার সেখানে পর্যটন এবং বিনিয়োগ নিয়ে যেতে চাইছে। শহরটার বিমানবন্দরের উন্নয়নে সরকার ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। আরল সাগর শুকিয়ে যাবার কারণে একসময়কার মৎস্যবন্দর এই শহরের জনসংখ্যা ৩০ হাজার থেকে কমে ১১ হাজার হয়ে গেছে।
‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর জেনিফার ব্রিক মুরতাজাসভিলি বলছেন যে, এই সহিংসতার ফলে কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের মানুষের সাথে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলি হয়তো এখন উজবেক সরকারের উপর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করবে।
মিরজিওইয়েভ অবশ্য ইতোমধ্যেই কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারে সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় যে, তিনি কেনই বা এটা করতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা ধাঁচের একটা উজবেকিস্তান তৈরির পথে এগুচ্ছেন; তবে এই পথে তার নিয়ন্ত্রণ কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উজবেকিস্তানের তুলার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল শিল্প পশ্চিমা দেশগুলিতে তাদের পণ্য বিক্রি করে উপার্জন করছে। কিন্তু খুব কম মানুষই খোঁজ রেখেছে যে, পশ্চিমাদের জন্যে পোষাক তৈরি করতে গিয়ে আরল সাগর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্জয় কত মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের লিবারাল চিন্তার মানুষদের কাছে উজবেকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কার, বাকস্বাধীনতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করার মত উদারতা মানুষের জীবনের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি তারা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি। একদিকে পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত; অপরদিকে তারা সন্তুষ্ট যে, মিরিজিওইয়েভ অন্ততঃ পশ্চিমাদের সাথে ভালো সম্পর্কই রেখেছেন। সহিংসতার পরেও পশ্চিমাদের উপর মিরজিওইয়েভের নির্ভরশীলতা না কমে বরং আরও বাড়বে।
গত ১লা জুলাই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের কারাকালপাকস্তান অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮ জন নিহত হয় এবং আরও কয়েক’শ আহত হয়। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওইয়েভের প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তন কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই মনে করেছিলেন যে, প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তন মূলতঃ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াবার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু এখানে কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারেও কিছু থাকতে পারে, তা অনেকেই চিন্তা করেননি। সোভিয়েত সময় থেকেই এই অঞ্চল উজবেকিস্তানের সাথে যুক্ত রয়েছে শায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে। সংবিধানের নতুন প্রস্তাবে দেশের কোন অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হবার ক্ষমতাকে বন্ধ করা হয়েছে। তবে বড় কোন সহিংসতা এখানে এবারই প্রথম। উজবেক সরকার বলছে যে, বিদেশী ইন্ধনে বহুদিনের পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে; যার উদ্দেশ্য হলো উজবেকিস্তানের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং জাতিগত বৈষম্যের জন্ম দেয়া।
‘আল জাজিরা’র এক লেখায় মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ফেলো ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস বলছেন যে, উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওইয়েভ ২০১৬ সালে ক্ষমতা নেবার পর থেকে অনেক ধরণের সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেদেশে রুশ প্রভাব নিয়ন্ত্রণের সাথেসাথে তিনি পশ্চিমা দেশগুলি এবং চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছেন। তিনি সেদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন এবং সংবাদপত্রগুলিকে বেশকিছুটা স্বাধীনতাও দিয়েছেন। হেস দুশ্চিন্তা করছেন যে, কারাকালপাকস্থানের এই সহিংসতার কারণে উজবেকিস্তানের সংস্কারগুলি বুঝি আবারও বন্ধ হতে চললো। মিরিজিওইয়েভ যেভাবে বিদ্রোহ দমন করেছেন, তাতে তিনি তার পূর্বসুরী ইসলাম কারিমভের কঠোর শাসনকেই হয়তো অনুসরণ করতে যাচ্ছেন।
তবে এখানে কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের বাস্তবতা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের সংস্কার নীতির আলোচনা যুক্তিযুক্ত নয়। কারাকালপাকস্তান অঞ্চল উজবেকিস্তানের সবচাইতে কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলির একটা। দেশের সাড়ে ৩ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ২০ লক্ষ থাকে এই অঞ্চলে। প্রধানতঃ মরু এই অঞ্চল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ আরল সাগরের জন্যে পরিচিত। কিন্তু এখানকার পরিবেশ এবং অর্থনীতি গত কয়েক দশকের মাঝে মারাত্মক সমস্যার মুখে পতিত হয়েছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে নরওয়ের ‘অসলো ইউনিভার্সিটি’ এবং ‘দ্যা জার্নাল অব দ্যা নরওয়েজিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন’এর যৌথ প্রচেষ্টায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয় যে, মধ্য এশিয়ার বিশাল হ্রদ আরল সাগর এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সোভিয়েত সময় থেকে আরল সাগরে পতিত হওয়া নদীগুলি থেকে পানি প্রত্যাহার করে তুলার চাষ করা হয়েছে। অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের ফলে এখন আরল সাগর প্রায় পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। আর এর স্থলে এখন রয়ে গেছে লবণ এবং কীটনাশকের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটা বিষাক্ত পরিবেশ; যা মানুষের শরীরে ক্যান্সার, যক্ষ্মা এবং রক্তশূণ্যতার মতো নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারাকালপাকস্তান বর্তমানে একটা অর্থনৈতিক দুর্দশার নাম। উজবেকিস্তানের সবচাইতে বেশি নবজাতক মৃত্যুর হার হলো এই অঞ্চলে। এছাড়াও শিশুদের মাঝে বক্ষব্যাধি এবং কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব অত্যধিক বেশি।
কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্দোলন করলেও বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাঁচার সম্ভাবনা তাদের যথেষ্টই কম। পুরো অঞ্চলের জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ হলো জাতি হিসেবে কারাকালপাক; বাকিরা কাজাখ এবং উজবেক। কারাকালপাকদের নিজস্ব ভাষা, লাইব্রেরি এবং সংস্কৃতিও রয়েছে। তবে উজবেক সরকার এই অঞ্চলকে ভুলে যায়নি। ২০২২ সালেই সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কারাকালপাকস্তান অঞ্চলে এবছরের মাঝেই ৭’শ ৩১টা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সেখানে ২’শ ৫৬টা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৮ হাজার ৬’শ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২১ সালে কারাকালপাকস্তান এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল খোরেজমে ৭’শ ৬৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে মোট ৮৩টা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে; যার মাঝে একটা বড় অংশ ছিল বিদেশী বিনিয়োগ। এর আগে ২০১৭ সালে ১’শ কিঃমিঃ পাইপলাইনের মাধ্যমে সেখানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের জন্যে বিশুদ্ধ্ব খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। উজিবেক পত্রিকা ‘গ্যাজেটা’র এক খবরে বলা হয় যে, দৈনিক ৭ হাজার কিউবিক মিটার পানির সরবরাহ প্রকল্পের মাধ্যমে শুকিয়ে যাওয়া আমু দড়িয়া নদী এবং কূপগুলির পানিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। ২০২০ সালের অগাস্টে ‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, উজবেক সরকার কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের শহর ময়নাকের সাথে ৩০ বছর পর বিমান যোগাযোগ চালু করেছে; যার মাধ্যমে সরকার সেখানে পর্যটন এবং বিনিয়োগ নিয়ে যেতে চাইছে। শহরটার বিমানবন্দরের উন্নয়নে সরকার ৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। আরল সাগর শুকিয়ে যাবার কারণে একসময়কার মৎস্যবন্দর এই শহরের জনসংখ্যা ৩০ হাজার থেকে কমে ১১ হাজার হয়ে গেছে।
‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ‘ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর জেনিফার ব্রিক মুরতাজাসভিলি বলছেন যে, এই সহিংসতার ফলে কারাকালপাকস্তান অঞ্চলের মানুষের সাথে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলি হয়তো এখন উজবেক সরকারের উপর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করবে।
মিরজিওইয়েভ অবশ্য ইতোমধ্যেই কারাকালপাকস্তানের ব্যাপারে সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার নয় যে, তিনি কেনই বা এটা করতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা ধাঁচের একটা উজবেকিস্তান তৈরির পথে এগুচ্ছেন; তবে এই পথে তার নিয়ন্ত্রণ কতটুকু রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উজবেকিস্তানের তুলার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল শিল্প পশ্চিমা দেশগুলিতে তাদের পণ্য বিক্রি করে উপার্জন করছে। কিন্তু খুব কম মানুষই খোঁজ রেখেছে যে, পশ্চিমাদের জন্যে পোষাক তৈরি করতে গিয়ে আরল সাগর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের পরিবেশগত বিপর্জয় কত মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের লিবারাল চিন্তার মানুষদের কাছে উজবেকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কার, বাকস্বাধীনতা এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করার মত উদারতা মানুষের জীবনের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি তারা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি। একদিকে পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত; অপরদিকে তারা সন্তুষ্ট যে, মিরিজিওইয়েভ অন্ততঃ পশ্চিমাদের সাথে ভালো সম্পর্কই রেখেছেন। সহিংসতার পরেও পশ্চিমাদের উপর মিরজিওইয়েভের নির্ভরশীলতা না কমে বরং আরও বাড়বে।
Sunday, 3 July 2022
এরদোগান কেন বিন সালমানকে আলিঙ্গন করছেন?
০৩রা জুলাই ২০২২
গত ২২শে জুন সৌদি যুবরাজ এবং সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান তুরস্ক সফরে যান। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিক উত্তেজনার পর বিন সালমানের এই সফরকে অনেকেই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। বিশেষ করে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটের ভেতর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ডের পর সৌদি আরবের ব্যাপারে তুরস্কের শক্ত অবস্থানের ক্ষেত্রে এই সফর যথেষ্টই বড় পরিবর্তন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের এহেন নীতি পরিবর্তন অনেককেই অবাক করেছে। ২০২০ সাল থেকে সৌদি আরব তুর্কি পণ্যের উপর অনানুষ্ঠানিক অবরোধ বজায় রেখেছিল এবং দুই বছরের ধরে সৌদি নাগরিকদের তুরস্ক ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিন সালমানের সফরের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে এই সফরকে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় বলে আখ্যা দেয়া হয়। একইসাথে বাণিজ্য সহজীকরণ, কর্মকর্তাদের নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন এবং সম্ভাব্য মুদ্রা বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
‘ব্লু-বে এসেট ম্যানেজমেন্ট’এর জ্যেষ্ঠ কৌসুলী টিমথি এশ ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, এরদোগানের এই নীতি পরিবর্তন মূলতঃ অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণেই। আগামী বছরের জুনে তুরস্কে নির্বাচন। এর আগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে ঠেকেছে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে; তুর্কি মুদ্রা লিরা গত এক বছরের মাঝে অর্ধেকের বেশি মূল্য হারিয়েছে। এর মুহুর্তে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তার দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এরদোগের প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা।
লন্ডন ভিত্তিক আরব মিডিয়া ‘দ্যা নিউ এরাব’এর এক লেখায় কাতারের ‘ইবনে খালদুন সেন্টার ফর হিউম্যানিটিজ এন্ড সোশাল সায়েন্সেস’এর গবেষক আলী বাকির এবং লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর ‘ইন্সটিটিউট অব মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ’এর ফেলো এইরুপ এরসয় বলছেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যথেষ্ট এগুলেও সম্পর্ককে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্যে কিছু ঘটেনি। কথা নয়, বরং সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলিই বলে দেবে যে এই সম্পর্ক কতটা আন্তরিক। এক যৌথ বিবৃতিতে অনেক কিছুই বলা হলেও বিবৃতিটা যতটা না সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি, তার চাইতে বরং সহযোগিতার অভিব্যক্তি। মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে বিবৃতির দুইটা ভার্সন সাংবাদিকদের দেয়া হয়। দুই নেতার যৌথ বিবৃতিতে যতটা পরিবর্তন করতে হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, সম্পর্কের ভিত্তি এখনও বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে নয়; বরং স্বার্থের উপর। দুই দেশের মাঝে পর্যটন বাড়াবার কথা বলা হলেও শেষ মুহুর্তে বিবৃতি থেকে পারস্পরিক ফ্লাইট বৃদ্ধি করার বাক্যটা কেটে দেয়া হয়। আর বিবৃতিতে কারুর কোন স্বাক্ষরও নেই। লেখায় বলা হচ্ছে যে, সৌদিরা তাদের চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকার রেকর্ড রয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বেশকিছু অংশই ছিল পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে বাস্তবায়ন করা ব্যাপারে; বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সহযোগিতার ক্ষেত্রে।
‘লন্ডন এনার্জি ক্লাব’ এবং ‘গ্লোবাল রিসোর্সেস পার্টনার্স’এর চেয়ারম্যান মেহমেত ওগুটচু ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, দুই দেশের মাঝে এখনও আস্থার ঘাটতি রয়েছে। উভয় দেশই অঞ্চলিকভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এবং তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখে। তবে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা বিষয়টাকে অনেকেই দুই দেশের মাঝে সমঝোতার জায়গা বলে মনে করছেন। ইরানের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা উভয় দেশেরই সমস্যা। ওগুটচু বলছেন যে, সৌদিরা বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের এখন মূল ফোকাস হলো চীন। কাজেই মার্কিনীরা সামনের দিনগুলিতে সৌদিদের সাথে থাকবে না। এমতাবস্থায় রিয়াদের নেতৃত্ব তুরস্ককে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে দেখছে। তবে এই সম্পর্ক পারস্পরিক দেয়ানেয়ার উপর নির্ভরশীল হবে। কাজেই এখানে উভয় দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত। তথাপি ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে সৌদি যুবরাজ এরদোগানকে আর্থিক দিক থেকে সহায়তার হাত বাড়াবেন কিনা, সেব্যাপারে কোন সমঝোতা দুই দেশের মাঝে হয়নি।
মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর তুর্কি ধারার ডেপুটি ডিরেক্টর পিনার দোস্ত ‘সিএনবিসি’কে বলছেন যে, সৌদিদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারটাকে আঞ্চলিকভাবে অনেক দেশের সাথেই তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইস্রাইলের সাথে তুরস্ক ইতোমধ্যেই সম্পর্কোন্নন করেছে; মিশরের সাথেও তুরস্ক কথা চালাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আঞ্চলিকভাবে তুরস্ক তার একাকীত্ব ঘোচাতে চাইছে। যেমন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্প নিয়ে কয়েকটা দেশ সহযোগিতা করলেও সেখানে তুরস্ককে বাদ রাখা হয়েছে। তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আরও বাড়াতে চাইছে। সৌদি আরবকে তুরস্ক তার পণ্য এবং পর্যটনের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে দেখে। তুরস্কের পণ্যের উপর সৌদিদের অনানুষ্ঠানিক অবরোধ তুরস্কের অর্থনীতিকে সহায়তা দেবে। প্রায় দুই বছর পর গত মে মাসে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মাঝে ফ্লাইট পুনরায় চালু হয়েছে। তবে একইসাথে পিনার দোস্ত মনে করছেন যে, এই সফরের মাধ্যমে ইরান বিরোধী আরব-ইস্রাইলি জোটের আরও কাছাকাছি গিয়েছে তুরস্ক।
‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিন সালমানের তুরস্ক সফর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই এলো। বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতদিন সৌদিদের মানবাধিকার বিষয়ে সমালোচনা করলেও এখন সৌদিদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর নেই। অনেকেই বলছেন যে, বাইডেনের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হবে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে মূল্যস্ফীতি লাগামে আনতে সোদিদেরকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করা; এবং একইসাথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অনুপ্রেরণা যোগানো। বাইডেনের আসন্ন সফরের বাস্তবতায় তুর্কি নীতি পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে টিমথি এশ বলছেন যে, বিন সালমান আঙ্কারা এসে এরদোগানের নিঃশর্ত আত্মসমপর্নকেই যেন গ্রহণ করলেন! এটা প্রমাণ করে যে, এরদোগান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে কতটা চাপের মাঝে রয়েছেন। অর্থনৈতিক চাপ এড়াতে আশেপাশের যেসব দেশের সাথে সম্পর্কে উত্তেজনা ছিল, তাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে তুরস্ক। ইউক্রেনের বন্দরগুলি থেকে জরুরি খাদ্যপণ্যগুলি রপ্তানির অনুমতি দিতে রাশিয়ার সাথে কথা বলছে তুরস্ক। তবে আঞ্চলিকভাবে আরব দেশগুলি এবং ইস্রাইলের আরও কাছাকাছি যাবার কারণে তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে এটা নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সমীকরণ।
গত ২২শে জুন সৌদি যুবরাজ এবং সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান তুরস্ক সফরে যান। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিক উত্তেজনার পর বিন সালমানের এই সফরকে অনেকেই গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। বিশেষ করে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটের ভেতর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ডের পর সৌদি আরবের ব্যাপারে তুরস্কের শক্ত অবস্থানের ক্ষেত্রে এই সফর যথেষ্টই বড় পরিবর্তন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের এহেন নীতি পরিবর্তন অনেককেই অবাক করেছে। ২০২০ সাল থেকে সৌদি আরব তুর্কি পণ্যের উপর অনানুষ্ঠানিক অবরোধ বজায় রেখেছিল এবং দুই বছরের ধরে সৌদি নাগরিকদের তুরস্ক ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিন সালমানের সফরের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে এই সফরকে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় বলে আখ্যা দেয়া হয়। একইসাথে বাণিজ্য সহজীকরণ, কর্মকর্তাদের নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন এবং সম্ভাব্য মুদ্রা বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
‘ব্লু-বে এসেট ম্যানেজমেন্ট’এর জ্যেষ্ঠ কৌসুলী টিমথি এশ ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, এরদোগানের এই নীতি পরিবর্তন মূলতঃ অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণেই। আগামী বছরের জুনে তুরস্কে নির্বাচন। এর আগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে ঠেকেছে; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে; তুর্কি মুদ্রা লিরা গত এক বছরের মাঝে অর্ধেকের বেশি মূল্য হারিয়েছে। এর মুহুর্তে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তার দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এরদোগের প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা।
লন্ডন ভিত্তিক আরব মিডিয়া ‘দ্যা নিউ এরাব’এর এক লেখায় কাতারের ‘ইবনে খালদুন সেন্টার ফর হিউম্যানিটিজ এন্ড সোশাল সায়েন্সেস’এর গবেষক আলী বাকির এবং লন্ডনের ‘কিংস কলেজ’এর ‘ইন্সটিটিউট অব মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ’এর ফেলো এইরুপ এরসয় বলছেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যথেষ্ট এগুলেও সম্পর্ককে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্যে কিছু ঘটেনি। কথা নয়, বরং সামনের দিনগুলিতে দুই দেশের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলিই বলে দেবে যে এই সম্পর্ক কতটা আন্তরিক। এক যৌথ বিবৃতিতে অনেক কিছুই বলা হলেও বিবৃতিটা যতটা না সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি, তার চাইতে বরং সহযোগিতার অভিব্যক্তি। মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে বিবৃতির দুইটা ভার্সন সাংবাদিকদের দেয়া হয়। দুই নেতার যৌথ বিবৃতিতে যতটা পরিবর্তন করতে হয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, সম্পর্কের ভিত্তি এখনও বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে নয়; বরং স্বার্থের উপর। দুই দেশের মাঝে পর্যটন বাড়াবার কথা বলা হলেও শেষ মুহুর্তে বিবৃতি থেকে পারস্পরিক ফ্লাইট বৃদ্ধি করার বাক্যটা কেটে দেয়া হয়। আর বিবৃতিতে কারুর কোন স্বাক্ষরও নেই। লেখায় বলা হচ্ছে যে, সৌদিরা তাদের চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকার রেকর্ড রয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বেশকিছু অংশই ছিল পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে বাস্তবায়ন করা ব্যাপারে; বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সহযোগিতার ক্ষেত্রে।
‘লন্ডন এনার্জি ক্লাব’ এবং ‘গ্লোবাল রিসোর্সেস পার্টনার্স’এর চেয়ারম্যান মেহমেত ওগুটচু ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, দুই দেশের মাঝে এখনও আস্থার ঘাটতি রয়েছে। উভয় দেশই অঞ্চলিকভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এবং তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখে। তবে নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা বিষয়টাকে অনেকেই দুই দেশের মাঝে সমঝোতার জায়গা বলে মনে করছেন। ইরানের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা উভয় দেশেরই সমস্যা। ওগুটচু বলছেন যে, সৌদিরা বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের এখন মূল ফোকাস হলো চীন। কাজেই মার্কিনীরা সামনের দিনগুলিতে সৌদিদের সাথে থাকবে না। এমতাবস্থায় রিয়াদের নেতৃত্ব তুরস্ককে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে দেখছে। তবে এই সম্পর্ক পারস্পরিক দেয়ানেয়ার উপর নির্ভরশীল হবে। কাজেই এখানে উভয় দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত। তথাপি ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে সৌদি যুবরাজ এরদোগানকে আর্থিক দিক থেকে সহায়তার হাত বাড়াবেন কিনা, সেব্যাপারে কোন সমঝোতা দুই দেশের মাঝে হয়নি।
মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর তুর্কি ধারার ডেপুটি ডিরেক্টর পিনার দোস্ত ‘সিএনবিসি’কে বলছেন যে, সৌদিদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারটাকে আঞ্চলিকভাবে অনেক দেশের সাথেই তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অংশ হিসেবে দেখতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইস্রাইলের সাথে তুরস্ক ইতোমধ্যেই সম্পর্কোন্নন করেছে; মিশরের সাথেও তুরস্ক কথা চালাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আঞ্চলিকভাবে তুরস্ক তার একাকীত্ব ঘোচাতে চাইছে। যেমন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্প নিয়ে কয়েকটা দেশ সহযোগিতা করলেও সেখানে তুরস্ককে বাদ রাখা হয়েছে। তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে তার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে আরও বাড়াতে চাইছে। সৌদি আরবকে তুরস্ক তার পণ্য এবং পর্যটনের জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে দেখে। তুরস্কের পণ্যের উপর সৌদিদের অনানুষ্ঠানিক অবরোধ তুরস্কের অর্থনীতিকে সহায়তা দেবে। প্রায় দুই বছর পর গত মে মাসে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মাঝে ফ্লাইট পুনরায় চালু হয়েছে। তবে একইসাথে পিনার দোস্ত মনে করছেন যে, এই সফরের মাধ্যমে ইরান বিরোধী আরব-ইস্রাইলি জোটের আরও কাছাকাছি গিয়েছে তুরস্ক।
‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিন সালমানের তুরস্ক সফর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগেই এলো। বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতদিন সৌদিদের মানবাধিকার বিষয়ে সমালোচনা করলেও এখন সৌদিদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর নেই। অনেকেই বলছেন যে, বাইডেনের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হবে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে মূল্যস্ফীতি লাগামে আনতে সোদিদেরকে তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে অনুরোধ করা; এবং একইসাথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অনুপ্রেরণা যোগানো। বাইডেনের আসন্ন সফরের বাস্তবতায় তুর্কি নীতি পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে টিমথি এশ বলছেন যে, বিন সালমান আঙ্কারা এসে এরদোগানের নিঃশর্ত আত্মসমপর্নকেই যেন গ্রহণ করলেন! এটা প্রমাণ করে যে, এরদোগান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে কতটা চাপের মাঝে রয়েছেন। অর্থনৈতিক চাপ এড়াতে আশেপাশের যেসব দেশের সাথে সম্পর্কে উত্তেজনা ছিল, তাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে তুরস্ক। ইউক্রেনের বন্দরগুলি থেকে জরুরি খাদ্যপণ্যগুলি রপ্তানির অনুমতি দিতে রাশিয়ার সাথে কথা বলছে তুরস্ক। তবে আঞ্চলিকভাবে আরব দেশগুলি এবং ইস্রাইলের আরও কাছাকাছি যাবার কারণে তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন আরও বাড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানে এটা নতুন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সমীকরণ।
Saturday, 2 July 2022
রাশিয়া কি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাসে যুদ্ধ জিততে চলেছে?
০২রা জুলাই ২০২২
গত ২৫শে জুন রাশিয়া ঘোষণা দেয় যে, তাদের সেনারা ইউক্রেনের পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর সেভেরোডোনেতস্ক পুরোপুরিভাবে দখল করে নিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই রুশ বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল এই শহর; আর্টিলারি এবং বিমান হামলায় এখন এই শহরের খুব কমই অবশিষ্ট রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি এক বার্তায় শহরটা হারাবার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, দিনটা ইউক্রেনের মনোবল এবং আবেগের জন্যে খুবই কঠিন একটা দিন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেভেরোডোনেতস্ক শহর দখলের মাধ্যমে ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন আরও এগিয়ে গেলো। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং উত্তরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ছেড়ে আসতে বাধ্য হবার পর থেকে ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়াই রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডনবাস অঞ্চল ডোনেতস্ক এবং লুহানস্ক নামে দু’টা ভাগে বিভক্ত। এই দু’টার যেকোন একটার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার একটা বড় বিজয় বলে দেখাতে পারবেন। অন্ততঃ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নানা বিপর্জয়ের মাঝে রুশ বাহিনীর জন্যে সত্যিকারের যেকোন বিজয় অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেভেরোডোনেতস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর রাশিয়ার জন্যে পুরো লুহানস্ক এলাকা নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। তবে পুরো লুহানস্কের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে নিশ্চিত হচ্ছে না অত তাড়াতাড়ি। এই মুহুর্তে তাদের পথে রয়েছে ইউক্রেনের আরেক শহর লিসিচানস্ক। সেভেরোডোনেতস্ক শহর থেকে পিছু হটে ইউক্রেনিয়ান সেনারা খুব সম্ভবতঃ লিসিচানস্কেই গিয়েছে।
‘বিবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সেভেরোডোনেতস্ক এবং লিসিচানস্ক উভয় শহরই সিভার্স্কি ডোনেতস নদীর তীরে অবস্থিত। একমাস আগে এই নদীটা একবার অতিক্রম করতে গিয়ে রুশরা পুরো একটা ব্যাটালিয়ন হারায়। সেই ব্যর্থ মিশনে ইউক্রেনের আর্টিলারি হামলায় কয়েক’শ রুশ সেনা প্রাণ হারায় এবং কয়েক ডজন সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। এই নদীর উপর সকল সেতু ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এখন লিসিচানস্ক শহর দখলে নিতে হলে রুশদেরকে এই নদীই অতিক্রম করতে হবে। কাজেই এই নদী এখন রুশদের সামনে একটা বড় প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, লিসিচানস্ক শহরটা একটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত হওয়ায় এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা খুব সহজ কাজ হবে না।
‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’ যুদ্ধের প্রথম থেকেই প্রতিদিন ব্রিফিং দিচ্ছে। ২৪শে জুন তাদের বিশ্লেষণে বলা হয় যে, এটা এখন বোধগম্য যে, ইউক্রেনের সেনারা লিসিচানস্কের উঁচু ভূমিতে অবস্থান নেবে; যেখান থেকে তারা হয়তো বেশ কিছু সময় রুশ হামলা প্রতিহত করতে পারবে। এখন রাশিয়ার সামনে করণীয় হলো এই শহরটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করা। সেই লক্ষ্যে রুশরা লিসিচানস্ক শহরকে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে। রুশ সমর্থিত ইউক্রেনিয়ানদের মুখপাত্র আন্দ্রেই মরোচকো সাংবাদিকদের বলেন যে, তারা এখন যে গতিতে এগুচ্ছেন, তাতে তারা শিগগিরই পুরো লুহানস্ক অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। তাদের অবস্থান থেকে তারা এখন লিসিচানস্কে ইউক্রেনিয়ান সেনাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম বলে বলেন তিনি।
কেউ কেউ সেভেরোডোনেতস্ক নিয়ন্ত্রণে যাওয়াকে একটা প্রতীকী বিজয় হিসেবে দেখছেন; যার কৌশলগত গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কমই। ইউক্রেনের সাবেক জেনারেল ইহর রোমানেঙ্কো ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, সেভেরোডোনেতস্ক তার দায়িত্ব পালন করেছে। সামরিক দিক থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা শহরের গুরুত্ব খুব কমই। রুশরা অনেক শক্তি ক্ষয় করেছে; যা সামনের দিনের যুদ্ধে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার’এর হিসেবে এই শহরের পতন যুদ্ধক্ষেত্রে কোন কিছুই নিশ্চিত করেনি। আরেক মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর বিশ্লেষক পাভেল লুজিন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ইউক্রেনের সেনারা অনেকদিন ধরেই একটা বড় রুশ বাহিনীকে আটকে রেখে পরবর্তীতে পিছু হটেছে। রাশিয়ার কাছে সময় গুরুত্বপূর্ণ; কারণ রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। এই মুহুর্তে লুহানস্ক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার কাছে চলে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। লুহানস্কের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি ২০১৪ সাল থেকে রুশ সমর্থিত মিলিশিয়াদের হাতেই রয়েছে। তবে ডোনেতস্ক অঞ্চল, যা লুহানস্কের চাইতে অনেক বড়, সেটার ৪০ শতাংশ ভূমি এখনও ইউক্রেনের অধীনেই রয়েছে। আর যেহেতু সেই অঞ্চলে ইউক্রেনিয়ানরা ২০১৪ সাল থেকে সামরিক স্থাপনা তৈরি করে আসছে, তাই সেটা দখলে নেয়াটা রুশদের জন্যে আরও অনেক কঠিন হবে। ইউক্রেনের বিশ্লেষক লিস্ট আলেক্সেই কুশ্চএর মতে, মারিউপোল শহর হারানোটা ইউক্রেনের জন্যে অনেক বড় ক্ষতি ছিল; কারণ সেটা ছিল সমুদ্রবন্দর এবং সেখানে ইউক্রেনের বেশিরভাগ লৌহজাত পণ্য তৈরি হতো।
যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া মারাত্মক ভুল করেছে এই ভেবে যে, ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতাকে রুশরা হয়তো খুব সহজেই ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। আর ইউক্রেনকে যে পশ্চিমারা সামরিক সহায়তা দেবে, সেটাও হয়তো পুতিন হিসেবের মাঝে নেননি। হয়তো ইউক্রেনের যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে ধারণা করেই তিনি এমনটা মনে করেছিলেন। মার্কিন নেতৃত্বও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথমে নিশ্চিত ছিল না যে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী টিকতে পারবে কিনা। সেকারণে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সামরিক সহায়তার ঘোষণা আসতে বেশ সময় লেগেছে। তথাপি ইউক্রেনের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করার জন্যে যেসব অস্ত্র প্রয়োজন ছিল, সেগুলি মার্কিনীরা সরবরাহ করতে যথেষ্ট গরিমসি করেছে। ডনবাসে রুশদের লক্ষ্য নির্ধারিত হবার পরেই মার্কিনীরা ইউক্রেনকে ট্যাংক এবং আর্টিলারির মতো অস্ত্র দিতে শুরু করে। তবে সেগুলির সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি পশ্চিমারা ইউক্রেনকে কোন যুদ্ধবিমান সরবরাহ না করায় রুশ শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জয়লাভ করা ইউক্রেনিয়ানদের জন্যে প্রায় অসম্ভবই ঠেকছে। আপাততঃ ডনবাসের যুদ্ধ দীর্ঘ করার মার্কিন লক্ষ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া ইউক্রেনিয়ানদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। তবে সেই পথে সেভেরোডোনেতস্কের মতো শহরের পতন দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরেও রাশিয়া হয়তো ধীরে ধীরে পুরো ডনবাস দখলে নিয়ে নিতে পারে; যার পরবর্তীতে যুদ্ধের ইতি টানার একটা পদক্ষেপ হয়তো ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে দেখা যেতে পারে; যা মার্কিন নীতির বিরুদ্ধ।
গত ২৫শে জুন রাশিয়া ঘোষণা দেয় যে, তাদের সেনারা ইউক্রেনের পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর সেভেরোডোনেতস্ক পুরোপুরিভাবে দখল করে নিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই রুশ বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল এই শহর; আর্টিলারি এবং বিমান হামলায় এখন এই শহরের খুব কমই অবশিষ্ট রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি এক বার্তায় শহরটা হারাবার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, দিনটা ইউক্রেনের মনোবল এবং আবেগের জন্যে খুবই কঠিন একটা দিন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেভেরোডোনেতস্ক শহর দখলের মাধ্যমে ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন আরও এগিয়ে গেলো। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং উত্তরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ছেড়ে আসতে বাধ্য হবার পর থেকে ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়াই রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডনবাস অঞ্চল ডোনেতস্ক এবং লুহানস্ক নামে দু’টা ভাগে বিভক্ত। এই দু’টার যেকোন একটার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার একটা বড় বিজয় বলে দেখাতে পারবেন। অন্ততঃ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নানা বিপর্জয়ের মাঝে রুশ বাহিনীর জন্যে সত্যিকারের যেকোন বিজয় অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেভেরোডোনেতস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর রাশিয়ার জন্যে পুরো লুহানস্ক এলাকা নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা আরও একধাপ এগিয়ে গেলো। তবে পুরো লুহানস্কের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে নিশ্চিত হচ্ছে না অত তাড়াতাড়ি। এই মুহুর্তে তাদের পথে রয়েছে ইউক্রেনের আরেক শহর লিসিচানস্ক। সেভেরোডোনেতস্ক শহর থেকে পিছু হটে ইউক্রেনিয়ান সেনারা খুব সম্ভবতঃ লিসিচানস্কেই গিয়েছে।
‘বিবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সেভেরোডোনেতস্ক এবং লিসিচানস্ক উভয় শহরই সিভার্স্কি ডোনেতস নদীর তীরে অবস্থিত। একমাস আগে এই নদীটা একবার অতিক্রম করতে গিয়ে রুশরা পুরো একটা ব্যাটালিয়ন হারায়। সেই ব্যর্থ মিশনে ইউক্রেনের আর্টিলারি হামলায় কয়েক’শ রুশ সেনা প্রাণ হারায় এবং কয়েক ডজন সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। এই নদীর উপর সকল সেতু ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এখন লিসিচানস্ক শহর দখলে নিতে হলে রুশদেরকে এই নদীই অতিক্রম করতে হবে। কাজেই এই নদী এখন রুশদের সামনে একটা বড় প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, লিসিচানস্ক শহরটা একটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত হওয়ায় এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা খুব সহজ কাজ হবে না।
‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’ যুদ্ধের প্রথম থেকেই প্রতিদিন ব্রিফিং দিচ্ছে। ২৪শে জুন তাদের বিশ্লেষণে বলা হয় যে, এটা এখন বোধগম্য যে, ইউক্রেনের সেনারা লিসিচানস্কের উঁচু ভূমিতে অবস্থান নেবে; যেখান থেকে তারা হয়তো বেশ কিছু সময় রুশ হামলা প্রতিহত করতে পারবে। এখন রাশিয়ার সামনে করণীয় হলো এই শহরটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করা। সেই লক্ষ্যে রুশরা লিসিচানস্ক শহরকে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে। রুশ সমর্থিত ইউক্রেনিয়ানদের মুখপাত্র আন্দ্রেই মরোচকো সাংবাদিকদের বলেন যে, তারা এখন যে গতিতে এগুচ্ছেন, তাতে তারা শিগগিরই পুরো লুহানস্ক অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। তাদের অবস্থান থেকে তারা এখন লিসিচানস্কে ইউক্রেনিয়ান সেনাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম বলে বলেন তিনি।
কেউ কেউ সেভেরোডোনেতস্ক নিয়ন্ত্রণে যাওয়াকে একটা প্রতীকী বিজয় হিসেবে দেখছেন; যার কৌশলগত গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কমই। ইউক্রেনের সাবেক জেনারেল ইহর রোমানেঙ্কো ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, সেভেরোডোনেতস্ক তার দায়িত্ব পালন করেছে। সামরিক দিক থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা শহরের গুরুত্ব খুব কমই। রুশরা অনেক শক্তি ক্ষয় করেছে; যা সামনের দিনের যুদ্ধে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার’এর হিসেবে এই শহরের পতন যুদ্ধক্ষেত্রে কোন কিছুই নিশ্চিত করেনি। আরেক মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর বিশ্লেষক পাভেল লুজিন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ইউক্রেনের সেনারা অনেকদিন ধরেই একটা বড় রুশ বাহিনীকে আটকে রেখে পরবর্তীতে পিছু হটেছে। রাশিয়ার কাছে সময় গুরুত্বপূর্ণ; কারণ রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। এই মুহুর্তে লুহানস্ক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার কাছে চলে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। লুহানস্কের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি ২০১৪ সাল থেকে রুশ সমর্থিত মিলিশিয়াদের হাতেই রয়েছে। তবে ডোনেতস্ক অঞ্চল, যা লুহানস্কের চাইতে অনেক বড়, সেটার ৪০ শতাংশ ভূমি এখনও ইউক্রেনের অধীনেই রয়েছে। আর যেহেতু সেই অঞ্চলে ইউক্রেনিয়ানরা ২০১৪ সাল থেকে সামরিক স্থাপনা তৈরি করে আসছে, তাই সেটা দখলে নেয়াটা রুশদের জন্যে আরও অনেক কঠিন হবে। ইউক্রেনের বিশ্লেষক লিস্ট আলেক্সেই কুশ্চএর মতে, মারিউপোল শহর হারানোটা ইউক্রেনের জন্যে অনেক বড় ক্ষতি ছিল; কারণ সেটা ছিল সমুদ্রবন্দর এবং সেখানে ইউক্রেনের বেশিরভাগ লৌহজাত পণ্য তৈরি হতো।
যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া মারাত্মক ভুল করেছে এই ভেবে যে, ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতাকে রুশরা হয়তো খুব সহজেই ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। আর ইউক্রেনকে যে পশ্চিমারা সামরিক সহায়তা দেবে, সেটাও হয়তো পুতিন হিসেবের মাঝে নেননি। হয়তো ইউক্রেনের যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে ধারণা করেই তিনি এমনটা মনে করেছিলেন। মার্কিন নেতৃত্বও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথমে নিশ্চিত ছিল না যে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী টিকতে পারবে কিনা। সেকারণে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সামরিক সহায়তার ঘোষণা আসতে বেশ সময় লেগেছে। তথাপি ইউক্রেনের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করার জন্যে যেসব অস্ত্র প্রয়োজন ছিল, সেগুলি মার্কিনীরা সরবরাহ করতে যথেষ্ট গরিমসি করেছে। ডনবাসে রুশদের লক্ষ্য নির্ধারিত হবার পরেই মার্কিনীরা ইউক্রেনকে ট্যাংক এবং আর্টিলারির মতো অস্ত্র দিতে শুরু করে। তবে সেগুলির সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, তেমনি পশ্চিমারা ইউক্রেনকে কোন যুদ্ধবিমান সরবরাহ না করায় রুশ শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জয়লাভ করা ইউক্রেনিয়ানদের জন্যে প্রায় অসম্ভবই ঠেকছে। আপাততঃ ডনবাসের যুদ্ধ দীর্ঘ করার মার্কিন লক্ষ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া ইউক্রেনিয়ানদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। তবে সেই পথে সেভেরোডোনেতস্কের মতো শহরের পতন দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরেও রাশিয়া হয়তো ধীরে ধীরে পুরো ডনবাস দখলে নিয়ে নিতে পারে; যার পরবর্তীতে যুদ্ধের ইতি টানার একটা পদক্ষেপ হয়তো ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে দেখা যেতে পারে; যা মার্কিন নীতির বিরুদ্ধ।